ঈদসংখ্যার গল্প ।। কবুতর।। রেজা নুর

মফিজ স্যার যখন আমাদের বাড়ীতে গৃহ শিক্ষক হয়ে আসলেন তখন বইপত্র পড়ার মতো বয়স আমার হয়নি। মা’র আঁচল নাটাই, আর আমি এলোমেলো বাতাসের ভীরু ঘুড়ি। কিছুটা উড়ি তো ফিরে ফিরে আসি নাটাইয়ের কাছে। বাড়ীর উঠোন তখনও মুখ গুঁজে উপভোগ করে আমার আলতো পায়ের সুড়সুড়ি। পাঁচিলের সামনের নিমগাছ পার হয়ে কাঁঠাল তলায় এসে দাঁড়াই। সমবয়সীরা কেউ এলে খেলি।
বড়ো বোন রাবিয়াকে পড়ানোর সময় আমার অ আ ক খ’র রঙিন ছবি’র বইটা নিয়ে বসে যেতাম আমিও। খুব অল্পে পড়া ফুরিয়ে যেতো আমার। তবুও রাবিয়া বু’র পড়ানো শুনতাম। কত রকম নতুন কথা, নতুন নতুন শব্দ! মফিজ স্যার নিচু স্বরে কখনও পড়ে যেতেন বইয়ের কোনো অংশ, বুঝিয়ে দিতেন তারপর। স্যার তখন সম্ভবত টেনে পড়েন, বু থ্রি কিংবা ফোরে। এখন বুঝতে পারি,তাঁর মতো শান্ত, স্থির কিশোর হয় না কখনও। ছিপছিপে লম্বা, কুচকুচে কালো রঙ আর হাসিমাখা মায়াভরা মুখ। মাথা নিচু ক’রে হাঁটতেন সব সময়। রান্নাঘরে আমাদের সাথে গোল হয়ে পিড়িতে বসে ভাত খেতেন। মা কিছু জিজ্ঞেস করলেও শব্দ ক’রে উত্তর দিতে শুনিনি। মাথা নাড়তেন শুধু। অথবা অস্ফুট স্বরে বলতেন কিছু একটা।
একদিন স্যারের বাড়ীতে যাবার বায়না ধরলাম। বেশ কিছুদিন পার হলেও আমাকে নিয়ে যাবার লক্ষণ দেখলাম না। স্যার নির্বিকার। শেষে একদিন মা আমাকে জামা-কাপড় পরিয়ে দিলেন। আমি আর স্যার পায়ে হেঁটে রওনা দিলাম তাঁর গ্রামের দিকে।
সোনাকুড় আমাদের বল্লা গ্রাম থেকে দুই মাইল দূর। মাঝখানে শাদিপুর আর হাজিরবাগ। তখনও রাস্তায় ইট পড়েনি। থানা শহর ঝিকরগাছা থেকে বাঁকড়া পর্যন্ত কাঁচাপথ। স্যার সামনে, আমি হাঁটছি পিছনে। যাবার আনন্দে, আর আগ্রহে উড়ে যাবার ইচ্ছে করছে। হালকা পায়ে দৌঁড়ানোর মতো হাঁটছি সারাপথ। বাড়ির কাছাকাছি এলে চওড়া রাস্তা ছেড়ে সরু পথ ধরলেন মফিজ স্যার। দু’পাশে ক্ষেতের পর ক্ষেত ছোলাবুট লাগানো। কেবল পেকে পেকে উঠেছে। সবুজের মধ্যে সোনালি রঙের ছোপের আড়ালে পাকা-ছোলার গুচ্ছ গুচ্ছ ফল ঝুলে আছে। স্যারদের বাড়ির পাশের আমতলায় কয়েকজন মিলে সেইরকম ছোলা পুড়িয়ে খাবার আয়োজন করছে। আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করলো, ইডা কিডা মফিজ ভাই?
আমার ছাত্র। বেড়াতি আইয়েচে।
এতো ছোটো মানুষ কি থাকতি পাইরব্যানে তোমাগের বাড়ি? ঐ দ্যাকো একুনি ওর চোকি পানি আইয়েচে।
নাহ, হাঁইটে এটটু কষ্ট হইয়ে গেচে। ওর চোক দে আবার এটটু পানি ঝরে।
মাটির দেয়ালের ওপর খড়-কুটোর চালে ছোট ছোট ঘর। বারান্দায় খেজুরের পাটি পেতে আমাকে বসতে দিলো। মিহিন বুননের সুন্দর পরিপাটি পাটির চারপাশ রঙিন কাপড় দিয়ে বাঁধানো। হালকা শীতাভ হাওয়ায় ওতে বসতেই আরাম বোধ হলো। বদনায় ক’রে পা ধোবার পানি এনে দিলো অল্প বয়সী একটি মেয়ে। খালি পা। ময়লা সালোয়ার কামিজ পরা। ধূলোবালিতে মলিন হয়ে আছে প্রায়-কিশোরী এই মেয়েটির শ্যামল শুকনো মুখ।
বিকেল বেলা পাশের বাড়ি থেকে একদল ছেলেমেয়ে এলো আমাকে দেখতে। ষোল-সতেরো বছরের একটি মেয়ে আসতে আসতে বললো, কই, শুনলাম মফিজ ভাইয়ের ছাত্র এয়েচে। উঠোনের একপাশে লাগানো ঝাঁকড়া হয়ে ওঠা পাতা বাহার গাছ দেখছিলাম। ফিরে তাকালে চোখে চোখ পড়লো।আমি লজ্জায় আড়ষ্টতায় দাঁড়িয়ে রইলাম।ওরা এগিয়ে এলো।স্যার বললেন, কী রে দীপা কেমন আছিস?
ভালো, মফিজ ভাই, আপনার ছোট্ট সাগরেদ দেখতি আসলাম।
ভালো করিচিস।
ওর এটটু আমাগের পাড়ায় বেড়াতি নিয়ে যাবো?
যা।
আমার দিকে তাকিয়ে দীপা নাম জিজ্ঞেস করলো।বললে মিষ্টি হেসে হাত ধ’রে চিবুক টেনে আদর করলো একটু।হাত টেনে নিয়ে বললো, চলো সাগরেদ, তুমার বেড়ায় নে আসি।
অনেকগুলো বাড়িঘর আর ছোটো ছোটো উঠোন পার হয়ে মাঠের দিকে নিয়ে চললো ওরা আমাকে। আমার হাত ছাড়েনি দীপা। আলতো ক’রে ধ’রে আছে, শিথিল ক’রে গুঁজে নিয়েছে ওর বাম কনুইয়ের নিচে। পেছনে অনেকগুলো পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। নীরব পিঁপড়ের সারির মতো চলছি আমরা। দীপার গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণ আর বিকেলের মাঠ থেকে ভেসে আসা ভিজে ঠান্ডা বাতাস চলার তন্ময়তা এনেছে।
দীপা বললো, জানো সাইফ কাল এখানে জারিগান হবে।
কিছু বলার মতো খুঁজে পেলাম না। দেখলাম, খেলার মাঠের এককোণায় সারি সারি কাঠের খাট পাতা। উপরে নারকেল পাতার চাল। কাঁচা বাঁশের দন্ডে দাঁড়িয়ে আছে। জারিগান কী তাই ভাবছি। বড়োরা গান শুনে রেডিও রেখে দিলে আমি শুনি। ক’টায় কোন্ সেন্টারে কী গান হয় মুখস্ত আমার।
‘যারে যা চিঠি লেইখা দিলাম শোনা বন্ধির নামে’।‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু ব’লে গণ্য হলাম’। ‘এই পৃথিবীর ‘পরে কতো ফুল ফোটে আর ঝরে’— এই ধরনের গান কখন বাজে একরকম ধারণা হয়ে এসেছে। জারিগান শুনিনি কখনও।
আস্তে ক’রে জিজ্ঞেস করলাম, জারিগান কী?
কাল বিকেলে শুনবি।
দুপুরের পরেই আমাকে নিতে এসেছে দীপা।সংগে সেই ক্ষুদে দলবল। কাল শূন্য মাঠের কোণায় নি:সঙ্গ মঞ্চ দেখেছিলাম। আজ লোকে লোকারণ্য। চারপাশের গ্রাম থেকে এসেছে এরা। কেউ পায়ে হেঁটে, সাইকেলে কিংবা নৌকায়।কপোতাক্ষর পাড়ে ছোটো বলেরমাঠে এই আয়োজন।গান শুরু হয়নি। বাবরী চুলের দু’চারজন লোক বসে আছেন মঞ্চে।গায়ে লম্বা জামা।কটকটে লাল কিংবা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি।ওপাশের সারিতে বাদকদল। ঢুলি তার বিশাল ছিট-কাপড়ের ঝালরযুক্ত জামা পরানো ঢোলে কাঠি দিয়ে ঢুমঢাম আঘাতে শব্দ পরীক্ষা করছে।চাকিওয়ালা দু’হাতের মুঠোয় সুগোল কাঁসার চাকতিদুটো একসাথে ক’রে ঝম্ ঝম্ শব্দের তরঙ্গ ছড়িয়ে দিচ্ছে।অদূরের কপোতাক্ষর জলের কল্লোলে মিশে যাচ্ছে মনে হয় সুরেলা ঝংকার।বাঁশিবাদক তার চকচকে বাঁশের লম্বা বাঁশিটি মুছছে এক টুকরো কাপড় দিয়ে।ফুঁ দিলো একবার।রঙধনুর মতো বাঁকা রঙিন কিছু সুর মিশে গেলো বাতাসে।
মোটামুটি বয়সী এক ভদ্রলোক মঞ্চে এসে সবাইকে চুপ করতে বললেন।কবিয়ালদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারা কে কোথা থেকে এসেছেন, কেমন এবং কতো বড়ো গায়ক, এইসব।
একজন বাউল উঠে দাঁড়ালেন। মঞ্চের সামনে এগিয়ে এসে গানে টান দিলেন।গলায় হারমোনিয়াম পেঁচানো আর ঢুলি দু’জন মঞ্চের দু’ধারে।হারমোনিয়ামে সুর তোলার পর পরই ঢোলে তাল উঠে গেলো।গানের পরতে পরতে সুরের রেশ বাঁক নিচ্ছে যেখানে সেখানেই খই ফুটছে ঢুলির কাঠিতে।দুই হাঁটু ভেঙ্গে ভেঙ্গে কোমর বেঁকিয়ে ঢোলের সাদাটে বাদামি অংশে সুর তালের খেলায় নেচে নেচে হারিয়ে ফেলছে নিজেকে।শ্রোতারা হৈ হৈ ক’রে ঢুলির আনন্দই দেখছে বেশি।চোখ বুঁজে বাঁশি বাজাচ্ছে বাঁশিওয়ালা।বাঁশের ছিদ্র-যুক্ত এই কঞ্চির ভেতর দিয়ে সুরের এমন অমিয় কী ক’রে ঝরে? তন্ময় হয়ে রইলাম।কবিয়ালের গানের এই লাইনে হুঁশ এলো কিছুটা:
‘বিড়াল কয় মাছ খাবো না ভাত খাবো না, সন্দেশ খাবো
বুঁচা লেজে কুলো বেন্দে পদ্মা নদী পাউড়ি দেবো।
বিড়াল কয়…’
কবিয়ালের একেক পঙক্তি গাওয়া শেষ হলে তার পেছনের দোহারকিদাররা সেই লাইনটি আবার গাইছে এক সঙ্গে।তার একক কন্ঠের সুরের অনুরণন ছড়িয়ে পড়ছে শ্রোতাদের হৃদয়ে।সারামাঠ জুড়ে এতো মানুষ।ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা, বড়োরা, মহিলারাও এসেছেন বাড়ির কাজকর্ম আগে ভাগে সেরে নিয়ে।কেমন নিশ্চুপ নিঝুম তন্ময়তায় শুনছে সবাই।
মঞ্চের কাছাকাছি বসতে পেরেছিলাম আমরা। ঘাসের ওপরে ব’সে কোলে ক’রে ওর বুকে হেলান দিয়ে বসিয়েছিলো দীপা আমাকে।এমন রেশমের মতো নরোম উষ্ণ অনুভব পাইনি কখন্ও।ওর হাতের তালু আমার থুতনিতে হালকা রেখে জিজ্ঞেস করলো, কিরাম ল্যাগদেছে গান?
ওর আদরমাখা হাতের ওপর থুতনি আরেকটু নিচে নামিয়ে মুখ একটু বাঁকা ক’রে ফিরে চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ।মনে হলো, এমন নরোম হাতের নির্ভরতা যদি আমার চোয়ালে চিরদিন লেগে থাকতো!
বাড়ি ফিরে এলে মফিজ স্যার বললেন, কিরে সাইফ কিরাম গান শুনলি? ভালো লেগেছে?
জ্বি স্যার।
কাল তোকে বাঁকড়া বাজারে নিয়ে যাবো।আগে কোনোদিন গিচিস?
না। আমি মাথা নাড়ালাম।সাথে আর একটা খেয়াল নড়ে উঠলো মাথার ভেতর।
চাচাতো ভাই কবির কবুতর পোষে খুব।স্কুলে যেতে আসতে কবুতরের গল্প বলে সব সময়।
ওর কারিগরী বিদ্যা চমৎকার।হাতুর বাটাল আর ছোট্ট করাতসহ সমস্ত নিজস্ব সরঞ্জাম দিয়ে কাঠের খোপ বানিয়েছে। দোতলা বহুখোপের সেই কোঠায় ডগমগ করতে থাকে নানা ধরনের কবুতর।ছোট্ট চালে উড়ে গিয়ে পুরুষটা লেজ বাঁকিয়ে ঘুরে ঘুরে বাকবাকুম বাকবাকুম ক’রে ক’রে প্রণয়িনীর প্রণয় প্রার্থনা করে।বাচ্চা ফুটলে আমাকে ধরতে দেয় কবির।বলে, সাবধানে নিবি। ফ্যালায় দিসনে যোনো।মনে মনে বলি, কী যে বলিস, আমার জান থাকতি কবুতর প্যড়ে যাবে হাতেত্তে?
বাঁকড়ার হাটে কবুতর পাওয়া যায় স্যার? জিজ্ঞেস করলাম।
কবুতর কী করবি। চাচিমা আমার ওপর রাগ কইরব্যানে।
আপনি কিনে দিলি কিচু বলতি পারবে না মা।
ঠিক আছে। আমার নাছোড়বান্দামিতে স্যার রাজি হলেন।
আমরা রওয়ানা দিতে যাবো। এমন সময় দেখলাম ছোট ভাই টুটুলকে নিয়ে আমাদের দিকে আসছে দীপা।বললো, চলো আমরাও বাজারে যাবো।
মনের মধ্যে অজানা আনন্দের শিহরণ।বললাম, তালি তো খুব ভালো হবে দীপা বু।
আ.., দু’দিন তো কোনো কতাই বলিসনি।আজ মুখ ফুইটেচে দেকতিছি।বু বলেও ডাকলি আমার।তু্ই খুব ভালো ছেইলে রে।
দীপা বু আমার হাত ধ’রে হাঁটছেন। টুটুল ধ’রেছে অন্যহাত। স্যার হাঁটছেন কিছুটা এগিয়ে।টুটুল আর দীপা বু চপ্পল পায়ে দিয়েছে।ফট্ ফট্ শব্দের ছন্দ আমার দু’পাশে।হালকা ধূলো উড়ছে ওদের পায়ের পেছনে।সাদা সাদা ধূলোর প্রলেপ দীপা বু’র রাঙা পায়।পায়ে আলতা দিয়েছিলো মনে হয়। পা ধোবার পরও আলতার লালচে রেখা আয়তকার হয়ে আছে পায়ের পাতায়।এতো লম্বা চুল দীপা বু’র। উড়ে এসে লাগছে চোখেমুখে।ঘ্রাণ পাচ্ছি।লাক্স সাবান মেখেছে মনে হয়। সাবান আর চুলের মিলনে সে এক মুগ্ধকর ঘ্রাণ!
ছবির মতো ভেসে উঠছে বাজারের ঘর-দালানগুলো।রাইস মিলের ধোঁয়া উড়ছে।দীপা বু আঙুল উঠিয়ে বললো, ঐ দ্যাক বাঁকড়া বাজার।আমরা পিরাই আ্ইসেই গিচি।
বাজারের ঢোকার আগে বাঁ দিকে কপোতাক্ষর ওপর বাঁশের বিশাল সাঁকো দেখতে পেলাম।একসাথে তিনচারজন হাঁটা যায় এরকম চওড়া ক’রে বাঁশের চটা দিয়ে বানানো।বেশ জব্দ মনে হলো। কেউ কেউ সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে ওর ওপর দিয়ে।নেমে সাইকেল হাঁটিয়ে নেবার দরকার হচ্ছে না।সাঁকোর নীচে অপরূপ স্বচ্ছ পানি। ব’য়ে চলেছে আপন মনে।মাঝে মাঝে বিরল কিছু শেওলার দল ঘোড়-সওয়ারের মতো ব’সে আছে ঢেউয়ের ওপর।মনে হলো দেখি দাঁড়িয়ে।
মফিজ স্যার পেছনে এসে একসাথে হলেন। বললেন, দীপা, বাজার স্যেরে হাঁস-মুরগী আর কবুতরের জাগায় যাওয়া লাগবে। সাইফ কবুতর কিনবে।
শব্দ ক’রে হাসলো দীপা বু।মুখের দিকে তাকালাম।ভোরের আলোর হাসির মতো স্নিগ্ধ দীপা বু’র সুন্দর মুখে দুষ্টুমির ঝিলিক।
ও রে দুষ্টু! মনে মনে কবুতরের বাগবাকুম ফ্যুটতেছে, আমার কাচে বলিস নি তো?
তুমি তো ইশকুলি গিছাও।
আসতি আসতিউ তো কোতি পাত্তিস।
এতোলোকের মধ্যে হাঁটা সত্যি কঠিন। কোনোরকমে লোকজনের ফাঁক-ফোকড় গলিয়ে কবুতর বিক্রীর জায়গায় পৌঁছলাম আমরা। গোল গোল খাঁচার ওপরে দড়ির জাল-বিশিষ্ট পাত্রে ভেসে আছে কবুতরের মুখগুলো।বেরিয়ে আসতে চাইছে ওরা।আমি একমনে দেখছি।গলায় ধূসর রঙের বেড়ি পরানো এক পুরুষ কবুতর পছন্দ করলো দীপা।ধবধবে সাদা, লাল টুকটুকে পা আর টলটলে গভীর কালো চোখের বাচ্চামতো একটি কবুতর দেখিয়ে বললাম, এইডে নোবো এর সাতে।
দীপা বললো, তুই এই মেয়ে কবুতর চিনলি কি ক্যরে, তাই বলতি হবে।
ওর চোখে কোন্ ইশারা ওই বয়সেও বুঝতে পারলাম।
লজ্জা পেয়ে বললাম, আমার চাচাতো ভাই কবুতর পোষে, তাই জানি।
পরদিন সকালে বাড়ি ফিরে আসলাম আমরা।দীপা বু সেদিন স্কুল কামাই দিয়েছিলো। বলেছিলো, স্কুল কুতায় যাবে, তুই তো পালায় যাবি একদিন।স্যারের বাড়ি থেকে সেই যে আমার হাত ধ’রে কাঁধে হাত রেখেছিলো, বড়ো রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেও হাত সরিয়ে নেয়নি।কতবার কতভাবে মুঠোয় চেপে চেপে খেলা করেছে আমার হাত দুটো নিয়ে।একেবারে নতুন একটা জামা পরেছিলো দীপা। ন্যাপথলির্ গন্ধ বেরুচ্ছিলো।ছল ছল চোখে দু’একবার তাকিয়েছিলাম ওর দিকে।অনেক দূর যাবার পরও শেষবারের মতো যখন পেছনে তাকালাম। দেখলাম, ছোট্ট পুতুলের দাঁড়িয়ে দীপা।বেণী করা চুলের ওপরে ভাসছে গোলাপি ফিতের ফুল।সেই ফুলের সুগন্ধময় আবেশ বয়ে আনছে এই সকাল বেলার সজীব বাতাস।
আমির হোসেন মামু আমার কবুতর জোড়ার জন্য কোঠা বানিয়ে দিলেন।আমাদের বাড়িতে কাজ করলেও বয়সে বড়ো সবাইকে আমরা মানানসই কোনো সম্পর্ক নিয়ে ডাকতাম।তার দৈনন্দিন কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও প্রয়োজনের চেয়ে বড়ো এক কোঠা বানালেন।বললেন, তোর কবুতর যখন বাচ্চা পাড়া শুরু করবে তখন দেকিস সবগুলো খোপ লাগবে। এখন বড়ো মনে হলিউ তখন বুঝবি।
আমার জগতে ‌এখন শুধু কবুতর।স্যার ক্লাসে এলে তাঁর মাথার ওপর কবুতর ব’সে থাকতে দেখি। ব্লাক বোর্ডে চক-পেন্সিলের অক্ষরও কবুতর।আমার সহপাঠি সবাই মনে হয় বাগবাকুম ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানে না।নিজে কখন খেয়েছি মনে না থাকলেও কুবতরের দানাপানি দিতে ভুল হয় না।সময়মতো কোঠায় উঠিয়ে দরোজায় খিল দেয়া। সকালে রোদ ওঠার আগে ওদের ছেড়ে দেয়া রুটিন হয়ে গেলো।একদিন লক্ষ করলাম ওরা জোড়া বাঁধছে না। ছেলে কবুতরটা লেজ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মহাদর্পে মানাতে চাচ্ছে মেয়েটাকে। আর মেয়ে কবুতরটা ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে বার বার।দুশ্চিন্তা হলো।কবিরের কাছে পরামর্শ চাইলাম।কবির পর্যবেক্ষণ ক’রে বললো, তোর মদ্দা পায়রাটা বেশি বড়ো হ্যয়ে গেছে মায়া পায়রার চ্যেয়ে। জুড়া বানতি সুমায় লাগবে।
জোড়া বেঁধেছিলো ওরা। অফুরাণ প্রেম দেখেছি ওদের। মোমের মতো মেয়ে কবুতর ঠোঁট বাড়িয়ে আদর নিয়েছে কতো।অল্প উড়ে গিয়ে বসেছে অন্য চালে।উঠোনের আমড়া গাছের ডালে নতুবা আম গাছের উঁচুতে।তবুও ছাড়বার পাত্র না মদ্দাটা।পিছু নেয় মায়ার।চালে ফিরে এসে আবার নতুন প্রেমে হারায় দু’জন। সারাদিন এতো সুখি হলেও সন্ধেবেলা কোঠায় উঠতে চায় না। প্রতিদিন জোর করে উঠাতে হয়।খিল বন্ধ করার পর ওদের পায়ের খটখটে, খড় খড় শব্দ শুনি।বুঝতে পারি না কিছু।
একদিন দুপুরে ওদের খাবার আর পানি বদলে দিতে গিয়ে দেখি কোঠার ভেতরে লাল বড়ো বড়ো পিঁপড়ের সারি। খাবারের পাত্র রেখে হাত সরিয়ে নেবার সময় কামড়ে দিলো হাতে।কী বিষাক্ত কামড়।ডাশা ডাশা রাগান্বিত পিঁপড়েরা দলবেঁধে উঠে আসছে মাটি থেকে খুঁটি বেয়ে উপরে।
চোখে পানি এসে গেলো তখনই। সারারাত আমার কবুতর দু’টো ওদের কামড় খায় আর আমি আরামে ঘুমিয়ে থাকি।ওহ!
কোঠা পরিষ্কার ক’রে জায়গা বদলে দিলাম।বারান্দার পাশের চালের নীচে টাঙানো হলো কোঠা। কামরা থেকে বেরিয়ে ওরা যেনো কিছুটা হাঁটহাঁটি করতে পারে সেজন্য লম্বা একটা তক্তা বাঁধা হলো কোঠার নীচে।কলপাড়ের পাশের ছোট আমগাছে গিয়েও বসতে লাগলো।কলের পানির স্বচ্ছ মিহি স্রোত থেকে ঠোঁট ডু্‌বিয়ে পানি খায় দু’জন। কুটো জোগাড় ক’রে কোঠায় নিয়ে যায়। কী যে ভালো লাগে দেখে।
একদিন সকাল বেলা আনন্দময় তীব্র আলো ঝলসে দিলো আমার দু’চোখ। খিল খুললে বেরিয়ে পড়লো ওরা। দেখি দুটো সাদা মুক্তোর মতো ডিম পড়ে আছে হালকা খড়কুটের বুত্তের ‘পরে।সে কি আনন্দ আমার!দিনে কতবার দেখি ডিমদুটো!
পালা ক’রে ডিমে তা দিতে শুরু করলো ওরা। একটু শুকিয়ে গোলো দু’জনই। চলাফেরায় কেমন স্থিরতা।প্রায় চুপচাপ। ডাকে কম। তা’ দেবার সময় শুধু শুনতে পাই হু হু ক’রে গর্জে চলেছে বহুক্ষণ।আমার চোখে এখন দু’টো ফুটফুটে কবুতর ছানার স্বপ্ন।আমি যেন দেখতে পাই পালকহীন ছোট্ট দুটো ছানা চিঁ চিঁ করছে।মা-বাবা ঠোঁটে ক’রে খাবার এনে খাইয়ে দিচ্ছে ওদের।
ফুটবল খেলা ছিলো সেদিন। মাঠ থেকে ফিরে গোসল খাওয়া সেরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সন্ধের আগেই। কবুতর ছানারা পিছু ছাড়ে নি আমার। দেখছি, গায়ে পালক এসেছে। বেশ বড়োটি হয়ে উঠেছে। দু’হাতের তালুতে মুঠো ভরে নিলাম ওদের। কী ডাগর চোখে দেখছে এদিক ওদিক! আমার নখ ঠুঁকরে দিচ্ছে। এক সময় মুঠো ছেড়ে উড়ে গেলো দু’জন। মা’র ডাকে ঘুম ভেঙে গেলো।
‘কাইল পায়রার খোপে খিল দিসনি?’ আমি চোখ মুছে তাকিয়ে থাকলাম মা’র দিকে। আবছা আলোয় দেখলাম মা’র মুখটা মলিন। আমাকে দেখছেন। চোখ থেকে হঠাৎ পানি গড়িয়ে পড়লো আমার হাতের ওপর। কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, ‘তোর কইতর খাঁটাশে নিয়ে গেছে কাল রাত্তিরি’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *