ঈদসংখ্যার গল্প।। নতুন আলো।। তামান্না স্মৃতি

আমার মা নারিকেল দিয়ে গলদা চিংড়ির মালাইকারী ভীষণ ভালো রান্না করতেন। যেদিন বাড়িতে মা এই রান্নাটা করতেন সেদিন আমরা ভাইবোনেরা অন্য কোনো তরকারি আর পাতে নিতাম না। এমনকী আমার ছোটো বোন শেফুও সেদিন ভাত খাওয়া নিয়ে কোনো রকম বাহানা করতো না। অথচ অন্যদিন ওকে ভাত খাওয়াতে মায়ের বারোটা বেজে যেত। মায়ের হাতের আরো এমন অনেক রান্না ছিল। যেমন, কুমড়ো ফুলের বড়া, গরুর মাংসের শুটকি, কচুর লতি দিয়ে ইলিশ মাছের মাথা, ঘন দুধের পায়েস, ছানার সন্দেশ এমন আরো কত কী!

পঁচিশ বছর আগে বিয়ের পর প্রথম যখন আমি মজুমদার বাড়িতে এলাম তখন বয়স অনেক কম ছিলো তাই চোখে অনেক স্বপ্ন ছিল। ভেবেছিলাম, মায়ের বাড়ি ছেড়ে এসেছি তো কী হয়েছে শ্বশুর বাড়িকে একেবারে নিজের বাড়ির মতোন আপন করে নিব। তা করেও নিয়েছিলাম অবশ্য। তাই বিয়ের পর প্রথম যেদিন রান্না ঘরে ঢুকেছিলাম সেদিন খুব শখ করে নারিকেল দিয়ে চিংড়ি মাছের মালাইকারী রেঁধেছিলাম। আমার নিজের প্রিয় খাবার আজ আমার শ্বশুর বাড়ির সবাইকে খাওয়াব এটাই ছিলো আমার মনের একান্ত ইচ্ছে। কেননা ততদিনে আমি নিজেও মায়ের কাছ থেকে আমার প্রিয় রান্নাগুলো খুব যত্ন করে শিখে নিয়েছিলাম। কিন্তু প্রথম দিনেই যেন আমার স্বপ্নের ঘোর কাটলো। আমার শ্বশুর বাড়ির কেউই নাকি তরকারিতে নারিকেল খান না। তাই আমার এত সাধ করে রান্না করা চিংড়ি মাছের মালায়কারী কেউ পাতেই তুললেন না, এমনকি আমার স্বামী পর্যন্ত না।

তবে আমার স্বামী খাবার টেবিলে বাড়ির আর সকলের সামনেই খুব নরম স্বরে বলেছিলেন, তোমার যেহেতু নারিকেল দিয়ে চিংড়ি মাছ এত পছন্দ তাই তুমি মাঝে মাঝে ওটা রান্না করে খেও। আমাদের চিংড়ি মাছের ভুনা করে দিলেই চলবে।

আমি শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলেছিলাম মাত্র। তবে আমার আর শ্বশুর বাড়িতে কখনোয় ওটা রান্না করা হয়ে ওঠেনি। এমনকি মা যতদিন বেঁচে ছিলেন মায়ের বাড়িতে গিয়ে যখন এত পছন্দের খাবারটা খেতাম তখনো বিয়ের আগের মতো সেভাবে আর ভালো লাগাটা কাজ করত না। হয়তো অভ্যাসটাই বদলে গিয়েছিল! এভাবেই বিয়ের পর জীবন থেকে অনেক প্রিয় কিছু যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়েছিল। সেটা কোন প্রিয় খাবারই হোক অথবা প্রিয় কোনো অভ্যাসই হোক। এই যেমন বিয়ের আগে, রাতের বেলা গল্পের বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়া ছিল আমার নিত্য দিনের একটা অভ্যেস। অথচ বিয়ের পর দেখা গেল আমার স্বামীর ক্ষেত্রে বিষয়টা ঠিক উল্টো। তিনি নিজে তো গল্পের বই পড়েন না উল্টো কেউ পড়লে যেন বিরক্ত হন। আমি বিয়ের পর অলস দুপুরগুলোতে দু একবার গল্পের বই নিয়ে তার পাশে গিয়ে বিছানায় শুয়েছিলাম। তা দেখে তিনি আমাকে মুখে কিছু বলেননি ঠিকই তবে তার চোখে এমন একটা স্পষ্ট বিরক্তি দেখেছিলাম যা দেখার পর গল্পের বই হাতে নেয়ার সাহস অথবা ইচ্ছে কোনটাই আমার আর হয়নি। এছাড়াও আরো এমন অনেক কাঁটাছেঁড়ার গল্প রয়েছে। বিয়ের আগে বাড়িতে যে কোন রকম গহনা পড়ে থাকতে আমি খুবই অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম। কেমন যেন অস্বস্তি হতো। সারা শরীর যেন কুটকুট করতো। অথচ আমার এমন ভাগ্য যে আমার স্বামী পছন্দ করেন গহনাতে মুড়ানো নারীর শরীর। তাই বিয়ের পর থেকেই আমার শরীরে শোভা পেতে লাগলো ভারী ভারী দামী গহনা। আমার আশেপাশের সবাই ভাবলো, আমি কতোই না ভাগ্যবতী! মজার ব্যাপার হলো, সোনায় মুড়োনো দামী গহনার আড়ালে আমার শরীরের অস্বস্তিগুলো কেমন যেন দূর হয়ে গেল কিংবা বলা যায় শরীরে মুড়ানো সোনার এই গহনাগুলোতে আমার এই শরীরটাও যেন একরকম বাধ্য হয়ে গেল।

সবকিছু মেনে নিয়ে মজুমদার বাড়ির যোগ্য বৌ হওয়ার আমার এই দৃঢ় সঙ্কল্প দেখে আমার ছোট বোন শেফু আমার উপর ভীষণ রাগ করতো। মুখ ঝামটা দিয়ে বলতো, তুমি এমন কেন বলোতো আপা? তোমার কি নিজের কোনো চাওয়া পাওয়া থাকতে নেই? ওরা যা বলবে সেটাই তোমার মেনে নিতে হবে? তোমার ইচ্ছে অথবা অনিচ্ছের কোনো মূল্যই কি ওদের কাছে নেই? তুমি তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকেদের, নিদেনপক্ষে তোমার স্বামীকে তো কিছু বলতে পারো?

আমি শেফুর কথা শুনে মনে মনে হাসতাম। মেয়েটা সেই ছোট বেলা থেকে একই রকম রয়ে গেল। নিজের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে জোর গলায় কথা বলা, নিজের অধিকারটুকু যেভাবেই হোক নিজের মত করে আদায় করে নেয়া এগুলো আমাদের শেফু ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো পারে। আর এই জন্যই শেফু শুধু নিজের বাবা মার বাড়িতেই নয় বরং সে তার বিয়ের পরেও নিজের সম্মান শ্বশুর বাড়িত প্রতিষ্ঠা করেছে এবং নিজের অধিকার সসম্মানে প্রতিষ্ঠা করে বেশ ভালোও আছে। একটা কলেজে চাকরি করছে, বিকেলে আর্ট ক্লাসে জয়েন করেছে। তার আবার ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির ভীষণ শখ কিনা!

তবে শেফুর কথাগুলো শুনে তাকে প্রায়ই আমার বলতে ইচ্ছে করতো, সবাই তোর মতোন এমন ভাগ্যবতী হয় নারে বোকা, যে নিজের অধিকারটুকু জোর গলায় আদায় করে নিতে পারে। কেউ কেউ আমার মতো এমন অভাগাও হয় যারা কিনা শুধু গহনার চাদরে নয় অভিমানের চাদরেও নিজেদের মুড়িয়ে রাখে। তাই অভিমানের জন্যই বল অথবা চাপা স্বভাবের জন্যই বল জোর করে কোনো কিছু আদায় করায় তাদের যে বড্ড অনীহা।

একটা কথা বলতে আজ আমার কোনো বাধা নেই। এই পঁচিশ বছরের বিবাহিত জীবনে অনেক কিছু যেমন হারিয়েছি তেমন নতুন করে অনেক কিছু পেয়েছি। মায়ের আলমারির ন্যাপথলিন দেয়া পুরোনো শাড়ির গন্ধগুলো হয়তো হারিয়েছি তবে নতুন কেনা শাড়ির ঘ্রাণ পেয়েছি, বাবার বাড়ির বৈঠক খানায় আমাদের ভাইবোনদের হাসি, আড্ডা, খুনসুটি সব হারিয়েছি তবে শ্বশুর বাড়ির ড্রয়িং রুমের আড্ডায় ভাসুর, দেবর, জাদের আমার প্রতি ভ্রূকুটি ভরা দৃষ্টি হয়তো পেয়েছি। হারিয়ে ফেলেছি বাবার বাড়িতে ফেলে আসা শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যের সেই আমার আমিকে আর নতুন করে পেয়েছি মজুমদার বাড়ির বৌমাকে, আমার স্বামীর স্ত্রীকে আর আমার ছেলেদের মাকে।

যে কথা বলতে এসেছিলাম সেটাতো আপনাদের বলতে ভুলেই গেছি। আজ আমার বড় ছেলে অনীকের বিয়ের দিন। ঘন্টা দুয়েক আগে অনীক তিথিকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। আমি কিন্তু তিথিকে অনীকের বৌ বলব না। তার তো বাবা মার দেয়া নিজের একটা নাম আছে, তাই না? সে যতদিন এই বাড়িতে থাকবে ততদিন নিজের বাবা মায়ের দেয়া নামে, নিজের পরিচয়ে, নিজের পরিচিত অভ্যাসের মধ্যে থাকবে। এটাই আমি চাই। আমার মতো মজুমদার বাড়ির বৌ এর আড়ালে তিথিরও যেন নিজের পরিচয় চাপা পড়ে না যায়। তাই আমি তাদের বিয়ের আগেই তিথিদের বাড়িতে যেয়ে তিথির শোবার ঘরটা দেখে এসেছি। এই বাড়িতে তিথির জন্য ঠিক তার শোবার ঘরের মতোই এমন একটা ঘর সাজিয়েছি যেন তিথির কখনো মনে না হয় সে তার বাবা মায়ের বাড়িতে নয় অন্য কোথাও আছে। এটাই তিথির জন্য আমার বিয়ের উপহার। পাগলি মেয়েটা আমার এই উপহার দেখে কেঁদে কেটে এমন একটা হুলস্থুল কান্ড করলো যে কী বলব! তবে সে জানে না, অনিকের বিয়ের কথা হওয়ার পর থেকেই আমি নিজের সাথে মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। সারাজীবন অভিমানের চাদরে নিজেকে ঢেকে রেখে নিজের যে পরিমান ক্ষতি আমি করেছি, যে পরিমান ভুল আমি করেছি তিথিকে সেই ভুল আমি করতে দিব না। আমি প্রমান করে দিব যে, নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখেও খুব ভালো বউ হওয়া যায়, ভালো স্ত্রী হওয়া যায়, ভালো মা হওয়া যায়। তার জন্য নিজের সত্ত্বাকে মেরে ফেলার কোনো প্রয়োজন হয় না। আমার এই সঙ্কল্পে আমার ছেলেরা আমার পাশে আছে। আমি আমার ছেলেদের ছোট বেলা থেকেই এই শিক্ষা দিয়ে এসেছি। কারন আমার মনে হয়েছে আমাদের কাউকে না কাউকে তো নতুন আলোর সূচনা করতে হবে। সূচনাটা না হয় আজ আমি করলাম। তবে কাল কিন্তু আপনার পালা, করবেন তো?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *