গল্প।।গন্ধ।। সাঈদ আজাদ

     ক.

     মাঘ মাস। রাতগুলোতে এখন জাড় পড়ে জবর! ঠান্ডায় একেবারে হাড়ে কাঁপন ধরে যায়। বাড়িটার উত্তর দিক খোলা বলে শীতটা যেন বেশিই লাগে। সূর্য ডুবতে না ডুবতেই উত্তর দিক হতে কনকনে শীতল একটা হাওয়া এসে হামলে পড়ে বাড়ি-ঘরে । সারা রাত আর সকালেও হাওয়াটা বাড়ির আশপাশটায় ঘাপটি মেরে থাকে। অনেকটা বেলার পর রোদটা কড়া হলে, তারপর শীতটা এই বাড়ি ছাড়ে। …মানুষ বলে বটে, মাঘের শীতে এখন আর বাঘ কাঁপে না। আর হাটে-বাজারে গেলে মিজানও কথাটার সত্যতা যেন কিছুটা টের পায়। কিন্তু এই বাড়িটার কথা আলাদা। এই বাড়ির বারান্দায় বাঘ বেঁধে রাখলে সন্ধ্যাবেলা সেও কাঁপবে।

     মিজান আজ শুয়েছে আসমার আগেই। দোকান গোছাতে গিয়ে সারাদিন খুব খাটুনি গেছে। শরীরটা ক্লান্ত। রাতের খাবারও খাওয়া হয়নি। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বরফ-ঠান্ডা ভাত-তরকারি গরম করতে ইচ্ছে করেনি। মুখ-হাত ধুতে গিয়ে ঠান্ডায় যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছিল মুখটা। এখন কম্বলের নিচে শুয়ে অনেকটা আরাম লাগছে। এতক্ষণ ঘুমে চোখ বুজে বুজে আসছিল। কিন্তু শোয়ার পর ঘুম ঘুম ভাবটা চলে গেছে হঠাৎ। ঘুম আর সহজে আসবে না। জানে মিজান। মাঝে মাঝে তার এমন হয়। বাড়ি ফিরতে ফিরতে চোখজুড়ে এত ঘুম নামে, রাস্তায় শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। বাড়ি পৌঁছে বিছানায় গেলেই ঘুম উধাও।

     আসমা এই শীতেও বাইরে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে হাত-মুখ ধুচ্ছে। বিদ্যুত নেই সন্ধ্যা থেকেই। অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে মিজান টিউবয়েলের হাতল নাড়ার শব্দ পায়।  আলসেমি করে মশারি টাঙ্গানো হয়নি। খোলা মুখে একটা দুটো মশা কামড়াচ্ছে। কম্বলের ভেতর থেকে হাত বের করে মশা মারতে ইচ্ছে করছে না। খাক রক্ত। দু চারটা মশা আর কতটুকু রক্ত খাবে!

      আসমা হারিকেন নিয়ে ঘরে ঢুকে। হারিকেনের আলোয় ঘরের বেড়ায় তার ছায়া কাঁপে। ঘরে এসে আসমা হাত আয়নায় মুখে ক্রিম ঘষছে এখন। ভারি সুন্দর একটা গন্ধ পাচ্ছে মিজান। দামীই হওয়ার কথা ক্রিমটা। বোধহয় শ্বশুর কিনে দিয়েছে মেয়েকে। স্বল্প আলোতে আসমার মুখের একপাশ চকচক করছে।


     বলতে নেই, আসমার রূপ আগুনের মত। অমন মেয়েকে বউ করার কথা মিজান স্বপ্নেও ভাবেনি। তার মত লোকের এমনটা ভাবার কারণও নেই। বিয়েটা হয়েছে আসমার বাপের ইচ্ছায়। মিজান জানে, ভালো মানুষ বলেই আসমার বাপ তাকে মেয়ের জামাই হিসাবে পছন্দ করেছে। না হলে, তারতো তেমন কোন গুণ নেই। টাকা পয়সাও নেই। নেই কোন বংশ পরিচয়। তা বলতে কী, মিজানের অই একটা গুণই বোধহয় আছে। লোকে তাকে ভালো মানুষ বলে। আসলে সে ভালো নয়, বোকা। মিজান নিজে জানে সে বোকা!

     আসমার বাপের ধানের আড়ত। মৌসুমে কম দামে ধান কিনে কিনে ধানের পাহাড় করে রাখে। দাম বাড়লে তখন বেচে। মিজান ভ্যানে করে ধান পৌঁছে দিত আড়তে। সে একাই ধান পৌঁছে দেয় এমন না। আরো কতজনই এমন ভ্যানে করে আসমার বাপের আড়তে ধান পৌঁছে দেয়। তাকে বিশেষ ভাবে খেয়াল করার কথা না। তাহলেও করল আসমার বাপ। অবশ্য ছোট একটা কারণও ছিল। অথবা, ওটাই আসমার বাপের কাছে বড় কারণ।

     একবার বাড়িতে কী একটা দুর্ঘটনার সংবাদে আশেপাশে কাউকে না পেয়ে তাকে আড়তে রেখে তড়িঘড়ি বাড়িতে গিয়েছিল তার শ্বশুর। তখনো অবশ্য শ্বশুর হয়নি লোকটা। আড়তে বসে দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছিল না মিজান। হাটবার বলে বস্তার পর বস্তা ভর্তি ধান ট্রাকে উঠছে। আরেক দিকে ভ্যানকে ভ্যান ধানের বস্তা আসছে আড়তে। এক ব্যাপারী যেতে না যেতেই আরেক ব্যাপারী হাজির। এক ভ্যানের পর আরেক ভ্যান। এতদিন দেখেছে বটে, এই আড়তে ব্যবসা ভালো। তাই বলে এতটা! আন্দাজ করতে পারেনি মিজান। নগদ টাকা গুণে কুল পাচ্ছিল না সে। যেমন বিক্রি হচ্ছে, তেমন কেনাও হচ্ছে। তারপরও অনেক টাকাই রয়ে যাচ্ছিল ক্যাশে। এক দিনেই এত টাকার বেচা-বিক্রি হয়! মাসে না জানি কত!

     শ্বশুর অবশ্য বাড়ি সামলে বিকালের দিকেই ফিরে আসে আড়তে। মিজান তখনো ঘাড় গুঁজে টাকা গুণছে। দুপুরে যে খাবে সে সময়ও পায়নি। খেতে গেলে দোকানে রেখে যাবে কাকে? আর টাকার বোধহয় কী এক ক্ষমতা আছে! অত টাকা নাড়তে নাড়তে ক্ষুধাটা যেন টেরই পাচ্ছিল না মিজান। 

   শ্বশুর ফিরেই জানতে চাইল, তুমি বাইরে গিয়েছিলে এর মধ্যে?

   সুযোগ পেলাম কই! ট্রাকের পর ট্রাক ভর্তি ধানের বস্তা উঠছে। এদিকে ভ্যান ভর্তি ভর্তি আসছে। টাকা গুণে-বুঝে রাখতে রাখতে নিঃশ্বাস নেওয়ার সময়ও পাইনি।

     দুপুরে খেতে যাওনি?

     না। ক্যাশ কার কাছে রেখে যাব? আপনিতো আমার কাছে রেখে গেলেন।

     আচ্ছা, এখন আমি এসে গেছি। তুমি যাও। খেয়ে আবার এসো। এই নাও, একশ টাকা। খেয়ে এসো। আজ তোমার সাথে বাড়ি ফিরবো। জরুরী কোন কাজ নেইতো?

     হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিতে সংকোচ হয় মিজানের। বিপদ চিন্তা করেই এতক্ষণ কাজ করেছে সে। পারিশ্রমিকের চিন্তা মাথায় আসেনি। বলে, টাকাটা রাখেন। আমার কাছে টাকা আছে। বিকালে আমার কোন কাজ নেই। খেয়ে আসি আমি।

     মিজানের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে টাকাটা পকেটে পুরে, শ্বশুর বলেছিলেন, এসো খেয়ে। এক সাথে ফিরবো।

      কাছেই সস্তার একটা হোটেল থেকে খেয়ে দ্রুতই ফিরে গিয়েছিল মিজান। প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত বেচা-বিক্রি চলল আড়তে। মিজান এক কোণে বসে বসে দেখল। সন্ধ্যায় মিজানকে নিয়ে আড়ত থেকে বের হয় শ্বশুর। হাঁটতে হাঁটতে তার বাপ-মায়ের কথা, বাড়ি-ঘরের কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে। এসব কেন জিজ্ঞেস করছে ঠিক বুঝতে পারছিল না মিজান।

   বাজারের সবাই জানে সে এতিম। ছোট বেলাই বাবা মারা গেছে। মায়ের আরেক জায়গায় বিয়ে হয়েছে। জায়গা জমি বলতে থাকার দু শতক ভিটা। তাতে একচালা টিনের ঘর।

  কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেন, সিগারেটের নেশা আছে?

   জ্বি না।

   আর কোন বাজে নেশা? আজকালতো ঘরে ঘরে তোমার বয়সীরা গাঁজা ইয়াবা খায়। ওসবের নামই শুনেছি কেবল। চোখে দেখিনি। আর অত টাকা কই আমার! ওসব কিনতেতো টাকা লাগে।

     বিয়ে-শাদী করার ইচ্ছে আছে, না একা একাই জীবন যাবে?

     বিয়েতো করা লাগেই। একা কি আর বাঁচা যায়! কিন্তু আমিতো খুব গরীব। আজকাল মেয়ের বাপেরা আমার মত এতিম আর গরীবের কাছে মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না। মিজান সরল মনে বলে।

     হুম। এতিম তার উপর গরীব। সমস্যাই। … কিন্তু আমার এমন ছেলেকেই পছন্দ। তোমার আর কিছু না থাক, সততা আছে। এটা এই যুগে দুর্লভ! সংসারী হতে চাও?

    জ্বি? মিজান ঠিক বুঝতে পারে না প্রশ্নটা।
    কাল আবার আড়তে এসো। কথা আছে।

    একদিনের আচরণে মুগ্ধ হয়েই মেঝ মেয়েকে তার সঙ্গে বিয়ে দিবেন বলে ঠিক করেছেন তার শ্বশুর। এমন যে হতে পারে, ভাবতেও পারেনি মিজান। কে-ই-বা ভাববে! আজকাল এমন হয় নাকি? অমন সুন্দরীর তার মত মানুষের ঘরে ঠিক যত্ন হওয়ার কথা না। হচ্ছেও না।

    টের পায় মিজান, আসমা তাকে সহ্যই করতে পারে না। আসলে টের পাওয়ার কিছু নেই। বিয়ের পর থেকেইতো আসমা আচরণে বুঝিয়ে দিচ্ছে, মিজানকে তার পছন্দ নয়। ইদানিং আসমার আচরণে বেপরোয়া হয়েছে, এই যা।

    কম্বলটাতে বড় ওম। ওম ওম ভাবটায় শরীরের ক্লান্তিটা কমেছে। হঠাৎ যেন গায়ের ডান পাশটায় কেউ ঠান্ডা পানি ঢেলে দেয়।

     আসমা পাশে শুয়েছে। অনেকটা দূরত্ব রেখে। কম্বল টেনেছে আসমাই। মিজান মৃদু স্বরে বলে, কম্বলটা মনে হয় তোমার দিকে বেশি চলে গেছে।

    যাক। এই কম্বল আমার ভাই সৌদি থেকে পাঠিয়েছে। আমার গায়ে দেওয়ার জন্য। অই পাশে কাঁথা রাখা আছে। শীত করলে গায়ে দিতে পারো।

     মোটা কাঁথা হলেও মাঘের শীত আটকাতে পারে না। যদিও এই কাঁথাতেই বিয়ের আগে শীত আটকাতো। বউয়ের পাশে শীতে কুঁকড়ে শুয়ে থেকে রাত পার করে মিজান। নির্ঘুম। আসমার আচরণে যতটা দুঃখ পাওয়ার কথা, ততটা আর আজকাল পায় না। যে কোন পাওয়াই ক্রমাগত হলে, তার ধার কমে আসে। সুখ। দুঃখ। কী অবহেলা।

     বউ তাকে মানুষ হিসাবে পাত্তা দেয়নি বিয়ের পর থেকেই। বর হিসাবেও মেনে নেয়নি মন থেকে। সুযোগ পেলেই মানুষের সামনে অপমান করে। ঠেস দিয়ে কথা বলে। বাপের কথায় তাকে বিয়ে করতে কেন রাজী হয়েছিল কে জানে! আসমার অতীতে কি কালো কিছু ছিল? থাকলেও জানে না মিজান। কারো কাছে কখনো কিছু জিজ্ঞাসাও করেনি।

    আসমার চোখে মিজানের দোষের কমতি নেই। সে দেখতে ভালো নয়, শুকনো চেহারা। স্বভাবে নরম-শরম। গরীবতো বটেই। আর বড় বেশি ভালো মানুষ। যদিও বিয়ের পর মিজানের অবস্থা অনেকটাই ভালো হয়েছে। বিত্তবান না হোক, সে এখন স্বচ্ছল।  কিন্তু আসমা চেয়েছিল বিত্ত। দুহাতে খরচ করার জন্য প্রচুর অর্থ। সংসার চায়নি। ভালোবাসা চায়নি। সেটা বুঝেই মিজানও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। মুখ বুজে বউয়ের শখ মেটানোর টাকা রোজগার করে যায়। কিন্তু তাতেও বউয়ের দৃষ্টি পড়ে না তার দিকে।  আসমা দিনমান নিজেকে নিয়েই থাকে। পাশের বাড়ি এক বুড়ি এসে রান্না করে দিলে খায় মিজান। রান্না না হলে চিড়া ভিজিয়ে খেয়ে শুয়ে থাকে।

     মিজান রান্না পারে। সেলাই পারে। সুতা দিয়ে কাপড়ে সুন্দর নকশা করতে পারে। ঘর ঝাড়– দিতে, কাপড় কাচতে পারে। একা একা থাকতে থাকতে এসব শিখেছে মিজান। বিয়ের পর প্রথম প্রথম রান্না করতোও। বিয়ের আগের অভ্যাস। এমনকি গোসলের পর আসমার ছেড়ে যাওয়া কাপড় কেচে দিত। মাঝে মাঝে তেমন প্রয়োজন হলে বাড়ি-ঘর ঝাঁটও দিতো। এসবই আসমার করার কথা। কিন্তু সে বাড়িতে পা দিয়েই বলে রেখেছিল, তোমার বাড়ির কোন কাজ আমি করতে পারবো না। আমি বাপের বাড়িতে কোন দিন কাজ করিনি।

   তাই দোকান সামলেও ঘর-গেরস্থালির কাজ মিজানই করত। কিন্তু আসমা তার কাজ করটা পছন্দ করত না। বলত মাগি মানুষের কাজ পুরুষ মানুষ করলে, পুরুষকে আর পুরুষ মনে হয় না। কাজ করবে কাজের মানুষ। বাপের বাড়িতে জনমভর তাই দেখে এলাম। সেখানে আমাদের মেলা কাজের লোক।

   আসমার পছন্দ সেজে-গুজে মোটর সাইকেলে ঘুরা। হলে আসা নতুন নতুন সিনেমা দেখতে যাওয়া। কিন্তু মিজানের অতটা সময় কোথায়! আর অত টাকা খরচ করার সঙ্গতি-ই-বা কই! কিন্তু সেসব আসমা বুঝলেতো।

     লোকে মিজানকে ভালো মানুষ হিসাবেই চেনে। অই ভালো মানুষ হিসাবেই আসমার বাপ তার সাথে মেয়ের বিয়েটা দিয়েছিল। কিন্তু লোকে যে তাকে ভালো মানুষ বলে, এটাও আসমার অপছন্দ। পুরুষ মানুষ নাকি একটা ভালো হতে নেই। একটু আধটু খুঁত না থাকলে মানুষ নাকি পূর্ণাঙ্গ হয় না! তার পছন্দ ডাকা বুকা পুরুষ। আর যার মধ্যে কিছুটা বখাটেপনা আছে।

    রাজু তেমনই একজন ছেলে। বয়সটা পঁচিশের নিচে। আসমার চেয়ে বছর তিনেকের বড়। শ^শুরের আড়তে কাজ করে। শ^শুরের বয়স হয়েছে। একা ব্যবসা সামলাতে পারে না বলে রাজুকে রেখেছে। মিজানকেও গদিতে বসার কথা বলেছিল। মিজান রাজী হয়নি। শ^শুর তাকে ভালো জানে। কোন কারণে উনিশ-বিশ হলে আস্থাটা থাকবে না। অর্থ বড় খারাপ জিনিস। সম্পর্ক খারাপ করতে সময় লাগে না। আর মিজান চাচ্ছে নিজের পায়েই দাঁড়াতে।

     মাঝে-মধ্যে রাজু বাড়িতে আসে। শ^শুর তার হাতে এটা ওটা দিয়ে পাঠায়। রাজু বাড়িতে এলে আসমা যেন খুশিই হয়। আড়ে আড়ে দুজনকে দেখে মিজান। দেখে আর দীর্ঘশ^াস ফেলে। বলতে নেই, দুজনকে খুব মানায়। রাজু সুপুরুষ। লম্বা, চেহারাটায় নায়ক নায়ক ভাব। তার কাপড়-চোপড়, চুলের কাট, হাসি- সবই নজর কাড়ে। গায়ে নিত্য নতুন গন্ধ লাগিয়ে আসে। আড়তে কাজ করে এত টাকা খরচের সঙ্গতি থাকার কথা না। কী জানি, হয়তো সে আড়তের ক্যাশ থেকে টাকা পয়সা সরায়। … তার সামনেই আসমা রাজুর সাথে আকারে-ইঙ্গিতে কথাবার্তা চালায়। হাসাহাসি করে। চা বানিয়ে খাওয়ায় রাজুকে। না সামনা-সামনি কখনো খারাপ কিছু করেনি। আড়ালে কিছু করে কিনা জানে না মিজান। তবে তার মন বলে, আড়ালেও কিছু হয় না। হলে, সে বাড়ি থেকে চলে গেলেইতো আসতে পারে  রাজু। তা না করে মিজান বাড়ি থাকতেই কেন আসে! আসমা আসলে মিজানকে দুঃখ দেওয়ার জন্যই বাড়ি থাকতে রাজুকে আসতে বলে। মতলব খারাপ হলে অনুপস্থিতে আসতে বলতো ।

   এসব ভাবনাতে একটু যেন ভরসাও পাওয়া যায়। কোথাও কি একটু ভালোবাসা আছে? একবারে তলানীতে?

    খ.

   দোকান থেকে সবে ফিরছে মিজান। উঠানে পা দিতেই বলে আসমা, আমি সইয়ের কাছে যাচ্ছি। রাতে থাকবো। তোমার পেয়ারের বুড়িও আসতে পারবে না আজকে। তার মেয়ের না কি বাচ্চা হয়েছে। দুপুরেই বলে গেছে। রাতে রান্না করে খেয়ো নিও। তুমিতো আবার সব রান্নাই পারো। শেষের কথাগুলো ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে আসমা।  

  দারুণ একটা গন্ধ আসছে আসমার গা থেকে। সেজেছেও খুব। মিজান বলে, আমি এগিয়ে দিয়ে আসি? সন্ধ্যা হয়ে গেছে।

     তাচ্ছিল্যের স্বরে আসমা বলে, এগিয়ে দিয়ে ফেরার পথে আবার পথ হারিয়ে ফেলবে নাতো? এমন একটা লোকের সাথে বাপ আমার বিয়েটা কেন দিয়েছিল কে জানে!

     মিজান আর কথা বাড়ায় না। আসমা যে মিথ্যে বলেছে তাও না। গ্রামের লোকেরাও তাকে এমন গোছেরই ভাবে। নরম-সরম, গোবেচারা! যেন সে কোন কাজই পারে না। করে না। মিজানের ইচ্ছে করছিল জানতে, কোন সইয়ের কাছে যাবে। আসমার সই-বন্ধু কোনটারই অভাব নেই। সুন্দর আর সাহসী যারা, বোধহয় তাদের অভাব হয় না বন্ধু বা সইয়ের। 

     আসমা নিজেই বলে, যার জামাই চাল কলের মালিক তার কাছে যাবো। ভেবো না রাতটা থেকেই ফিরে আসবো। সইয়ের জামাই গেছে ঢাকা। একা থাকতে ভয় পায়। তাই আমি যাচ্ছি।

     গ.

      মিজান অন্যদিন সকাল সকালই ঘুম থেকে উঠে। আজও সকালেই ঘুমটা ভেঙ্গেছে তার। এখনো বাইরে আলো ফোটেনি ভালোমত। বাড়িতে একা বলে, আজ দেরিতেই বিছানা থেকে উঠবে ভাবে। সকালের নাস্তাও খেতে ইচ্ছে করছে না। এক সকাল না খেলে আর কী হবে। আরাম আরাম আলসেমি ভাবটা নিয়ে চোখ বুঝে শুয়ে থাকে মিজান। ভাবে, রোদ না উঠা পর্যন্ত শুয়েই থাকবে।

     মিজানকে অবাক করে দিয়ে আসমা খুব সকালেই ফিরে আসে। গেইট থেকে আসমা চেঁচিয়ে রান্নার বুড়িকে ডাকতে থাকে। মিজান ঘুমের ভান করে বিছানায়ই পড়েই থাকে।

    আসমা রান্নার বুড়ির সাথে কী যেন বলে। ঠিক বুঝতে পারে না মিজান। আসমা ঘরে ঢুকেছে বুঝতে পারে। বিছানার দিকে হেঁটে আসছে বুঝতে পারে। হয়তো ভাইয়ের পাঠানো কম্বল টান দিয়ে নিয়ে নিবে। কিন্তু কম্বল সরায় না আসমা। মিজানের বাসী মুখে-ঠোঁটে চুমু খায়। মিজান অবাক হয়। চোখ বন্ধ করে চুপ করে থাকে। সাড়া দেয় না। নড়াচড়াও করে না। আসমার গা থেকে কেমন চেনা চেনা একটা তেলের গন্ধ আসছে। গন্ধটা পরিচিত হলেও তেলটা ঠিক চিনতে পারে না মিজান। তার পরিচিত আর কে যেন ব্যবহার করে এই তেলটা। মনে করতে পারে না মিজান।

    আসমা সকালে নিজের হাতে রান্না করে। কত দিন পরে রান্নাঘরে ঢুকল কে জানে! গরম ভাত আর সরিষার তেল দিয়ে আলু ভর্তা বানায়। ডিম ভাজী করে সুন্দর করে সাজিয়ে মিজানকে খেতে দেয়। মিজান অবাকের উপরে অবাক! একরাতে এত বদলে গেলো আসমা। তার বউ এত ভালো রান্না করতে পারে! তবে, ধোয়া উঠা গরম ভাত, লোভনীয় আলুর ভর্তা আর ফোলানো ডিম ভাজী দেখেও খেতে ইচ্ছে করে না মিজানের। অই গন্ধটা তার নাক থেকে যাচ্ছে না। গন্ধটাই তার খাওয়ার রুচি নষ্ট করে দিয়েছে। কনকনে শীতেও ঠান্ডা পানিতে গোসল করে দোকানে চলে যায় মিজান।

      সারাদিন কাজে-কামে মন বসাতে পারে না মিজান। গন্ধটা যেন নাক থেকে যাচ্ছেই না। তার মুদি দোকান। বাজারের মাঝামাঝি। চলে ভালোই। আজ হাটবার বলে, দোকান সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। দোকান একাই চালায় সে। ইচ্ছে, দোকান আরেকটু বড় হলে একজন কর্মচারী রাখবে। তখন না নিজে একটু আরাম করবে।

       বিকালের দিকে বেচা-বিক্রিতে কিছুটা ভাটা পড়ে। তখন রাজু আসে তার দোকানে। রাজুর আসাতে দোষের কিছু নেই। প্রায়ই তার দোকানে গল্প করতে আসে রাজু। আজ রাজু আসতেই তার মাথার দিকে চোখ যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিজান। লোকের কথা কি আর ভুল হয়? আগুন আর ঘি কাছাকাছি আসলেই অনর্থ। আজকে আর গল্প করার মন নেই মিজানের। রাজুকে বলে, তুমি যাও এখন। আমি দোকান বন্ধ করবো।

    এত তাড়াতাড়ি? মাত্র বিকাল হল। আসলাম তোমার সাথে গল্প করতে। … চা-টা খাওয়াও।
    না, আজকে আর হবে না। তুমি কাজে যাও। আমি বাড়ি যাবো। মনটা ভালো নেই।

  তোমার মন খারাপ মিজান ভাই! কোনদিনতো শুনি নাই, তোমার মন খারাপ। কম দিন ধরেতো চিনি না তোমাকে।

     মিজান কিছু বলে না। তাকায় রাজুর দিকে। রাজুর মাথা ভর্তি চুলের দিকে। ইদানিং রাজুর চুল পড়ছে খুব। ঘন কেশদাম বিরল হতে সময় লাগবে না। মিজান চুপচাপ দোকানের ঝাঁপ ফেলতে থাকে। 

     শেষ বিকালে নির্জন মাটির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে শীতে হুহু করে মিজানের মন। চারপাশটা কেমন নির্জন। মানুষের মন কি এতই মূল্যবান? কোন সাধনায় মন পাওয়া যায়? সাধনা কি লাগে? রাজুর মত লোকেরা কী সাধনায় মন পায়? নাকি তারা মন চায় না। চায় অন্য কিছু?

     বাড়ি ফিরেই মিজান ব্যাগ গোছাতে থাকে। আসমা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কোথাও যাবে তুমি? কাপড়-চোপড় গোছাও যে?

    কোথায় যাবো ঠিক জানি না।…আমিতো বিয়ের পর তোমাকে কিছু দিতে পারিনি আসমা। এই বাড়িটা আর বাজারের দোকানটা রইল। তুমি নিও। তোমার নামে কাগজ করাই আছে। বড় ট্রাংঙ্কটাতে রেখেছি।

      মানে কী! তোমার কথারতো আগা-মাথা কিছু বুঝতে পারছি না।

      আমি চলে যাচ্ছি।

       কোথায় যাবে?

       এখনো জানি না। তোমার গায়ে গন্ধটা পাওয়ার পর থেকেই যাওয়ার চিন্তা করছি।

       গন্ধ! কোন গন্ধের কথা বলছো?

       আসমা, আমি জানি আমি বোকা ধরণের মানুষ। তুমি আমার বাড়িতে সুখে নেই তাও জানি। তোমাকে কত স্বাধীনতা দিয়েছি আমি। প্রতিদানে শুধু তোমার একটু ভালোবাসা চেয়েছিলাম। আর কিছু না।

     আসমা তাকিয়েই থাকে। কিছু বলে না।

     মিজান বলে, আমাকেতো তুমি মানুষই মনে কর না। বিয়ের পর থেকেতো দেখে আসছি। আমার সাথে তোমার বিয়েটা যে তোমার বাপের ইচ্ছায় হয়েছে, সেটা সবাই জানে। তুমি আমাকে স্বামী হিসাবে মন থেকে মেনে নিতে পারোনি। আর পারবেও না। তবু ছোট মুখে একটা বড় কথা বলি। আমি তোমাকে মুক্ত করেই দিয়ে যাচ্ছি। তুমি যাকে বিয়ে করে সুখী হও, তাকেই না হয় আবার বিয়ে কর। লোকের যা ইচ্ছে বলুক। লোকের কথায় কী আসে যায়।… তোমার যেমন পছন্দ, আমিও বলি, রাজু ছেলেটা খারাপ না। তোমার দেনমোহর শোধে সামর্থ হলেও, শোধতো করা হয়নি। দেনমোহরের বদলে আমার ভিটা আর দোকান রইল। 

    হঠাৎ কী হলো তোমার? কাল থেকে কেমন বদলে গেছো? গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করে আসমা।

    অই গন্ধটা!

    গন্ধ? গলাটা হঠাৎ নেমে যায় আসমার। বারবার কোন গন্ধের কথা বলছো।

    ইদানিং রাজুর খুব চুল পড়ছে। আমিই ওকে অই কবিরাজি তেলটা মাথায় দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। যে তেলের গন্ধটা তোমার গা থেকে পেয়েছি।

    আসমা নির্বাক।

    ব্যাগ গোছানো শেষ করে মিজান ধীর পায়ে হেঁটে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। পেছনে তাকায় না একবারও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *