ঈদসংখ্যার গল্প।। বৃত্তের বাইরে কেন্দ্র।। মোহিত কামাল

বাসার বাইরে এসে থমকে দাঁড়াল নদী। বেশ গরম লাগছে। ঘরে টের পায়নি গরমের ছোঁয়া। হঠাৎ বদলে গেছে প্রকৃতি। তার পরনে রয়েছে সিনথেটিক কাপড়ের ধুতি-কাট সালোয়ার-কামিজ আর তাই টের পাচ্ছে গরমের রেশ। আবহাওয়া বুঝে পোশাক পরে নদী। ভুল হয়ে গেছে আজ। অনেকদিন ঘর থেকে বেরোয়নি। টের পায়নি প্রকৃতির বদলে যাওয়া তাপ। গরমে সুতি কাপড়ের পোশাক পরতে অভ্যস্ত। একবার ভাবছে বাসায় ফিরে যাবে, বদল করে আসবে পোশাক। আবার থামিয়ে দিচ্ছে ভাবনা। ধানমন্ডি প্লাজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে। ছুটির দিন আজ। রাস্তা বেশ ফাঁকা। নিত্যদিনের ভিড় কম। যানজট কম। বেশ স্বস্তি লাগছে। স্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করছে সিএনজি অটোরিকশার জন্য। না, পাওয়া যাচ্ছে না খালি সিএনজি। বিরক্তি জাগছে মনে। বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইল রাস্তার ডান দিকে। চটকরে চোখ বুজে হাত দিয়ে নাক চেপে ধরল। এদিকে এগিয়ে আসছে বাতাসের একটা ঘূর্ণি। রাস্তার ধুলোবালি, ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো, গাছের ঝরা পাতা, ঘূর্ণির সঙ্গে ঘুরে ঘুরে উড়ে যাচ্ছে উপরের দিকে। রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে ঘূর্ণিটি দক্ষিণ থেকে উত্তরে। পথচারীরা উত্তরমুখী দাঁড়িয়ে গেছে, হঠাৎ আসা ঘূর্ণির দাপট সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। নদীও মুখ ঘুরিয়ে নিল উত্তর দিকে। হঠাৎ ধাক্কা খেল একজনের সঙ্গে। চোখ অল্প ফাঁক করে বোঝার চেষ্টা করল কার সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে। নাকে রুমাল চেপে দাঁড়িয়ে আছে একটা ফুটফুটে মেয়ে। তারই বয়সি। মেয়েটিও দেখার চেষ্টা করছে নদীকে। নদী হাসল। মেয়েটিও।
মুহূর্তেই চলে গেল বাতাসের ঘূর্ণি। পরিচ্ছন্ন হয়ে গেছে চারপাশ। ঘূর্ণি চলে যাওয়ার পর কমে এল গরমের তেজ। সিনথেটিক পোশাকের কারণে অস্বস্তিকর গরমটাও উধাও হয়ে গেছে। বাতাসের দাপট কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ নড়ে উঠল নদীর মন। বুকে একটা অস্বাভাবিক ঘূর্ণি টের পেল সে। চট করে ভালো লেগে গেল মেয়েটিকে। যন্ত্রের মতো সামনে এসে বলল, আমার নাম নদী। তোমার নাম?
মেয়েটি হেসে জবাব দিল, মায়া।
নামটা শুনতেই নদীর মনে মায়ার স্রোত ছলকে উঠল। মায়াবী চোখে গভীরভাবে দেখল মায়াকে-চোখ দুটো বড় বড়, গভীর টান আছে কালো মণিতে। ফোলা ফোলা ঠোঁট। লালচে। মুখের ত্বক থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে লাল আভা। সাধারণত মেয়েরা মেয়েদের রূপ দেখে না। দেখলেও সংখ্যায় কম। অথচ নদীর বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। সে প্রথমে দেখে মেয়েটি মায়াবতী কি না। মায়াবতীই লাগছে মায়াকে। মায়াবতী মেয়েদের প্রতি তার রয়েছে দুর্বার এক আকর্ষণ। কেন এ আকর্ষণ তৈরি হয়, জানে না।
নদী বলল, তুমি এ এলাকাতেই থাক, তাই না?
মায়া বলল, হ্যাঁ। এখানে থাকি। বহুবার দেখেছি তোমাকে। কথা হয়নি। পরিচয় হয়নি।
নদী বলল, এ যে পরিচয় হলো। কথা হলো।
মায়া বলল, হ্যাঁ কথা হলো।
নদী বলল, ভবিষ্যতেও হবে। তোমার সেল নম্বরটা দেবে?
মায়া নম্বর বলতে লাগল, নদী মোবাইল ফোনসেটে স্টোর করে নিয়ে কল দিল। রিংটোন বেজে উঠল মায়ার ফোনসেটে।
মায়া কল অ্যাটেন্ড করতে যাবে, এ সময় নদী বলে, না না। ধরো না, ওটা আমার নম্বর। তোমার ওয়েলকাম টিউনটা দারুণ… একটু শুনতে দাও।
গান শুনে হাসল নদী। হেসে হেসে গেয়ে উঠল-ও সাথি রে যেয়ো না কখনও…
মায়াও নদীর নম্বর স্টোর করে ‘কল’ দিল। ওয়েলকাম টিউন বেজে উঠল-এক যে ছিল সোনার কন্যা…
শোনার পর মায়া বলল, তোমার গানটাও সুন্দর। হৃদয়ছোঁয়া, কিছুটা দুঃখের।
নদী হাসল। দুজনের হাসির মধ্য থেকে জেগে উঠল গভীর বন্ধুত্বের টান।
নদী প্রশ্ন করল, কোথায় যাচ্ছিলে?
জবাব দিল না মায়া। হাসল। ওর হাসিতে হেসে উঠল চারপাশ। মুগ্ধ হয়ে দেখল নদী। কথার জবাব না দিয়ে মায়া প্রশ্ন করল, তুমি যাচ্ছ কোথায়?
গুলশান যাব, সিএনজির জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
ওহ। আমি যাব মহাখালী।
বাহ! তোমাকে মহাখালী নামিয়ে দিতে পারব। এক সিএনজি হলে ভালো হবে!
মায়া বলল, মজা হবে। তোমার সঙ্গে পরিচয়টা মহাখালী পর্যন্ত জমে উঠবে।
‘জমে উঠবে’ শব্দটা লুফে নিল নদী। আনন্দ জাগল মনে।
ওরা রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। একটা অটোরিকশা দেখে হাত তুলল দুজন। না। দাঁড়াল না অটো-রিকশাটি। যাত্রী আছে ভেতরে। চলে গেল ছুটে।
কিছুক্ষণ পর একটা হলুদ ক্যাব সামনে এসে দাঁড়াল।
মায়া বলল, যাবে হলুদ ক্যাবে?
নদী বলল, গেলে ভালো হয়। তবে হলুদ ক্যাবে প্রাণ খুলে কথা বলা যায় না। ড্রাইভার সব কথা শোনে। সিএনজিতে ড্রাইভার কথা শুনতে পায় না।
মায়া বলল, অসুবিধে কী? আমরা দুজন মেয়ে। মেয়েদের কথা ড্রাইভার শুনলে দোষ কী?
দোষ আছে। ড্রাইভারগুলো মেয়েদের কথা শোনার জন্য কান খাড়া করে রাখে। প্রাণ খুলে কথা বলা যায় না তখন।
মায়া বলল, ঠিক বলেছ। তাহলে সিএনজি ধরো।
নদী বলল, দেরি হচ্ছে তো!
মায়া জবাব দিল, হোক। অনেকক্ষণ সময় কাটানো যাচ্ছে তোমার সঙ্গে।
নদী বলল, আমাকে ভালো লেগেছে তোমার?
মায়া জবাব দিল, খু-উ-ব।
নদী বলল, আমারও ভালো লেগেছে। আগে দূর থেকে দেখেছি তোমাকে। তখনও ভালো লাগত। কাছ থেকে দেখে কথা বলে আরও ভালো লাগছে।
হো হো করে হেসে উঠল মায়া।
নদী বলল, হাসলে কেন এমন করে?
হাসতে হাসতে মায়া বলল, এমনি হাসলাম। ভালো লাগছে তোমার সরল কথা শুনে।
ভালো লাগলে তো আমরা বন্ধু হতে পারি, তাই না?
মায়া জোরাল গলায় জবাব দিল, অবশ্যই।
এ সময় একটা সিএনজি অটোরিকশা দেখে হাত তুলল দুজনে। হাতের ইশারায় থামতে বলল। একসঙ্গেই দুজনে প্রশ্ন করল, গুলশান যাবেন?
