ছোটগল্প।। অদৃশ্য ঘন্টা।। আজাদ মণ্ডল
ছোটবেলায় আমার সাদাকলো একটা বিড়াল ছিল। যার গলায় খুব আদর করে ঘন্টা বেঁধে দিয়ে ছিলাম। আমার ছোট্ট পৃথিবী হয়ে উঠেছিল ঘন্টাময়। চলতে ফিরতে বিড়ালটা আমার ছোট্ট মস্তিষ্কে ঘন্টা বাজনার অন্যরকম একটা রহস্যময় ঝংকার তৈরী করত। সারাবাড়ি, উঠোন, পালান, সব জায়গায় টিনের চালে বৃষ্টির মতো ঘন্টার ঝনঝন শব্দ শোনা যেত। বাড়ির অন্যান্যদের রাতের ঘুম প্রায় হারাম হয়ে গিয়েছিল। ইঁদুর ধরার দৌড়ে ঘন্টার শব্দ হতো বেশি। গভীর রাতের নিরবতায় সেই শব্দ অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত। তাতে করে নিশাচর প্রাণীরদেরও অল্প-স্বল্প সমস্যা যে হয়েছিল, তা এখনকার মতো তখন অনুমান করতে পারি নাই। মাঝে-মাঝে ঘুমোতে না পেড়ে আমার আম্মা বিছানায় বসে থাকত। আমি ও উঠে আম্মার আঁচলে নিজেকে জড়িয়ে ঘন্টার বাজনা শুনতাম। আমার কৌতুহল আনন্দের ঘন্টা বিড়ালটা রদফারফা করে দিয়েছিল ।
আব্বা ব্যবসার কাজে এক সপ্তাহ বন্দরে ছিল। বাড়িতে আসতেই তাঁর রাজ্যে নতুন কিছুর সংযোজনে সে ভ্রুসংকোচন করে চোখ বুঝে ছিলেন অনেকক্ষণ। আব্বা কাউকে তেমন কিছু বলতেন না। তবে তার কথার ওজন ছিল। একবার কিছু বললে তার জন্য কাঁদতেও হতো। বাড়ির প্রায় সকলেই তাকে এড়িয়ে চলত। বেশির ভাগ সময় আম্মাকে দেখেছি তাঁর সামনে মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কথা শুনতে। তিনি যতক্ষণ বাড়িতে থাকত আমরা সবাই চুপ মেরে থাকতাম। সব চেয়ে চুপ থাকত আম্মা।
বেহুদা বাজনার জন্য ও আম্মাকে কাঁদতে হয়েছিল। রাতের বেলায় লম্বা ঘোমটা আর আমাকে দুইহাত দিয়ে জড়িয়ে পায়ের নিকট দাঁড় করিয়ে তিনি আব্বার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল-‘ ঘন্টা কুতায় পাইছে হেডাতো আমি জানিনে’, উত্তর শুনে আব্বা খাট থেকে নেমে দাঁত কিরিমিরি করে আম্মাকে বকা দিয়েছিল , ‘হারা দিন তো খালি গরুর মতো ঘাস চাবাও , দুনিয়ার খবর-টবর কিছু রাহো?’ আব্বার কথা শুনে আম্মা কাঁপতে ছিল। আমাকে তিনি বারবার আরো শক্ত করে ধরার চেষ্টা করেছিল। আম্মা ঘনঘন পান খেত। সোনা রঙ মুখের ঠোঁটে পানখাওয়ার পর যে লাল হতো, তা দেখে আমার খুব ভাল লাগত। কিন্তু, আব্বা সেদিন আম্মার পান খাওয়াকে গরুর ঘাস চিবানোর সাথে তুলনা করাতে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। ‘হোনো জহিরের মা, তোমার ছাওয়াল শমসেরের মাইয়া তো দূরের কতা, ওর গুষ্ঠি কারো সাথে যেনো আর না মেশে, এটা আমার শ্যাষ কতা, আর এই কতার যদি কোন নরচর অয়ত ইলি কলাম কপালে বহুত দুঃখ আছে।’ সেই রাতে আব্বার, আম্মার তরে আদেশ ছিল এটা।
আমার ছোট্ট পৃথিবী ঘন্টাময় করে দিয়েছিল অরুণা। অরু একদিন পাশের গ্রামের দুর্গাপূজার মেলায় গেছিল ওর আব্বার সাথে। আমাকে দিবে বলেও ঘন্টাটা কিনছিল । সেদিন অব্বার নিকট হতে চলে আসার পর, আব্বা খারাপ মানুষ বলে আমি আম্মার নিকট নিন্দা করেছিলাম। সাথে সাথে আম্মা আমার মুখে হাত দিয়ে শাসন করেছিল। বলেছিল, ‘ ছিঃ বাবা, এই সব কথা কুনুদিন মুখে অনবা না, এসব বলা পাপ, ওনারে সুম্মান করবা। অরুণার বাপের হাতেও না রজায় গানিয়া গোস্সা, তাই তোমারে ও গোহাতে মিশতে না করছে। কাল সহালে ঘন্টা খুইলা অরুণারে ফেরত দিয়া আসপা।’
পরের দিন সকালে ঘন্টা ফেরত না দিয়ে তার বদলে জিজ্ঞাস করছিলাম, ‘অরু আমাগো বিলাইডা দেখছোস?’ অরুণা দেখে নাই। উত্তর শুনে আব্বা-আম্মার নিষেদ ভুলে আমি অরুণাকে বলেছিলাম, চলতো অরু দুইজনে বিলাই তালাশ করি। তোর দেওয়া ঘন্টাডা বিলাইয়ের গলাই বাইদা দিছিলাম।’
দুইজনে দুপুর পর্যন্ত বিড়াল খুঁজেছিলাম। ঊঠোন, পালান, ঝোপ-ঝাড়, খরের পালার নিচে, পুকুর পাড়, মাচার তলা, ধানের ডোল কিন্তু বিড়াল আর খুঁজে পেয়েছিলাম না। শেষে অরুণা বলেছিল, ‘তোর বাপ খুবই খারাপ বেটা, হে আমারে ঘন্টা ফিরাই দিবের কইছেক্যা? তয় বিলাই না পাইয়া ভালা অইছে, ঘন্টা আর আমারে ফেরত দিবের পারবি না।’
অরুণার মন গভীরের কথা আমি ঐ সময় অতটা বুঝতে পারি নাই। তারচেয়ে আমি বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম সাদাকালা বিড়াল আর গলার ঘন্টা বাজনার জন্য। রাতে আম্মার নিকট বিড়ালের কথা জিজ্ঞাস করার আগে তার চোখে পানি দেখেছিলাম। আমি ভাবছিলাম সারাদিন অরুণার সাথে যে বিড়াল খুঁজেছি তাই হয়তো আব্বা আম্মাকে কটু কথা শুনিয়েছে। কিন্তু আম্মা আমাকে অন্য কথা শুনিয়ে ছিল। আমাকে বড়ফুফুর বাড়ি যেতে হবে স্কুলে পড়ার জন্য। অব্বার কথা গ্রামে থাকলে আমি নাকি অসভ্য হয়ে যাব। খুব ছোট তাই একা কেমনে থাকব। আম্মার এই কথায় আব্বা অনেক রাগ করেছে। আম্মা কাঁদতেছিল। সেই রাতে আমি আম্মাকে আর বিড়ালের কথা জিজ্ঞাস করতে পারি নাই। শহরের কাছে বড়ফুফুর বাড়ি ছিল। নিঃসন্তান ছিল সে। আমারে খুব আদর করত। মস্ত বড়বাড়ি। তার বাড়িতে যখন আমরা বেড়াতে যেতাম ফুফু আমাকে আদর করে
দোকান থেকে নানা রকম খাবার কিনে দিত। সেটা আমার খুব ভালো লাগত। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত, ঘরের লাইটের সুইচঅন-অফ। আবার বাথ রুম বা টয়লেটের কল দিয়ে পানি পড়ার দৃশ্যও আমাকে অবাক করত। সব মিলে আম্মার মুখে বড়ফুফুর বাড়িতে আমি থাকবার জন্য যাব শুনে খারাপ লাগছিল না। তার চেয়ে কেমন জানি ভাল লাগছিল। আব্বার শাসনের বালাই নেই এমন জায়গা পাওয়া তখন আমার ছোট্ট মস্তিষ্কের বলতে গেলে আরাধ্যছিল। পরের দিন অরুণাকে খবরটা দিয়ে ছিলাম। ওর মুখটা মরা মানুষের মত ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। চোখ দিয়ে পানিও পড়ছিল। আমি অরুর ফ্যাকাশে মুখ আর চোখের পানির গভীরতা বুঝতে পারছিলাম না। বুঝতে চাইও নাই। তার চেয়ে বড়ফুফুর বাড়ির সামনের দোকানের নানা রকম লোভনীয় খাবারের লোভে আমার জিব্বা দিয়ে লালা ঝরতে ছিল।
তার পরে আমার জীবন নৌকা, আব্বার ভাষায়- অসভ্য সমুদ্রের অকূল হতে, সভ্য বন্দরের আলো ঝলমলের তীর খুঁজে পেয়েছিল ঠিকই কিন্তু অসভ্য বন্দরের ঘোলাজলে আমি যে নিজের অজান্তে ছিপ ফেলে ছিলাম, সেই ছিপের টানকে নযেন মাঝেমাঝে আমাকে উতলা করে দিত এবং সেই বন্দরের জীর্ণ বাঁশির সুর আমাকে বোহেমিয়ান করে দেয় এখনো। যান্ত্রিক বেদনার কষাঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে গভীর মমতায় জলঘোলা বন্দরে কচুরী পানার পাতায় আমি কারো মুখদেখি,। অনুভব করি আবেগের। আমার মনে হয়, অভিশাপ হয়েই সেই প্রাচীন ছিপের সুতোয় আমি অজন্ম বাঁধা পড়ে গেছি। সাদাকালো বিড়ালের গলার ঘন্টা অনবরত বেঁজে চলেছে আমার গলায় বহু শতাব্দী ধরে। পার্থক্য এতটুকু, সাদাকালো যুগের ঘন্টা সুখ তাড়িত করতো রঙিন আভার নিষ্পাপে। আর রঙিন যুগের ঘন্টার সুখ সুধা সাদাকালো, পানশে। স্থায়ী আর অস্থায়ী আবাসের উত্তর দক্ষিণ মেরুর ব্যবধান কয়েক দিন বাদে আমার লালায়িত জিব্বাটের পেয়েছিল হারে-হারে। কিন্তু, বাবার অগ্নি চক্ষুর পাল্লার চেয়ে অসভ্য জগতে আমার অধিক ভালো লাগা মানসিক আধিক্যের পাল্লা কখনও ভারী হতে পারে নাই। আম্মার অকৃত্রিম আদর এমনকি অরুণার আমার দিকে করুণ মুখের আর্তি ও আমাকে টানতে পারেনি সভ্যসমাজে যাদুর মায়া হতে। আমি আস্তেআস্তে পিশে গেছি কিংবা বাধ্যহয়েছি জীবনের কুটিল তম ঘূর্ণনের আর্বতে। অভ্যস্ত হতেও কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু, সাদাকালো বিড়ালের গলার ঘন্টা আমার গলায় যে অদৃশ্য ভাবে ঝুলেছিল, সেটার টুং টাং সুর ঝংকার অনবরত আমাকে জানান দিয়েছে একান্ত নিরবে সময় অসময়ে।
আব্বাকে সম্মান করার আম্মার অনুরোধ বা আদেশ রাখতে পারিনি বহুবছর। আমার যা কিছু প্রিয় ছিল তার প্রায় সবকিছুই তার নিকট ছিল অপ্রিয়। তার কূট চালেই শমশের চাচা অরুণাকে বিয়ে দিয়েছিল বয়সের আগে। সপ্তাহ পরে জানতে পেরে ছিলাম সেই খবর। গরম পাত্রে পানির ফোটা পড়লে যে রকম ছ্যাত করে ধূঁয়া উড়ে আমার বুকের মধ্যও সে রকম ছ্যাত করে অদৃশ্য ধূঁয়া উড়ছিল। কষ্ট পেয়েছিলাম প্রিয় কিছু হারানোর। আমার চোখের পানিতে সেদিন বইয়ের পাতার কালো লেখা অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমার গলার অদৃশ্য ঘন্টা মুলত সেই সময় থেকে বজ্র আঁটুনী দিয়ে গেড়ো দেওয়া হয়েছিল।
এগারো ক্লাশে পড়ার সময়ই আব্বা মারা যায়। লাশের পাশে বসে সবাই যখন শেষ বিদায় চোখের পানি মুছতেছিল, জানি না কেন সেদিন আমার মাথায়ন অদ্ভুত হিসাব-নিকাষ চলছিল –আব্বা আপনি বিড়ালটাকে মেরে ফেল ছিলেন কেন? আপনি ঘন্টাটা খুলে পুকুর পানিতে ফেলেদিতেন? আমাকে আপনি মানুষ করতে চাচ্ছেন কিনা অরুণার ও তো অধিকার ছিল মানুষ হওয়ার, তাকে সেই সুযোগ দিলেন না কেন? আম্মার নিকট গোপন কিছু লুকানোর জন্য কী আপনি তার সাথে সব সময় কঠিন আচরণ করতেন? আপনি কী বন্দরে গোপনে বিয়ে করেছেন?
আম্মার বাড়ির ভিতর হইতে উচ্চ স্বরের কান্না আমাকে বিচলিত করেছিল। মনেমনে ভাবছিলাম, আম্মার মনে এত মায়া কেন? আমার ইচ্ছে করছিল আম্মার মাথায় তখনও বড় করে ঘোমটা আছে কিনা সেটা দেখার। পরোক্ষণে পুকুর পাড়ে গিয়েছিলাম আমার গলার অদৃশ্য বন্ধনীর তাড়াতে। কিন্তু হারানো কোন কিছুই কি আর ফিরে পাওয়া যায়? তবে,
পিছনে ফিরে আমার আম্মার মতো মাথায় মস্ত বড় ঘোমটা দেওয়া অরুণাকে দেখেছিলাম। অরু আমাকে আব্বা মারা যাওয়ার সান্তনা না দিয়ে জিজ্ঞাস করেছিল-‘জহির তুই এহন ও হেই ঘন্টা তালাশ করস?’ খুব ইচ্ছে করছিল অরুর মুখখানা দেখতে। তখন বাবার দেওয়া মস্তবড় ঘোমটার দায় নিজের মনে হয়েছিল আর মনে পড় ছিল আমার ক্লাশে মেয়েদের মুখ। মুখগুলোর একটি অরুণার হতে পারতো।
জঙ্গলের গাছদের মতোই বড় হয়েছি। পরিপূর্ণ সভ্য না হলেও সামাজিক দৃষ্টিকোণের বিশেষণ মাননীয় তকমার প্রলেপ কপালে এঁটিছি ঠিকই কিন্তু আমার সেই আজম্ম শৈশবের অভিশপ্ত গলার ঘন্টার বাজনা হতে কখনও রেহাই পাইনি। যখন লেখাপড়া করেছি তখন যেমন ঘন্টা আমাকে সময় মতো ক্লাস বা পরীক্ষার জন্য তাড়িত করেছে, আবার যখন চাকরি করেছি তখনও সময় মতো অফিসে পৌঁচ্ছেতে ঘন্টা তার স্বরূপ সময় মতো প্রকাশ করেছে। ঘন্টার অদৃশ্য বন্ধনী হতে মুক্তি পেতে কম চেষ্টা করেনি। কখনো কখনো সফলও হয়েছি কিন্তু অদৃশ্য দুর্বিপাকে তা আবার আত্মপ্রকাশ করেছে কাউকে না বলা দহন আর্তি হয়ে।
সেদিন মনটা খুব ভালছিল। ভালো লাভের একটা কাজ পেয়েছিলাম অফিসে বসে। খুশির তোড়ে কয়েক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে বাসায় ফিরে ছিলাম গাড়িতে ফুল ভলিউমে গান বাজিয়ে। সুখ বরবউকে জানানোর আগেই মেয়ে আমাকে সারপ্রাইজ দিলেন, সে একটা বিড়ালের বাচ্চা কিনেছে সেটা দেখিয়ে। মেনে নিলাম, নিস্তার আমার কখনই নাই। বাকি জীবনে আর পাবও না। তারপর ছোট একটা ঘন্টা কিনেনি যে বাচ্চাটির গলাই বেঁধে দিলাম। এখন ছোটবাচ্চাটি ঘন্টা বাঁজিয়ে হাঁটাচলা আর দৌঁড়াদৌড়ি করে। তাতে, মেয়ে আমার শৈশবের মতো আনন্দিত হয়। কখনো কখনো গভীর রাতে আমি ঘন্টার শব্দ শুনতে পাই। আমার ঘুম হয়না।
আমাকে সেই সাদাকালো বিড়ালের কথা মনেপড়ে। আম্মার মাথায় লম্বা ঘোমটার কথা মনেপড়ে। বাবার গম্ভীর মুখের কথা মনেপড়ে। আর মনে পড়ে অরুণাকে। কিন্তু অরুর মুখশ্রী আমি বিশেষ মনে করতে পারিনা ।ওর মুখ মনে করতেই মাথায় লম্বা ঘোমটা চোখে ভেসে উঠে। আমি তখন আম্মা আর অরুর মুখ গুলিয়ে ফেলি। বুক ফেটে নিরবে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। সেই দীর্ঘশ্বাস পাশে ঘুমিয়ে বা জেগে থাকা আমার বউ কখনো শুনতে পায়না …
চমৎকার গল্প। খুব ভালো লাগলো।