ছোটগল্প।। বেলিফুলের ঘ্রাণ।। শফিক নহোর
১.
পারুল গ্রামের মেয়ে। বেলিফুলের মতো সাদা চেহারা, চোখ দুটি মায়া ভর্তি। কথা বললে মনে হয় কথার সঙ্গে রসগোল্লার রস বেরিয়ে আসে। ঠোঁটের কিনারে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের ঝিলিকের মতো মিহি আবেগি ঢঙ লেগে থাকে সর্বক্ষণ। লেখাপড়ায় গাঁয়ের মধ্যে সেরা। স্কুলের মাস্টাররা স্নেহ করে খুব, একনামে তাকে সবাই চেনে জানে ভালো ছাত্রী হিসাবে।
পারুল স্বপ্ন দেখত ডাক্তার হবার। সেই স্বপ্ন একটা সময় অধরা রয়ে যায়। তার মা মারা যাবার পর। মায়ের মৃত্যুতে পারুল যেন ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা বনে যায়।উদাস একটা ভাব চেহারার ভেতর বেলেমাছের মতো জাবর কাটতে থাকে সারাক্ষণ। বাড়িতে বেশিদিন থাকতে পারেনি সৎ মা সংসার বলে।
তার পরে তাকে চলে আসতে হয়েছিল মামার বাড়িতে, সেখানে মামী তার একমাত্র সঙ্গী।
একটা সময় মনে হয়েছিল, মামীর ওপরই সে নির্ভরশীল। আসলে বিশ্বাস একটা সময় বিষ হয়ে ওঠে-ছিল।
সেই গোপন বেদনার দরজা বন্ধ করে রাখতে হয়। অপরের মুখে হাসি দেখার জন্য।
একদিন দুপুরে বিষণ্ণ হয়ে ওঠে পারুলের মন বাড়ি যাবার জন্য। ব্যাকুলতায় সে নিজেই অস্থির হয়ে উঠে একসময়। বাড়ি থেকে বের হবার পথে সুমন তাকে দেখে জানতে চাইল,
কোথায় যাবে?
গ্রামে?
আমাকে গ্রামে নিয়ে যাবে?
এটা তো গ্রামই , না-কি?
গ্রাম মনে হচ্ছে না।
না তা ঠিক না, মিনমিন করতে লাগল সুমন।
পারুল হাসলে মুখে টোল পড়ে, এটা তো প্রথমই দেখলাম। তাকে যেতে দিতে ইচ্ছা হয় না। কেন হয় না, জানি না। হয়তো মনের গভীরে তার জন্য কেউ যেতে বাধা দেয়।
পারুল সরিষা ক্ষেতের আইল দিয়ে হেটে যেতে লাগল, আমি পেছনে দাঁড়িয়ে রইলাম। যত দূর চোখের দৃষ্টি যায়। একটা সময় পারুল আবছায়া হয়ে গেল।
আমি বাহিরে দাঁড়িয়ে তার গুনগুনানোর শব্দও শুনতে পেলাম।
একটা অদ্ভুত দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। পুরনো একটা গানের লাইন ঠোঁটের কিনারে এসে জলে ভাসা লাশের মতো কেমন বেদনার মতো ভেসে উঠল। এমন শব্দ আগে কখনো শুনিনি। জানি, কখনো আর শুনবও না।
পারুল মিহি রঙের পাতলা জামা পরে বের হয়েছে এই শীতের দিনে। পরনে পুরনো ঢোলা সালোয়ার। চুল গুলো মৃদু বাতাসে উড়তে লাগল। মনে হল শ্যাম্পু করেছে, ঘ্রাণ এসে আমার নাকের ডগায় তা জানান দিতে লাগল।
আমি বললাম, সাবধানে যেও।
পারুল বলল, তাতে তোমার কি।
পারুল যেতে যেতে সরিষার শরীর ঘেঁসে মিহি হাতের স্পর্শে ছুঁয়ে দেয় থেকে থেকে। মনে হয় সে আমাকে স্পর্শ করছে।
‘তার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করছে আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
আমি অপেক্ষায় থাকি অথচ, পারুল আর পেছনে তাকায় না।
বাড়ি পাবার একটু আগে তার ভাই রানার সঙ্গে দেখা। বোনকে দেখে খুশিতে এগিয়ে এলো।
বুবু তুমি এতদিন পর এলে কেন?
তোমার জন্য আমার খুব মায়া হয়।
ওরে আমার আদরের ভাই, তোর জন্য বুঝি আমার মায়া হয় না।
মায়া হইলে এতদিন পরে আসলে কেন?
সন্ধ্যার আযান হল, ঘরে সন্ধ্যা বাতি দেবার জন্য রানা প্রদীপ জ্বালিয় জলচৌকির উপর রাখলো ঘরের বারান্দায়। আমি সেই আলোতে দাঁড়িয়ে মায়ের মায়াবী মুখ দেখি কবরের দিকে তাকিয়ে। সেদিন বাবা আমাকে দেখে যতটা খুশি হলেন; তার চেয়ে বেশি অখুশি হলেন মা। মনে হচ্ছে সাতার কাটতে কাটতে নদীর জলে তলিয়ে যাচ্ছি আমি। অজানা আনন্দে আমার চোখ ভিজে উঠল।
ঘরের ভেতর ঢুকতে আমার শরীর কেঁপে উঠল, মায়ের স্মৃতি প্রত্যেকটি জায়গায় মায়ের হাতের স্পর্শ। আমি রানাকে নিয়ে পাশের খুপরি ঘরে গেলাম। রানা আমাকে ছাড়া রাতে ঘুমাবে না। রাত যত গভীর হয় আমার ঘুম চোখ থেকে ততো দ্রুত পালাতে লাগল, একটা সময় রানা ঘুমিয়ে গেল। আমি রানার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এত ছোট মানুষ তবুও চোখের নীচে কালো দাগ পরে গেছে। হয়তো আমাকে নিয়ে মাকে নিয়ে চিন্তা করে।
এত ছোট মানুষ সত্যিই কি আমাদের নিয়ে ভাবে।
কেমন শুকিয়ে গেছে। মা মারা যাবার পর রানাকে কেউ সহজে দেখলে চিনতে পারবে না। আগে কত সুন্দর নাদুস নুদুস ছিল।
জেগে থাকা রাতের জোনাকি পোকার শব্দে মায়ের কণ্ঠ ভেসে আসে। আমি শুনতে পাই, মায়ের ডাক।
জানালা খুলে দেখলাম মায়ের কবর কেমন অন্ধকার জানালা দিয়ে বেশি দূর দেখা যায় না।
মনে হচ্ছে মা আমার সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়বে। আজ রাতের জোছনা এতো সুন্দর রঙ ধারণ করছে চোখ তাকে অবিশ্বাস করছে।
আমি কেন? এমন করে ভাবছি; মা আমার সঙ্গে নেই এটাই তো সত্য।
এই জগতে মা ছাড়া আমাকে দেখার মতো কেউ নেই। যারা বেঁচে আছে তারাও তো আমার কাছে এখন পর। পর না হলে কি আমাকে মামা বাড়ি থেকে লেখা পড়া করতে হয়।
২.
সকালে ঘুম থেকে উঠে , বাড়ির আঙিনায় সবজি বাগান থেকে সবজি তুলছে পারুল। সৎ মা সংসারে যদিও দু’একদিনের জন্য বেড়াতে যাওয়া সেখানে গিয়েও কাজের ঝিয়ের মতো কাজ কর্ম করতে হয়।
সংসারে এখন এসেছে , আমারে খাবার জন্য। নিজের মাকে খেয়েছে তাতে পরাণ ভরেনি পোড়ামুখী কোথাকার?
পাশের বাড়ির যদু মামার বউয়ের কাছে আমার সৎ মা নালিশ করছে; আমি তো তার কোনো ক্ষতি করি নি। আমাকে সে দু’চোখে দেখতে পারে না। কিছু কথা দূর থেকে ধনুকের মতো ছুটে এসে আমার বুকে বিঁধছে। আমি আমার ছোট ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতি উত্তর করলাম না। সম্পর্ক এমনিতেই ভালো না ভালো রাখার চেষ্টা আমি করলেও আমার সৎ মা তা করছেন না। আমার নামে বিভিন্ন মানুষের কাছে দুর্নাম করছে। সৎ হলেও তো মা! কিন্তু আমি তাকে সম্মান ও ভালোবাসা সেভাবেই দিতে চেয়েছি; কিন্তু গু, এমন জিনিস যত দামি পাত্রেই রাখি না কেন? গু, তো কখনো হীরা হবে না।
একটা সময় পারুল বুঝতে পারে অভাবী বাবার সংসারে সব আবদার সবসময় করলে তার বাবা পূরণ করতে পারবে না। সেই কথা যদি কোনো ভাবে তার সৎ মায়ের কানে গিয়ে পৌঁছায় তাহলে তৈলে বেগুনে জ্বলে উঠবে। তখন শুরু হবে নতুন এক ঝামেলা। এতকিছু না করে পারুল সিদ্ধান্ত নেয়।
বাবা যেহেতু, আমাকে মামার বাড়ি রেখে পড়াতে চাইছে, নিজের কষ্ট হলেও সেখানে থেকে লেখাপড়া করা উচিত। এই ভেবে কাউকে কিছু না বলে পরের দিন ঠিক মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
ফিরে আসবর সময় বাজারের মোড়ে সুমনের সঙ্গে কাকতালীয় ভাবে দেখা হয়ে গেল পারুলের।
সামনে একটু এগিয়ে যেতেই পাশে এসে চুপে স্বরে বলল,
-প্লিজ! পারুল রাগ করিস না। তোকে একটা কথা বলতে চাই।
-এতো বাহানা করবার কি আছে; বলে দে শুনি?
-না আগে বল,
কারো কাছে বলবি না।
-বিশ্বাস না হলে বলিস না। আমি কথা দিতে পারবো না।
-ওরে বাবা , তোর যে এতো জিদ তা তো জানতাম না।
- এখন জেনেছিস, তাহলে সামনে থেকে চলে যা। আশে পাশের মানুষ দেখলে খারাপ ভাববে। তাছাড়া আমি মামা বাড়ি থেকে লেখা পড়া করছি, তোর সঙ্গে কথা বলা দেখলে কেউ সহজ ভাবে বিষয়টা নেবে না। তার বিশেষ কারণ তুই ভাল করেই জানিস। তোর বাবাতো আমার মামার পুকুরে হিংসা করে বিষ দিয়েছিল। সেই ঝামেলা এখনো শেষ হয়নি। মামি তোর সঙ্গে কথা বলা দেখলে আমাকে খুব খারাপ মনে করবে। তাছাড়া মামি সেদিন তোকে খেয়াল করেছিল।
-আচ্ছা পারুল,
তোকে যদি আমি একটা চিঠি দেই নিবি তুই।
-জানি না।
-কেন? জানিস না।
কথা না বলে হাটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে পারুল দ্রুত চলে গেল। রাস্তার দু’ধারে সবুজ বৃক্ষের পাতাঝড়া শব্দের সঙ্গে বুকের ভেতর থেকে বেজে উঠল প্রেমময় এক আনন্দ। পেছন ফিরে দুবার তাকাতেই আমার বুকের ভেতর কেমন কেঁপে কেঁপে উঠল। আমি আর একটু এগিয়ে যেতেই অদৃশ্য হয়ে গেল পারুল। মনে হল গরম চা হাতে ঢেলে পড়ল।
-কি রে পারুল একদিন না যেতেই চলে আসছিস যে, তোর সৎ মা কি খারাপ আচরণ করেছে,
-না মামী সে খুব ভালো মানুষ। আমারে খুব আদর করছে। তোমার কথা জানতে চাইল। তুমি খুব আমাকে আদর কর তা বলেছি।
কথা বলতে বলতে পারুলর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। মামির দৃষ্টি গিয়ে পড়ল পারুলর চোখের দিকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে গিয়ে বলল,
-আসবর সময় কি খেয়ে এসেছিস। মাথা নেড়ে জবাব দিল।
‘না।’
৩.
-শোন খেয়ে নে, আজ ঢাকা থেকে তোর জাহিদ ভাই আসবে। আমারা ফকির বাড়ি যাবো পিঠার চাইল কুটতে, ঢেঁকিতে। এতদিন পর ছেলেটা বাড়ি আসছে; তোর মেঝ মামাকে বললাম, রোকেয়াকে নিয়ে আপনিও আসেন জাহিদের সঙ্গে তার নাকি অফিসে অনেক কাজ আসতে পারবো না। মানুষ একবার শহরে গেলে গ্রামে আর ফিরে আসতে চায় না কেউ যদিও আসে লাশ হয়ে। বেঁচে থাকতে আর ক’জন আসে গ্রামে। তাই না রে পারুল। তোর মেঝ মামা বলেছে, তোর লেখাপড়া ভালো হলে ঢাকা নাম করা কলেজে নিয়ে তোকে ভর্তি করবে।
তোকে নাকি ডাক্তারি পড়াবে, তোর মায়ের না কি স্বপ্ন ছিল। তুই ডাক্তারি পড়বি। আজকাল আর মামারা কারো জন্য এমন করে না। তবুও তোর মেঝ মামা বলেছে,আমার মেয়ে নাই তুই আমার মেয়ের মতো আমার এখানে থেকে লেখাপড়া করলে কি এমন ক্ষতি হত শুনি?
অবুঝ বালিকার মতো মামির মুখের দিকে চেয়ে রইল পারুল। পিঠা বানানোর চাউল কুটা শেষ করে পুকুর পাড় দিয়ে সরু রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে এগাতো লাগল, কাঁকে করে চাউলের গুড়া নিয়ে আসছে মামির সঙ্গে পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে লাগল পারুল। যদিও চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়নি বিষণ্ণ হয়ে কিছু একটা ভাবছে, স্বর্ণলতার দেহের মতো পরিপাটি হয়েছে পারুল। এ যেন গোবরে পদ্মফুল। দেখতে দেখতে চোখের সামনে বছর কীভাবে শেষ হয়ে যায়। মনে হয়ে বেলা উঠার সঙ্গে সঙ্গে বছর শেষ হয়ে যায়।
জাহিদ পারুকে দেখেছিল তখন পারুল ছোট, ক্লাস সেভেনে পড়ত, আর এখন। ক’দিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। দেখেতে দেখেতে মেয়েটা কেমন বড় হয়ে গেল। জাহিদ মেডিক্যালে পড়ছে। তার জন্য আজ এ-বাড়িতে মনে হচ্ছে জামাই আদর চলছে। এখনো আসবর কোন হদিস নাই । দুপুরে পুকুরের থেকে গোসল সেরে হালকা বেগুনী রঙের জামা পরেছে পারুল, দেখতে পরীর মতো লাগছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মাথার-চুল ঠিক করতেই হঠাৎ ঘরের ভেতরে জাহিদ এসে হাজির লজ্জায় দ্রুত বুকে ওড়না টেনে নিয়ে বাহিরে বের হয়ে গেল। জাহিদের সঙ্গে কোন কথা হল না।
মামী উচ্চ স্বরে নাম ধরে পারুল পারুল ডাকতে লাগল, পোড়ামুখী কোথায় গেলি, দেখেছিস জাহিদ এসেছে।
-কি রে তুই এখানে দাঁড়িয়ে কেন?
জাহিদ আসছে ওর টিউবওয়েল থেকে পানি তুলে দে, গোসল করুক। ছেলেটা শহরে থাকে। হঠাৎ করে পুকুরে গোসল করলে, হয়তো ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে।
-ঠাণ্ডা লাগবে কেন? সে নাকি ডাক্তার।
-ক্যান ডাক্তার মানষির বুঝি ঠাণ্ডা লাগে না।
জাহিদ ঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াল,
চাচি, তোমার সঙ্গে মেয়েটি কে?
কেন?
ওকে চিনতে পারছিস না, তোর রোজী ফুফুর মেয়ে। তোকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো তোর রোজী ফুফু। তুই তখন খুব-ছোট তোকে কোল থেকে মাটিতে নামতে দিতো না। তোকে খুব আদর করত।
-পারুল দেখছি, বড় হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে কথা বলছে না।
লজ্জা পেয়ে পারুল টিউবওয়েলের দিকে একটু এগিয়ে গেল। বালতি ভরে, গামছা নিয়ে জাহিদের হাতে দিয়ে বলল,
-পানি দিয়েছি, গোসল করে নিন।
-পারুল তোর এত লজ্জা কেন রে!
আমি কি তোর পর মানুষ।
- আমি কি বলেছি, আপনি পর মানুষ।
সকালে হঠাৎ ভীষণ জ্বর পারুলর গা মনে হচ্ছে পুড়ে যাচ্ছে। জাহিদ শরীরে হাত স্পর্শ করতেই কেমন কেঁপে উঠল।
চাচি ওকে দ্রুত একটা হাসপাতালে নেওয়া দরকার। বারেক ভাইকে ডাক দিন ভ্যান নিয়ে আসুক।
আচ্ছা চাচি, পারুল কি খুব মানসিক চিন্তা করে?
ছেলের যে কথা, মা মারা মেয়ে চিন্তা তো একটু করবোই।
ঠিক তা না, আমি বলছিলাম। লেখাপড়া নিয়ে কি বেশি চিন্তা করে, বাবা তো বলেছে, কলেজ শেষ হলেই ঢাকা নিয়ে ভর্তি করে দেবে। বলবেন চিন্তা না করতে।
কিছুক্ষণ পরে সজ্ঞানে ফিরে আসল পারুল, জানতে চায় সে এখানে কীভাবে এলো। ডাক্তার কিছু ওষুধ দিয়ে বলল,
-ঠিক মতো খেতে বলবেন। পেশার লো হয়ে ছিল। রাতে হয়তো ভালো ঘুম হয়নি। খাবার ঠিক মতো খেতে হবে। দুপুরে না খেয়ে ছিল। না খেয়ে থাকা খুব বোকামি এমন করা ঠিক নয়।
-কি ব্যাপার তোমার ছেলে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এবার দেখছি, আসার নাম গন্ধ নেই, একটা খবর নাও দেখ অসুস্থ হল কি-না। জাহিদ তো কখনো গ্রামের বাড়িতে এতদিন থাকে না।
-ঠিক আছে দেখি আজ ওকে ফোন দেবো। এ নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না।
জাহিদ এবার গ্রাম থেকে যাবার সময় কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। পারুলর প্রতি সে দুর্বল হয়ে পড়ছে মনের গভীরে তাকে নিয়ে সাত পাঁচ ভাবনায় ডুবে আছে। পারুল তাকে নিজের কাছে সপে দিতে নারাজ নিজেকে অযোগ্য মনে করেই নিজেকে আড়াল করেছে। তার মনের ভেতরেও জাহিদের জন্য মায়া বেঁধেছে, মনের গভীরে তা রয়ে গেল অপ্রকাশ্য।
দু বছর পর!
দিনদিন পারুল অসুস্থ হয়ে পড়ল। এদিকে জাহিদ ইন্টার্র্নি শেষ করে নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছে; পারুল মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। জাহিদের মা স্বপ্ন দেখেছিল, পারুল তার ছেলের বউ হয়েই এ-বাড়িতে থাকবে। জাহিদ একটা সময় নিজের মনের কথা পারুকে সব খুলে বলে। জাহিদ সত্যিকার অর্থে পারুকে মন থেকে ভালোবেসে ফেলে কিন্তু পারুল ভালবাসলেও তা প্রকাশ করেনি। পারুলর মনের ভেতর বার বার জানান দিয়েছে। হয়তো এ পৃথিবী আলো বাতাসে সে হয়তো বেশিদিন নেই। একটা সময় রক্ত বমি শুরু হল। ভয় পেয়ে গেল বাড়ির সবাই। হাসপাতালে ভর্তি করা হল পারুকে। পাশে থেকে সব রকম সাহায্য করছে জাহিদ। কিন্তু পারুল দিনদিন নিস্তেজ হয়ে পড়ল। ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে একটা সময় জানিয়ে দেয় তাকে বাঁচানো সম্ভব না। মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পরে পরিবারের সবাই।
হাসপাতাল থেকে পারুকে বাসায় নিয়ে আসতে হয়। নিজের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা হতে লাগল জাহিদের। নিজে ডাক্তার হয়েও নিজের ভালোবাসাকে বাঁচাতে পারল না। দিন যতো কমছে পারুলর মুখাবয়ব ততো পবিত্রায় পূর্ণতা পেয়ে বসলো। চোখের দিকে তাকালে মায়া হয়। এই মানুষটা আর মাত্র কদিন আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে। আর মাত্র ক’ দিন। আমার চোখে চোখ রাখবে না কখনো।
কোনোদিন তাকে দেখব না, স্পর্শ করতে পারব না। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ডাক্তার আকিত সাহেবের ফোন।
হ্যালো, জাহিদ বলছেন,
জি!
আপনি যে পেশেন্ট ভর্তি করেছিলেন, তার রিপোর্ট ভুল এসেছে; তার ক্যান্সার হয়নি।
সরি, আপনাকে সঠিক তথ্যটি না দিতে পেরে আমি লজ্জিত।
কথাটি শোনার পর ভেজা চোখে হেসে উঠল জাহিদ। পারুল তখন পানি চেয়ে বসল, পানি আনতে গিয়ে
ফিরে এসে দেখল, পারুল ঘুমিয়ে গেছে। বেলিফুলের মতো সাদা মুখাবয়ব। কারণে-অকারণে তুমি কাছে আসতে চাইলেও বাঁধা দেবার মত সাহস আমার কখনোই ছিল না। অথচ তুমি ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে আমাকে সবকিছুর আড়ালে রেখে তুমি জয়ী হতে পারনি। মোবাইল ফোনের নোট প্যাডে লিখেছিল পারুল।