ফারহানের নানাবাড়ি।। মোস্তাফিজুল হক

ফারহানের আর কোনোকিছুই ভালো লাগে না! কবে যে স্কুল ছুটি হবে? স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে জানলার ধারে বসে মনটা আরও খারাপ হয়ে যায়। কোনো আকাশ দেখা যায় না! ইস্ এত্ত কোলাহল এই শহরে! সারাদিন প্যাঁ পুঁ আর হকারের হাঁকডাক একদমই সহ্য হয় না।

‘ফারহান, শুয়ে শুয়ে কী বই পড়ছো?’

মা, ‘পথের পাঁচালী’ আর ‘দীপু নাম্বার টু’

‘আজ দু’দিন ধরে লক্ষ্য করছি, তুমি খুব চিন্তামগ্ন! কেন বলো তো?’

মা, আমরা কবে নানা-বাড়ি যাচ্ছি? আমার স্কুলের পুজোর ছুটি শুরু হতে আর পাঁচদিন বাকি। এবার কিন্তু বাবাকে বলে দিও পুরো ছুটিটাই আমরা নানা-বাড়িতে কাটাবো। বাবা আমাদের পৌঁছে দিয়ে চলে আসবে, আবার আসার সময় হলে নিয়ে আসবে।

দুর্গাপূজার ছুটিতে এবার ফারহানরা গ্রামে বেড়াতে যাচ্ছে। ওর যখন চারবছর তখন একবার নানাবাড়িতে গিয়েছিল। এবার ওর বয়স তেরো। তাই সে গ্রাম সম্পর্কে ধারণা নিতে ‘পথের পাঁচালি’ বইটা পড়ে নিয়েছে। বন্ধুদের কারো কাছে শুনেছে, গাঁয়ে নাকি ছেলেধরা থাকে। তাই সে ‘দীপু নাম্বার টু’ এর পাশাপাশি আরো কয়েকটা গোয়েন্দা কাহিনিও পড়েছে।

ফারহানদের নিয়ে ভাড়াটে অটোবাইকটা আনন্দপুর গ্রামের মেঠোপথে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছেমতি বিলের চারপাশে প্রকৃতি সবুজের মেলা বসিয়েছে। এদিকে মেঠোপথের পশ্চিম ধারে সারিসারি গেরস্ত বাড়ি। প্রতিটি বাড়িই যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা। ফলের বাগান, ছোট্ট ছিমছাম পুকুর, খড়ের গাদা আর ছনের গোয়াল ঘর হাতছানি দিয়ে ডাকে। রক্তজবা, কলাবতী আর কাঠগোলাপ যেন শিল্পীর রংতুলিতে আভা ছড়িয়েছে!

এই গাঁয়েই ফারহানের নানাবাড়ি। বাড়ির পাশে সবুজ পাতায় ঘোমটা দিয়ে বউ সেজে দাঁড়িয়ে আছে কলাগাছ। মোচার ফুলে কত কত মৌমাছি! তার গোনাগুনতি নেই। পাতার আড়াল থেকে ভেসে আসছে অনবরত ডেকে চলা ছোটমৌটুসির চড়া সুর। পথের দুধারে ভাঁটফুলের গাছ আর শঠির ঝোঁপ পেছনে ফেলে ফারহানরা নানাবাড়িতে প্রবেশ করলো। দুপুরে খেয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে চারপাশে পায়চারী করলো। গাঁয়ের প্রতিটা বাড়ির পেছনে চিরসবুজ বাঁশের ঝাড়। আঙিনায় ঝুঁটিওয়ালা মোরগ আর গাঁয়ের শিশুদের সরল হাসি লেগে থাকা মুখ। ঢাকার পরিবেশে এমন প্রকৃতির কথা সে কখনো কল্পনাও করতে পারে না।

আনন্দপুরে আজ ফারহানের তৃতীয় দিন চলছে। ইচ্ছেমতি বিলের পশ্চিম কোণায় ওর নানার দীঘির তালতলায় বসে আজকের বিকেলটা বর্শি দিয়ে মাছ ধরে পার করছে।

ধানীবিলের ঠিক মাঝখানে ফারহানের নানার উঁচুপাড়ের তালদীঘি পুকুর। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে চারটে তালগাছ মাথা উঁচু করে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। প্রশস্ত পাড়ে পেঁপে, পেয়ারা আর ডালিমের গাছ দীঘির সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্শিতে ফলে, টেংরা, পুঁটি সমানে উঠে আসছে। ফারহান মনেমনে ভাবে, ‘কতই না মজা হতো, যদি রূপকটা আমার সাথে চলে আসতো!’

সবুজবরণ ধানীমাঠে পূবের হাওয়া দোলা দিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমাকাশে গোধূলির রঙ ভেসে উঠেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা সুদূরের পানে উড়ে চলেছে। চড়ুই পাখির কিচিরমিচির শব্দে ফারহানের শরীরে কিছুটা ক্লান্তি ভর করেছে। সে মনেমনে ভাবছে শীতলপাটিটা বিছিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হয় না। অসুবিধা কী? সন্ধ্যা হয়ে গেলে নানাভাই এসে ডেকে নিয়ে যাবেন। এমন সময় সে পেছন থেকে কার যেন ডাক শুনতে পেল। সে পেছন ফিরে দেখে মস্তমোটা গোঁফওয়ালা ভূতের মতো ভয়ংকর চেহারার বদরাগী এক লোক!

‘ভালোই হল, তোকে পেয়ে। কয়েক লাখটাকা মুক্তিপণ আদায় করা যাবে। কোনোপ্রকার চালাকি করে পালাবার চেষ্টা করলে জানে মেরে ফেলবো।’

ভয়ে ফারহানের গলা শুকিয়ে শেষ। তবুও সে তার মনোবল দৃঢ় রাখতে চাইছে। সে দেখতে পেল বেশ খানিকটা দূরে আরও তিনজন লোক এগিয়ে আসছে!

এবার ফারহান ভাবছে, ‘তাহলে এই বদমাশ লোকটার হাত থেকে রক্ষা পাবো কী করে? চিৎকার দিলে যদি আমাকে আঘাত করে? আমার হাতও ধরে আছে! নিশ্চয়ই ওরাও এসে আমাকে পাকড়াও করে নিয়ে যাবে?’

এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার সে একটু চালাকি করে খুব হাবাগোবা আর প্রতিবন্ধির মতো আচরণ করবে বলে মনেমনে স্থির করলো।

‘চাচ্চু আমাকে মেরো না। আমি তোমাদের সাথেই যাবো। আমার বাবার অনেক টাকা। তোমরা চাইলেই পাবে। চাচু, তোমার ঠোঁটের উপরের ঐ কালো চুলগুলো আমাকেও কিন্তু লাগিয়ে দেবে।’

‘চুপ বেয়াদব, একদম কথা বলবি না। মাছ মারছিলি বুঝি? কোথায় রেখেছিস?’

এবার ফারহানের সাহস ফিরে এলো। এই সুযোগে রক্ষা পাওয়া যাবে। যেই লোকটা উপুড় হয়ে জিওল মাছগুলো উঠাতে যাবে, অমনি ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে সে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে চিৎকার করে দৌড়াতে লাগলো।

কিন্তু পরক্ষণেই ফারহান ভীষণ লজ্জিত হল- যখন মা ধাক্কা দিয়ে বললেন, ‘কি রে, ঘুমের ভেতরে এভাবে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিল্লাচ্ছিস কেন?’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *