ঈদসংখ্যার ছোটগল্প।। হালিম চৌধুরী যেভাবে চাদ মোল্লা হলো।। ইলিয়াস ফারুকী
বিশ্বাস মানুষকে অনেক কিছু দেয়। চাদ মোল্লা কথাটা হৃদয়ের গভীর থেকে বিশ্বাস করে। তার এই কথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বাপ দাদার দেয়া নাম বদলে সে নতুন জীবনের সাথে এই যে নতুন নাম
পেয়েছে তাতে তার কোন আক্ষেপ নেই। আজ যে সে বেঁচে আছে এবং নতুন নামে দ্বিতীয় জীবন উপভোগ করছে তাও তার বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছার কারণেই। সে তার সাধ্যের বাইরেও শুধুমাত্র নিজের আস্থা থেকে যা আশা করেছে তা পেয়েছে। চাদ মোল্লা খুবই ধার্মীক মানুষ। নিজেই বলে আমি ধর্ম অনুরাগী, ধর্মভিরু নই। ধর্মকে যদি ভয়ই পাই তাহলে ধর্ম পালন করব কীভাবে। এবং তার এই ধর্মীয় বিশ্বাসই তার ভেতরে বিশ্বাসের আস্থাকে দৃঢ় করেছে।
চাদ মোল্লা তার প্রকৃত নাম না। তার বাবা মার দেয়া নাম হলো হালিম চৌধুরী। এক ঘটনায় সে বাপ দাদার দেয়া নাম হারিয়ে ফেলে। তার বাড়ি চাঁদপুরের হাইমচরে। একরাতে প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত মেঘনা তার পুরো পরিবারকে হজম করে ফেলে। কিন্তু হালিমকে হজম করতে না পেরে উগড়ে দেয়। সে যে বেঁচে আছে তা সে পরেরদিন সকালে এক চরে ঘুম ভাঙ্গলে টের পায়। উর্ধ্বে পাতলা একটি গেঞ্জি বাদে নীচে পুরো দিগম্বর।
স্রোত তার লুঙ্গি কোথায় নিয়ে গেছে বলা দুস্কর। সে নিজের এই অবস্থা দেখে বিব্রত হয়ে পড়ে। শোয়া থেকে খুব সাবধানে মাথা তোলে এবং বুঝতে পারে যে সে একটি বিরান চরে। নদীর পাড় থেকে উঠে একটু ভেতরে গিয়ে বসে। মাথাটাকে সচল করতে বেশ কিছুটা সময় নেয়। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলে বুঝতে পারে পেটে অনেক পানি কিন্তু দানা নেই। নদীর পাড়ের মানুষ, তাই কৌশলগুলো ভালো ভাবেই জানা।
প্রথমেই গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করে পেটের পানি বের করে। গেঞ্জিটা নীচের দিকে টেনে লজ্জা ঢাকার প্রয়াস করে। এবার চরের কোথাও কিছু খাবার পাওয়া যায় কীনা সেই চেষ্টা করে। বুঝতে পারে চরটা সবেই বিকাশ ঘটেছে, এখনো পুরোটা জেগে উঠতে পারে নাই। তাই
আয়তনে খুবই ছোট। প্রচণ্ড ক্ষুধায়ও চরটির ভবিষ্যৎ দেখে আপন মনে হাসে। নতুন চর রক্ত চায়। আর যেই মহাজন তাকে বেশি বেশি রক্ত দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারে, চরটা তারই বশ্যতা স্বীকার করে। সে দিব্য দেখতে পায়
যে দ্ এক বছরের মধ্যেই চরটি রক্তাক্ত হবে। আবারো মনে মনে হাসে। ভাবে হায়রে মানুষ। কতদিন বাঁচবে ঠিক নেই অথচ লোভ!
ঝেঁটিয়ে মাথা থেকে এসব চিন্তা বের করে দেয়। বুঝতে পারে আপাততঃ এই চরের সেই প্রথম আদম। নিজেকে আদি মানুষ আদম ভাবতে কেমন যেন সুখসুখ অনূভুতি শরিরময় ছড়িয়ে যায়। অনুভব করতে চেষ্টা করে
আদমের একাকিত্বের। কী করে তিনি এককিত্বকে উদযাপন করেছিলেন।
কিন্তু কল্পনায় খুব একটা বেশিক্ষণ বিচরণ করতে পারেনা। প্রচণ্ড ক্ষুধা তাকে কল্পনা বিলাস করতে দিচ্ছে না। থেকে থেকে ফিরে আসতে হচ্ছে বাস্তবে। এখন তার পুরো ধ্যান ধারণায় আদমের মতো বেহেশতের
অলৌকিক খাদ্য এবং পানীয়ে। তবে এটাও বুঝতে পারছে এটা বেহেশত না। বসে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। এ অবস্থায় কী করতে হয় তা বাবার কাছ থেকে শিখেছে। বসা থেকে উঠে দাড়ায়। প্রথমেই গেঞ্জিটা খুলে গলার অংশ গিট্টু দিয়ে দুই হাতের অংশে দুই পা চালান করে দেয়।
অনেকটা জাঙ্গিয়ার মতো করে পরে নেয়। সে ভালোভাবেই জানে যে এই চরে সে ছাড়া আর কেউ নেই। তার লজ্জা ঢাকার তেমন কোন প্রয়োজনই
ছিল না। তবু সে নিজেই লজ্জা পেতে থাকে। এখানেই সৃষ্টি কর্তার বড় কারিসমা হয়তো। এজন্যই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। একটু সুস্থির হতেই চরের চতুর্দিকে চোখ বুলাতে থাকে।
তার দৃষ্টি খুঁজে বেড়াচ্ছে লম্বা নেপিয়ার জাতীয় ঘাস, একটু দূরেই তা পেয়ে যায়। আনন্দে লাফাতে ইচ্ছে করে। তড়িৎ সে ঘাসগুলো তুলে এনে নদীতে ভালো করে ধুয়ে নেয়। ঘাস গুলোর নিচের কচি সাদা অংশ
ছাড়িয়ে নিয়ে খুব আনন্দ চিত্তে চিবোতে শুরু করে। ক্ষুধা পেটে যেন তাই অমৃত মনে হয়। যথেষ্ট পরিমাণ পেটে চালান হয়ে গেলে সে ক্ষান্ত দেয়।
মানুষের সাথে থাকা এই শত্রুটাই মানুষকে অমানুষ বানিয়ে দেয়।
বন্ধুদের আড্ডার সময় নয়নের একটি কথা মনে করে আপন মনে হেসে উঠে। নয়ন প্রায়ই বলত, ‘ব্যাটা খাবি দাবি ফুর্তি করবি। মনে রাখবি দুনিয়াটা হলো, পেট আর চ…এর জন্য।’
নিজের শত্রুটাকে ঠাণ্ডা করে এবার তার মনোযোগ, কিভাবে এখান থেকে উদ্ধার পেয়ে লোকালয়ে যাওয়া যায়। নতুন খাদ্যকে অনভ্যাস্থ পাকস্থলিতে মানিয়ে নিতে নিজেকে কিছুটা সময় দেয়। যখন বুঝতে পারে সমস্যা হবেনা সে উঠে দাড়ায়। পুরো চরটা ঘুরে আসতে ঘন্টাখানিক সময় লেগে যায়। চরটা ঘুরে বুঝতে পারে কোন জলযানের চলাচল এর পাশ দিয়ে নেই। খরা বৈশাখেও আষাঢ়ে মেঘের মতো দুঃশ্চিন্তা তার কপালে ভাঁজ ফেলে দেয়। নিজেকে উদ্ধারের বিভিন্ন পরিকল্পনা মাথায় আসলেও তড়িৎ পালিয়ে যায়। সকাল গড়িয়ে দুপুর হাজির হলেও চর থেকে বেরোবার কোনই পথ
খুঁজে পায়না। উদাস নয়ন এবং ভগ্ন হৃদয়ে নিয়ে নদীর পাড়ে বসে থাকে। বৈশাখের ধোঁয়া উঠা রোদে চরের এই নির্জন দুপুরে হঠাৎ ঘুঘুর ডাক তার কানে আসে। এই গনগনে দুপুরে নেশা ধরানো ঘুঘুর ডাকে তম্ময় হয়ে যায় সে। তার ঘোর কাটে কপালে জমে থাকা ঘাম চুইয়ে তার চোখে প্রবেশ করলে। সে বাস্তবে ফিরে আসে। ঠিক তখনই নদীতে ভাসমান কিছু একটা চোখে পড়ে। ভালো করে লক্ষ্য করলে বুঝতে পারে কলাগাছ ভেসে আসছে। আনন্দে লাফাতে ইচ্ছে করে। হিসাব করে পাড় থেকে কতটা দূরত্বে রয়েছে জিনিসটা। মনে মনে দূরত্বের হিসাব করেই নদীতে ঝাঁপ দেয়। স্রোতের সাথে পাল্লা দিয়ে কলাগাছটাকে নিয়ন্ত্রণে নিতে আধাঘন্টার মতো লেগে যায়। পিছল কলাগাছটাকে কোন রকমে চরের পাড়ে নিয়ে আসে। সে ভালো করেই জানে এই কলা
গাছটায় কোনরকমে ভেসে থাকতে পারবে ঠিকই কিন্তু ক্ষণিক পরপর পানির নীচে যেতে হবে। যা মোটেই সুখকর হবেনা। গাছটাকে টেনে পাড়ের অনেকখানি ভেতরে নিয়ে আসে। এবার চরময় ঘুরে ছড়িয়ে ছিটে
থাকা গাছের ডাল সংগ্রহ করে। একটি ইট ভেঙ্গে এর ধারালো প্রান্ত দিয়ে কলাগাছটিকে মাঝ বরাবর দুভাগ করে। সংগ্রহিত গাছের ডাল গেঁথে ছোট ভেলার মতো তৈরী করে। এসব করতেই তার বিকেল হয় যায়।
সিদ্ধান্ত নেয় আজ আর নদীতে ভেলা ভাসাবে না। সকালের খাওয়া ততক্ষণে হজম হয়ে তার পেট নতুন করে নোটিশ দিতে শুরু করেছে। নিজের বানানো জাঙ্গিয়া নিয়ে নদীর মধ্যে নেমে জাঙ্গিয়াকে থলের মতো করে স্রোতের বিপরীতে টেনে নিয়ে কিছুক্ষণ পরপর পানির উপর টেনে তুলতে থাকে। উদ্দেশ্য যদি একটা মাছ পাওয়া যায়। অনেক্ষণ চেষ্টার পর তার থলিতে ভারি কিছু একটা মনে হয়। একটানে পানির উপর তুলে এনে দেখে একটা ছয় সাত ইঞ্চির মৃগেলের নলা। সন্তুষ্টি চিত্তে চিন্তা করে এটা তার জন্য যথেষ্ট। পাড়ে এনেই নিজের বানানো জাঙ্গিয়াটা পরে নেয়। শুকনো দুটো ডাল নিয়ে পরস্পরের সাথে ঘর্ষণ করে অনেকক্ষণ চেষ্টা করে শুকনো পাতা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে মাছটাকে ঝলসে নিয়ে খাবার শেষ করে। রাতে চরে কতটুকু পানি উঠে তা জানা না থাকায় নিজের বানানো ভেলাটাকে চরের মাঝামাঝি নিয়ে রাখে। নিজেও একই জায়গায় রাত কাটানোর প্রস্তুতি নেয়। নিজেকে উদ্ধারে কোন অবহেলাকেই সে প্রশ্রয় দিতে রাজি না।
সকালেই নিজের তৈরী ছোট ভেলা নিয়ে স্রোতের পক্ষে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। স্রোতের তোড়ে যাতে ভেসে না যায় তাই কলা গাছের আঁশ দিয়ে ভেলাটাকে নিজের শরীরের সাথে ভালোভাবে বেঁধে নিতে ভুলেনা। সাঁতরে নিজেকে যতটা সম্ভব নদীর মাঝপথে জাহাজ চলাচলের পথে নিয়ে যায়। কতক্ষণ সে এভাবে ভেসে ছিলো বলতে পারবেনা। তার জ্ঞান ফিরে একটা কার্গো জাহাজের ডেকে। মানুষের ফিসফিসানের আওয়াজ শুনতে পায়। প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও ক্ষণিকপরেই তা স্পষ্ট হতে থাকে। বুঝতে পারে তাকে নিয়েই কথা হচ্ছে। টের পায় খুব আরামদায়ক কোথাও শুয়ে আছে। আরামে আবারো চোখ বন্ধ করে থাকে।
খুব ইচ্ছে করে তার ভেতরে জমে থাকা স্তব এবং স্তÍতি একজন হৃদয়ের মানুষের নিকট ব্যাক্ত করে। তার কল্পনায় ছেদ পড়ে যখন কেউ একজন বলে উঠে এঁরোই হেঁতারে দেহি মনে হর হেতে দরিয়া ভাঙ্গা চানপুইর্যা।
নোয়াখালীর ভাষা শুনে এবার পুরোপুরি চোখ খুলে তাকায়। ওর চোখ খুলতেই সবার মাঝে আনন্দের আবহ সৃষ্টি হয়। সবাই তার নিকট চলে আসে। সেও উঠে বসতে চেষ্টা করে। পরক্ষণেই নিজের দিগম্বর অবস্থা টের পেয়ে আবারো চাদরের নিচেই শুয়ে থাকে।
সে পরে জানতে পেরেছিলো যে ওরা তাকে প্রায় সাগরের মোহনার কাছাকাছি থেকে উদ্ধার করেছিলো। ঢাকায় আসতে তাদের চারদিন লেগেছিলো। এই চারদিন ওদের খাতির যত্নে সে অনেকটা সুস্থ হয়ে
উঠেছিলো। জাহাজে ইমামতি করায় তখন জাহাজের লোকজন তার নাম দিয়েছিলো চাদ মোল্লা। পুরান ঢাকার সুরিটোলায় জাহাজের মালিকের বাসার নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে তার কাজও জুটিয়ে দিয়েছিলো ওই জাহাজের লোকজন। মালিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় ওরা ওর নাম বলেছিলো চাদ মোল্লা। সেই থেকেই হালিম চৌধুরী চাদ মোল্লা হয়ে
যায়।