ঈদসংখ্যার গল্প ।। এক হাতে তালি বাজেনা।। ইসহাক খান

আচানক কারবার। সামান্য এক চড়েই চেয়ার সমেত উল্টে পড়ে গেল মস্তান ছেলেটি। যার ভয়ে মহল্লা শুদ্ধ মানুষ থরোবড়ি কম্পে কম্পিত সেই দাপুটে ছেলেটি সাধারণ একটি মেয়ের হাতে চড় খেয়ে ডিগবাজি খেয়ে উল্টে পড়ে গেল। পড়েই সে চোখে তারার ঝিকিমিকি দেখলো। চোখ কচলে তাকালো। দেখলো মেয়েটি তখনো মুখ তুলে রাগত তাকিয়ে আছে। মহল্লার তিন রাস্তার মোড়। যেখানে মধ্যরাত পর্যন্ত লোক গম-গম করে। সেখানে একটি রেস্টুরেন্ট আছে। সেই রেস্টুরেন্ট ঘিরে মানুষের মধ্যরাত পর্যন্ত জমজমাট আড্ডা।
রেস্টুরেন্টের সামনে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা। মহল্লার এই জায়গাটা নিয়ে অনেকেরই নানা অভিযোগ। মেয়েরা বেশিরভাগ সময় জায়গাটা এড়িয়ে চলে।
রেস্টুরেন্টের সামনের খোলা জায়গায় মহল্লার কয়েকজন বখাটে ছেলে অযথাই বসে বসে গুলতানি মারে। মেয়েদের দেখলে শীষ দেয়। নানা আজে-বাজে কথা বলে, উত্যক্ত করে। ভয়ে কেউ টু শব্দটি করে না। তারা অস্ত্রবাজ, চাঁদাবাজ, দখলদার। দিনে দুপুরে পাবলিকের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে চাঁদাবাজি করে। কারো কিছু বলার নেই। তার বড় কারণ তাদের পেছনে আছে শক্ত খুঁটি। এলাকার কমিশানর তাদের নেতা, বড়ভাই। জায়গাটা সারাক্ষণই লোকের ভিড় থাকে। কাছেই একটি কাঁচা বাজার। তারপরও চিপা চাপায় ভ্যানগাড়িতে অনেকগুলো অস্থায়ী কাঁচা তরকারির দোকান। রেস্টুরেন্টে বেশুমার গান বেজে চলে। বখাটেরা রেস্টুরেন্টের বাইরে কেউ মোটরসাইকেলে কেউ কোমর বাঁকিয়ে বেঢপ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। একমাত্র টাকু মন্টু চেয়ারে ভাব নিয়ে বসে।
ছোটবেলায় মন্টু খুব সাদামাটা ধরণের ছিল। কিন্তু দুবার এসএসসি ফেল করার পর তার জীবন পাল্টে যায়। স্বভাবে বেপরোয়া, মুরুব্বিদের সঙ্গে বেয়াদবি খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। চেহারার কমলতা উধাও হয়ে যায়। সেখানে ভয়াবহ রুক্ষতা খামচে ধরে। অল্প বয়সে মাথার চুল উধাও। সেই থেকে নামের সঙ্গে টাকু শব্দটি স্থায়ী হয়ে গেছে। এখন শুধু মন্টু বললে অনেকেই চিনতে পারবে না। টাকু বিশেষণ জুড়ে দিলে মহল্লার ছেলে-
বুড়ো সবাই একনামে চেনে।
মন্টুর দুর্ব্যবহারে এলাকার মুরুব্বিরা ওকে এড়িয়ে চললেও সে কিন্তু তাঁদের ছাড়ে না। কথা না শুনলে জনসম্মুখে কাউকে ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয়। গার্জেনদের নালিশ দিলে অপমানের মাত্রা চড়ে। ওর গার্জেনরা বলে, ‘ছেলে আমাদের শাসনের বাইরে। আমাদের কিছু করার নেই।’
সেই টাকু মন্টুকে একটি সাধারণ মেয়ে অনেক মানুষের সামনে চড় মেরেছে। এবং সেই চড়ে এলাকার বড় মাস্তান টাকু মন্টু চেয়ার সমেত উল্টে পড়ে গেছে। একি যা-

তা কথা। মুহূর্তে তিনরাস্তার মোড় থমকে গেছে। যারা দৃশ্যটি দেখেছে তারা চোখ কপালে তুলে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। মুখে কারো রা নেই। মন্টুর সঙ্গিরাও হতভম্ব। আশে-পাশের সবাই আতঙ্কে পরবর্তী পরিণতির অপেক্ষা করছে। মেয়েটিও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে কঠিন ভাব। যেন সে দেখিয়ে দিয়েছে-ইটের জবাব কিভাবে পাথ্বর দিয়ে দিতে হয়। কলেজে আসা যাওয়ার পথে প্রায় প্রতিদিনই ওই বখাটেরা তাকে উত্যক্ত করে। মন্টুর কাছে সে নালিশ দিয়েছিল। মন্টু উল্টো মেয়েটিকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। আজ টাকু মন্টুর সামনে একটি ছেলে মেয়েটিকে বাজে কথা বললে মেয়েটি সেই ছেলেটিকে কিছু না বলে আচমকা টাকু মন্টুর গালে কষে চড় মারে। মন্টুকে মারার কারণ সেদিন নালিশ শুনে সে বিশ্বাস করেনি। উল্টো মেয়েটিকে বকাঝকা করে বিদায় করেছে। আজ সুযোগ পেয়ে মেয়েটি তাই ওদের নেতাকে চড় মেরে বসেছে। মারলে আসলটাকেই মারতে হয়।
ছেচড়াদের মেরে হাত নষ্ট করার মানে হয় না। মূল শেকড় উপড়ে না ফেললে আগাছা কোনদিন শেষ হয় না। সেই মন্ত্রে মেয়েটি আসল জায়গায় ডোজ দিয়েছে। কঠিন ডোজ। এখন পরিণতির পালা।
২.
মহল্লার ঘরে ঘরে সর্বত্র আলোচনা টাকু মন্টুকে চড় মারা। বিস্ময়ে কারো মুখ হাঁ হয়ে যাচ্ছে। অনেকে বিশ্বাস করতে পারছে না। দুর্বল মানুষেরা আল্লাহকে সাক্ষি মেনে বলছে, ‘উপযুক্ত কাজ হয়েছে। হে মাবুদ, তুমি মুন্নিকে সহি সালামতে রাইখো।’
সাহস আছে মেয়েটার। সব ঘরেই আলোচনার মূল কথা একই। মুন্নির বড়ভাই বেকার মিন্নাস আলী, ফাজিল পাস করে দুবছর হলো কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার মুখেও একই কথা। সাহস আছে মুন্নির। কথাটা লুফে নেন মন্নাফ মিয়া। তিনি বলেন, ‘তোরা যাকে সাহস বলছিস, আমি বলছি সেটা বিপদ। মহা-বিপদ। আমাদের কি ওদের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা আছে? আমি চলি আজান দিয়া। এখন আমার আয় বন্ধ হলে সবার উপায় কি হবে?’
মিন্নাস কথা বলে না। বেকারদের সব ব্যাপারে কথা বলতে নেই। তারা পিতামাতার ঘাড়ে বোঝা। তাদের কথার কেউ মূল্য দেয় না। মন্নাফ মিয়া অজু করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন। জোহরের নামাজের সময় হয়ে গেছে। তাকে মসজিদে আজান দিতে যেতে হবে। পাঁচবেলা এই তার চাকরি। তার এই চাকরি মেয়ে মুন্নির পছন্দ না। বলে, ‘আব্বা তোমার এই চাকরি হাওয়ার উপর চলে। কোন স্থায়িত্ব নেই। কোন প্রমেশন নেই, পেনশন নেই। কোন নিয়োগ পত্র নেই।’
মেয়ের কথায় মন্নাফ মিয়ার শিরায়-শিরায় রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়। তিনি একটি দ্বীনি কাজ করছেন। আল্লার রাস্তায় তিনি মানুষকে পাঁচবেলা আহবান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহপাক কেয়ামতের ময়দানে তাকে পুরস্কৃত করবেন। সেই দ্বীনি কাজকে ওই নাদানরা টাকা দিয়ে বিচার করে। নাওজুবিল্লাহ।
এইসব দিন দুনিয়ার ভাবনায় মন্নাফ মিয়া অজুর দোয়া ভাল করে পাঠ করতে পারছেন না। বার-বার দোয়া ভুল হয়ে যাচ্ছে। মরার পর একজন মুমিনের সওয়াবের সব রাস্তা বন্ধ হয়ে।

যায়। একমাত্র নেকবান পুত্র এবং কন্যার ভাল আমল পিতার আমলে যুক্ত হয়। সেই কারণে ছেলেকে তিনি মাদ্রাসায় পড়িয়েছেন। মেয়েটাকেও তাই পড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উপরের ক্লাসে উঠে মেয়ে কিছুতেই মাদ্রাসায় পড়তে রাজী হলো না। ছেড়ে দিল পড়া।
জেনারেল স্কুলে ভর্তি হলো। এখন সে হিজাবও পরে না। আজ সে প্রকাশ্যে একজন মাস্তানকে চড় মেরেছে। এর জের যে কতদূর গড়াবে সে কথা ভেবে মন্নাফ মিয়া কূল-কিনারা পাচ্ছেন না। মাথায় টুপি পরতে পরতে আল্লাহর নাম নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
মুন্নির মা জোবেদা খাতুন পারত পক্ষে স্বামীর সঙ্গে তর্ক করেন না। মন্নাফ মিয়াও স্ত্রীর কথা আমলে নিতে চান না। নারী জাতির বোধ বিবেচনা কম। তারা পুরুষের অর্ধেক। এটা তার কথা নয়। কোরানপাকের কথা। খুৎবায় হুজুরদের বয়ানেও অনেকবার এই কথা শুনেছেন।
জোবেদা খাতুন যখন বললেন, ‘আপনি এতো পেরেশোন হচ্ছেন ক্যান? মেয়ে বাড়ি আসুক, শোনামেলা করে দেখেন, কার দোষ?’ শোনামাত্র আজান দেওয়া কন্ঠ শাণিত হয়ে গেল। রেগে বললেন, ‘কি শুনবো? আমি বুঝি না? এক হাতে কোনদিন তালি বাজে?’
‘আমিতো মুন্নির কোন দোষ দেখি না। মুন্নি আমাকে অনেকদিন বলেছে, ওই বদমাইশ গুলো রাস্তায় ওই মোড়ে ওকে ত্যক্ত করে। আজে-বাজে কথা বলে।’
‘বলবে না? তোমার মেয়ে হিজাব পরে না কেন?’
‘পরবে। ছোট মানুষ।’
মন্নাফ মিয়া ভেংচিয়ে বলেন, ‘ছোট মানুষ! সময় মতো বিয়া দিলে আজ তিন পোলার মা অইতো।’
‘আপনার যে উদ্ভট কথা। আপনি মেয়ে মানুষের কি বোঝেন?’
‘ফালতু বক-বক কইরো না।’
‘কিসের ফালতু? সত্যি কথা বললেই ফালতু হয়ে যায়? হিজাব কি মুন্নি একাই পরে
না? ওর সাথে আরো অনেকেইতো পরে না। কই, তাদের নিয়েতো কোন কথা নাই?
কতবার মেয়েটা বলছে ছেলেগুলো ওকে বিরক্ত করে। আপনাকেতো আমি সে কথা বলেছি।
আপনি কোন প্রতিকার করছেন?’
‘তাই বলে মেয়েমানুষ হয়ে পুরুষের গালে চড় মারবে?’
৩.
এদিকে টাকু মন্টুর পরিবর্তন ভিন্ন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ওর শিষ্যরা ভেবে পাচ্ছে না চড় খেয়ে লিডার খাম হয়ে গেল কেন? সে যে মুখ তুলে একবার মুন্নির দিকে তাকিয়েছিল দ্বিতীয়বার আর তাকায়নি। মুন্নি চলে যাবার পর টাকু মন্টু নিজেও নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করে। শিষ্যরা পিছু পিছু যেতে থাকলে টাকু মন্টু ধমকিয়ে সবাইকে বিদায় করে দেয়। সেই থেকে তিন রাস্তার মোড়ে টাকু মন্টুকে আর দেখা যায় না।
টাকু মন্টুর বার বার মনে হতে থাকে, তাকে কেউ চড় মারতে পারে সেটা তার ভাবনায় ছিল না। চড় খাওয়ার পর নিজেকে পরাজিত মানুষ ভাবতে শুরু করে সে। তার ভাবনা এমন-যদি সে মুন্নিকে জোর করে তুলে এনে সারারাত নির্যাতনও করে তবু তার প্রকাশ্য চড় খাওয়া উঠে আসবে না। নারীর হাতের একটি মাত্র চড় আমূল বদলে দেয় টাকু মন্টুর জীবন। সারাক্ষণ গৃহে বন্দী হয়ে থাকে। বাসার লোকজন নানা কথা বলে। বাবা ছেলের ব্যাপারে কথা বলা ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু একটি মেয়ের হাতে চড় খাওয়ার পর সেই

অপমানটা তাকেও বিদ্ধ করছে নানা ভাবে। ছেলে সাধারণ একটি মেয়ের হাতে চড় খেয়ে এসেছে। এই নিয়ে এলাকায় তুমুল আলোচনা। এলাকায় তিনি মুখ দেখাতে পারছেন না। স্ত্রী বেদানা বেগম ছেলের হয়ে কিছু বলতে গেলে বাবা খেকিয়ে ওঠেন। ‘রাখো তোমার অজুহাত। এক হাতে তালি বাজে না। এটা তোমার ছেলের পাওনা ছিল। ওই মেয়ে ঠিকই করেছে। মহল্লায় তোমার ছেলের বিরুদ্ধে নালিশে-নালিশে আমি বাসা থেকে বেরুতে পারতাম না। সবার সঙ্গে বেয়াদবি, মাস্তানি। আর আজ পুচকে একটা মেয়ের হাতে চড় খেয়ে তোমার ছেলের মান্তানি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।’
‘আপনি খালি আমার ছেলের দোষ খোঁজেন। বয়স কালে ওরকম একটু আধটু মাস্তানি সবাই করে।’
‘ভাল কথা। তাহলে তোমার ছেলে ঘরে বন্দী হয়ে আছে ক্যা? সীনা টান করে পথে বের হতে বলো।’ কথাগুলো ঘরে শুয়ে শুয়ে শুনছিল টাকু মন্টু। লজ্জায় আরো কুকড়ে যাচ্ছিল।
শেষপর্যন্ত বাবাও এইভাবে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছে। আচমকা মন্টুর ঘরে বেদানা বেগম এসে উপস্থিত। বলে, ‘খোকা তোকে একটা কথা
বলি?’
‘বলো।’
‘ওই মেয়েকে তোর কেমন লাগে?’
‘কেন মা?’
‘না, মানে, নিশ্চয়ই তাকে তোর মনে ধরেছিল। না হলে তুই তাকে উড়ো কথা কেন বলবি?’
‘কি যে বলো না মা!’
‘খারাপটা কি বলেছি?’
‘দেখ মা, এই নিয়ে আমি আর একটি কথাও শুনতে চাই না। তুমি কি চাও, আমি সারাজীবন ওই মেয়ের সামনে মাথা নিচু করে থাকি?’
‘মানে?’
৪.
যে শিষ্যটি মুন্নিকে বাজে মন্তব্য করেছিল এবং যার প্রেক্ষিতে মুন্নি ঘুরে এসে টাকু মন্টুর গালে চড় মেরেছিল সেই নুলা মিজান একপেশে হয়ে গেছে দলে। তাকে আর কেউ সহ্য করতে পারছে না। তার কারণেই তারা লিডারকে দলে পাচ্ছে না। সে নিজেকে ডিফেন্ড করতে চাইলে একজন গালাগাল দিয়ে বলে, ‘চুপ হুমুন্দির পুত। তুই কথা কইস না। তোর কারণে লিডার আজ বোবা হয়ে গেছে।’
‘তাতে আমার কি দোষ?’ আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে নুলা মিজান কিছু বলতে চাইলে বাকিরা তাকে চেপে ধরে। ‘চুপ। চুপ। তুই আর কথা কইস না।’ আরেকজন বলে,
‘তুই কথা কয়া মেজাজ আর খাট্টাস কইরা দিস না।’
একজন বললো, ‘আমরা বরং বসকে দেখে আসি। আজ বেশ কয়দিন হয়ে গেল বসের কোন খবর নাই। আমরাও তার কোন খবর নেই নাই। কামডা কি ভাল হইছে?’
‘মোটেও ভাল হয় নাই।’ জবাব দিল নুলা মিজান।
‘তুই চুপ কর। তোর কারণে আজ আমরা লিডারকে হারাইছি। খবরদার তুই একটা কথাও কবি না। তাইলে কইলাম তোর নুলাগিরি ছুটাইয়া দিমু।’

এক্সিডেন্ট করে একটি হাত কাটা গেছে বলে নাম হয়েছে নুলা মিজান। মিজানের এই কষ্ট আরো বাড়ে যখন ওর বন্ধুরা ওকে নুলা মিজান বলে। অন্যরা সামনে কেউ বলে না। বললে তার খবর আছে। কিন্তু বন্ধুদের সে থামাতে পারে না। মিজানকে রেখেই বন্ধুরা গেল টাকু মন্টুকে দেখতে। বাসায় নক করলে দরজা খুলে দেয় টাকু মন্টুর মা বেদানা বেগম। একসঙ্গে বেশ কয়েকটি কন্ঠে সালামের আওয়াজ ভেসে আসে। বেদানা বেগম সালামের জবাব দিয়ে তাকিয়ে থাকে। একজন বলে, ‘খালাম্মা,
আমরা মন্টুভাইকে দেখতে আসছি।’
‘মন্টুতো বাসায় নাই।’
‘কোথায় গেছে?’
‘তাতো জানি না।’
‘কয়া যায় নাই?’
‘বাইরে গেলে ও কি কখনো কয়া যায়?’
বেদানা বেগম দরজা বন্ধ করে চলে গেলে ওরা হাঁ মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। কারো কারো কাছে বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। একজন বলে, ‘বস বাইরে গেলে আড্ডার না গিয়া আর কই যাইবো? মনে হয়, খালাম্মা মিছা কথা কয়া আমগো ভাগাইতে চাইছে।’
‘আমারও তাই ধারণা।’
অগত্যা তারা আবার ফিরে আসে তিন রাস্তার মোড় আড্ডার জায়গায়।
৫.
কলেজ ছুটির পর দল বেঁধে মেয়েরা বেরিয়ে আসছে। কল-কাকলিতে চারপাশ সরগরম। অধিকাংশ মেয়েরা মুন্নিকে ঘিরে আসছে। সবাই মুন্নিকে বাহবা দিতে ব্যস্ত।
‘কাজের মতো একটা কাজ করেছিস।’
‘আচ্ছা-এতো সাহস তুই পেলি কিভাবে?’
‘তোর হাতে এতো শক্তি। চড় খায়া নাকি ছেচড়া মাস্তান উত্তাইয়া পইড়া গেছে?’
এই কথায় হাসির রোল পড়ে। সেই হাসির রোল সহজে থামে না। দূর থেকে দেখা যায় একটি মোটরসাইকেলে একজন বসে আছে। একজন তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। সেই মোটরসাইকেলের কাছে এসে সবার হাসি থেমে যায়। আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি নুলা মিজান। বসে আছে টাকু মন্টু। টাকু মন্টু মাথা নামিয়ে বসে আছে। ধুপধাপ করে হাঁটা মেয়েদের মুখে চাপা হাসি। মুন্নি একঝলক দেখে মাথা নামিয়ে নিঃশব্দে হাটঁত থাকে। তার হাঁটার গতি শ্লথ হয়। বাকিরা পা টেনে-টেনে হাটঁতে থাকে। খানিক দূরে গিয়ে মেয়েরা আবার খল-খলিয়ে হেসে ওঠে। তাদের এই অকারণ হাসি মুন্নির কাছেও ভাললাগে না। টাকু মন্টুর মাথা আরো নুইয়ে পড়েছে। তার কানে গরম শিষার মতো বিধঁছে মেয়েদের হাসি। যারা একদিন মাথা তুলে কথা বলার সাহস পায়নি তারাই আজ ব্যঙ্গ করে হাসছে। এই ভাবনাটা মুন্নিকেও ভাবিয়ে তুললো। লোকটা হয়তো মরমে মরে যাচ্ছে। আর ওরা কিনা দাঁত কেলিয়ে হাসছে। মুন্নি সরেজমিনে দেখতে দৃষ্টি ফেরাতে মন্টুর বিবর্ণ মুখটি দেখতে পেল। মন্টু তাকালে দুজনের চোখাচোখি হয়। মন্টুর চোখজোড়া থেকে যেন বেদনা গলে গলে

পড়ছে। মুন্নির মনটা বেদনায় ভার হয়ে গেল। সে ছুটে গিয়ে বান্ধবীদের ধমকে বললো,
‘তোরা অকারণে হাসছিস কেন?’
‘কোন সমস্যা?’ একজন তীর্যক ভাবে প্রশ্ন করলো।
মুন্নি কন্ঠ তুলে বললো, ‘কারো কষ্ট নিয়ে হাসা-হাসি করা অমানুষের কাজ।’
‘তাহলে আমরা কি করবো?’
‘তাকে তার মতো থাকতে দে। তাকে ভাল হওয়ার সুযোগ দে। না হলে আগের মতো হলে তখন?’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *