ছোটগল্প।। বাবার পাঞ্জাবী।। শামসউজজোহা

আমার স্কুলের সেই বন্ধুর কথা এখনও মনে পড়ে। বাশার। ফিরোজ আহমেদ বাশার। ওর বাবার শখ ছিল বাশারের রেজাল্ট হবে ভাল আর বাশারের নজর ছিল খাবারের দিকে। স্কুলে বাদাম, ঝালমুড়ি থেকে যা কিছু পাওয়া যায় তার সব কিছু। ও নিজেই গল্প করতো শুধু বাইরে গিয়েই নয়, বাসাতেও সে প্রচুর খেতে পারতো। আর সেটা তাকে দেখেও বোঝা যেত।
বাবাকে বাশার ভয় পেত খুব, কারণ তাঁর কড়া শাষন, পড়া না পারলে শেষ পর্যন্ত মার। কাঁদতে কাঁদতে নাক মুছতো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে, সেই অভ্যেসটা প্রায় স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। স্কুলে এসেও প্রায়ই তাই করতো।
ওর এই গল্পটা আমাদের ক্লাসের সবারই জানা, তাই হাসাহাসি করতাম আমরা সবাই। বাশার কথায় কথায় বলতো, বাবা দেখলে মারবে।
তখন আমি বলতাম আমার কোন ভয় নেই কারণ আমার বাবা নেই, তাই মার দেবার ভয়ও নেই।

২.

কলেজের শুরু থেকেই মার অনেক তাড়া ছিল ভাল রেজাল্টের যেন আমি ডাক্তার হতে পারি। ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ার এই তাড়ায় কেটে গেল। ভেবেছি মার খুব ইচ্ছে হয়তো, আমি ডাক্তার হই। কিন্তু সেই ইচ্ছে আর পুরণ হলো না। মা খুব একটা রিআ্যাক্ট করেন নি তখন।

৩.

আমি এখন ভার্সিটিতে। একবার হুট করে কিছু না ভেবেই মাকে বলে বসলাম। আমি মেডিকেলে ভর্তি হতে পারি নি, তোমার কি মন খারাপ? তোমার কি খুব বেশী ইচ্ছে ছিল?
‘ঠিক আমার না, ইচ্ছেটা তোমার বাবার ছিল’ মা বললেন।
সেই থেকে বন্ধুদের কাছ থেকে শোনা বাবার গল্পেগুলো আমার কাছে অধরা স্বপ্ন হয়ে গেল।
সেই থেকেই আমার কাছে খুব মনে হতো বাবা মানে ডাক্তার হওয়া। বাবা মানে স্কুলের পড়ার তাড়া। বাবা মানে নতুন জামা। বাবা মানে ভার্সিটিতে থেকে টাকা চেয়ে চিঠি। বাবা মানে ‘কবে বাড়ি আসবি?’
বাবা মানে ভার্সিটিতে মায়ের হাতে রান্না করা খাবার নিয়ে হোষ্টেল গেটে অপেক্ষা।

৪.

আমার মা শুধুই আমার মা নন, আমার বাবাও। এইভেবে ভুলে গেলাম, ভুলে থাকলাম আমার বাবার কথা, বাবার ছবির কথা।
সেই ভাবেই চলতে থাকলো আমার কর্মব্যস্ত দিনগুলি, এখন অলসদুপুরগুলি কি অবাক করা ব্যস্ততায় কাটছে, ভাববার সময় নেই।
এবার ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যাব আমরা সবাই মিলে ঠিক করলাম। বাবার কথা তবু আমার মনেই হয়নি। মা ভোলেন নি তার বাবার কথা। আমার নানা, নানী দুজনের সাথেই ঈদ করবো এবার।
মা কিনেছেন তার বাবার জন্য নতুন পাঞ্জাবী। আমাকে বললেন কেমন মানাবে রে খোকা তোর নানাকে।
বললাম, ভাল। কিন্তু কিভাবে বলেছিলাম জানি না।
আমি জানি খুব ভাল মানাবে। কিন্তু আমার বাবার জন্য আমি আজ চাইলেও তো আর কিনতে পারবো না একটিও পাঞ্জাবি। সেই কথাটিই কি বারবার আমার কথায়, তাকানোয় ভেষে উঠেছিল?
আমি তা জানি না, সেদিন আমি ঘরের ভেতর লুকিয়ে ফেলেছিলাম, আমাকেই।
দেখলাম আমার কপালে মা হাত রেখেছেন, হাত রেখেছেন আমার বাবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *