ঈদসংখ্যার গল্প।। শূন্য।। জয়শ্রী দাস

রেজার সাহেবের বয়স ৭৫ বছর। তিনি অবিবাহিত। নিজে অনিচ্ছাকৃত ভাবে বিয়ে করেননি এমন নয়, বিয়ে করার সময় ছিল না। রেজা সাহেবের একটি ছোট ভাই ছিল নাম হেলালুর। ভাইটি একটি দুর্ঘটনায় মারা যায়। প্রেম করে মাত্র ২৩ বছর বয়সে বিয়ে করেছিল হেলালুর। তাই বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় যখন হেলালুর মারা যায় তখন তার ঘরে দুটি ছেলে সন্তান। হেলালুর স্ত্রী সুন্দরী। তাই মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে রেজা ছোট ভাইয়ের দুটো সন্তানের দায়িত্ব নিয়ে , নিজের ভাইয়ের স্ত্রীর বিয়ে দেন অন্য একজনের সঙ্গে।

রেজা কঠিনভাবে আটকে যায় সংসারের যাঁতাকলে। ভাইয়ের ছেলেরা বড় হতে থাকে। একজন ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে যতটুকু সময় পেয়েছেন সম্পূর্ণ সময়টুকু ব্যয় করেছেন ভাইয়ের সন্তানদের পেছনে। ব্যাংকে কাজ করতে করতে পরিচয় হয়, জুঁই এর সাথে।

রেজা যা আয় করতেন, সব উজার করে দিতেন দুই ভাইয়ের সন্তান এবং জুঁইয়ের জন্য।

জুঁই এবং রেজার সাহেবের প্রায় দশ বছর আগে পরিচয় হয়। তখন রেজা সাহেব ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সদস্য। জুঁই তখন ৩০ বছরের একজন ব্যাংকের কর্মকর্তা। নিজের বদলিজনিত একটা বিষয় নিয়ে জুঁই গিয়েছিল রেজা সাহেবের কাছে।

হালকা গোলাপী পারের সাদা শাড়ি ও সিল্কের ব্লাউজ পড়ে এক সন্ধ্যায় জুঁই উপস্থিত হয়েছিল রেজা সাহেবের বাড়িতে ।

-আসেন, কেমন আছেন আপনি?

-ভালো আছি স্যার। চা কিংবা কফি।

-স্যার আমি বাসা থেকে খেয়ে এসেছি।

– বাসায় কে কে আছেন?

-মা,বাবা এবং ছোট একটি ভাই।বাবা দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থ। আমি একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাই স্যার আমার এ শহরেই থাকতে হবে, আপনি যদি দয়া করে বদলিটা বন্ধ করতেন, আমার উপকার হত।

-আমি চেষ্টা করব।

রেজা সাহেবের ছোট ভাইয়ের দুই ছেলে ইতিমধ্যে বড় হয়ে গেছে। তাদের একজন চলে গেছে আমেরিকাতে, অন্য জনও চলে যাবে । যে ভাইয়ের ছেলেটি বাড়িতে ছিল, সে জুঁইকে দেখল। দেখে তারা খুব ভালো লাগলো। জুঁই এবং রেজা সাহেবের ছোট ভাইয়ের ছেলে অনু প্রায় সমবয়সী। জুঁই সুন্দরী। তার রূপে আগুনের স্পর্শ আছে।

জুঁইকে দেখতে যতটা নরম মনে হয়, ততটা সে নয় । তার মনের মধ্যের চিত্রটি খুব রুক্ষতায় ভরা। সেইবার রেজা জুঁইয়ের বদলি বন্ধ করল। রেজা সবসময় নিজেকে নিয়ে থাকতে পছন্দ করে। সে অন্যদের মতো হ্যাংলামো করতে পছন্দ করে না। ওই দিনের পরে রেজা সাহেব কখনোই জুঁইকে ফোন করেনি কিংবা কথাও বলেনি। কিন্তু ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং শারীরিক সৌন্দর্যের অধিকারী রেজাকে জুঁইয়ের এর ভীষণ ভালো লেগে যায়।

-স্যার আপনি কেমন আছেন?

-ও জুঁই ফোন করেছেন। কিছু কি প্রয়োজন আপনার?

-না, না স্যার। এমনি ফোন করেছি।

গলার স্বরের মধ্যে যতটুকু পারা যায় ন্যাকামি ঠেলে দিয়ে উত্তর দিচ্ছিল জুঁই। কিন্তু এতে করে রেজা আরো বেশি বিরক্ত হচ্ছিল।

রেজা সকালবেলা উঠে। তার প্রিয় বিড়াল ‘গেলেনা’ কে খেতে দেয়, এরপর একটু গান শুনেন, সকালের খাবার খেয়ে অফিসে কাজ করতে থাকেন, এর মাঝে তিনি বিভিন্ন সংবাদপত্রের পাতা উল্টে দেখতে থাকেন। এভাবে কেটে যায় তার একটা দিন। কিন্তু জুঁই তার এই আগ্রহীনতার কারণে আরো বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে।এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় উপস্থিত হয় রেজার বাড়িতে।

বাইরে অঝোর ধারায় ঝড়ছিল শ্রাবণের বৃষ্টি। গ্রামোফোন বেজে চলছিল বৃষ্টির গান। বাড়িতে সেদিন কেউ ছিলনা। ঝড়-বৃষ্টির রাতে মুখোমুখি দুজন।

-এমন একটা দিনে না বলে চলে এলেন?

-আপনাকে দেখতে মন চাচ্ছে।

-আপনি চলে গেলে ভালো হয়। মেয়েদের আমি ভয় করি।

-একটা বছর আপনার জন্য অপেক্ষা। সেই পরিচয় পর থেকে বোঝানোর চেষ্টা করছি, আপনাকে আমার ভালো লাগে। কিন্তু কখনোই আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতেও রাজি হয় নি। আমি কি দেখতে খারাপ?

-আপনি দেখতে খারাপ-ভালো সে কথা নয়। আমার বয়স ষাটের কোঠা ছাড়িয়েছে, এখনও অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছি। ভাইয়ের ছেলে দুটোকে রেখে ভাই মারা গেল, তাদের বড় করেছি। বড় করতে করতে ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমার একটা জীবন আছে। এখন অবশ্য সে জীবন নিয়ে ভাবিনা। জীবনে বহু নারী আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। কোন আগ্রহ কোনো কালে ছিল না, এখনো নেই। আপনি বাড়ি চলে যান খুব সুন্দর কোন পাত্র দেখে বিয়ে করে ফেলেন। আমাকে আমার মত থাকতে হবে।

হঠাৎ করেই জুঁই অন্তরের মধ্য থেকে কান্নার ঢেউ নিয়ে এসে কাঁদতে থাকে। রেজা বাইরে ঝড় বৃষ্টি আর ভেতরে জুঁইয়ের কান্না, দুটোতেই খুব উথাল পাথাল হয়ে উঠে।

জুঁইয়ের কাছে গিয়ে তার রেশম কোমল চুলে হাত রেখে বলে ,

-আপনি চলে যান, অনেক রাত হয়েছে।

জুঁই হঠাৎ করেই, প্রচন্ড ঝড়ের তান্ডবের মত রেজার দুটো ঠোঁটের উপরে তাণ্ডব চালিয়ে দেয়। ১০ নম্বর বিপদ সংকেত এর সাইরেন বাঁজতে থাকে।

কিছুক্ষণ পরে ঝড় থামে, মানুষ দুটো নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যায়।

এভাবে বহুবার তাদের দেখা হয়।

শহরের অলি গলিতে, রেজার বাড়িতে, আরো কত নির্জনতায়।

রেজার ছোট ভাইয়ের ছেলে অনুর সাথে বহুবার দেখা হয় জুঁইয়ের। জুঁই, রেজা ও অনু আড্ডায় আকুন্ঠ ডুব দেয়।

-এবার তবে বিয়েটা করে ফেলি।

রেজার এ প্রস্তাবে জুঁই, একটা অতিরিক্ত আবেগের পরিবেশ তৈরি করে ফেলে।

-আর কটা দিন অপেক্ষা করো ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা, মা বাবার দুজনার শরীর খারাপ। এভাবে তাদের রেখে আসতে পারি না।

-সবার দায়িত্ব আমি নেবো, আমার দাযিত্ব শুধু তুমি নাও।

জুঁই অদ্ভুত সুন্দর একটা হাসি হেসে বলে ‘আর কটা দিন অপেক্ষা করো।’

অপেক্ষার প্রহর আর শেষ হয় না।

তিন দিনের জন্য অফিসের কাজে রেজা ঢাকার বাইরে যায় । শহরে তখন চলছে ফুলের মিছিল, গাছে ধরেছে গ্রীষ্মের সোনালু ফুল। হলুদের তীব্রতায় দাহ হচ্ছে শহরের বহু মানুষের মন। কাজ একদিনের মাথায় শেষ হয়ে যাওয়াতে, রেজা ফিরে আসে বাড়িতে।

কলিংবেল বাজাতে দরজা খুলে দেয় জুঁই। এবার শুরু হল লুকোচুরির যবনিকা পতন।

-তুমি আমার বাড়িতে?

-কেন তোমার বাড়ি আমার বাড়ি নয়?

-সে কথা নয়!

-তবে কি কথা? সন্দেহ করছ।

-না, কিসের সন্দেহ?

-আমি জানি যে তুমি আমাকে সন্দেহ করছ না। তুমি অতিরিক্ত ভালো মানুষ। দশ বছরের প্রেমিক তুমি, এখনো শুধু ঠোঁটের মধ্যে আবদ্ধ আছে প্রেম। কিন্তু আমার মধ্যে ছটফট ভাব। আমার উড়াল দিতে ইচ্ছে করে, ধরতে ইচ্ছে করে, খামছি দিতে ইচ্ছে করে।

-এমন করে ঝগড়া করছ কেন? বহুবার তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছি। তুমি বিভিন্ন দোহাই দিয়ে রাজি হওনি। সেখানে আমার দোষ কোথায়?

-বিয়ে ওই ‘আহ্লাদী’ শব্দটি ছাড়া কি কোন সম্পর্ক হয় না?

-হয় আমি তো কখনো বলিনি যে হয় না, এই যে আমি তোমাকে তীব্র ভালোবাসি। তোমার সকল পার্থিব চাওয়া পাওয়ায় আমি হ্যাঁ বলেছি, পাশে থেকেছি।

-রেজা আমার এতে কুলোয় নি। আমি তোমাকে সবটুকু চেয়েছিলাম। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই । আমি আর অনু একসাথে থাকব বলে ঠিক করেছি। অনু দেশের বাইরে যাওয়ার স্বপ্ন তুমি ঠিক করে দিয়েছো আর অনু ঠিক করে দিয়েছে আমারটা। আগামীকালকে আমরা দুজন জন আমেরিকাতে চলে যাবো। তুমি হঠাৎ করে আজকে না ফিরলে হয়তো দেখা হত না। যা হোক তোমার ব্যাংক ব্যালেন্স শূন্যের করে দিয়েছি, এখন একটু কষ্ট করে এই বাড়িতে থাকো আর বাকি জীবনটা কাটাও।

৭৫ বছরের রেজার মাথাটি ভীষণভাবে ঘুরছিল, তবুও নিজেকে সামলে নিলেন।

বারান্দার কামিনী ফুলের গাছটি, প্রিয় বিড়াল গেলোনা, আর বাড়ি বিক্রির টাকা নিয়ে রেজা উপস্থিত হলেন বৃদ্ধাশ্রমে। বুকের বাম পাশে চিনচিন করে জুঁইয়ের নামটি বেঁজে চলছিল। কিন্তু সকলকে সেবার মাধ্যমে রেজা নিজেকে ব্যস্ত রাখলেন । কোনদিন কথা হয়নি জুঁইয়ের সাথে কিংবা অনুর সাথে। তবুও ভীষণ ভালো আছে রেজা। প্রকৃতির ধ্রুব সত্য এক নিয়মে, গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা বারান্দার কামিনী ফুলের গাছটির পাশে একদিন পরে ছিলেন রেজা, গেলোনা ডাকছে মিউ মিউ করে। ঝড়ে পড়ছিল কামিনী ফুলের সুগন্ধা চারিধারে। শান্তির ঘুম ঘুমাতে লাগলেন রেজা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *