ঈদসংখ্যার গল্প।। এক জীবনের গল্প।। পিয়ারা বেগম

সারাদিন ছুটা বুয়ার কাজ করি। সন্ধ্যায় ক্লেনান্ত শইলডা লইয়া বাসায় ঢুকি। বাসা না কইয়া দিন গুজরাণের একটা আস্তানা কওয়াই ঠিক। কাহিল শইলডা লইয়া একটু জিরাই, তয় গোসল করি। হায়, হায়! ইফতারের সময় কখন যে পার অইয়া যায় টেরই পাইনা। দুতিন বাসা থাইকা ইফতার দিয়া দেয়। এগুলান ভেতরে ঢুহে না। খাইতে নিলেই আমার কইলজার টুকরো পোলার ঘরের তিন বছরের নাতিডার কতা মনে অয়। চারচক্ষে ভাসে মেয়ের ঘরের নাতনির গায় কাতর চেহেরাডা। কী করমু? পরাণডা পুড়ায় তাই মাঝেমধ্যে ঢু মারি। ইফতার না খাইয়া পোলার বাসায় লইয়া যাই। নাতিডায় ছোলামুড়ি, পিঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ পাইয়া কি খুশি! আবার রসালো জিলাপিও। আমার মানিক সোনারে জিলাপি আগে খাইতে দিই। আমার খাওয়ার চাইতে বেশি আনন্দ পাই নাত-নাতনিকে খাওয়াইলে। আমার বাসায় দক্ষিণে দিকে পোলায় আর উত্তরে থাহে মাইয়া। তাই একদিনে দুই বাসায় যাইতে পারিনা। এমনি কইরা পোলামাইয়ার বাসায় দিয়া আইতাছি যখন ভালমন্দ খাওন দেয় বিবি সাবেরা। মাঝেমধ্যে ছোলা মুড়ি অল্প মুখে লই। তারপরে ঘরে পানি পান্তা যা আছে পাতে নিই। গোগ্রাসে গিলতে থাহি। দারুণ স্বাদ লাগে। জিহবার স্বাদ আছে বইলাই দেহডা এখনও খাঁড়া আছে। কোন বাসায় খাওনের শর্তে কাম করিনা। কারণ, আমার টেহার দরকার বেশি। তারপরেও বিবি সাবেরা প্রায়ই মাঝেমধ্যে ভালোমন্দ রানলেও দেয়। এমনিতেই আমার চইলা যায়। তয়, কারো কাছে চাইয়া কিছু আনি না। লগের মাতারিরা কয়, তুমি ঠকতাছ। ঈদের সময় বিবিসাব গো কাছে চাইতি অয়। সমিস্যার কতা কাইন্দাকাইট্টা কইতি অয়। জানস তো, না কানলে মায়ও ছাওয়ালরে দুধ দেয় না। লগের মাইনষের কতায় আমি নাচি না। কখনও কারো কাছে চাইতে আমার শরম লাগে। আল্লাহর রহমতে বিবি সাবেরা আমারে ভালা জানে। তানিরা খুশি অইয়াই আমারে দেয়। মিছামিছি কতা কইয়া কিছু আদায় করা গুনাহের কাম।

রোজা থাইকা কাম করি। বিহান রাইতে ভাত খাইতে ভাল্লাগে না৷ খাওনের থাইকা ঘুমডা মজা লাগে বেশি। তাই তড়িঘড়ি কইরা শুই। গড়াগড়ি করতে না করতে ফজরের আজান পড়ে। গড়িমসি করি। ওডতে মনডায় চায় না। তবুও ওডি। ওযু কইরা নামাজ পড়ি। আবার বিছানায় যাই। এপাশ-ওপাশ করতে করতে কামের সময় অইয়া যায়৷ রোজার সময় ভোর বিহানে কেউ শোয়াত্তনে ওডে না। সাত-আটটার দিকে যাই। সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত কাম করি। শইলডা তো মেশিনের মতনই। আর কত?

মাঝেমধ্যে শইলডা বেসামাল অইয়া যায়। কোমর ব্যথা, বুক ব্যথায় কোঁকাই। দেরি অইলে বিবি সাবেরা ফোন করে। ফোনে কোঁকানি গ্যাঙানি হুইন্যা বিবি সাব কোন দিন মায়া করে। কোনদিন করে না। এমনি কইরা একেকটা দিন জিরাই। আমি অইলাম বোকাসোকা বুয়া। মোবাইলে রিং বাজলে ধরতারি কিন্তু কারো কাছে মোবাইল করতে পারিনা। ছুডি কাডাইলে পরের দিন সকাল অইলেই আগেবাগে ছুটতে হয়। তহন ব্যথাবোতা কই পালায় কইতারিনা। আগে তিনতলা থাইকা পাঁচ-ছয়তলায়ও কাম লইছি। এখন সিঁড়ি বাইয়া উডতে হাঁটুতে জোর পাই না। তবুও টেহার লোভে তিন জিরানি দিয়া উডি। কষ্ট অয়। খুউব কষ্ট। মাসের শেষে মাইনেগুলান পাইলে ব্যথাট্যথার কথা ভুইলা যাই।

দুজনে মিইল্যা একটা রুমে থাহি বইলা বাসা ভাড়া গড়পড়তায় কম পড়ে। রান্নাবান্না আলাদা করি। মিলেমিশে থাহি। রাইতবিরাতে সুখদুঃখের কতা কই। কইতে কইতে ঘুমে চোখ বুইঝা আওনের লগেলগে ঘুমাইয়া যাই। হায় রে জীবন! হেই কবে বিধবা অইয়া ঢাহা শহরে গুপিবাগে আইছি। আইছি কি আর সাধে। গ্রামের কাম অইল মওসুমি। ধান লওনের সময়, গম, তিলমরিচের সময়। মাডি কাডার কাম আছে শীতকাল থাইকা চইত বৈশাখ মাস পর্যন্ত। বাকী সময় বইয়া বইয়া খাওন। তা-ও থাকতাম। থাহি নাই, দেশগেরামে অল্প বয়সে স্বামী মারা গেলে বদনামের ভাগীদার অইতে অয়। পাড়াপ্রতিবেশির জোয়ান পোলাগো কমন ভাবী ডাক হুনতে হুনতে অতিষ্ট লাগে। কামে, আকামে খাতির করে। পোলাপান দোকানে গেলে চকলেট কিইন্যা দেয়। আমার লাগিও ঝালমুড়ি নইলে চানাচুর কিইন্যা দেয়। ফেরত দিলেও মাইনষে হুনব। বদনাম অইব। আর খাইলে শত দোষ। যত্ত দোষ নন্দ ঘোষ। কি করমু! পোড়া কপাল! কাঁচা বয়সে স্বামীরে হারাইলাম। কথায় কয় না, নরম জাগায় হগ্গলতেই পাও রাখতে চায়। ছাড়া বাড়ি পাইলে কে না পেসাব করে?

তাই ঢাহা শহরে আইছি। স্বাধীন মতন কাম করতাছি। আইলাম ছেড়ি, অইলাম বুড়ি। কেউ কারো দিকে ফিইরা চাওনের সময়গময় নাই। সহাল বেলা লেতুর ধইরা মানুষের মিছিল ছোডে। গার্মেন্টসে যায় মাইয়ারা।

ঢাহা আইয়া বাবার মামাত বইন ছফুরা হুফুর বাসায় ওডি। দুগ্গা পোলাপাইন লইয়া একটা ছাপরা ঘর ভাড়া নিই। হুফুই আমারে ছুডা বুয়ার কাম লইয়া দেয়।

হেই থাইকা আজও অবধি কামের বুয়াই আছি। প্রেথম প্রেথম টুকটাক ঝামেলাও অইছে। কামের বুয়া সাপ্লাই দিত আরেক মাতারি। আমারে ছফুরা হুফু কাম ঠিক কইরা দেওনে ঐ মাতারি হেব্বি খেইপ্পা ঢোল অইয়া রইছে। আমারে রাস্তায় কয়, আইয়াই ডাট মাইরা কাম লইছ? আমি হ্যাবলা-ক্যালার মতন ডেলা ডেলা চোখে চাইয়া রইছি। কইলাম, খালাম্মা আমারে কিছু কইলেন?

উনি মুখ ভেংচি দিয়া কইল, কানে খাড তুমি? হুননাই কি কইছি। আমি কইলাম, না গো খালাম্মা, খেয়াল করি নাই। উনার লগের মাতারি কয়, এমন নিরীহ ছেমড়িরে হুদাহুদি কষ্ট দিছ না তো। এইডা কওনে আমারে ছাইড়া দিল। বাসায় আইয়া হুফুরে আর হুনাই নাই। আমার হুফুও তেজী কম না। যুদি ঝগড়াবিবাদ লাইগা যায় তাইলে আমারই ক্ষতি অইব। পরে হুনছি, এই মাতারি এই এলাকার বাসায় বাসায় কামের মানুষ ঠিক কইরা দেয়৷ এতে যারে দেয় আর যাদের বাসায় দেয় দুজনের কাছ থাইকাই টেহা নেয়।

কি আর কমু! পোড়া কপাল কি আর জোড়া লাগে।পোলাডারে লেহাপড়া করাইতে পারি নাই। চেরেষ্টা কইরাও পারলামনা। জীবনভর বেগার খাটুনি খাটলাম। পোলায় ভালোবাইসা বিয়া করল। বউ আমার লগে এই রাইতের পরবাস থাকলনা। আলাদা বাসা কইরা গেল গা। মাইয়াডারে বিয়া দিলাম। জামাইও বাদাইম্যা৷ পোলামাইয়া পালা ধইরা মাস শেষ অওনের আশায় বইয়া থাহে। কবে মাইনা পামু? আজ এই ছুতা, কাইল আরেক ছুতা দিয়া টেহা চায়। আমি যেন টেহার গাছ লাগাইছি। ঝাঁকি দিলে ঝরঝরাইয়া পড়ে।

এ বয়সে শরীরে আর সয় না। পেটও চালাইতে কাম করি আবার বাসস্থানের কতাও ভাবতে অয়। বাড়িতে একটা দোচালা ঘর ছিল। ঐ ঘরের বেড়া ভাইঙ্গাচুইরা ঝুরঝুরা অইয়া খইয়া খইয়া পড়ছে। ঘরের চালও ঝুরঝুরা। তাই বাড়িতে একখানা চৌয়ারী ঘর উডাইছি। তিন বছরে ঘরের ভিডিও পাকা করছি। ঘরের ভিতর দুইডা বাথরুম দিছি। রান্নাঘরে গ্যাসের সিলিন্ডার বুয়াইছি। অহন ঈদের ছুডিছাডায় বাড়িতে যাই।

এক কানি জমি বন্ধক ছিল, টাকা দিয়া বন্ধকী ছুডাইছি। শেষ বয়সে অসুখে-বিসুখে নিজের ঘরে গড়াগড়ি কইরা মরতে চাই। করছি তো পোলা-মাইয়ার লাইগাই। এইডাও ভাই-বইনে বুঝে না। আমি মইরা গেলে ওরা দু’ভাইবোনেই পাইব। বাপ মইরা গেছে শিশুকালে। বাপের জায়গা টুকু আছে যহন তাই ঘরখান কইরা দিয়া গেলাম। তাই কষ্টেসৃষ্টে সময় পার করতাছি। বেহিসাবি খরচা করি না। জ্বরে ভুগছি কয়দিন। প্যারাসিটামল বড়ি কিইন্যা খাইছি। লগের ছেড়ি ময়জুনে যত্নআত্তি করছে। পোলামাইয়া দুজনেরে একজনেরেও কাছে পাই নাই।

বাসায় বাসায় কাম করি ত্রিশবত্রিশ বছর প্রায়। বড় বড় লোকের বড় বড় দুঃখকষ্ট। তাদের দুঃখকষ্ট দেইখা আমার দুঃখগুলোকে দুঃখই মনে অয় না।

এক বিবি সাবের পোলাপান দুইডা। দুই জনেরই বাড়িগাড়ি আছে। বাপ-মা বুড়া অওনের আগে আওয়া-যাওয়া করত। বাবা দুই বার স্ট্রোক না কি করছে। মায় ডায়াবেটিসে এক্কেবারে শুকাইয়া কাঠ অইয়া গেছে। এমন শইলডা লইয়া স্বামীরে যত্ন করে। পোলামাইয়া এখন বুড়ো মা-বাপেরে তত্ত্বতালাশ তো করেই না। খোঁজখবর পর্যন্ত নেয় না।

আরেক বাসায় আগে ছুডা কাম করতাম। আমার আচার-ব্যবহার বালা দেইখ্যা বিবি সাবের লাইগ্যা আমারে বান্ধা কাম ঠিক করছে। আমার পোলায় বিয়া কইরা আলাদা বাসা করল। তাই ঘরভাড়া ছাইড়া দিলাম। পাঁচ বছর এই এক বাসায়ই কাম করছি। বিবি সাব বড় লোকের বউ। স্বামী অফিসের বড় সচিব না কি আছিল। তানি পেনশনে গিয়া আট বছর বাঁইচা আছিল। মারা গেছে মাসেক খান অইল। চারপোলা তিন মাইয়া। একেকতলায় চারডা ইউনিট। প্রেত্যেকেরে একেকতলার চার ইউনিট একেকেজনেরে ভাগবাটোয়ারা কইরা দিয়া গেছে। বাড়িডা বিবি সাবের নামে। দশতলা বাড়ি। নীচতলা গেরেজ, কেয়ার টেকার, লিফ্ট ম্যান থাহনের দুইডা রুম।

দশতলা ভাড়ার টেহা দিয়া বাড়ির যাবতীয় খরচাপাতি চালাইব।

দুতলায় চাইরডা ফেলাট একত্র কইরা বাড়িওয়ালি থাকত। বিবি সাব যদ্দিন বাঁইচা থাকে ততোদিনে তানি ভোগ করব। মৃত্যুর পর বাকীগুলো ভাগবাটোয়ারা করার কতা কইয়া গেছেন।

এত দিন যার যার আলাদা এক ইউনিটে ছিল এই বিল্ডিংয়ে। উনি মারা যাওয়ার পর ছটরবটর কইরা পোলারা অন্য জায়গায় চইলা গেল। এর চেয়ে বড় ফেলাটে ভাড়া নিছে পোলারা। মাইয়া গো যার যার বাড়ি আছে। পোলারা কয়, এখন থাইকা যার যার ফেলাটের ভাড়ার টাকা আমরা নিয়া যামু। মায়ের লগে কে থাকব হেই চিন্তা করে না কেউ। মাইয়ারা তিনজনই মায় থাকতে ফেলাটের ভাড়ার টেহা নিতে রাজী না। পোলার বউয়েরা কয়, আমাগো খরচাপাতি বাড়ছে। আমরা ভাড়ার টেহা না নিলে চলমু ক্যামনে?

পাঁচ বছর আমারে পনের হাজার কইরা মাসোহারা দিত। কারণ, আমি ছুটা কাম কইরা ১৪/১৫ হাজার টেহা কামাইতাম। শেষের তিন বছর বিবিসাব বিছানায় ঘাটপায়খানা করত। আমিই পয়পরিষ্কার করতাম। বিবিসাব মরার আগেই তানির মেয়েগো সামনে আমারে দুই লাখ টেহা দিছে খুশি অইয়া। আট আনা সোনার দুই জোড়া কানের টবও দিছে। আমি মায়ের মতনই যত্নআত্তি করছি। মারা যাওয়ার দিন আগে টাস টাস কইরা কতা কইছে। হঠাৎ জবান বন্ধ অইয়া গেছে। আমি কেয়ার টেকার ও ড্রাইভারকে ডাইকা আনছি। ওরা তানির পোলামাইগো ফোন করছে। দামী হাসপাতালে মাইয়ারা নিয়া ভর্তি করাইছে। পরের দিন মারা গেছে। পোলারা হাসপাতালে আইছে হুনছি। বউরা আহে নাই। মরার পর সব্বাই হাজির। কষ্টে আমার বুকডা ফাইট্টা গেছে।

আমারে কইত, আমি মরলে বিছানার নিচ থেকে চাবির গোছা লইয়া কাড়াকাড়ি লাগব। কোন পোলার বউ চোখ দিয়া দেখতে আইত না। বাসার ভাড়াগুলান লইয়া চম্পট দিত। পোলারাও না। ছোড পোলার বউ একলগেই আছিল। অন্য বউরা ফুসলাইয়া আলাদা করাইছে। মাইয়ারা দুইজনে আইত এইডাওডা নিয়া। বড় মেয়ে বিদেশে। বড় আফায় দুএকদিন পরপর খোজঁখবর নিত।

বিবি সাবেরে আমি খালাম্মা কইয়া ডাকতাম। আইজও মনে অইলে কান্দি। রোজার ঈদের আগের দিন মারা গেছে। ঈদ আইলেই মনে অয়। ত্রিশবত্রিশ ধইরা কত মাইনষের সুখদুঃখের সাক্ষী আমি। দেখছি নতুন বউয়ের বাসর রাতে চোহের নোনা পানি। স্বামী নাকি গাঞ্জা মদ খাইত। মদখোর স্বামীর অত্যাচার সহ্য কইরা বউডা নীরবে শুধু কাঁদত। যৌতুক লোভী স্বামী, শ্বাশুড়ি ননদের জ্বালাতনে পুত্রবধূর আত্মহত্যা দেখছি। পুত্রবধূর নির্যাতনে শ্বাশুড়ির কষ্টও দেখছি। মারধর করতে দেখছি। মায়ের কষ্ট দেইখা ভেড়া পোলা টু শব্দও করতে পারতনা। আরও দেখছি, রাগী দজ্জাল বউয়ের অত্যাচারে স্বামী বেচারার করুণ অবস্থা। কষ্ট কইরা কাম কইরা খাইলেও বহুত বালা আছি।

তাই অহনে মনে কষ্ট নাই। কারো তলে যামু না। নিজের ঘরে থাহি। যদ্দিন চলাফেরা করতারি নিজেই কইরা খামু। ঘরদোর ভাগ কইরা দিছি। আমি মরার পর ভাগ নিবি। শেষমেশ যে যত্ন-তদবির করে নগদ টেহা দিয়া যামু। ব্যাংকে নগদ টেহা রাখছি ১৪ লাখ। নমিনি দিছি পোলামাইয়ারে সমান সমান। খালাম্মা গো বাসায় থাকাকালীন তানির ছোড মাইয়া ব্যাংকের অফিসার। ছোড আফায় আমারে একাউন্ট কইরা দিছে। যা জমাইছি আফারে লইয়াই করতাম। ঈদে আমার ৩০/৪০ হাজার যাকাতের টেহা ওঠত। সবটেহা জমাইতাম। তাই কই হঠাৎ মারা গেলে শোকর আলহামদুলিল্লাহ! যার যার হক বুইঝা নিব। মাগার জীবিত থাকতে সম্বল হাত ছাড়া করতামনা। জীবনে আর চাওয়ার নাই। বাকী জীবনের ভোগান্তির কথা তো কইতে পারি না। তবে যার কেউ নাই ওপরে তো একজন আছেনই। মাইডায় দেশে আইয়া ঘরদোর করছে। আমার মতনই মাইয়াডা পরিশ্রমী। বেড়াইতে আহে মাঝেমধ্যে। ভালোমন্দ রান্ধি। নাতিও অইছে মাশআল্লাহ! আমি খুব খুশি। পোলাডারে ড্রাইভারী শিখাইছি। এখন ছোড আফার গাড়ির ড্রাইভার। আসলে সততা! সততার ফল টাটকা। তাই পোলারে শিখাইছি। কইছি কোন দিন মালিকের লগে বেঈমানী করিছ না। দেখবি তরতর কইরা ওইট্টা যাবি। পোলায় হুনছে। তাই এখনও ঢাহা যাই ঈদলগনে। আফরা ফোন কইরা নেয়। চার-পাঁচ দিন থাকি দুই আফার বাসায়। ঈদের বখশিশ আর যাকাতের পাঁচ-ছয় হাজার টেকা এখনও পাই। পোলার বউও বাড়িতে আইয়ে। ঘরদোর অইছে। নিজেগো ভাগ বুইঝা নিছে। বাড়িতে আইলে একলগেই খাই।

শেষ বয়সে বাপের বাস্তুভিটার কতা মনে অয়। মনডা কান্দে। তাই পাগল পাগল অইয়া যাইতাম। ভাইপুতেরা ডাকাখুঁজি কইরা ঘরে নিত। ভালামন্দ রান্ধাবাড়া করত বউয়েরা। তবুও মনে টেহে না। কথায় কয় না, কিনতে ছাগল বেঁচতে পাগল। আমিও যাইতে পাগল অইতাম আবার আইতেও পাগল অইতাম। ছোডবেলার কাউরে দেহি না। যারা আছে ঘরে তিনমাথা একসাথে কইরা বইয়া রইছে। কাছে গিয়া বইয়া কতাবার্তা কইতাম। আগের মতন মায়া মহব্বত লাগে না। অচেনা অচেনা লাগে। আমাগো এজমালি বাংলাঘরের পেছনে গোপাট আছিল। আছিল বেতবন, বাঁশঝাড়ও। কত বেথুন পাড়ছি কাঁটার ঘাঁই খাইয়া। ছোডবেলার কতা মনে অয়। সারাদিন চইচই কইরা ঘুরছি। গাছে চড়ছি, খালে সাঁতার কাটছি। লগের মাইনষেরে দেহিনা। হেই হিজলগাছ, মোতরার জঙ্গল। সবশেষ! চেনা মানুষও শেষ! মনে অইলে ভেতরডা মোচড় দিয়া ওডে। কই আর যামু? কারে দেখতে যামু! ভেতরডা হাহাকার কইরা ওডে! এত্ত কষ্ট লাগে কিছু কইতে পারি না। তাই শূন্য বুকটা আরও শূন্য কইরা ফিইরা আই স্বামীর ভিটায়। এই ভিটাই শান্তি পাই। ওখানে যেন কোথাও কেউ আমার আপন নাই ! একা! একদম একা লাগে। তবুও বাপের ভিটা!! চোখের কোণায় ফোটা ফোটা পানি জমে! পানি আড়াল করি। কেউ দেখে ফালাইলে কি ভাববো। ভাবি, এত পানি কইত্তনে আইয়ে? কেন-ই-বা আইয়ে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *