উপন্যাস

কিশোর উপন্যাস।। রহস্যময় লোকটা।। সারওয়ার-উল-ইসলাম।। পর্ব ছয়

৬.

বিকেলবেলা আমরা চারজন কালুর ফুচকা-চটপটির দোকানের সামনে টুলে বসে ফুচকা খাচ্ছি। আমাদের পাড়ায় কালুর ফুচকা আর চটপটির বেশ নাম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর টাটকার কারণেই কালুর এত জনপ্রিয়তা। আশেপাশের পাড়া থেকে মানুষ কালুর ফুচকা-চটপটি খাওয়ার জন্য আসে। দামটাও তুলনামূলকভাবে কম। আর কম বলেই টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে মাঝে মাঝে আমরা খেতে পারি।

আমাদের সেই প্ল্যানিংটা সাকসেস করার জন্য বলা যায় কোমর বেঁধেই নেমেছি। পাগলটাকে চোখে চোখে রাখছি। আমাদের চারজনের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে একটা কোড নেম রেখেছি─ যেমন খোকার─খো, অপুর─অ, পল্টুর─প আর আমার লিন্টুর─লি নিয়ে সাজিয়ে তৈরি করেছি ‘অলিখোপ’। আমরা চারজন একসঙ্গে পাড়ায় হাঁটলে যদি আমাদের ভেতর কেউ একজন পাগলটাকে দেখে তবে সঙ্গে সঙ্গে ‘অলিখোপ’ উচ্চারণ করলে অন্যরা সচেতন হয়ে যাই─পাগলটাকে আশেপাশে খুঁজতে থাকি। কিংবা একজন বাজার করতে গিয়ে পাগলটাকে দেখেছে তখন অন্যদেরকে এসে বলবে অলিখোপকে দেখলাম। অর্থাৎ পাগল নামটা আমরা ভুল করেও উচ্চারণ করবো না এই প্রতিজ্ঞা করেছি। সেই কারণেই অলিখোপের ব্যবহার।

গত কয়েক দিনে ধরে আমরা অলিখোপকে নজরে রেখেছি। কোনো প্রকার সন্দেহজনক আচরণ তার ভেতরে লক্ষা করা যায়নি। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করে অবাক হয়েছি। সেটা হলো সন্ধ্যার পর তাকে এখন বটগাছটার নিচে শুয়ে থাকতে দেখা যায় না। সারাদিন বাজারে ঘোরাফেরা করে। এর কাছে ওর কাছে চেয়েটেয়ে খায়, সন্ধ্যার পর আচমকা সে যেন কোথায় উধাও হয়ে যায়। এদিকে আরেকটি ঘটনা ঘটেছে পরশুদিন ইনজাম আর তৌফিকদের বাসায়, সেই একই হাতের লেখা দুটি চিঠি এসেছে তাতে লেখা আছে─ জনাব, আপনার ছেলে ইনজাম ভালো আছে, তার জন্যে চিন্তা করার কারণ নেই। কিভাবে আপনার ছেলে অসৎ পথে বা ক্রাইমের পথে পা বাড়াল তা পুরাপুরি জানা হয়ে গেলে ওকে ছেড়ে দেয়া হবে। বটগাছ কেটে ফেলার ডিসিশনটা যিনি নিয়েছিলেন তিনি ভুল করেছেন। গাছ নিধন করা আর নিজের পায়ে কুড়াল মারা সমান কথা। গাছ যে ছায়া দেয় বাতাস দেয় তা মানুষের জন্য কতটা জরুরি সেটা আমার চেয়ে আপনারা অনেক ভাল জানেন। আশা করি গাছ কাটা থেকে বিরত থাকবেন─ ইরকিটি কিরকিটি ভূতং চৌধুরী। অস্থায়ী বাসিন্দা, বটবৃক্ষ।

চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে দু’বাড়িতেই উত্তেজনা, আতঙ্ক আরও বেড়ে গেছে। কারণ ভূতের অনেক গল্প শুনেছে মানুষ। কিন্তু এরকম ঘটনা ইতোপূর্বে কেউ কখনো শোনেনি। তাই বলা যায় ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়তার সৃষ্টি করেছে।

ইনজামদের বাড়িতে কোত্থেকে এক ফকির আনা হয়েছে। সে নাকি দু’রাত ধ্যানে থাকলে বলে দিতে পারবে ইনজাম এখন কোথায় কিভাবে আছে। ফকির আনার ব্যাপারটা তারা প্রথমে চেয়েছিল গোপন রাখতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি। কারণ ফকিরের আদেশ রাত্রি যখন দ্বিপ্রহর হবে তখন একটা কালো রঙের ছাগল জবাই করে তার রক্ত আয়নায় মাখতে হবে। সেই আয়নায় নাকি ইনজামকে দেখা যাবে। সেই কারণে গত রাতে যখন ছাগল জবাই করার প্রস্তুতি চলছিল তখন ছাগলের ম্যা ম্যা চিৎকার শুনে আশেপাশের বাড়ির মানুষ জেগে গিয়ে ব্যাপারটা জেনে যায়। আজ রাতে ফকির ইনজামের মা বাবাকে দেখাবে ইনজাম কোথায় আছে।

