ছোটগল্প।। স্বপ্নভুবনের অধিবাসী।। আবু সাইদ কামাল
ছায়া নড়ে উঠলে পিছনে ফিরে তাকায় বীথি। দেখে নাতনি চম্পা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে বিছানার দিকে এগোচ্ছে। পড়া শেষে ঘুমের সময় নানির সাথে শোয়। বীথির কাছে নানা রকম গল্প শুনে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে…! রাত দশটা বাজে। পাহাড় পাদমূলের ছোট্ট এক খালের নাম পরানখালি। ঐ খালের দক্ষিণ পাড়ে দুই কুঁড়ে ঘরের একটি বাড়ি। চম্পার নানির বাড়ি এটাই। নানির সাথে থাকে চম্পা। মা-বাবা ঢাকায় কাজ করে। রাতের কেরোসিনের বাতি বা হারিকেনের আলোতে পড়ে। গ্রীষ্মের রাতে নানি হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে। চম্পা নানিকে বলে, নানি!
আজকে কোন গল্পটা বলবে ?
-আমি তো মুর্খ মানুষ। কোনোদিন ইস্কুলে যাই নাই। লেখাপড়াও করি নাই। তাইলে প্রত্যেক রাইতে কেমনে গল্প শোনাব!
-তাইলে তোমার জীবনের গল্প বলো!
-আমার জীবন তো বড় দুঃখের। জানসই তো আমার একটা হাত…
-জানি তো।
-এই জন্য তো ছোট বেলা থেকে খেলাধুলাসহ অনেক কিছুই আমি করতে পারি নাই।
-তারপরও যতটুকু তোমার জানা আছে কিংবা তোমার জীবন-কাহিনীর সাথে যে সব স্মৃতি
আছে, তা থেকেই বলো না শুনি!
-ঠিক আছে, তাইলে আমার জীবন-কাহিনী থেকে বলছি, শোন !
এই বলে বৃদ্ধা বীথি যে কাহিনীটা বলে, তা হলো এই:
কৈশোরে পা রেখেই বীথির শাড়ি পরা শুরু। বাড়ির পাশেই আনন্দপুর সরকারি প্রাথমিক ও জুনিয়র হাইস্কুল। যদিও সমবয়েসিদের স্কুলে যেতে দেখেছে, তবে নিজে কোনোদিন বিদ্যালয়ে যায়নি। অভিভাবক বলতে হতদরিদ্র মা। মায়ের পেটে থাকা অবস্থায়ই বীথি বাবাকে হারায়। বাড়ির উত্তরেই তো গারো পাহাড় ঘেঁষা পরানখালি নদী। ছোট্ট নদীটা পার হলেই গারো পাহাড়। ঐ পাহাড়ের অরণ্যে কাঠ কাটতে গিয়েছিল মা ও বাবা। অরণ্যের বিষাক্ত সাপ কামড়ে দিলে বাবাকে ধরাধরি করে মা বাড়ি পর্যন্ত আনতে পেরেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রাণে বাঁচাতে পারেনি। বড় এক ভাই আছে বীথির। মা, বীথি এবং বড় ভাইকে নিয়ে তাদের সংসার। বাবা মারা গেলে সংসারে দেখা দেয় দারুণ অভাব। তখন বাধ্য হয়ে বীথির বড় ভাই বিজয়কে একই গ্রামের স্বপন মোড়লের বাড়িতে বছর ভিত্তিক কাজে দেয়। স্বপন মোড়লের গরু ও মহিষের দুটি বাথান। বিজয়কে মোষের বাথানে নিয়োগ করা হয়। প্রতি বাথানে দু’জন করে রাখাল। মোষের বাথানে আর একজন বয়স্ক রাখাল রয়েছে। স্বপন মোড়লের মাঠ ভরা জমি। তারওপর প্রতিদিন গো-মহিষের দু’টি বাথান থেকেও বাড়তি আয় আসে। গ্রামের বাজারে দুধ বিক্রি করে নগদ টাকা পায়। মাঠভরা জমি চাষ করতেও তো গরু-মহিষ লাগে। দু‘টি মহিষের গাড়ি তার। ধান বা কৃষিজাত পণ্য বহনের জন্য মোষের গাড়ি দু’টি ব্যবহার করে। তাছাড়া হাটে পশুর দামও বেশ। শৈশব থেকে দুরন্ত বিজয় মোষের পিঠে চড়ে মাঠে চষে বেড়ায়। বাথান নিয়ে কখনো চলে আসে উত্তর প্রান্তে একেবারে পরানখালির পাড়ে। তখন বাড়ির পাশের মাঠে মোষের পিঠে বড় ভাইকে দেখে বীথি বলে, মা ওই দেখো! দেখো বিজয় দাদা…।
মোষের পিঠে ছেলে বিজয়কে দেখে মা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। পেটের দায়ে ছোট থেকেই ছেলেটাকে পরের বাড়ি কাজে দিতে হয়েছে। এভাবে রাখালিপনা করে ছেলেটা বড় হতে থাকে। বড় হতে থাকে বীথিও। উৎসবাদি হলে মাঝে-মধ্যে স্বপন মোড়লের বাড়ি থেকে মায়ের কাছে নিমন্ত্রণ নিয়ে আসে ছেলে বিজয়। সেদিন বিজয় এসে মাকে বলে যে, আষাঢ়ের মাঝামাঝি সময়ে আমন ধানের ক্ষেতে পয়লা গোছা দেবে স্বপন মোড়ল। আমন ধানের প্রথম চারা রোপনের দিন স্বপন বরাবরই একটা উৎসবের আয়োজন করে। বীথির মা তো বছরের অভাবের সময় স্বপন মোড়লের কাছ থেকে আগাম টাকা এনে রেখেছে। রোয়া লাগানোর কামলা দিয়ে শোধ করবে। বিজয় বলে গেছে, আগামীকাল মঙ্গলবার আষাঢ়ের পনেরো তারিখ।
আগামীদিন থেকেই রোয়া লাগানো শুরু করবে স্বপন মোড়ল। মা-ছেলের আলোচনা শুনে মা’র কাছে ধানের চারা রোপনের কাজে যাবার বায়না ধরে বীথি। মা বলে, তুই কীভাবে রোয়া লাগাবি?
তোর ডান হাতটা যে…
মায়ের এ কথা শুনে বীথির উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ে। চুপসে যায় সে। কারণ সে জানে তার দুর্বলতার কথা। তবু ফের সে বায়নার ধরন পাল্টে বলে, আমি তোমার লগে গেলেও রোয়া লাগানোর জন্য ক্ষেতে নামব না তো। পয়লা রোয়া লাগানোর তামাশা দেখব।
-আচ্ছা।
এই বলে মেয়েকে সান্ত¦না দেয় মা। বাড়িভিটা ছাড়া বীথিদের চাষাবাদের কোনো জায়গা-জমি নেই। তাই নিজেদের জমিতে পয়লা গোছা দেওয়ার মতো আচারাদি পালন করার সুযোগ তাদেও নেই। কৃষিকাজ ঘিরে ওদের এসব সামাজিক উৎসবাদির জন্য অন্যের মুখাপেক্ষি হতে হয়। নিজেদের জমি নেই বলে মাকে বাধ্য হয়ে অন্যের বাড়িতে কৃষি শ্রমিকের কাজ করতে হয়। বছরব্যাপী চাষাবাদের সময়ে বীথির মা স্বপন মোড়লের জমিতেই রোয়া লাগানো কিংবা ধান কাটার কাজ করে।
সেদিন সকালে পান্তা ভাত খেয়ে মা-মেয়ে রওয়ানা হয় স্বপন মোড়লের ক্ষেতের দিকে। বীথিদের বাড়ি থেকে দক্ষিণে। মাঝ মাঠে। এক ডাকের পথ। সীমান্ত সড়ক সংলগ্ন প্রায় দেড় একর জমিতে গরু-মোষের আটটা হাল চালিয়ে তৈরি করছে পয়লা রোয়া লাগানোর জমি। ছ’জন কামলা আগেরদিন থেকে বীজ তলাতে জালা ভাঙা তথা ধানের চারা উপড়ানোর কাজ করেছে। হাল চাষের পর চারটা গরুর মই দিয়ে ক্ষেত ‘পেকার’ কাজ শেষ করে। তারপর ধানের চারার আঁটি ছড়িয়ে দেওয়া হয় ‘পেকা’ ক্ষেতে। সমান বা পরিপাটি ক্ষেত। তখন সকাল ন’টা বাজে। ওসময়েই রং-বেরঙের পোশাক পরে ক্ষেতে নামতে থাকে ঐ সম্প্রদায়ের রমনীরা। কিশোরী, তরুণী, প্রৌঢ়াসহ প্রায় পঁচিশ-ত্রিশজন নারী পালা ধরে ধানের চারা লাগানোর জন্য ক্ষেতে নামে। সবাই যখন ক্ষেতে নেমে চারা রোপনে লেগে যায়, বীথি ক্ষেতের আইলে মনভার করে দাঁড়িয়ে। সে তো রোয়া লাগাতে পারে না। কারণ, তার ডান হাতটা বিকলাঙ্গ। আর এ জন্যই হাতটা সে শাড়ির আঁচল-তলে লুকিয়ে রাখে। বৃদ্ধা বীথি এ পর্যন্ত বলে নাতনিকে ডাকে। কিন্তু চম্পা ততক্ষণে ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেছে। বৃদ্ধার দু’চোখে ঘুম নেই। বিছনায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করলেও ঘুম আসে না। সে তখন তার অতীতের গল্পে বিভোর হয়।
দুই
একে তো হতদরিদ্র, তারওপর বাবা নেই। ভাই তো অন্যের বাড়িতে বছরবাঁধা কামলা। মা-ও অন্যেও জমিতে কৃষি শ্রমিকের কাজ করে। মাঠে যে সময় কাজ থাকে না, সে সময়ে গ্রামে দিন মজুরের বিপদ। তখন না খেয়ে থাকতে হয়। দুঃসহ দারিদ্র্যের কাষাঘাতে বাধ্য হয়ে তার মা তখন চোরাচালানীর কাজে জড়ায়।
জন্মগতভাবেই বাম হাতটা বিকলাঙ্গ থাকায় শৈশব থেকে অকেজো হাতটা শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখতে অভ্যস্ত বীথি। এভাবে বড় হতে থাকলে এক পর্যায়ে গায়ে-গতরে বসন্তের জোয়ার দেখা দেয়। দেশের বিলুপ্তপ্রায় একটি ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর সদস্য ওরা। কিন্তু কৈশোর থেকে যৌবনের সোনালি পথেও বীথিকে স্বসম্প্রদায়ের কোনো ছেলে বিয়ে করতে আগ্রহ দেখায়নি।
আসেনি কোনো বিয়ের ঘরও।
তবে পেয়েছে ভিন্ন সম্প্রদায়ের দু’য়েকটি বখে যাওয়া ছেলের বাঁকা ইশারা। ওদের একজনকে বেছেও নিয়েছিল। গোপনে ঘনীভূত হয়েছিল তাদের সম্পর্ক। ছেলেটা সাবেক চেয়ারম্যানের বখে যাওয়া ছোটভাই। সচ্ছল পরিবারের সদস্য বলে বীথি দেহদানের বিনিময়ে ছেলেটার কাছ থেকে পেয়েছে কিছুটা আর্থিক সমর্থন। তা-ও আর ক’দিন! হঠাৎ ছেলেটা পুলিশের চাকুরি নিয়ে চলে যায় দূরে। এ গ্রামেরই মদ্যপ সুরুজকে সবাই মন্দ লোক বলে জানে। সীমান্তে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স বলে নিজেকে পরিচয় দেয়। গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে ওদের দালাল বলেও পরিচিত। হতদরিদ্রদের চোরচালানীর কাজে নামিয়ে তাদের কাছ থেকে মাসোহারা নেয়। বিনিময়ে নিরাপদে ওপার থেকে পান, আনারস, কমলা, তেজপাতাসহ কখনো জিরার ব্যবসাও চালায়। এপার থেকে মাছ, শুটকি, মুরগি, ডিম, চাউল ইত্যাদি ওপারে পাচার করে। এ কাজ করতে গিয়েই বীথির বিধাব মায়ের সাথে সুরুজের আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠে।
চোরচালানীর ব্যবসা করে বীথির মা দুঃসময়টা পাড়ি দিতো। তবে মাঠে কাজ থাকলে বীথির মা চোরাচালানীর কাজে যেতো না। মায়ের কাছ থেকে মাসোহারা নিতেই বীথিদের বাড়িতে সুরুজের যাতায়াত। আর এভাবে যাতায়ত করতে করতে বীথির ওপর দৃষ্টি পড়ে সুরুজের। তাদের বাড়ির আঙিনায় ঘুরঘুর করে সুরুজ বীথির দিকে লালসার হাত বাড়ায়। সুরুজ বিবাহিত। ঘরে স্ত্রী-সন্তান আছে। নেশায় আসক্ত থাকে বলে স্ত্রী এবং দুই সন্তানের প্রতি তেমন দায়িত্বশীল না। বীথির উপচেপড়া যৌবন মদ্যপ সুরুজকে আকৃষ্ট করেছে বেশ আগে থেকে। নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে প্রথমে টাকার বিনিময়ে বীথি তার ডাকে সাড়া দেয়। টিকে থাকার প্রশ্নে মা-ও দেয় প্রশ্রয়। এতে প্রথমত: টাকা আসে, দ্বীতিয়ত: চোরাচালানী নিয়ন্ত্রণকারী সুরুজকে বশে রাখতে পারায়, নিরাপদে চালাতে পারে ক্ষুদে চোরাচালানী ব্যবসা।
নতুবা যে না খেয়ে মরতে হবে।
এক পর্যায়ে বীথি আর সুরুজ স্বামী স্ত্রী’র মতো এক ঘরে বসবাসে সম্মত হয়। কিন্তু বীথিদের বাড়িতে সে রকম অতিরিক্ত ঘর নেই। প্রয়োজনের তাগিদে তাই ওরা তাদের বাড়ির সামান্য পুবে, খালের পাড়ে, খাস জায়গায় একটি কুঁড়েঘর বাঁধে। কোনো আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয় না তাদের। স্বামী-স্ত্রী’র ন্যায় ওরা এক ঘরে বসবাস শুরু করে। তবে বীথি কিংবা সুরুজ-কারো পক্ষ থেকে কোনো সামাজিক বাধা আসেনি। আরোপিত হয়নি কোনো ধর্মীয় বিধি-নিষেধ। কারণ, একদিকে বীথি শারীরিক প্রতিবন্ধী। স্বসমাজ বা স্বধর্ম তার প্রতি কোনো সুবিচার করতে পারেনি। অন্যদিকে সুরুজ সীমান্তের ক্ষতাবানদেও প্রতিনিধি। গোপনে সীমিত আকারের চোরাচালানী নিয়ন্ত্রণ করাই তার মূল কাজ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের সোর্সের কাজ করে বলে তার অগাধ ক্ষমতা। তবে নেই ধর্মীয় কিংবা সামাজিক মূল্যবোধ। নেই মান-সম্মানের ভয়ও। যেনো মুক্ত-স্বাধীন মানুষ। কাজেই কাউকে পরোয়া নেই তার। স্ত্রী-সন্তানের জন্য সামান্য পিছুটান। তবে নিয়মিত সংসারের খরচ দিয়ে স্ত্রী-সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালন করে।
এ ভাবে দু-সম্প্রদায়ের দু’জন মানব-মানবী পৃথক বাড়িতে সংসার করতে থাকে। তখন থেকে অন্য দশটি নারীর মতো বীথিও মা হবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। স্বপ্ন-রঙের সতেজ আবীর মেখে নেয় আপন মনে। আর স্বপ্ন-সাধ পূরণ করতে সত্যি সত্যি যখন গর্ভসঞ্চার হয়, তখন সে কী আনন্দ তার! এ জন্য সে সমাজের কারোকে পরোয়া করেনি। গ্রামে সে এতটাই হতদরিদ্র এবং তুচ্ছ যে, ধর্ম কিংবা সমাজ-শক্তি বরাবরই তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের চোখে দেখেছে। মোদ্দাকথা, সে-ও যে সমাজের একজন মানুষ, এটা ধর্ম কিংবা সমাজ কখনো বিবেচনায় নেয়নি। আবার সুরুজও এতটা মদ্যপ যে, সমাজ কিংবা ধর্ম তাকেও মানুষ বলে বিবেচনা করেনি। এভাবে চলতে থাকে তাদের সংসার-জীবন। স্বাভাবিক নিয়মেই শেষে ফুটফুটে এক কন্যা শিশু ঠাঁই নেয় বীথির কোল জুড়ে। যেনো নারীত্বের পূর্ণতা পায়, আনন্দের ঘোরে পড়ে বীথি। মেয়ের নাম রাখে সমলা।
তাদের দাম্পত্য জীবনে আসা মেয়েকে নিয়ে আবর্তিত হয় বীথির জীবন-স্বপ্ন। যে জীবনের জন্য শৈশব থেকে তৃষ্ণার্ত ছিল, মা হবার পর থেকে এ জীবনের স্বাদই তাকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায়। তবে ঘোর মদ্যপের সাথে সংসার জীবনে অনাবিল শান্তি কখনো ছিল না। মাতাল হয়ে রাতে ঘরে ফিরতো সুরুজ। তাকে বশে রাখার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেও তুষ্ট করতে পারেনি বীথি। এক ঘরে বসবাস করলেও ঐ মদ্যপের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। বরং বলা যায়, তাদের মাঝে একটা সমঝোতার সংসার ছিল এটি। মাঝে-মধ্যে গভীর রাতে সুরুজের হাতে মার খেতে হতো তাকে। শারীরিক বৈকল্যের কারণে শুনতে হতো নিন্দাবাক্যের আশ্রাব্য গালাগাল। তবুও সংসারটা ধরে রাখার আপ্রাণ প্রয়াস ছিল বীথির। কিন্তু এক পর্যায়ে বীথির ওপর সুরুজের শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার এতটাই বাড়ে যে, তা থেকে মনে মনে বীথি মুক্তি কামনা করতে থাকে। কিন্তু স্বেচ্ছায় তার কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় নেই। কারণ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দালাল বলে সে এতটাই ক্ষমতাবান যে, এ থেকে মুক্তি পেতে হলে তাকে এ স্থান ত্যাগ করতে হবে। তার সে উপায়ও নেই। তাই মুখ বুঝে সব সহ্য করে যাচ্ছিল বীথি। সমলার বয়স যখন আট-দশ বছর, তখন অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে সুরুজ অসুস্থ হয়ে পড়ে। শায়্যাশায়ী হয় প্রথম পক্ষের স্ত্রী’র কাছে। সেখানে সুরুজকে দেখতে যাবার সাহস নেই। এমনিতে সংখ্যাগনিষ্ঠ সমাজের মানুষ বীথি। ওদের লোকবলও বেশি। নাগালে পেলে সুরুজের প্রথম স্ত্রী এবং সন্তানেরা বীথিকে মারধর করতেও কসুর করবে না। শয্যাশায়ী হয়ে তিনদিনের মাঝেই অকালে পরপারে পাড়ি জমায় সুরুজ। তার মৃত্যু সংবাদে ভেঙে পড়ে বীথি। তাদের সন্তান সমলা তো চিরদিনের মতো বাবাকে হারিয়েছে। এ জন্য সন্তানকে নিয়ে বীথি সুরুজের বাড়ির পাশে তাদের স্বসম্প্রদায়ের এক সদস্যের বাড়ির আঙিনা গিয়ে মুখে আঁচল টেনে দাঁড়িয়ে থাকে। দেখতে থাকে শেষকৃত্যের আয়োজন। দূরে দাঁড়িয়ে মা-মেয়ের মৃতের বাড়ির দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকে। এ দৃশ্য হঠাৎ সুরুজের ছোটভাইয়ের চোখে পড়ে। সে এগিয়ে এসে মা-মেয়েকে নিয়ে মৃত লাশ দেখায়। এ সময়ে অসহায় কান্নায় ভেঙে পড়ে বীথি। কাঁদে পিতা হারা শিশু সমলাও।
যতক্ষণ মরদেহ বাড়িতে ছিল, ততক্ষণ ওরা বাড়ির আঙিনাতে অবস্থান করে। তারপর সমাজের মানুষ যখন মরদেহ সমাহিত করার জন্য নিয়ে এগোতে থাকে, মা মেয়েও পিছু পিছু যায়। দূরে দাঁড়িয়ে বীথি গালে হাত দিয়ে শেষ ঠিকানায় সুরুজের মরদেহ সমাহিত করার দৃশ্য দেখে। ভিন্ন সম্প্রদায়ের বলে কারো সাথে কথা হয় না ওদের। শেষকৃত্যের কাজ সম্পন্ন হলে সমাজের মানুষ একে একে চলে যেতে থাকে। তখন পিতৃহারা শিশু সমলাকে নিয়ে প্রায় আধাকিলো দূরে বাড়ির দিকে মাটির সড়কপথে হাঁটতে থাকে বীথি। মেয়ের মুখাবয়বে চোখের জল নিঃসরণের দাগ লেগে আছে তখনো। মায়ের চোখ-মুখ থেকেও নোনাজলের দাগ মুছে যায়নি। নীরবে বীথি হাঁটে আর শোকাচ্ছন্ন মনে অনেক কিছু ভাবে। নানা রকম দুর্ভাবনা অক্টোপাশের মতো ঘিওে ধরে। ভাবে, খুঁজতে হবে বেঁচে থাকার ভিন্ন উপায়। এসব ভাবনার মাঝেই ভেতরে ভেতরে ঘুওে দাঁড়ায় বীথি। সাথে সাথে আশ্চর্য এক বোধোদয় হয়। সে হাঁটে আর প্রতিটা নিশ্বাসের সাথে উচ্চারণ করে─আজ থেকে আমি মুক্ত-স্বাধীন।
সাথে সাথে আত্মবিশ্বাসে তার চোখজোড়া উজ্জ্বল হয়। এভাবেই সে এমন মুক্তিকে স্বাগত জানায়। তবে সুরুজের মৃত্যুর ঘটনায় আর্থিক দুঃসময় ঘনিয়ে আসে বীথির জীবনে। ততদিনে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে বীথির বিধবা মা-ও। চরম দুঃসময়ে একাই কঠোর জীবন সংগ্রামে নামে বীথি। শুরু হয় বেঁচে থাকার আর এক লড়াই। বাঁচার জন্য সে ক্ষুদে চোরাচালানী ব্যবসা আরও জোরদার করে। প্রতিদিন ওপার থেকে এপারে চোরাই পথে পান, কমলা বা সুপারি প্রভৃতি পাহাড়ি পণ্য পাচারের কাজ করে। একটি হাত বিকলঙ্গ। এমন শরীরে আর কতটুকু পণ্যই বা বহন করতে পারে।
এভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়েই মেয়েটাকে পড়ালেখা করায়। অদম্য চেষ্টায় মেয়েটিকে শিক্ষার আলোয় করে উজ্জ্বল। মর্যাদার একটা স্থানে দাঁড় করায়। এমন করেই হাতাশার সাগর সাঁতরে অর্জন করে আত্মবল। নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে বীথি জীবন জয়ের প্রয়াস চালায়। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর বীথিদের সম্প্রদায়ের একটি ছেলে এগিয়ে আসে সমলার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। সমান্তরাল শিক্ষিত কর্মঠ- একটি ছেলে। মেয়ের এমন বিয়ের প্রস্তাব এলে, পরানখালির পাড়ে ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে, বীথির এত আনন্দ কি আর ধরে? সমলাকে বিয়ে দিয়ে নিজের বাড়িতেই রাখে কিছুদিন। কর্মঠ বলেই ছেলেটা ঢাকায় গিয়ে নিজের কাজ নিজেই খোঁজে। বস্ত্রকলে চাকুরি নেয়। কিছুদিনের পরেই সমলাকেও নিয়ে কাজে ঢোকায়। একটা পার্লারে। ওরা দুজনই উপার্জনশীল। ক্রমে ওরা গ্রামে একটা সচ্ছল অবস্থান তৈরী করে। তখন কে তাদের আর তুচ্ছ বলে!
বছর দুই পরে তাদের ঘর উজ্জ্বল করে পৃথিবীতে আসে চম্পা। মা-বাবা কর্মজীবী বলে চম্পাকে ছোট থেকে নানিই লালন-পালন করেছে। তখন বীথিকেও ঢাকায় মেয়ের বাসায় থাকতে হয়েছে কিছুদিন। চম্পার পর সমলার ঘরে একটা ছেলে সন্তানও এসেছে। সে মায়ের সাথেই থাকে। গ্রামে বাড়ির পাশে স্কুল। ঢাকায় স্কুলে আনা-নেয়া বেশ ঝামেলার ব্যাপার। তাই গ্রামের স্কুলেই মেয়েকে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয় তার মা-বাবা। সেই থেকে নানির সাথে গ্রামের বাড়িতে থাকে চম্পা। পড়াশোনা করে গ্রামের স্কুলে। চম্পা বীথির প্রতিক্ষণের-প্রতিদিনের চলার সাথী হয়ে দাঁড়ায়। তাকে ঘিরে আবর্তিত বৃদ্ধা বীথির জীবন।
গভীর রাত পর্যন্ত নিজের জীবনের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে আত্মকথনে মগ্ন হয় বীথি। ভাবে দুঃখ জয়ের জন্য কঠোর সংগ্রাম এবং তার জীবনের সাহসী অধ্যায়ের কথাও। জীবন সংগ্রাম তো শুরু হয়েছে-সেই শৈশব থেকেই। এতদিনে এই জনপদ এবং পাহাড় পাদদেশের ভূ-চিত্রে কতো পরিবর্তন এসেছে। একথা সত্য যে, কারো চরিত্র বা মুখের চেহারা বহুদিন এক থাকে না। কালের স্পর্শ পড়ে সবখানেই। তেমনটি তার জীবনেও ঘটেছে। আত্মবিশ্লেষণ করে মনে মনে বলে, অভাবে পড়ে তথা বাঁচার প্রয়োজনে এক পর্যায়ে সীমিত পর্যায়ে গ্রামীণ পরিবেশে তাকে টাকার বিনিময়ে দেহদানও করতে হয়েছে। এক সময়ের চারিত্রিক সেই ত্রুটি সময়ে সেরে উঠেছে। অপরাধ জেনেও করতে হয়েছে ক্ষুদে চোরাচালানীর কাজ। চরম দুঃখ-কষ্টে ভরা জীবনের লম্বা ভ্রমণের শেষ পর্যায়ে সমাজে এসেছে তার নিজস্ব একটা অবস্থান। ততদিনে কালের নির্দয় আঘাতে মুখের প্রচ্ছদে এসেছে বার্ধক্যের ছাপ। পাহাড়ি ঢলে যেমন বছর বছর বালু বা পলি ফেলে অনেক নিচু জমি ডাঙায় পরিণত করেছে, তেমনি তার জীবনেও এসেছে আশাতীত পরবির্তন। পরিবর্তন এসেছে তাদের সমাজ জীবনেও। এক সময়ের স্বপন মোড়লও আগের অবস্থায় নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিল। কিন্তু পঁচাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে পট পরিবর্তনের ফলে তাদের সম্প্রদায়ের সমাজজীবনেও নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। ১৯৭৬ সালে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর প্রতিরোধ যুদ্ধের ডাকে কাদের … বাহিনী গঠিত হয়। সীমান্ত এলাকা তখন হয়ে উঠে যুদ্ধক্ষেত্র। প্রায়ই সীমান্ত রক্ষী ও কাদের বাহিনীর মাঝে সংঘর্ষ লেগে যেতো। সে সময়ে সশস্ত্র বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের পরোক্ষ প্রশ্রয়ে দুবৃত্তরা রাতের বেলায় সীমান্ত এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ নীরিহ মানুষের বাড়িতে চালিয়েছে লুটতরাজ। সেই সময়ে স্বপন মোড়লের বাড়ি থেকে চাঁদনি রাতে লুণ্ঠিত হয় গরু ও মহিষের বাথান। সে রাতের ঘটনা আজও বীথির স্মৃতির আকাশে তারার মতো জ্বলজ্বল করে। গরু-মহিষের বাথান যখন দুবৃত্তরা লুট করে নিয়ে যায়, নিরীহ পশুগুলোর হাম্বা হাম্বা আওয়াজ গ্রামের মানুষ শুনেছে ঠিকই। কিন্তু কেউ মুখ খোলার সাহস করেনি। কারণ, তখন যুদ্ধের সময়। যুদ্ধের মাঠে যা কিছু হয় সবই তো বৈধ। যুদ্ধের ডামাডোলে ততদিনে নিরাপরাধ ক’টি গ্রামবাসীর প্রাণও যে ঝরেছে, সে নজীরও এলাকায় ছিল। তাই ওসব অন্যায়-অপরাধে সাধারণ মানুষ কখনো মুখ খোলার সাহস করেনি।
এক বছর চলা ওই যুদ্ধে সেই সম্প্রদায়ের ধনি পরিবারগুলোর অনেকে নিঃস্ব হয়ে যায়। সে আঘাত সইতে না পেরে এক বছরের ব্যবধানে মারা যায় স্বপন মোড়ল। সংসারে দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে। মেয়ে দুটির বিয়ে দিয়েছে বছর কয়েক আগে। ছেলে দুটির মাঝে একজন কিশোর এবং আর একজন যৌবনপ্রাপ্ত হয়েছিল। বাবার জীবদ্ধশায় বড় ছেলেটির বিয়ে হয়েছে। পিতার অবর্তমানে বছর কয়েকের মাঝে ছেলে দুটির অদূরদর্শিতার কারণে ছারখার হয়ে হয়ে যায় তাদের সংসার। প্রায় এক একর জমির উপর থাকা বাড়ি ভিটাটাও শেষ পর্যন্ত বিক্রি করে ওরা কিছুটা উত্তরে গিয়ে বীথিদের বাড়ির কাছে এক খণ্ড পৈতৃক কান্দা জমিতে দু’টি কুঁড়ে ঘরের বাড়ি করে। এভাবে ওরা নিঃস্ব হয়ে যায়। একদিকে দারিদ্র্য, অন্যদিকে অশিক্ষা ও কুসংস্কারের অন্ধকারে পতিত হয়ে ক্ষয়িষ্ণু সম্প্রদায়টি বিলুপ্তির পথে ধাবিত হতে থাকে। গ্রামে তেমন একটি সমাজব্যবস্থার মাঝে আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতার দেখা পায় বীথিদের পরিবার। বীথি কিংবা তার পরিবার এখন কারো মুখাপেক্ষী নয়। স্বয়ম্ভর। এখানেই বীথির তৃপ্তি। এসব ভেবে বীথি মনে মনে বলে, সমাজের আর দশজনের মতো আমারও সংসার আছে। একটা হাত অকেজো হলেও আজ আমি অনেকের তুলনায় ভালো এবং সুখী। শত বাধা সত্ত্বেও আমি টিকে আছি, বেঁচে আছি।
নিজের অজান্তেই কখনো সে মনে মনে ভাবে যে, শেষ পর্যন্ত জীবন যুদ্ধে হেরে যায়নি। স্বাভাবিক সমাজ প্রবাহের সমান্তরাল, প্রতিবন্ধী বীথিও তার ব্যতিক্রম এক পারিবারিক জীবন প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। স্ব-সমাজের রক্ষণশীল দৈত্য তাদের পথ রোধ করতে পারবে কিনা সে জানে না। প্রচলিত সমাজ তাদের আত্মস্থ করে নিয়েছে কিনা, বীথি তাও বুঝে না; সে শুধু বুঝে- সে এবং তার পরিবারের সদস্যরা অন্যদের মতো এখনও বেঁচে আছে, সম্মানের সাথে বেঁচে আছে। বীথি এখন যেনো তার স্বপ্নভুবনের অধিবাসী। নাতি-নাতনির সাথে ফুলের মতন সেও মধুর হাসি মেলে ধরে। বীথি মনে মনে আপন অস্তিত্বের জয়গান গায়। মুক্ত-স্বাধীন জীবনের স্বাদ পেয়ে সে কখনো অপার আনন্দে আন্দোলিত হয়।