ঈদসংখ্যার গল্প।। এক্সক্লুসিভ নিউজ।। প্রিন্স আশরাফ
রাত তিনটের কাঁচা ঘুম থেকে মোবাইলের যন্ত্রণায় উঠে পড়ে ভোর সাড়ে চারটেয় বেরিয়ে পড়তে হলে চাকরির পশ্চাদদেশে লাথি কষাতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছেটাকে অনেক কষ্টে দমন করে রিপোর্টার মাহফুজ মিথুন মোবাইলেই এক ঘন্টা পরে এ্যালার্ম দিয়ে বালিশে মাথা লাগায়। মগজের কোষে কোষে এখনও চিফ রিপোর্টারের কথাগুলো ছড়িয়ে পড়ছে, ‘সুবহে সাদিকের আগে ওদের পাকড়াও করে সচিত্র প্রতিবেদন নেবে। নিয়েই ল্যাপটপের ইন্টারনেট থেকে মেইল করে পাঠিয়ে দেবে। সকালের ফাস্ট নিউজ আওয়ারেই ওটা অনইয়ারে দিতে চাই। ফক্করবাদ গ্রামে আমাদের জেলা করেসপন্ডেন্টস থাকবে। সেই নিউজটা…’ লাথিটা এবারে ওই করেসপন্ডেটস ব্যাটার পশ্চাদদেশে দিতে ইচ্ছে করছে। শালার বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়ো! সামান্য ঘটনাকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে এরা এরকম বানায় যে খাওয়া ঘুম হারাম হয়ে যায়।
চ্যানেলের ফাস্টের স্টিকার লাগানো মাইক্রোবাস মেসের দোরগোড়ায় হাজির। ল্যাপটপ, মোডেম, মোবাইল, পেনড্রাইভ নিয়ে পুরোপুরি ডিজিটাল মানুষ হয়ে মিথুন গাড়িতে উঠল। ড্রাইভার গোমড়ামুখে একমনে সিগারেট টেনে চলেছে। একেবারে পেছনের সিটে ক্যামেরাম্যান ঝিমাচ্ছে। তার সহকারী রনক আক্রাম বসে আছে। রনক তার জন্য জায়গা করে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, ‘বস, ঘটনা কি?
‘স্যার এত তাড়াহুড়ো লাগালো কেন? কোন ব্রেকিং নিউজ নাকি?’
মিথুন দাতে দাত চেপে বলল, ‘শীতের রাতে কাঁচা ঘুম ভেঙে বেরোনোর চেয়ে বড় কোন ব্রেকিং নিউজ আর আছে নাকি?’
রনক দাঁত বেরে করে হেসে বলল, ‘বস, শুনলাম কোন যুবতি মাইয়া নাকি পীর হইছে। মাইয়া গায়ে হাত ছোঁয়াইলে অসুখ সেরে যাচ্ছে।’
`তোর কোন অসুখ আছে নাকি?’ মিথুন সিটে গা এলিয়ে দিয়ে রসিকতা করল। ‘থাকলে কইস, ব্যবস্থা নেয়া যাবে।’
`মাইয়া হাত বুলাইলে অসুখ আছে। সারা গায়ে অসুখ।’ রনকের দাঁত বেরিয়েই আছে। ছেলেটার হাসি রোগ আছে। ‘কন না, বস, কেস কি?’
মিথুন কোন উত্তর না দিয়ে বাইরে দেখতে লাগল। খুব ভোরের অদ্ভুত একটা ব্যাপার আছে। সব কিছু অস্পষ্ট থেকে ষ্পষ্টতার দিকে যাচ্ছে। নতুন দিনের শুরুর প্রস্তুতি যেন। তাতে মন ভালো করার উপাদান গুড়ো গুড়ো হয়ে ছড়ানো রয়েছে। মিথুনের মন ধীরে ধীরে ভালো হতে থাকে। মিথুন পিছনের সিটে আয়েশ করে হেলান দিতে দিতে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, ‘মজনু ভাই, জায়গাটা চেনেন? কদ্দুর যেতে হবে জানেন কিছু?’ মজুন ভাই সামনের কুয়াশা থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, ‘জায়গা চিনি না। তবে কোন দিকে তা জানি। অনেকটা পথই যেতে হবে। পথে দুই দুইটা
২
ফেরি পড়বে। ফেরিতেই ঘন্টা কাবার। আপনি আরামে ঘুমান। দুপুরের আগে কোনমতেই পৌছানো সম্ভব না।’মিথুন আঁতকে উঠল, ‘সেকি! বসে যে বলল, সকালের মধ্যেই প্রথম নিউজ আওয়ারে অনওয়ার করবে।’
মজুন ভাই ব্যঙ্গের হাসি ঠোটে ঝুলিয়ে বলল, ‘হ, গদি আটা চেয়ারে বসে কইলেই হল। মাঠে নাইমাই দেখুক না! আমগোর মতন বনবাদাড় তো ঠ্যাঙায়ে বেড়াইতে হয় না।’
মিথুন ড্রাইভারকে আর ঘাটাল না। বকতে থাকলে ঘুম চটে যাবে। রনক ঝিমাচ্ছে। এই ফাকে সেও একটু ঝিমুনির মত দিয়ে নিক। মজনুর কথাই ঠিক। বেলা বারোটার পরে ফক্করবাদ গ্রামে ঢুকল চ্যানেল ফাস্টের গাড়ি। প্রতিনিধি গাজী শামস আরো কয়েকজন সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে পথের মোড়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদের নিরাশ করে সে গাড়িতে পথ চেনাতে ড্রাইভারের পাশে বসল।
কুশল বিনিময় শেষে প্রতিনিধিই আগ বাড়িয়ে ব্যাপারটা বলল, ‘এক জ্বিনসাধক ব্যাটা অনেকদিন ধরে করে খাচ্ছিল। ক্যান্সার এইডস থেকে শুরু করে হেন প্রকার অসুখ বিসুখ বা সমস্যা নেই যা জিনসাধক জিনের মাধ্যমে সারাই না। কাজ হোক আর না হোক দশ গ্রামের লোক হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আমাদের গ্রামের রসুল অনেক দিন ধরে একটু পাগলাটে স্বভাবের। ইচ্ছেমত কাউকে কিছু না বলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যায়। আবার কিছুদিন পর ফিরে আসে। রসুল এরকম কাজকাম করে যা তার মতো আটবছরের ছেলের করার কথা না। দেড়মনি ধানের বস্তা পর্যন্ত উঁচু করে তুলতে পারে। সবাই বলে জিনের আছর লাগছে।’
রনক হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, ‘ঘটনা কি এই রসুলকে নিয়ে?’
‘হ্যাঁ। রসুলের মা রসুলকে নিয়ে জিনসাধকের আস্তানায় যায়।
আস্তানার উঠোনের মাটিতে বেশ গভীর গর্ত খোঁড়ে জ্বিনসাধক। তারপর সেই গর্তের মধ্যে রসুলকে দাড় করিয়ে দেয়। রসুলের মাথা পর্যন্ত গর্তের মধ্যে পুতে ফেলা হয়। চারিদিকে গ্রামের লোক তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জ্বিনসাধকের কর্মকান্ড দেখতে থাকে। সাধক ব্যাটা নানান ভং চং করে। কি সব ছকটক বানায়। জাফরানী কালি দিয়ে ছকে কুফরী কালাম লেখে। আরো কি কি যেন করে। তারপরে সেই ভয়ংকর কর্মকাণ্ড শুরু করে।’
‘কি সেটা?’ প্রতিনিধির বাকোয়াজ বাজিতে অধের্য মিথুন জিজ্ঞেস করে।