ড্রাইভার মাথা দুলিয়ে বলল, ভাড়া বাড়িয়ে দিতে হবে।
নদী বলল, ঠিক আছে বাড়িয়ে দেব।
ড্রাইভার আবার বলল, ত্রিশ টাকা বাড়িয়ে দিতে হবে।
মায়া রাগ করে বলল, কেন? ত্রিশ টাকা কেন? দরকার হলে পঞ্চাশ দেব।
ড্রাইভার মাথা নত করে ফেলল।
নদী বলল, ঠিক আছে ত্রিশ টাকা বাড়িয়ে দেব। ওঠো মায়া।
মায়া গজগজ করে সিএনজিতে উঠে বসল।
নদী বলল, বি ইজি মায়া, বি কুল। ড্রাইভারগুলো এমনই। সবাই এভাবে বাড়তি টাকা চেয়ে বসে। ওদের দাপটের কাছে যাত্রীরা অসহায়। দেখো না, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম আমরা?
চুপ হয়ে গেল মায়া। নদীও চুপ। চলতে শুরু করেছে সিএনজি আটোরিকশা।
নদী ডান হাত দিয়ে মায়ার বাঁ হাতের কনুই বরাবর ধরে বসে রইল।
কোনও ছেলের প্রতি তেমন টান জাগে না নদীর মনে। সমবয়সি মেয়েদের প্রতি গভীর টান তৈরি হয় তার। কেন হয়, জানে না সে। মায়ার জন্য অদ্ভুত মায়াবী টান তৈরি হয়ে গেছে আজ। ভালো লাগছে ওর হাত ধরে বসে থাকতে। কত ছেলে প্রপ্রোজ করেছে নদীকে। পাত্তাই দেয়নি নদী। কোনও ছেলের জন্য ভালোবাসা জাগে না মনে, এ কেমন কথা? ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে কোনও ছেলের জন্য যেমন ভালোবাসা জাগার কথা, তেমন ভালোবাসার ঢল আসছে মনে। মায়ার কনুই শক্ত করে ধরে বসে থাকে সে।
মায়া সহজ থেকে বলল, বলেছিলে সিএনজি আটোতে উঠে কথা বলবে, দেখছি চুপ করে আছ এখন? বিষয়টা কী? আমি কি তোমার মন খারাপ করে দিলাম?
না, না। মন খারাপ হবে কেন? ভালো লাগছে খুব। তোমাকে পেয়ে অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে মন।
অন্য রকম মানে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল মায়া।
মানে ভিন্ন রকম। মনে হচ্ছে তুমি আমার খুব আপন কেউ। মনের মানুষ। মনে ঘূর্ণি জাগছে।
বলো কি! আপন ভাবছ, ঠিক আছে। মনের মানুষ ভাবছ কেন? তোমার মনের মানুষ হবে কোনও এক সুদর্শন তরুণ, তাই না?
না, ছেলেদের একদম ভাল্লাগে না আমার।
তো, কাদের ভালো লাগে!
বাদ দাও। এখন তোমাকে ভালো লাগছে, যেমনটা ভালো লাগতে পারে একটা ছেলেকে, তেমন করে ভালো লাগা টের পাচ্ছি তোমার জন্য।
মায়া হেসে বলল, বন্ধুকে তো ভালোবাসা যায়। নিশ্চয় ভালো বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছ আমাকে?
হ্যাঁ, বন্ধু। ভালোবাসার বন্ধু।
মায়া মুগ্ধ হয়ে ঘুরে তাকাল নদীর দিকে। তার হাতের চাপের উষ্ণতা টের পেতে লাগল। ভালো লাগছে এ অনুভ‚তি। তবু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, তোমার ছেলেবন্ধু হলে আমাকে এভাবে ভালোবাসতে পারবে না।
নদী জোর দিয়ে বলল, আমার কোনও ছেলে বন্ধু হবে না।
হবে না মানে? কোনও ছেলে তোমাকে প্রপোজ করেনি? করবে না?
হ্যাঁ, করে। ভবিষ্যতেও করবে, তবে তাদের প্রতি আমার টান তৈরি হয় না। ভালোবাসা আসে না মনে।
বলো কি! আবারও অবাক হয়ে প্রশ্ন করে মায়া।
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নদী বলল, এটা কি অস্বাভাবিক?
মাথা নাড়াল মায়া। বলল, জানি না। স্বাভাবিক হতে পারে। ফিলিংস তো আর কেউ ইচ্ছা করে তৈরি করে না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়। ফিলিংসে তো কোনও খাদ নেই তোমার, কী বলো?
না। খাদ নেই। এটা সত্যি।
তাহলে অস্বাভাবিক না। জোর দিয়ে বলল মায়া।
নদী এবার সাহসী হয়ে বলল, তাহলে কি তুমি আমার ভালোবাসা গ্রহণ করেছ? ফ্রেন্ডশিপ মেনে নিচ্ছ?
মায়া বলল, হুঁম! ফ্রেন্ডশিপ গ্রহণ করলাম।
নদী বেপরোয়া হয়ে প্রশ্ন করল, ভালোবাসা? ভালোবাসা গ্রহণ করছ না?
হুঁম। বন্ধুকে তো ভালোবাসা যায়। গ্রহণ করব না কেন?
নদী উল্লসিত হয়ে ওঠে। বেপরোয়াভাবে মায়াকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ প্রকাশ করে। তারপর মায়ার গালের ডান পাশে দুঠোঁট জড়ো করে একটা চুমু বসিয়ে দেয়।
কিছুটা হকচকিত হয়ে মায়া সামলে নিল নিজেকে। নদীর এ অধিকারটুকু আনন্দের প্রকাশ হিসেবে দেখল সে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল সানির কথা। যেদিন প্রথম দেখা হলো, রিকশায় বসে সানি ওর গালে চুমু বসিয়ে দিয়েছিল। একটা মেয়েকে কীভাবে চুমু দিতে হয় জানা ছিল না সানির। ফলে লাল লাল দাগ বসে গিয়েছিল ওর গালে। হাজারো মিথ্যা অজুহাত দিতে হয়েছিল সবার প্রশ্নের। বিষয়টা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসি ফোটে। হাসি দেখে নদী আরও খুশি হয়। দুহাত দিয়ে মায়াকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। কী করবে বুঝতে পারছে না মায়া। কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল।
আচমকা ব্রেক কষে অটোরিকশা। দ্রুত বাঁ হাত দিয়ে সামনের চিকন রডের ঘেরে হাত ঠেকাল নদী। নিজেকে রক্ষা করে, মায়াকেও জড়িয়ে রাখে ডান হাতে-যেন বুক আগলে রাখতে চায় বুকের ধন।
নদী ধমকে বলল, ড্রাইভার ভাই, দেখে শুনে চালাতে পারেন না!
ধমকটা আমলে নিল না চালক। আবার স্টার্ট নিয়ে চলতে শুরু করল সিএনজি আটো। এবার গতি বেশ নিয়ন্ত্রিত।
মায়ার হঠাৎ মনে পড়ে গেল কিছুদিন আগের একটি ঘটনা। পত্রিকার পাতায় একটা দোমড়ানো মোচড়ানো সিএনজি অটোরিকশার ছবি ছাপা হয়েছিল। পেছন থেকে অটোরিকশাটা ধাক্কা দিয়েছিল একটা বড় বাস। সামনে দাঁড়ানো ছিল আরেকটা বাস। অটোরিকশার যাত্রী ছিলেন দেশের প্রখ্যাত এক কথাশিল্পী। ড্রাইভারসহ তিনি প্রায় স্যান্ডউইচ হয়ে গিয়েছিলেন। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন। ড্রাইভারের পেছনে, যাত্রীর সামনে চিকন রডের যে ব্যারিকেড রয়েছে, সেটিতে ধাক্কা খেয়ে লেখকের চোখের ওপরের অংশ ছিঁড়ে গিয়েছিল, থেঁতলে গিয়েছিল হাঁটু। লেখকের দারুণ ভক্ত মায়া। এ মুহূর্তের ঘটনায় পুরো চিত্রটা ভেসে উঠল মস্তিষ্কে। নদীকে আঁকড়ে ধরে বসে রইল সে।
টানা গতিতে মহাখালী ফ্লাইওভারের দিকে ছুটে যাচ্ছিল আটো।
মায়া বলল, নিচ দিয়ে চলেন। আমি কলেরা হাসপাতালে সামনে পুষ্টি ইনস্টিটিউটে নামব।
গাড়ির গতি কমিয়ে উপরে না উঠে শাঁই করে ওভারব্রিজের নিচে বাঁ পাশের রাস্তায় চলে এল ড্রাইভার। আবার জড়াজড়ি অবস্থা তৈরি হয়। ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখে মায়াকে আগলাতে চায় নদী। এ আন্তরিকতা ভালো লাগে মায়ার। অনুভ‚তিটা মুখ ফুটে প্রকাশ করল না।
নদী বলল, পুষ্টি ইনস্টিটিউটে যাবে কেন?
এবারও হেসে উঠল মায়া। এ হাসি স্বাভাবিক না।
হাসির সঙ্গে মিশে গেল রহস্যময়তা। মুখের দিকে তাকায়নি নদী। তাকালে হাসির রহস্যময়তা টের পেয়ে যেত।
মায়াকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে নদী আবার বলল, আমি আর গুলশানে যাব না। তোমার সঙ্গে থাকি? থাকতে ইচ্ছা করছে।
তোমার গুলশানে যাওয়া জরুরি না?
না। তেমন জরুরি না। না গেলে অসুবিধা হবে না। তোমার সঙ্গে থাকি?
সরাসরি প্রস্তাব শুনে মুহূর্তের জন্য নড়ে উঠল মায়া। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, চলো।
ব্রিজের নিচে রেললাইন। রেলক্রসিংয়ে লালবাতি জ্বলছে। ক্রসিংয়ের দুই পারে তৈরি হয়ে আছে জ্যাম। দাঁড়িয়ে আছে শত শত গাড়ি।
নদী বলল, এ জায়গায় সিএনজি কিংবা ক্যাব এসে দাঁড়ালে ভয় লাগে আমার।
কেন, ভয় পাও কেন?
আমার দূর সম্পর্কের এক মামাকে ‘মরিচের গুঁড়ো বাহিনী’ একবার আক্রমণ করেছিল এখানে। দুপাশ থেকে দুজন ছিনতাইকারী উঠেছিল আটোতে। উঠেই চোখে গুঁড়ো ঘষে দিয়েছিল। প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, মরতে মরতে বেঁচে উঠেছেন মামা। গুঁড়ো মেখে ওরা মামার সবকিছু ছিনিয়ে নেয়, এ জায়গায় নামিয়ে দেয়। প্রায় বেহুঁশ অবস্থায় পথচারীরা মামাকে এখান থেকে উদ্ধার করে। সন্ত্রাসের আখড়ায় পরিণত হয়েছে জায়গাটা। এরপর থেকে সাধারণত আমরা ব্রিজের ওপর দিয়ে যাই।
মায়া কিছুটা ভীত হয়ে এবার নদীকে বাঁ হাতে জড়িয়ে ধরল। মুখ ফুটে কোনও কথা না বলে বসে রইল। নদীর ভালো লাগে এ জড়িয়ে থাকা।
কিছুক্ষণ পর ট্রেন চলে যাওয়ার পর ক্রসিং খুলে দেওয়ার সঙ্গে চলতে লাগল সিএনজি। একটা হুড়াহুড়ির গতি, বিশৃঙ্খলা আর হর্নের বিদ্ঘুটে আওয়াজের মধ্যেও নদী আবার জিজ্ঞেস করল, পুষ্টি ইনস্টিটিউটে কেন যাবে? কে আছে ওখানে?
চলো। গেলেই দেখতে পাবে।
নদী আর কথা বাড়াল না। চুপ করে আছে। মায়াও। অনেকটা সচেতনভাবে নদী ডান হাত দিয়ে মায়াকে জড়িয়ে রেখেছে। সচেতনভাবে সুখ টের পাচ্ছে মনে। কেন সুখ আসছে মনে? কোত্থেকে আসছে? জানে না সে।

দুই

পুষ্টি হাসপাতালের সামনে আসার পর ভেতর থেকে সুদর্শন এক তরুণ এগিয়ে এল অটোরিকশার সামনে। মায়া আগেই এসএমএস করে দিয়েছিল ‘কামিং উইথ এ ফ্রেন্ড’।
অটোরিকশা থেকে নেমে এল তারা। নেমে ভাড়া দিতে চায় নদী। ছেলেটি বাধা দিয়ে বলল, ভাড়া আমি দিচ্ছি। নদী কঠিন চোখে তাকাল ছেলেটির দিকে। শান্ত গলায় বলল, আপনি দেবেন কেন? আমরা এসেছি। আমিই দেব।
তাকানোর ভঙ্গি দেখে ঘাবড়ে গেল ছেলেটি। থেমে গেল। ভাড়া দেওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলল।
ভাড়া মিটিয়ে মায়ার দিকে তাকাল নদী।
নদীর মুখের দিকে তাকিয়ে মায়াও টলে উঠল। মনে হচ্ছে সামনে দাঁড়িয়ে আছে কঠিন এক মেয়ে। মায়াবী নদী যেন বদলে গেছে। ভিন্ন এক নদী এসে দখল করেছে মেয়েটিকে।
পরিচয় করিয়ে দিল মায়া, ওর নাম সানি। আমার…
পুরো কথা শেষ করতে পারল না মায়া। অসম্পূর্ণ কথাটা শেষ করে করল নদীই, তোমার ফ্রেন্ড?
নাহ। শুধু ফ্রেন্ড না। হাসল মায়া।
তবে কি? অ্যাফেয়ার চলছে?
প্রশ্ন শুনে আবারও হাসল মায়া। সানিও। কেউ জবাব দিল না।
নদী বলল, বুঝেছি। আর বলতে হবে না। বলতে গিয়ে মুখে হাসি ফুটল না। নদীর ফরসা মুখে হঠাৎ মেঘের ছায়া ভেসে উঠল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। বুকে নীল যন্ত্রণার ছোবল বসে গেছে। এমন অনুভ‚তি হলো কেন? বুঝতে পারল না নদী। নিজের ফিলিংসের পরিবর্তনটুকু মেলাতে পারছে সে, ধরতে পারছে। বুঝতে পারছে না কেন এ পরিবর্তন? এটা কি হিংসুটেপনা?
নাহ! হিংসুটে ভাবতে পারছে না নিজেকে। মায়াকে ভালো লাগছে। মায়ার জন্য ভালোবাসা জাগছে মনে। তবে মায়ার আনন্দে আনন্দ আসছে না কেন? আসা উচিত ছিল। অথচ মনটা কেমন ক্রোধে ডুবে যাচ্ছে? তাহলে কি সানিকে সহ্য হচ্ছে না মায়ার পাশে? হতে পারে এমনটা। সানিকে শত্রæ মনে হচ্ছে। মায়া কেন ভালোবাসবে সানিকে? মায়া কেন মুগ্ধ হবে সানিকে দেখে? বুক ভেঙে যাচ্ছে। ভেতর থেকে দাপিয়ে উঠতে চাচ্ছে কান্না। নিজেকে সামাল নিয়ে কঠিনভাবে দাঁড়িয়ে আছে নদী।
সানি বলল, চলো, আমাদের ক্যাফেটেরিয়াতে চলো। মায়ার বাঁ হাত চেপে ধরে নদী। বাধা দিল না মায়া। তারা সানির পেছনে হেঁটে এগিয়ে যেতে লাগল পুষ্টি ইনস্টিটিউটের ক্যাফের দিকে।
ফিসফিস করে সানি কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল মায়াকে।
ধমক দিল মায়া। ফিসফিস করছ কেন? খোলামেলা বলো।
আচমকা বিদ্যুৎ ছলকে ওঠে, খুশি জেগে উঠল নদীর মনে। সানিকে বকা দিয়েছে মায়া। বকাটা নদীর মনে আনন্দ জাগিয়ে তুলছে। বুঝতে পারল নদী।
সানি এবার খেয়াল করে বুঝতে পারল, মেয়েটি সহজ হয়ে গেছে। সাহসী হয়ে বলল, প্রথমে ভেবেছিলাম তুমি কঠিন মেয়ে। এখন মনে হচ্ছে ভুল মনে হয়েছিল। মনে হচ্ছে তুমি মিষ্টি মেয়ে, লক্ষ্মী মেয়ে।
কথা বলছে না নদী। চুপচাপ হাত ধরে থাকে মায়ার। এক দিনের পরিচয়ে এমন আপন হতে পারে কেউ? ভাবে মায়া। খুব আপন মনে হলো নদীকে। তবে সানিকে নিয়ে মনের পরিবর্তনটুকু বুঝতে পারল না সে।
ক্যাফেটেরিয়াতে বসিয়ে উঠে গেছে সানি।
সানিকে নিয়ে প্রশ্ন করল মায়া, কেমন দেখলে তাকে?
নদী ছোট্ট জবাব দেয়, ভালো না।
ভালো না মানে?
ভালো না মানে, সানিকে আমি সহ্য করতে পারছি না।
কেন? সহ্য করতে পারছ না কেন?
কেন তোমাকে ভালোবাসবে সে?
আমি তাকে ভালোবাসি। সে আমাকে ভালোবাসবে। এটাই তো স্বাভাবিক।
না। শক্ত করে বলল নদী।
‘না’ কেন?
তোমাকে ভালোবাসব আমি। তুমি ভালোবাসবে আমাকে।
মায়া হেসে বলল, সে তো বাসবই। তাই বলে সানিকে বাসব না?
জবাব না দিয়ে অভিমান করে মায়াবী চোখ তুলে নদী তাকাল মায়ার দিকে।
মায়া ভাবে, এত অভিমানী হচ্ছে কেন নদী? কেন সহ্য করতে পারছে না সানিকে? সানি উঠে যাওয়ার পর আবার পরিবর্তন ঘটে গেল নদীর মধ্যে। টের পেতে লাগল মায়া। সে সহজ হয়ে গেছে আগের মতো। সহজ নদীকেও ভালো লাগে মায়ার।

তিন

সানি ফিরে আসছে অর্ডার দিয়ে।
সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হয়ে গেল নদী। এই পরিবর্তনটুকুও ধরতে পারল মায়া।
অবাক হয়ে একবার দেখে নিল নদীকে। সরল একটা মেয়ের ছবি ভেসে থাকতে দেখল নদীর মুখে। সেই সহজ প্রতিচ্ছবির মধ্যে রয়েছে সানির জন্য কঠিন এক অবস্থান। কেন? ভেবে ক‚ল পেল না মায়া।
ক্যাফেটেরিয়া মোটামুটি খালি।
সানি এসে ওদের সামনে বসল। সানির পাশের চেয়ার খালি।
মায়া বলল, আমি ওই খালি চেয়ারটায় বসি, নদী?
ওর হাত চেপে ধরল নদী। উঠতে দিল না। আবার ছেড়ে দেওয়ায় মায়া উঠতে গিয়েও উঠল না। নদীর চাপের কাছে হার মানল নিজের ইচ্ছা।
সানি বলল, আজ বন্ধের দিনেও আমাদের অফিস খোলা। একটা বড় প্রোগ্রাম আছে সামনে। কেবল দায়িত্বপ্রাপ্ত জুনিয়র অফিসাররা অফিসে এসেছি আজ। এজন্য চারপাশ খালি। মানুষজন কম।
কথা বলছে না নদী। চুপ হয়ে আছে।
মায়া জিজ্ঞেস করল, নদী, তোমার ভালো লাগছে না?
নদীর ভালো লাগছে মায়ার সান্নিধ্য। মাথা নাড়িয়ে বলল, লাগছে।
তাহলে মন খারাপ কেন? কথা বলো।
সানিকে সহ্য করতে পারছে না মায়ার পাশে। এজন্য মন খারাপ। মনের এক পাশে ভালো লাগা অন্য পাশে অসহ্যবোধ-দুইয়ের মিশ্র আক্রমণে কিছুটা বিভ্রান্ত নদী বলল, তোমরা কথা বলো, আমি শুনি।
এবার উঠে সানির পাশে বসল মায়া।
ওদের কথা বলার অনুমতি দিয়েও পুড়তে লাগল নদী। দুজনের অন্তরঙ্গতা একদম সইতে পারছে না সে! অথচ ভালো বন্ধু হিসেবে দুজনকে স্বাগত জানানোর কথা। স্বাগত জানানো দূরে থাক, কেমন অসাড় হয়ে যাচ্ছে নদী!
কথা বলতে বলতে টেবিলের ওপর বাঁ হাত মেলে ধরল সানি। মায়া নিজের ডান হাত রাখল সানির খোলা হাতের তালুতে। সানি শক্ত করে চেপে ধরল মায়ার হাত। অসাধারণ সুন্দর দৃশ্যটি আড়চোখে দেখল নদী। সুন্দর দৃশ্যটি আর সুন্দর মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, একটা পচা হাতের ওপর হাত রেখেছে মায়া। জ্বলুনি আরও বেড়ে গেল। কোথায় জ্বলছে জানে না সে। জ্বলছে মন। জ্বলছে দেহ। সর্বত্র জ্বলুনি। জ্বালা সামাল দেওয়ার জন্য একবার চোখ বোজে নদী। তা দেখতে পেয়ে হাত সরিয়ে নিল মায়া। চোখ খুলে দেখল, মায়ার হাত নেই সানির হাতে। সঙ্গে সঙ্গে জ্বালা কমে গেল। হাসি ফুটল নদীর মুখে।
এবারও মায়া খেয়াল করল নদীর মুখে হাসি। এই হাসি এই মেঘ! মুখের অভিব্যক্তি এত দ্রæত পরিবর্তন হয় কেন? মেয়েটার রহস্যময়তা ভালো লাগে মায়ার, আবার ভয়ও লাগে। ‘ভালো লাগা’ কিংবা ‘ভয়’ কি একসঙ্গে থাকতে পারে? জানে না মায়া।
হঠাৎ সোল্লাসে লাফিয়ে উঠল সানি। চিৎকার করে বলল, ওয়েলকাম রনি। সানির বয়সি আরেক তরুণ অফিসার এ সময় ক্যাফেতে ঢোকে।
রনিকে উদ্দেশ করে সানি বলল, ও হচ্ছে নদী। মায়ার ফ্রেন্ড। বসো। ওর পাশে বসো তুমি।
নদী একদম কুঁকড়ে গেল। ওর সংকুচিত ভাব দেখে মায়া উঠে এল নদীর পাশে। এক হাতে জড়িয়ে ধরে বসল নদীকে। সঙ্গে সঙ্গে সংকুচিত ভঙ্গি সহজ হয়ে গেল।
রনি সামনাসামনি বসে বলল, হাই মায়া! হাই নদী! রনির স্মার্ট কথায় কোনও জবাব দিল না নদী। মায়া কেবল হেসে স্বাগত জানাল।
রনি চুপসে গেল। স্বতঃস্ফ‚র্ততা হারিয়ে বলল, সানি, বড় স্যার আমাদের দুজনকে ডেকেছেন। ওরা বসুক, চলো আমরা দেখা করে আসি।
বড় স্যারের কক্ষে চলে গেল সানি ও রনি। নদী বলল, আমার একটা আবদার রাখবে?
কী আবদার?
চলো, চলে যাই। ওরা ব্যস্ত। ওদের ছেড়ে আমাকে সময় দাও আজ।
যেতে ইচ্ছা করছে না মায়ার। নদীর দিকে তাকিয়ে বলল, ওরা আসুক। আর একটু বসো।
সঙ্গে সঙ্গে নদীর মুখের ফরসা ত্বকে কালো ছোপ বসে গেল। খারাপ হয়ে গেল মন।
মায়া বলল, কোথায় যাবে?
নদী অনেকটা বেপরোয়া হয়ে বলল, আমাদের বাসায় কাটাবে আজ। রাজি?
নদীর উচ্ছাস দমিয়ে দিতে ইচ্ছা করল না মায়ার। বলল রাজি।
দুজনেই উঠে দাঁড়াল। সানিকে মায়া এসএমএস দিল ‘আমরা আজ যাচ্ছি’।
দুজন চলে এল নদীদের বাসায়। পুরো দুপুরটা কাটাল তারা একসঙ্গে। বিকেলের দিকে মায়া চলে গেল নিজের বাসায়। প্রথম দিনের পরিচয়টা গভীর ভালোবাসার জন্ম দিল নদীর মনে। মায়ার ভালো লাগে ভালোবাসার বন্ধুত্ব।

চার

শারমিন জাহান-নদীর মা-মেয়ের কপালে হাত রেখে বললেন, শরীর খারাপ? শুয়ে আছ কেন অসময়ে?
নদী বলল, বিরক্ত করো না।
দুপুর প্রায় বারোটা। এখনও বিছানা থেকে উঠছ না, মা হয়ে জানতে চাইতে পারব না?
না। সব জানা উচিত নয় মায়েদের।
শারমিন জাহান বললেন, ওঠো, মুখ-হাত ধুয়ে খেয়ে নাও।
খাব না। চিৎকার করে বলল নদী।
মেজাজ দেখাচ্ছ কেন?
জানি না।
মায়াকে কল করব? মায়া এলে নিশ্চয় তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।
না। সে আসবে না। আমার কল কেটে দিয়েছে। সানির সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছে আজ। ফোন বন্ধ রেখেছে।
ওহ্! শারমিন জাহান কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
একটু পর শুনতে পেলেন হু হু করে কাঁদছে নদী। দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি উঁকি দিয়ে দেখলেন মেয়েকে। এমন করে কাঁদছে কেন নদী? কারও সঙ্গে ভালোবাসায় জড়িয়েছে? ভালোবাসার কান্নাই এমন হয়।
না। নিজেকে বোঝালেন তিনি, কোনও ছেলেকে সহ্য করতে পারে না নদী। ভালোবাসবে কাকে? মেয়ের মনে কি অন্য কোনও কষ্ট আছে? সেই কষ্ট কি কাউকে বলতে পারছে না? কষ্টের ঘূর্ণিই কি কাঁদাচ্ছে তাকে?
হতাশ চোখে শারমিন জাহান তাকিয়ে রইলেন নদীর দিকে। বালিশ বুকে চেপে কাঁদছে নদী। কাঁদুক। কাঁদলে হালকা হবে সে। হালকা হয়ে আবার আসল নদী জেগে উঠবে। উঠবে কি? মায়ের মনে প্রশ্ন এল। উত্তর এল না। চোখে ভেসে উঠল শূন্য বৃত্ত। এ বৃত্তের বাইরের জগৎ অচেনা তাঁর কাছে। মনে হচ্ছে, বৃত্তের কেন্দ্রটি ভেতরে নয়। কেন্দ্রটি বৃত্তের বাইরে। সেই কেন্দ্রের খবর জানা নেই তাঁর। তবে বুঝতে পারলেন কেন্দ্রের মাঝে জাগছে ঘূর্ণি, কেবলই ধোঁয়াশা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *