ঈদসংখ্যার গল্প।। হরিণাক্ষি নদীটি নিখোঁজ হয়ে গেছে।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী
আমাদের একটা গ্রাম আছে। অনেক দূরে। সেই গ্রামেই আমি শৈশব, কৈশোর কাটিয়ে যখন যুবক হলাম তখন এই শহরে এসেছি। এখানেই কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য করে বসতি বানিয়েছি। বিয়ে করে সংসার করেছি। আমার ছেলেমেয়ে হয়েছে। তাদের বিয়ে দিলাম। এখন
তোমরা হয়েছো। কত দূর তোমার গ্রাম?
অনেক দূর। নীলাক্ষি জেলার শেষ প্রান্তে যেখানে হাওর-বিল-ঝিল-নদী-নালায় ভর্তি। সেখানে।
তোমার গ্রামের নাম কী?
গ্রামের নাম মাঝিপাড়া। অনেক সুন্দর গ্রাম।
মাঝিপাড়া নাম হয় নাকি? সেখানে কি সবাই মাঝি ছিল?
সবাই নয়। তবে অনেকেই মাঝি ছিল। এইজন্যই নাম হয়েছিল মাঝিপাড়া।
ইশ্। এমন বোকা নামও হয়। আরও সুন্দর নাম দিতে পারতে, ঠিক না দাদুভাই?
হয়তো পারত। তখন মুরুব্বিরা কেন এই নাম দিল তা তো জানি না।
তোমাদের গ্রামের পাশে কী নদী আছে?
হ্যাঁ। নদী তো আছেই। অনেক বড়ো নদী। এপারে দাঁড়ালে ওপার দেখা যায় না; এমন বড়ো নদী।
বর্ষকালে নদীর ভাঙনে অনেক গ্রামও বিলীন হয়ে যেত। স্রােতের পানিতে ভেসে যেতে কত কিছু!
তুমি কি সেখানে সাঁতার কাটতে?
হ্যাঁ। সাঁতার কাটতাম। নৌকা চালাতাম। কলাগাছের ভেলা চালাতাম। মাছ ধরতাম। সারা দিন নদীর ধারেই কাটাতাম। নদীই তো আমাদের জীবন। এই দেশের মানুষের জীবন।
তোমাদের নদীটির নাম কী দাদুভাই?
হরিণাক্ষি। হরিণাক্ষি নদীর নাম শুনেনি এই দেশে এমন মানুষ নেই।
হরিণাক্ষি মানে কী দাদুভাই?
হরিণের চোখ। নদীর পানি ছিল খুব স্বচ্ছ যেন হরিণের চোখের মতো টলমল করত। এইজন্য নদীর নাম ছিল হরিণাক্ষি।
ছিল বলছো কেন? এখন কি তাহলে নেই?
ওহ্। থাকবে না কেন? নিশ্চয়ই আছে। নদী কি আর হারিয়ে যায়? আমি কি আর তোমাদের মতো এত ব্যাকরণ মেনে কথা বলতে পারি? তাছাড়া এখন বুড়ো হয়েছি না!
একদিন আমাকে নিয়ে যাবে তোমাদের মাঝিপাড়া গ্রামে। তারপর হরিণাক্ষি নদীর তীরে। আমি নদী দেখব। নদীতে নৌকা চালাব। সাঁতার কাটব। মাছ ধরব। আমাকে নিয়ে যাবে দাদুভাই?
হ্যাঁ। নিশ্চয়ই যাব। আমাদের গ্রাম মানে তোমারও গ্রাম। তোমরাই তো আমার উত্তরাধিকারী।
তাহলে এবারের দুর্গাপূজার ছুটিতে চলো গ্রামের বাড়িতেই কাটাই। আনন্দ করব।
নৌকায় চড়ে নদীতে ভাসতে ভাসতে কোজাগরী চাঁদ দেখব। আকাশে থাকবে ঝুলন্ত চাঁদ আর আমরা হরিণাক্ষির টলমলে জলে নৌকার পাটাতনে শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখব। তুমি গল্প করবে। তিন পুরুষের গল্প। আর আমরা তোমার গল্প শুনব। কিন্তু দাদুভাই তুমি তো বাড়িতে যাও না। গ্রামের খোঁজ-খবরও নেও না। সেখানে কে আছে যে আমরা থাকতে পারব?
আমার চাচারা আছেন। চাচাত ভাইবোন আছে। দেখবে ওরা কত সমাদর করে।
ঠিক দাদুভাই। তাই হবে। ওখানে গিয়ে কী কী করব?
হরিণাক্ষি নদী দেখবে। দেখবে নদীতে শত রঙের পালতোলা নৌকা। মাঝিরা গান গাইতে গাইতে দূর-দিগন্তে মিশে যাচ্ছে। জেলেরা মাছ ধরছে। হাজারো রকমের পাখি উড়ছে। নদীর ঘাটে আবালবৃদ্ধবণিতা স্নান করছে। জলকেলি খেলছে, ডুবসাঁতার কাটছে। প্রতিটি দিন যেন মহোৎসবের আনন্দের ঝাঁপি খুলে বসে। তুমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে। প্রকৃতির মনকাড়া দৃশ্য দেখে তোমার চোখ ফেরাতে পারবে না। এতই সুন্দর! তারপর গ্রামে দেখবে কীভাবে জেলেপল্লিতে মেয়েরা পুঁটি মাছের চ্যাপা-শুঁটকি বানায়। কুমোর কীভাবে হাড়ি বানায়,
কামার কীভাবে দা-কুড়াল-কোদাল-খুন্তি-কাঁচি-লাঙলের ফলা বানায়। এমন সুখসম্ভারের গ্রাম দেখে সেখান থেকে তোমার আসতেই ইচ্ছে করবে না।
আমার আজকেই চলে যেতে ইচ্ছে করছে দাদুভাই। এবার কিন্তু যেতেই হবে।
অবশ্যই যাব। তোমার মাবাবা না গেলেও তুমি আমার সঙ্গে যাবে।
গ্রামের নিসর্গকে কাছে থেকে দেখা, নিসর্গের সঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্য এক প্রকার ব্যাকুলতা অনাবিলের থাকলেও তাকে কোনো দিন গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়নি। কীভাবে যাবে?
এখন নগরসভ্যতার বেড়াজালে যেভাবে মানুষ আটকে যাচ্ছে গ্রামের জাদুকরি আকর্ষণ আর মানুষকে টানে না। ওর বাবা-মা চাকরি করে, অনাবিল ক্লাস নাইনে পড়লেও বলা যায় স্কুলের চেয়ে কোচিং সেন্টারেই বেশি পড়ে, বেশি সময় কাটায়। স্কুলের চেয়ে কোচিং সেন্টারেই বেশি সময় দিতে হয়। তিন জনের এক সঙ্গে ছুটি হলেও বিশ্রামসহ আরও নানাবিধ কাজের জন্য
গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা মুখেও আনা যায় না। অথচ আমাদের এই বয়সের দিনগুলো কত
রঙিনই না ছিল!
সন্ধ্যায় যদিও অনাবিলকে বললাম গ্রামে বাড়িতে যেতে কিন্তু সত্যি কি তাকে নিয়ে যাওয়া
হবে? ওর মা-বাবা যদি আবার বেঁকে বসে তাহলে যাওয়া কী সম্ভব? হরিণাক্ষি নদী কি অনাবিলকে দেখানো সম্ভব? আমি যতই ভাবছি ততই মনের গভীরে নিদারুণ হাহাকার উদ্ধস গত হচ্ছে। মনে পড়ছে সেই শৈশব আর কৈশোরের কথা। এক সময় মাঝিপাড়া গ্রামে প্রায় অর্ধেক হিন্দু আর অর্ধেক মুসলমানের বসবাস ছিল। প্রায় হাজার পরিবারের গ্রামটি অনেক বড় ছিল।
পাড়ার পুব পাশে জেলেদের পল্লি ছিল যেখানে শ’খানেক পরিবার ছিল। সাতচল্লিশে দেশ ভাগের
সময় অবস্থাসম্পন্ন দশ বারোটি হিন্দু পরিবার ইন্ডিয়া চলে গেল। সেই পরিবারে ছিলেন দুজন নিবেদিত শিক্ষক যাঁদের ধ্যান-জ্ঞানই ছিল দেশে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া। দুজন শিক্ষক এই দেশ ছেড়ে যেতে চাননি কিন্তু নিজ নিজ পরিবারের চাপে তাঁদের এখানে থাকার মতো অবস্থাও ছিল না। তখনই মনে হয়েছিল গ্রামটিতে অন্ধকারের আবছায় পড়েছে। তারপর একাত্তরে স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় এবং তার অব্যাবহিত পরে মোটমাট শ’খানেক পরিবার ইন্ডিয়া চলে যায়। পড়ে থাকল কেবল জেলেপাড়া, কুমারপাড়া, কামারদের মতো হতদরিদ্র মানুষগুলো। এদের হয়তো যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না; না-হয় সাতচল্লিশের পর এবং একাত্তরে পর ওদের ওপর যে ধরনের সাম্প্রদায়িক নির্যাতন হয়েছিল তারা কি আর থাকত? হয়তো সুখ-দুঃখের সঙ্গে জীবনকে একাকার করে
ইন্ডিয়া যেত এবং সেখান থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনা হয়তো দ-কারণ্যের অভিমুখে রওনা হতো।
হিন্দুরা না-হয় ইন্ডিয়া গেল কিন্তু বাকিরা কি গ্রামে থাকল? আমরা কি গ্রামে থাকলাম? যারা লেখাপড়া শিখে চাকরি-বাকরি করার জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে তারাও আর গ্রামমুখী হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার বাবার সঙ্গে গ্রাম ছেড়েছিলাম এবং তখন থেকেই শহরেই আছি।
কখনো গ্রামমুখী হয়নি। আজ কেন আমার বুকের ভেতরে এমন হাহাকার বুদ্বুদের মতো উন্মজ্জন
হচ্ছে। হরিণাক্ষি নদীর জন্য কেন প্রাণ এমন আকুলি-বিকুলি করছে? সেই শৈশব-কৈশোরের কথা
মনে হতেই আমার মন বিদীর্ণ হতে শুরু করে এবং মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা মাত্র। আমার কত বন্ধু ছিল! প্রতিদিনই নদীতে গোসল করতে যেতাম, অবসর সময়ে নৌকা চালাতাম, বাবার সঙ্গে নৌকায় চড়ে ওপারে হেমগঞ্জ বাজার থেকে সপ্তাহের বাজার করে আনতাম। এমন শান্ত নদী, এমন টলমলে জলের নদী আর কোথায় আছে? জেলে পরিবারগুলো হরিণাক্ষি নদীর মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করত। কত রকমের জাল ছিল তাদের সেসবের নামও আজকে ভুলে গেছি। গ্রামের সবার মাছ ধরারছিল প্রতিদিনের কাজ। এখন হরিণাক্ষি নদীটি কেমন আছে? আগের মতো সেই স্বচ্ছ জলের মতো শান্ত কি আছে? আগের মতো কি নৌকা চালিয়ে অনাবিলকে নিয়ে হেমগঞ্জের বাজার থেকে কদমা, জিলাপি, মুড়ির মোয়া কিনে আনতে পারব? কে জানে? ঢাকায় যখন প্রথম এসেছিলাম বুড়িগঙ্গার স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ জল দেখে মনে জুড়িয়ে যেত আর এখন বুড়িগঙ্গার অনচ্ছ জল দেখে প্রাণ কাঁদে। এই দেশে কেন নদীর প্রতি মানুষের মমতা নেই? নদী যে একটি জনপদের সভ্যতার মা সে কথা কি মানুষ ভুলে গেছে? নাকি ভুলে যায়? আমাদের পূর্বপুরুষরা
নদীপথেই ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে। নদীর ঘাটেই গড়ে উঠেছে বাজার, গঞ্জ, শহর। এখন বুড়িগঙ্গায় নর্দমার পানির মতোয় পুঁতিগন্ধময় পচা পানি, আবর্জনায় স্থানে স্থানে ভরাট হয়ে গেছে, আর জলজ উদ্ভিদ অবাধে বংশ বিস্তার করে যাচ্ছে। এই নদীর করুণ দশা দেখলে প্রাণ
কেঁদে ওঠে আর ভাবি আমাদের হরিণাক্ষি নদীটি কেমন আছে? নদীর পারে মাঝিপাড়ার মানুষগুলো কেমন আছে? তাদের মধ্যে কি সেই আগেকার মতো আনন্দ আছে? আছে কি সুখ-শান্তিতে একসঙ্গে থাকার মানসিকতা? ধীরে ধীরে রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে আর আমি যেন নষ্টালজিয়াতে আক্রান্ত হয়ে ভূতগ্রস্তের মতো হয়ে যাচ্ছি। গ্রামের কথা, মায়ের কথা, হরিণাক্ষির নদীর কথাই আমার বেশি মনে পড়ছে। শৈশবের আমার বন্ধুরা কে কোথায় আছে জানি না। দু-
একজন ঢাকা চলে এসেছিল যাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে। অন্যরা গ্রামেই রয়ে গেল। শুনেছি আমার বাল্যবন্ধু হান্নান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছে। তার খ্যাতি আছে। ফুটবল প্লেয়ার ইদ্রিস মারা গেছে তিন বছর আগে। দশ গ্রামের মধ্যে নামকরা ফুটবল প্লেয়ার ছিল। আবু কালাম ছিল কুস্তিগীর। আবু কালাম কেমন আছে? এভাবে আমার শৈশবের সব বন্ধুদের
নাম মনে পড়ছে আর আমি যেন কোথায় হারিয়ে যেতে লাগলাম। ডাক্তারের পরামর্শানুযায়ী ঘুম আর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রয়োজনে ডাবল ডোজের ওষুধ খেয়ে হলেও ঘুমাতে হবে। কিন্তু আজ রাতে আমি একটু ঘুমাতে পারিনি। ঘুমাতে ইচ্ছেও হয়নি। জানালার ফাঁক গলিয়ে সামান্য সড়কবাতির আলো এসে রুমে ঢুকেছে। এক টুকরো চাঁদের আলোও রুমে ঢুকেছে। আলো-আঁধারের মিশেল রুমে আমার অতীত যেন অক্টোপাশের মতো জড়িয়ে ধরে রেখেছে। অনাবিলের মা-বাবা গ্রামে যেতে রাজি হয়নি। তারা বলল, গ্রামে কে কীভাবে আছে আমরা জানি না। তারা আমাদের দেখে বিব্রত হতে পারে। মানুষকে বিব্রত করা ঠিক হবে না। বরং অনাবিলকে নিয়ে দুদিনের জন্য বেড়িয়ে আসেন। গাড়ি নিয়ে যাবেন, কোনো অসুবিধা হলে সেদিনই ফিরে আসবেন। যদি সেখানে থাকার মতো পরিবেশ থাকে তাহলে আগামী বছর আমরাও যাব। অথবা শীতের ছুটিতেও যেতে পারব।
ওদের যৌক্তিক কথা শুনে আমার মনে হলো সবাই না গিয়ে বরং দুজন যাওয়াই উত্তম। আমি অনাবিলকে নিয়ে রওনা হলাম দুর্গাপূজার ছুটিতে। ঢাকা থেকে মাঝিপাড়া গ্রাম পর্যন্ত যেতে চার-পাঁচ ঘণ্টা লাগতে পারে যদি না ট্র্যাফিক জ্যামে আটকা পড়তে হয়। প্রথমে নীলাক্ষি জেলা শহরে গিয়ে সেখান থেকে আরও দশ কিলোমিটার যেতে হবে। পথে খাওয়ার জন্য
অনাবিলের মা গাড়িতে খাবার দিয়েছে। নীলাক্ষি শহরটি ড্রাইভারের চেনা আছে বলে ঢাকা শহর
পার হয়ে ড্রাইভার আলি হোসেন আশি কিলোমিটার বেগে গাড়ি হাঁকাচ্ছে।
কেমন লাগছে অনাবিল?
আমরা যারা সব সময়ই ঢাকায় থাকি, মানে শহরে থাকি তারা কি প্রকৃতিপ্রতিবন্ধী?
অনাবিল বয়সে ছোটো হলেও ওর বোধশক্তি অনেক বেশি। ওর কথাটি বুঝতে আমার অনেকক্ষণ সময় ব্যয় করতে হয়েছে। প্রকৃতিপ্রতিবন্ধী মানে কী? তার মানে অনাবিল বোঝাতে চেয়েছে যে, প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা নেই। ওর প্রশ্নটি শুনে একদিকে হতবাক আর অন্যদিকে বোধের জন্য আনন্দের যুগপৎ মিশ্রণে আমি অভিভূত হয়ে পড়ি। ওর দিকে তাকিয়ে দেখি সে ঘনশ্যামল বৃক্ষপত্রখচিত কালছে দূর-দিগন্তে নিষ্পলক চেয়ে আছে। আমি বললাম, অনেকটা তাই। তোমরা
এখন যন্ত্রযুগে বসবাস করছ তাই প্রকৃতির সঙ্গে তোমাদের মিথস্ক্রিয়া হচ্ছে না। আর প্রকৃতিকেই যদি জানতে না পারলে তাহলে জীবনকে কীভাবে উপভোগ করবে? বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যে প্রকৃতির গন্ধ পাওয়া যায়। হুম। প্রায় সব লেখকেরই প্রকৃতি নিয়ে লেখা আছে তবে তাদের লেখা অত্যন্ত নিবিড়, অনেক বেশি। ধানসিঁড়ি নদীটি দেখতে ইচ্ছে করছে। কপোতাক্ষ নদটি দেখতে ইচ্ছে করছে দাদু ভাই। তাঁরা কীভাবে একটি নদীকে কবিতা দিয়ে জীবন্ত করে রাখলেন তাই দেখতে চাই। ঠিক আছে। যাওয়া যাবে? আমারও ইচ্ছে হয় ওই নদী দুটি দেখে আসি।
আমি হরিণাক্ষি নদীটি নিয়ে একটি কবিতা লিখব। অবশ্যই কবিতা আমি লিখতে পারব কিনা জানি না। তবে নদীটি নিয়ে অন্য কিছু লিখব। বেশ তো! এতো বড়ো আনন্দের কথা!
গাড়িটি দুর্বার গতিতে ছুটছে। দুপুরে নীলাক্ষি শহরের আগেই একটি বটতলায় গাড়ি থামিয়ে আমরা খেয়ে নিলাম। নীলাক্ষি শহরে আমাদের কোনো কাজ নেই বলে পথেই দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করে নিলাম। এখান থেকে বাইপাস রোডে চলে মাঝিপাড়া গ্রামে। আমরা কি হরিণাক্ষি নদী দেখে পরে তোমাদের বাড়িতে যাব? স্মৃতি হাতড়ে আমি বললাম, হ্যাঁ। হরিণাক্ষি নদীটির তীর ঘেঁষে একটি সড়ক মাঝিপাড়ার দিকে গেছে। এখন সেই সড়কটি কি এখনো মেঠো পথ কিনা জানি না। হয়তো পাকাও হতে পারে। চলো দেখি।
নীলাক্ষি শহরের পাশ ঘেঁষে আমরা রওনা হলাম। আশ্বিনের স্নিগ্ধ রোদ, ঝলমল করছে নীলাকাশ আর
বৃক্ষপত্রাদি যে ঘন সবুজে ডুব দিয়ে প্রকৃতির ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে। চোখ জুড়িয়ে যায়। যত তাকিয়ে থাকছি তত বিহ্বল হয়ে যাচ্ছি। এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা থেকে কতটা বছর বঞ্চিত আমি হিসেব মিলাচ্ছি। অফিস, বাসা, কাঁচাবাজার, শপিংমল এসবেই কাটিয়ে দিলাম একটা জীবন! আজ বড় আফসোস হচ্ছে। জীবনকে কেন বঞ্চিত করলাম? কোথায় পাব হিজল-বট- পাকুড়, কোথায় পাব দোয়েল-শ্যামা-বক? এতকাল পরে গ্রামে এসে যেন মন জুড়িয়ে যাচ্ছে।
ড্রাইভারের ডাকে আমার সম্বিৎ ফিরে পেলাম। স্যার, আমরা তো প্রায় এসে গেছি। এখানে তো কোনো নদীর চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
মনে হয় আরও দূরে। এগিয়ে যাও।
না স্যার, আর দূরে হওয়ার কথা নয়। সামনের বাজারে নেমে ভালো করে ঠিকানা নিয়ে নেন।
সামনে একটা ছোটো বাজার গড়ে উঠেছে। আমার সঙ্গে অনাবিলও নামল বাজার দেখার জন্য।
এখানে তো আগে বাজার ছিল না। পথঘাটও এমন ছিল না। তাহলে কি ভুল পথে এসেছি?
অনাবিলকে নিয়ে আমি সামনের দিকে এগিয়ে যাই। বাজারটি ছোটো হলেও অনেকমানুষের ভিড়ে গম গম করছে। বিভিন্ন দোকানে, বিশেষ করে চায়ের স্টলগুলোর কোনায়কানায় টানানো টেলিভিশনে হিন্দি মুভি চলছে। লোকজন চা খায় আর মুভি দেখে। মুভি দেখে আর চা খায়। একটি দোকানে বড়ো আকারের টিভিতে ক্রিকেট খেলা চলছে। সেখানে অনেক মানুষ ভিড় করে খেলা দেখছে আর মাঝে মাঝে হইহুল্লোর করছে।
এই জনপদ কি আমার? আমি কি এখানেই শৈশব আর কৈশোর কাটিয়েছিলাম? আমি যেন নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। এ-রকম স্থান-পাত্র তো কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না।
আমি যত ভাবছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি। চায়ের স্টলের সামনে দাঁড়াতেই এক তরুণ উঠে এসে সালাম দিল। অন্যরা অনড়।
আফনে কি কাউরে বিছরাইতাছুইন?
হ্যাঁ। আপনি কি বলতে পারবেন, হরিণাক্ষি নদীটি কত দূর?
হরিণাক্ষি নদী? এই নামের কোনো নদীর কথা তো হুনি নাই। আফনে কইত্থে আইছুন?
আমার বাড়ি মাঝিপাড়া। আমি ঢাকা থেকে এসেছি।
মাঝিপাড়া! ওই সামনের গেরামই মাঝিপাড়া। কিন্তুক আফনেরে তো কুনো সোময় দ্যাহি নাই।
আমি অনেক বছর এলাম। তাই দেখোনি।
লোকটি স্টলের ভিতরে ঢুকে একজন বৃদ্ধ লোককে ঢেকে নিয়ে এসে বলে, তাইনের বাড়ি মাঝিপাড়া। চিনোইননি?
বৃদ্ধ চোখ কচলিয়ে বলে, মাঝিপাড়া? আফনের নাম কী?
আমি বৃদ্ধকে চিনতে পেরেছি। কিন্তু সে আমাকে চিনতে পারবে কিনা কে জানে? তাকে দেখে আনন্দে আমার বুক ভরে গেলেও একটু সময় নিলাম জড়িয়ে ধরতে। আমি বললাম, আমার নাম বেলায়েত। খন্দকার বাড়ির বেলায়েত।
লোকটি মানে, কুস্তিগীর আবু কালাম যার জোড়া ভ্রু দেখে আমি চিনেছি। আগের শরীরটা আর নেই। সে চোখ মুছে আরেকটু কাছে এসে দাঁড়ালে আমি তাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, তুই কুস্তিগীর আবু কালাম না রে?
আবু কালাম আমাকে আরও জড়িয়ে ধরে বলল, এম্বায় মানুষ ভুইল্যা যায়? কতটা বছর ফরে দ্যাশে আইলাইন।
আবু কালাম আমার বন্ধু ছিল। তখন তুই তুখারিই আমাদের সম্বোধন ছিল। এখন আমি তুই করে ডাকলেও হয়তো আমার বেশভূষা দেখে আপনি করে ডাকছে। আমি তাকে সংকোচ ভেঙে আগের সম্বোধন করতে বললাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, হরিণাক্ষি নদীটি কোথায়?
আবু কালাম হয়তো কষ্টে অথবা নিদারুণ কোনো আবেগে হু হু করে কেঁদে উঠল এবং কিছুক্ষণ সময় নিয়ে যখন বলতে শুরু করল তখন আশপাশে মানুষের ভিড়টা বড়ো হয়ে গেছে। আবু কালাম বলল, আগের আর কিছুই নাই। আমি আবু কালাম ছাড়া আগের কিছুই ফাইবি না এইহ্যানে। হরিণাক্ষি নিখোঁজ অইয়া গ্যাছে। কুনো চিহ্ন নাই। এই বাজার দেখতাছো
এইহানেই নদী আছিলো। আইজ নদী নাই। নিখোঁজ।
নদীও মরে যায়? নদীও নিখোঁজ হয়ে যায়? ভাবতে ভাবতে আমার চোখ দুটিও জলে ঝাপসা হয়ে গেল এবং তখন তাকিয়ে দেখি অনাবিলের মুখখানি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আজ তাহলে নৌকায় চড়ে কোজাগরি চাঁদ দেখা যাবে না। অনাবলি আমার জামার খুঁট ধরে টান দিয়ে বলে, দাদাভাই চলো ঢাকায় ফিরে যাই।