ওদিকে তৌফিকদের বাড়িতেও একজন পীর সাহেব গতকাল এসে চলে গেছে। তৌফিক নাকি এখন বঙ্গোপসাগরে এক ট্রলারে জেলেদের সঙ্গে মাছ ধরছে। সে আর কখনো বাড়ি ফিরবে না। যে ভূতটা তৌফিককে ধরে নিয়ে গেছে সেটা নাকি মেছোভ‚ত। মাছ খেতে পছন্দ করে। এক শর্তে তৌফিককে আনা যাবে আর তা হলো পীর সাহেবকে নগদ এক লাখ এক টাকা দিতে হবে─তবেই তৌফিককে এদিকে ফেরানো সম্ভব। এত টাকার কথা শুনে তৌফিকের বাবা মা চিন্তিত হয়ে পড়েছে।

খোকা ঝালে উহ আহ্ করছে। ফুচকার ঘুঘনিতে অনেক ঝাল দেওয়া হয়েছে আজ। তারপরও মজা লাগছে। আমি ছটা ফুচকা খেয়েছি, সাত নম্বরটা এইমাত্র মুখে দিতে যাব ঠিক তখনি অপু বলে উঠল─ অলিখোপ। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তিনজনের চোখ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল পাগলটাকে খোঁজার জন্য। হ্যাঁ দেখা মিলল। মুন্সীর পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বিল মিটিয়ে কালুর দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ি। মুন্সীর পানের দোকানের বাঁদিকে একটা ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর, আমরা ওই দোকানের সামনে এমন ভাব করে দাঁড়াই যেন বোঝা যায় আমরা কিছু একটা কেনার জন্য দোকানে ঢুকছি। সিদ্ধান্ত নিচ্ছি কি কিনব?

আমাদের মাত্র সাত আট গজ সামনে পাগলটা দাঁড়িয়ে আছে। এত কাছ থেকে কখনো বোধহয় পাগলটাকে লক্ষ্য করা হয়নি। বাঁ-কানে একটা অর্ধেক বিড়ি গোঁজা। মুন্সীর পানের দোকানের সামনে থেকে হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে যাচ্ছে-আমরাও আস্তে আস্তে তাকে ফলো করি। ধীর পায়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে হাঁটছে পাগলটা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। দোকানে দোকানে লাইট জ্বালানো হচ্ছে। পাগলটা একমনে মেইন রাস্তার দিকে যাচ্ছে। আমরাও পেছনে পেছনে হাঁটছি। নিজেদের ভেতর একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে।

পাগলটা মেইন রাস্তায় আসার পর একবার পেছনের দিকে তাকাল। তারপর একবার ডান আর বাঁয়ে তাকিয়ে রাস্তা পার হয়ে ওপাশের ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে থাকে। ঠিক তখনি অপু বলল, দাঁড়া। আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম।
পাগলটা কেন পেছনে তাকাল? অপু বলল।
খোকা বলল, হ্যাঁ তাই তো।
পল্টু বলল, আরে ধুত এমনি তাকিয়েছে।
আমার কেন যেন সন্দেহ ঠেকল। বললাম, ব্যাপারটা একটু খটকা লাগল।
চল ব্যাটাকে ফলো করি─অপু বলল।          

আমরা তড়িৎ গতিতে রাস্তা পার হয়ে ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে থাকি। পাগলটা এ মুহূর্তে আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে। আশ্চর্য পাগলটা ফুটপাত থেকে ডান দিকে গলিতে মোড় নেয়ার সময় একবার পেছনে তাকাল আমাদের দিকে। সন্ধ্যা পুরোপুরি নেমে গেছে। রাস্তার নিয়ন বাতিগুলো জ্বলছে। আমরা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেই।
কিন্তু ডান দিকের গলিতে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই─একটা কুকুর ধুলাতে চিৎ হয়ে একবার ডানে একবার বাঁয়ে কাত হয়ে গড়াগড়ি করছে। একজন মানুষকেও আমরা দেখতে পেলাম না। আমাদের চারজনের শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল ভয়ে। একজন জলজ্যান্ত মানুষ একটু আগে এই পথে গেল। আমরা কয়েক সেকেন্ডের ভেতর এসে লোকটাকে আর পেলাম না। এও কি সম্ভব! আশেপাশে কোনো দোকানপাট নেই। যার ভেতরে আড়াল করবে নিজেকে। ডান দিকে আট ফিট উঁচু দেয়াল। দেয়ালের ওপর কাঁটা তারের বেড়া। দেয়াল টপকে যাওয়াও সম্ভব না। গেল কোথায়? ভাবতে থাকি চারজন দাঁড়িয়ে।

Series Navigation<< কিশোর উপন্যাস।। রহস্যময় লোকটা।। সারওয়ার-উল-ইসলাম-পর্ব তিনকিশোর উপন্যাস।। রহস্যময় লোকটা।। সারওয়ার-উল-ইসলাম।। পর্ব সাত >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *