ছোটগল্প

ঈদসংখ্যার ছোটগল্প।। আশ্রিতা ।। নুসরাত সুলতানা

মুক্ত  নিজেই তার ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়েছে। ব্যাগে ছোট ছোট কয়েক প্যাকেট ডোরিও বিস্কিট,  ফাইভ স্টার চকলেট লেইস চিপস নিয়েছে। পথে খাবে আর দুই কাজিন বোনকে কিছু দেবে। ভীষণ খুশি সে দিদা বাড়ি যাচ্ছে। কাজিনদের সাথে খেলবে, দাদু বাড়িতে আছে গরু, ছাগল, হাঁস,  মুরগি,  পুকুরে মাছ। সবকিছু ভেবে মুক্ত খুবই উউদ্বেলিত।  আসিফ আর মিতালির একমাত্র ছেলে মুক্ত।  মিতালি  বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস এর সহযোগী অধ্যাপক আর আসিফ একটা বেসরকারি ব্যাংকের এসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট।  মুক্তর স্কুল, আসিফ, মিতালি সবার ছুটি মিলিয়ে একবারই গ্রামে যাওয়া সম্ভব হয়।

আসিফ এর বাবা নেই মা আছেন। রাতের বাসে চেপে আসিফ, মিতালি আর মুক্ত চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। সকালে  যেয়ে পৌঁছে ই গরম ভাত, দেশি মুরগির মাংস, পুকুরের বড় গ্রাস কাপ মাছ দিয়ে ভাত খেয়েই  মুক্ত ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে  গরুকে পাতা ছিড়ে খাওয়ানো নিয়ে। মুরগির বাচ্চা ধরার জন্য তাড়া করা, গরুর বাছুরের সাথে খেলা এসব নিয়ে। মুক্তর চোখেমুখে যেন আনন্দ ধরে না! আসিফ আর মিতালি সাধ্যাতীত চেষ্টা করে মুক্তকে সবকিছু দেয়ার। কিন্তু কোন ভাইবোন না থাকার কারণে  মুক্ত অনেকসময়ই নিঃসঙ্গ বোধ করে। মিতালির ইউনিভার্সিটি শেষ হয় দুপুর আড়াইটায়। বাকি সমটা মিতালি মুক্তকে দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে। আসিফের এক দুর সম্পর্কের খালাও থাকেন মুক্ত কে দেখাশোনা করার জন্য আর একজন বাধা গৃহ পরিচারিকা ও আছেন। মিতালি ও হাপিয়ে উঠেছিল একদম রুটিনমাফিক জীবনে।

মিতালি যেন একমুঠো মুক্তির স্বাদ পেয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আসিফ ও খুব খুশি স্ত্রী সন্তান কে নিয়ে নিজ বাড়িতে আসতে পেরে। খুবই উপভোগ্য সময় পার করছে মুক্ত, মিতালি আর আসিফ। গ্রামের টাটকা সবজি, পুকুরের তাজা মাছ, গাছের জাম্বুরা,  ডাব, পেয়ারা প্রকৃতি অকৃপণ হাতে নিজেকে উজার করে দিয়েছে এখানে। আসিফের বোন সাজেদা দাওয়াত দিয়েছে সবাইকে দুপুরবেলা।  সেখানে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল আসিফ, মিতালি, মুক্ত, আসিফের মা আর আসিফের ছোট ভাইয়ের পরিবার।  এমন সময় আসিফের দুর সম্পর্কের চাচাত ভাই কাঁদতে কাঁদতে এসে বলে চাচী আমার সব শেষ!  আসিফের মা জিজ্ঞেস করেন কি হয়েছে? জামাল জানায়, তোমাদের বৌ মা আর নেই! আসিফ আর আতিক (আসিফের ছোট ভাই) থেকে যায় জানাজা পড়ে দাফন করে দুপুরে সাজেদাদের বাড়ি আসবে। মিতালির শাশুড়ি বলেন, চল মিতালি মরা বাড়ি থেকে একবার ঘুরে তারপর সাজেদাদের বাড়ি যাব। মৃত বাড়ি যেয়ে মিতালি যা বুঝতে পারল তা হল জামালের স্ত্রী ডেঙ্গুতে মারা গিয়েছে।  গায়ে র‍্যাশ ছিল এবং হাসপাতাল নিতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। জামালের দুই বছরের মেয়ে যুবাইদা অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। কেউ শান্ত করতে পারছে না। কিছুই খাচ্ছে না। মিতালি আবার ফিরে এসে মুক্তর চকলেট থেকে চকলেট নিয়ে যায় যুবাইদার জন্য। চকলেট দিয়ে কোলে নিয়ে ফুল, পাখি দেখিয়ে যুবাইদাকে শান্ত করে সাজেদার বাড়ি দাওয়াত খেতে চলে যায়। ভ্যান গাড়ি করে যাবার সময় মুক্ত পুরো চুপ করে আছে।

মিতালি যতবারই জিজ্ঞেস করেছে কি হয়েছে?  ততবারই কাঁদ কাঁদ হয়ে বলেছে অই ছোট বেবিটা মাকে ছাড়া কিভাবে থাকবে? তুমিও কি মরে যাবে? মিতালি ছেলেকে বুকের মধ্যে নিয়ে বলেছে না বাবা আমি অনেকদিন তোমার সাথে বাঁচতে চাই। সারাটাদিন মিতালির ও খুউব মন খারাপ লেগেছে বাচ্চাটার জন্য। তারপর ও নিজের মনকে প্রবোধ দিয়েছে, আল্লাহ উত্তম ব্যবপস্থাপক।

পরের দিন সকালেবেলা মিতালি আসিফকে বলে চল যুবাইদার জন্য কিছু চকলেট, কেক, আর কিছু কাপড় নিয়ে আসি বাজার থেকে। মুক্তও খুব খুশি এই কথা শুনে। বাজার থেকে সব নিয়ে এসে তিনজন মিলে যায় জামালের বাড়ি। মেয়েটাও চকলেট, কেক, খেলনা পেয়ে খুব খুশি হয়ে যায়। মিতালি যখন যুবাইদাকে কেক খাওয়াচ্ছে আসিফ মিটমিট করে হাসছে, মিতালি সেটা খেয়াল করেছে। সেদিন রাতে আসিফ মিতালি কে বলে দেখেছ যুবাইদা কেমন তোমার কোলে কেমন শান্ত হয়ে থাকে? চল ওকে আমরা দত্তক নেই। মুক্তর একটা ভাই বা বোনের জন্য তুমি কি না করেছ! এই ডাক্তার, সেই ডাক্তার!  ল্যাপ্রোস্কপি, ডি. এন. সি,  হরমোন থেরাপি কোনটা করনি! আল্লাহ তোমাকে এই মেয়েটি দিয়েছেন। মিতালি বলে, ওর বাবা আছে, উনি দেবেন কেন? আর আমার এখন চল্লিষোর্ধ  বয়স!  আমি বাচ্চা পালার ঝামেলা নিতে পারবো না। বেশি সমস্যা হলে ওকে আমরা এস ও এস শিশু পল্লীতে দিয়ে দিতে পারি। ভাবী ওখানকার প্রোগ্রাম অফিসার। আসিফ বলে,  না ওকে আমরাই আমাদের সাথে নিয়ে যাবো। আমরা সবাই মিলে ওকে বড় করব। মুক্ত ও এখন নয় বছরের,  মুক্তও ওর খেয়াল রাখতে পারবে। তাছাড়া খালা আছেন, বুয়া আছেন। তোমার খুব কষ্ট হবে না। পরের দিন সকালে মুক্তকে আসিফকে জিজ্ঞেস করে, তুমি অই আপু বেবিটাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাবে? মুক্ত বলে হ্যাঁ আমি ওকে চকলেট কিনে দেব। এরপর আসিফ কথা বলে জামালের সাথে। বলে, জামাল ভাই জুবাইদাকে আমারে দিয়ে দাও। জামাল শুনেই প্রথমে চিৎকার করে ওঠে। বলে কি কস এইসব। আসিফ ধীরে ধীরে জামালকে বুঝায়।  বলে, দেখ জামাল ভাই তোমাকে তো বিয়ে করতেই হবে। সৎ মায়ের কাছে মেয়েটা ভালো থাকবে না। আর আমি যুবাইদাকে খুব ভালো করে মানুষ করব। আর আমি তোমাকে আবার বিয়ের খরচ বাবদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দেব। তুমি যুবাইদাকে লিখিত ভাবেই আমাকে দিয়ে দেবে। একদিকে টাকার লোভ অন্যদিকে মেয়ের ভালো মানুষ হওয়া দুটো লোভ সামলানো জামালের মতো স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়নি। জামাল শুধু বলে আমাকে ওকে দেখতে দিবি তো! আসিফ বলে বছরে একবার যেয়ে দেখে এস। বেশি না যাওয়াই ভালো।  

দেখতে দেখতে ঢাকা চলে আসার সময়। মিতালি মন থেকে এখনো নিতে পারছে না যুবাইদাকে। মিতালি আসিফকে বলছে, আমি মুক্ত কে দিয়েই সম্পূর্ণ। আমার আর বাচ্চা লাগবে না। আসিফ বলে, ও আমার মেয়ে। তুমি এতকিছু ভেবো না। ওকে আমি বড় করব। ঢাকা আসার সময়ে আসিফ জামালের কোলে যুবাইদাকে দিয়ে মোবাইলে একটা ছবি তোলে। বলে দোয়া করে দাও। এখন থেকে ও আদ্রিতা। অনেক খুশি মুক্ত।

সারা পথে অধিকাংশ সময় আসিফ আদ্রিতাকে রেখেছে।  কিন্তু আদ্রিতা মিতালির কাছে আসার জন্য কান্নাকাটি করে। মুক্ত মাঝে মাঝেই খেলনা নিয়ে খেলেছে আদ্রিতার সাথে। পৌঁছে গেছে তারা মিরপুর ডিওএইচ এস এর বাসায়। বাসায় এসে আসিফ বুয়া আর খালাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছে। ওরা যেন আদ্রিতার ঠিকভাবে খেয়াল রাখে সেটাও  বলে দিয়েছে। বাসায় এসে খালা আদ্রিতাকে গোসল করিয়ে, ভালো কাপড় পরিয়ে, নুডুলস রান্না করে খাইয়ে  মুক্তর খেলনা বের করে দেয়। মুক্তও নাশতা খেয়ে আদ্রিতার সাথে খেলে। আজ শনিবার কারোরই অফিস নেই। শুধু মিতালির মুখটাই একটু থমথমে হয়ে আছে। এবার রাতে ঘুমানোর পালা। আসিফ, মিতালি, মুক্ত সবাই এক বিছানায় ঘুমাতো। পাশের একটা কক্ষ পরেই থাকতো। আসিফ খালাকে বলেছে অই রুমটা গুছিয়ে দিতে আজ থেকে সে অই রুমে ঘুমাবে। আর মিতালি মুক্ত আর আদ্রিতাকে নিয়ে নিজের রুমে ঘুমাবে। মিতালি বলে উঠল, আদ্রিতা খালার কাছে ঘুমালে কি অসুবিধা?

আমরা আমাদের রুমে ঘুমাই। আসিফ খুব স্পষ্ট এবং দৃঢ় ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে মিতালির পাঁচ বছর বয়স হওয়া অব্দি তোমার কাছেই ঘুমাবে। কারণ ওর মা চাই তুমি ওর মা। আদ্রিতা ও মিতালির ঘুমের ভেতর মিতালির পিঠের ভেতর লেগে থাকে। 

একরকম আদ্রিতাকে মেনে নিয়েছে মিতালি। কিন্তু খালাকে বলে দিয়েছে মুক্তকে পড়ানোর সময় যেন আদ্রিতাকে কোনভাবে ডিষ্টার্ব না করে। মোদ্দাকথা মুক্তর কোনকিছু ই মিতালি আদ্রিতার জন্য কম্প্রোমাইজ করতে পারবে না। আদ্রিতা ভালো খাবার, ভালো কাপড় আর যত্ন পেয়ে একটা প্রষ্ফুটিত গোলাপ হয়ে উঠছে যেন! আসিফ অফিস থেকে ফিরে মিতালির সাথে দেখা করে দুইবাচ্চার সাথেই সময় কাটায়। আদ্রিতা আসিফকে পাপা ডাকে। মাঝে মাঝেই আসিফ মুক্তকে পড়ানোর সময় আদ্রিতাকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে যায়। সবাকিছু ই সুন্দর চলছিল। হঠাৎই আদ্রিতার জ্বর আসে। জ্বর কিছুতেই নামে না। প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে যাচ্ছে, ডাক্তার দেখিয়ে টেষ্ট করে জানা যায় প্যারা টাইফয়েড। মিতালি সারারাত ঘুমাতে পারে না। সকালে উঠেই ইউনিভার্সিটি যেতে হয়। ইউনিভার্সিটি সেমিষ্টার ফাইনালের সময় কোর্স শেষ করতে হবে। আসিফ মিতালি কে ছুটি নিতে বলে। মিতালি বেশ ঝাজালো কন্ঠে বলে ওঠে একজন আশ্রিতার জন্য আমি আমার ক্যারিয়ারের ক্ষতি পারব না। তাছাড়া  এখন সেমিষ্টার ফাইনাল সামনে। ইউনিভার্সিটি ছুটি দেবে না। আসিফ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে তারপর বলে ওঠে তুমি ওকে আশ্রিতা বল্লে! দেখ একদিন তোমাকে না ওর……! আসিফ অফিস থেকে চারদিন ছুটি নিয়ে আদ্রিতার সেবা যত্ন করে আল্লাহর ওপর ভরসা করে সুস্থ করে তোলে।

দেখতে দেখতে আদ্রিতা বেড়ে উঠেছে। মিতালিও মোটামুটি ভালোভাবেই মেনে নিয়েছে।  শুধু মুক্ত আর আদ্রিতার একটা সুক্ষ ফারাক মিতালির আচর, আচরণ,  প্রকাশ সবকিছুতে বিদ্যমান। কিন্তু আসিফের ক্ষেত্রে সেটা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই উহ্য। মিতালি যখন দুই বাচ্চার জন্য কাপড় কেনে মুক্তর জন্য তিনটা, আদ্রিতার জন্য দুইটা। মুক্তর জন্য কেনে ব্রান্ডের কাপড়,  আদ্রিতার জন্য এমনি দোকান থেকে। সবচেয়ে বড় মাছটা সবসময়ই মুক্তর জন্য।এমনি অনেক ছোট  ছোট ফারাক মিতালির আচরণে বিদ্যমান। আসিফ দু একবার  বলতে চেয়েছে কিন্তু মিতালি পাত্তা দেয়নি। আসিফও দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে চেপে গেছে। 

মুক্ত পড়াশোনা করে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে ইংলিশ ভার্সনে আর আদ্রিতাকে ভর্তি করা হল মিরপুর ক্যান্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে বাংলা ভার্সনে। মিতালির যুক্তি দুই বাচ্চা ইংলিশ ভার্সন হলে তার দেখাশোনা করা মুশকিল হয়ে যাবে।

মুক্তর জন্য দুজন গৃহ শিক্ষক রাখা হয়েছে। মিতালি আসিফকে বলে দিয়েছে পঞ্চম শ্রেনি অব্দি আসিফ যেন আদ্রিতাকে পড়াশোনা করায়।

মুক্ত জেস. এ.  সি.,পি.এস.সি দুটোতেই এ প্লাস পেয়েছে। এবার আরও যত্ন জোরদার করে মিতালি। 

দেখতে দেখতে আদ্রিতা পঞ্চম শ্রেনিতে উঠে যায়। এবার তো গৃহ শিক্ষক দেয়ার পালা। মিতালি বলে আমি পড়াব আর স্কুল কোচিং এ দেব। আদ্রিতা সব বিষয়ে পঁচানব্বই ভাগ নাম্বার পেয়ে জে. এস. সি পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়। আদ্রিতা প্রথম গৃহ শিক্ষক পায় অষ্টম শ্রেণিতে। মুক্ত এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি তে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে মিলিটারি ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (এম. আই.এস.টি) তে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়। আদ্রিতা এস.এস. সি তে জিপিএ ফাইভ পেয়ে আদমজী

ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজে ভর্তি হয়। এইচ. এস.সি তে আদ্রিতা ৪.৮ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। মিতালি বলে আদ্রিতাকে নার্সিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি করতে। 

যাতে দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। 

আসিফ আদ্রিতাকে ইডেন কলেজে কেমিষ্ট্রি অনার্স এ ভর্তি করে দেয়। ইতিমধ্যে মুগ্ধ পাড়ি দিয়েছে আমেরিকার ফ্লোরিডায় এম.এস ও পি.এইচ.ডি ডিগ্রির জন্য। 

এবার একটু একটু করে আসিফ আর মিতালি আদ্রিতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পরে। অফিস থেকে আসলে আদ্রিতাই আসিফকে লেবুর শরবত দেয়, চা/নাস্তা দেয়। মাঝে মাঝেই আদ্রিতা নতুন নতুন খাবার রেসিপি তৈরি করে। মিতালি প্রতিদিন অন্তত একবার মুগ্ধর সাথে কথা বলেই।

আদ্রিতাকে আসিফ বলে দিয়েছে লেখাপড়ায় যেন কোন ত্রুটি না হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেও অনেকে অনেক ভালো কিছু করে। মুল বিষয় হল লেখাপড়া।  আসিফ, আদ্রিতাকে একটা বাংলা আর একটা ইংলিশ দৈনিক পত্রিকা রেখে দিয়েছে। আসিফ চায় আদ্রিতা যেন বি সি এস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করতে পারে। 

আদ্রিতার দেখতে দেখতে অনার্স পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। একদিন আসিফ বলে আজ তুই আর আমি র‌্যাডিসনে ডিনার করব।

আদ্রিতা খুব খুশি হয়ে বলে, মা যাবে না? আসিফ বলে না আমরা বাবা মেয়ে যাব।

আদ্রিতাই সব খাবারের অর্ডার করে। দুজনে ডিনার শেষ করে। আদ্রিতা মায়ের জন্যও খাবার নেয়। এরপর দুজনে মিলে যেয়ে একটু লাউঞ্জে বসে। সেখানে আসিফ কফি অর্ডার করে। আসিফ পকেট থেকে একটা ছবি বের করে দেয়। বলে তোকে একটা মজার ছবি দেখাই। দেখ তো ছবিটা। ছবিতে একটা ছোট মেয়ে শিশু লুঙ্গি পরা এক ভদ্রলোকের কোলে।  আসিফ বলে এই ছোট মেয়েটা কে জানিস? আদ্রিতা হাসি হাসি মুখ করে বলে কে বাবা? আর লোকটা কে? লোকটা কেমন লুঙ্গি পরে আছে। আসিফ বলে, লোকটা আমার ভাই আর মেয়েটা তুই। আদ্রিতা বলে, ও আমাকে নিয়ে গ্রামে গিয়েছিলে বুঝি! আসিফ হ্যাঁ রে মা গ্রামেই আমি মানিক খুঁজে পেয়েছি। 

অই লোকটা তোর জন্মদাতা। আর আমি তোর বাবা। আদ্রিতা প্রথমে বলে, বাবা তুমি আমার সাথে জোক করছ? আসিফ বলে না মা। আজ তোকে আমি সব বলব। তারপর আসিফ আদ্রিতাকে সব খুলে বলে। কিভাবে আদ্রিতা যুবাইদা থেকে আদ্রিতা হয়েছে। প্রথমে আদ্রিতা খুব ভেঙে পড়ে এবং বলে, এইজন্যই মা আমাকে ভালোবাসে না। আমি তোমাদের কেউ না! আসিফ দাঁড়িয়ে মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে বলে, কখনও এই কথা বলবি না। তুই আমার মেয়ে, আমিই তোর বাবা। আমি তোকে কখনো কিছু না বল্লেও পারতাম। কিন্তু তোর জন্ম নিয়ে জানার অধিকার তোর আছে, আমি জানি তুই আমাদের ছেড়ে যাবি না।  আদ্রতা ডুকরে কেঁদে উঠে বলে তুমি, দাদা আর মাই আমার সব। আসিফ বলে এই কথা আজকে শেষ। তোর মা যেন কিছু বুঝতে না পারেন। আর তোর দাদাও যেন না জানে। শোন তোর মাকে দেখিস যখন আমি থাকব না। তোর মায়ের যেন কোন কষ্ট  না হয়! আদ্রিতা গলায় কান্না আটকে চোখের পানি মুছে বলে, বাবা আমি তোমার কথা অবশ্য ই রাখব।

বাসায় ফিরে এসে আদ্রিতা মিতালিকে জড়িয়ে ধরে বলে,” মা তোমার জন্য ডিনার নিয়ে এসেছি। মিতালিও  মেয়ের গাল টিপে দিয়ে বলে;বাপ,  বেটি যেয়ে খেয়ে আসা হয়েছে আর আমার জন্য নিয়ে আসা হয়েছে?  আমি গেলে বুঝি ভাগে কম পরতো। আসিফ এসে বলে, তুমি যে পরিমাণ খাও, 

বলা তো যায় না! মিতালি মেয়ের কাছে অভিযোগ জানায়! আদ্রিতা বাবাকে শাসন করে দেয়, বলে বাবা একদম মায়ের পেছনে পরবে না!

সময়ের এত তাড়া! প্রতিদিন শুধু চলে যায়! আদ্রিতার মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ।   আসিফ নিজে বি সি এস এর জন্য ম্যাথ আর ইংলিশ পড়ায়। মুক্তর ও পি এইচ ডি প্রায় শেষের পথে। ইদানীং মুক্তর ফেসবুক টাইমলাইনে প্রায়ই একটা মেয়ের ছবি দেখা যায় মুক্তর সাথে। বেশ লম্বা প্রায় মুক্তর সমান। ডাগর চোখ, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ।  গতকাল মিতালি দেখেছে অই মেয়েদের বাসায় গিয়েছে মুক্ত। মিতালি জিজ্ঞেস করলে বলেছে আমার চেয়ে দুই বছরের ছোট ও ও পি এইচ ডি করছে। ওরা পুরো পরিবার এখানে থাকে।

আজ সন্ধায় অনেক দিন পর ব্যাল্কনী তে মিতালি আর আসিফ বসেছে চা নিয়ে। বিয়ের পরে মিতালি অফিস থেকে ফিরে সুতি শাড়ি পরে আসিফের সাথে বসে চা খেত। মিতালি মুক্তর নিউজ ফিডে যেয়ে ছবিটি দেখায়। আসিফ বলে, ভালো তো তোমার ছেলের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। মিতালি বলে, আমার ছেলে কি তোমার শত্রু?  ক্যান ওর পেছনে লাগো? আসিফ বলে, আচ্ছা আমি কিছু বল্লাম না,  সময় বলবে। মেয়ের মাস্টার্স শেষ,  বিয়ে দেবে না! মিতালি বলে হ্যাঁ ভালো একটা ছেলে খুঁজে বের কর। আসিফ বলে আচ্ছা। দেখ তো এই ছেলেটা কেমন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকোনোমিকস এ অনার্স, মাস্টার্স করে এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেছে। দুই ভাই, বাবা ব্যাংকার,  মা স্কুল শিক্ষক। মিতালি বলে দেখ একটা ছেলে দেখলেই তো আর বিয়ে  হয়ে যায় না।

দুই পক্ষের জীবন বৃত্তান্ত পছন্দ হয়েছে। এবার ছেলে মেয়ে দেখা করার পালা। অনিক আর আদ্রিতা মিট করবে কোন কফিশপে। ছেলের আর মেয়ের বাবা আশেপাশে কোথাও বসে নিজেদের ভেতর কথাবার্তা সেরে নেবে। অনিকের আদ্রিতাকে খুব পছন্দ হয়েছে। পরিশীলিত, স্মার্ট  মেয়ে। এবার আসে দুই পক্ষের বসে আংটি বদলের প্রশ্ন।  আদ্রিতা আসিফকে বলে অনিককে সব জানাতে। নাহলে কখনও এই বিষয় নিয়ে কথা উঠতে পারে। আসিফ বলে বেশ মা তুই যা চাইবি তাই হবে। আসিফ একদিন অনিককে ফোন করে আসতে বলে। বলে যে তোমার সাথে লাঞ্চ করব আর গল্প করব। অনিক আসলে আসিফ  ওকে নিয়ে একটা দামী রেস্তোরাঁয় বসে। অর্ডার করে ওর পছন্দের কাচ্চি, গলদা চিংড়ি, দেশী চিকেন রোষ্ট। অনিক একটা আকাশী নীল পোলো, শার্ট, কালো জিন্স, আর রীমলেস চশমা পরে  এসেছে।  আসিফের খুব ভালো লাগে অনিককে। মনে মনে ভাবে; নাহ আমার মেয়েটা সুখে থাকবে ইনশাআল্লাহ।  খাওয়া শেষ করে আইস্ক্রীম খেতে খেতে আদ্রিতার জন্ম এবং ওকে দত্তক নেয়ার সব বৃত্তান্ত জানিয়ে বলে যে, ও আমারই মেয়ে। শুধু ওর জন্মদাতা আমার ভাই। অনিক নিঃসংকোচে বলে। এটা কোনকিছু ই না আমার কাছে। জন্মই সব না। আমার কাছে মেধা, মনন, বিশ্বাস আর আচরণ অনেক বড়। তবে এটা আর কাউকে জানানোর দরকার নেই। আসিফ বলে আদ্রিতা তোমাকে জানাতে বলেছিল। তোমার সাথে যেন হিপোক্রেসি না হয় তাই। অনিক বলে, আমি তার মনাসিকতাকে স্যালুট জানাই।

শুরু হয় বিয়ের দিন ক্ষন। এবার ফাইনালি সব সেট হবার আগে আসিফ মুক্তর সাথে কথা বলে। মুক্ত সব শুনে খুশি হয়ে বলে সেপ্টেম্বরে বিয়ে ঠিক কর তাহলে আমি আসতে পারব। এর ভেতর করোনা পরিস্থিতি ও একটু উন্নত হবে। মুক্ত বোনের জন্য অনেক কসমেটিকস নিয়ে এসেছে। ধুমধাম করে আসিফ আদ্রিতার বিয়ে দিয়েছে। দশ ভরি গয়না দিয়েছে। আসবাব পত্র সব দিয়েছে। মিতালি একটু গাইগুই করেছে। আসিফ কানে নেয়নি।

বিয়ে শেষ করে পরের দিন সন্ধ্যায় মুক্ত বাবা মার সাথে চা খেতে খেতে গল্পের ছলে জানায়,  রিনিকে ওর পছন্দ। ওরা কোলকাতার মুসলিম পরিবার। ওর মা ধর্মান্তরিত মুসলিম। আগে হিন্দু ছিল। আগামী বছর পি এইচ ডি শেষ করে ও রিনিকে বিয়ে করতে চায়। আসিফ জিজ্ঞেস করে, মুক্ত দেশে ফিরবে কি না? মুক্ত জানায় ওখানে ভালো কাজ না পেলে ফিরবে। মুক্ত বলে বিয়ের সময় তোমরা আমেরিকা তে আসবে। তারপর সবাই মিলে দেশে এসে একটা রিসিপশন হবে। রিনির বাবা মাও আসবে। রিনির বাবার আমেরিকা তে ফ্রোজেন ফুড আর কসমেটিকস এর ব্যবসা আছে। ওরা দুই ভাইবোন। ওর ভাইয়ের নাম রাজু। প্রগতিশীল পরিবার। ওর বাবা,  মা বলেছেন তোমাদেরকে জানাতে। তোমরা রাজি হলে ওনারাই কথা বলে প্রস্তাব দেবেন। মিতালি বলে, রাতে তোর বাবা আর আমি কথা বলে কাল জানাই। মুক্ত বলে আচ্ছা মা। রিনি খুব ওয়েল বিহেভ মেয়ে। ওরা ধর্ম ও মোটামুটি মেনে চলে।

রাতে ঘুমাতে গেলে মিতালি আসিফের সাথে কথা ওঠায়। মিতালি বলে এই মেয়েকে বিয়ে করালে ছেলে জীবনেও দেশে ফিরবে না। আসিফ বলে কিচ্ছু করার নেই। তুমি, আমি না চাইলে ও একা করবে। আজ নয় কাল। অযথা জল ঘোলা করে লাভ নেই। মিতালি বলে বেশ আর কি তাহলে!

মুক্ত দেশে থাকতেই  একদিন রিনির বাবা মায়ের সাথে কথা বলিয়ে দেয়। জামিল সাহেব (রিনির বাবা) মিতালি আর আসিফ কে আমেরিকা যাওয়ার দাওয়াত পাঠান।আসিফ বলে, জি সে তো আসতেই হবে। একটা সুবিধাজনক সময়ে আসব।

পরের বছর  মুক্তর বিয়ে হয়। দেশে মহা ধুমধামে ছেলের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়। 

আজকাল সেই বিয়ের প্রথম সময়ের মতো আসিফ আর মিতালি সময় কাটায়। হঠাৎ করে মাঝে মাঝেই  বুকের বামপাশে ব্যাথা অনুভূত হয়। ডাক্তার দেখানো হলে অনেক টেষ্ট দেন। টেষ্ট রিপোর্টে আসিফের  হার্টে  প্রায় সত্তুর ভাগ ব্লক ধরা পরে। ডাক্তার বাইপাস বা রিং পরানোর কথা বল্লে আসিফ বলে, কাটাকুটি ছাড়া যা হয় তাই কর ডাক্তার।  বন্ধু ডাক্তার বলে তাহলে খুব মেনে চলতে হবে। 

আসিফ নিয়মিত ঔষধ খাওয়া, হাঁটাচলা  খাওয়া দাওয়া বেশ মেনেই চলেছে। 

শরৎ আসলেই আসিফ খুব আকাশ দেখত। বলত কি অদ্ভুত সুন্দর আকাশ! সেই শরতেই আসিফের আকাশে ঠাঁই হল। মুক্ত আসল একা কারণ রিনির বাচ্চা হবে। যাওয়ার সময় মুক্ত বলে, তুমি আমার সাথে চল আমি তোমার ভিসা এপ্লাই করি। মিতালির এক কথা না! আমি তোমার বাবার কবরের কাছে যেয়ে সবচেয়ে শান্তি পাই। আমি কোথাও যাব না। খুব ভেঙে পরেছে আদ্রিতা। আদ্রিতার ছেলে আবির নানা ভাই বলতে অজ্ঞান ছিল। আদ্রিতা প্রায় প্রতি সপ্তাহে মাকে এসে দেখে যায়। মিতালি ও এখন মেয়ে আর নাতিকে দেখে খুব খুশি হয়!

হঠাৎ করেই একদিন মুক্ত বলে মা রিনির বাবার বিজনেস এর অবস্থা খুব খারাপ। আমরা এতদিন এক বাড়িতে ছিলাম। দুই মাস পরে তোমার নাতি/নাতনী জন্মাবে। রিনির বাবা বাড়ি বিক্রি করে ছোট একটা বাসায় উঠবেন। রিনি তো এখন কাজ করতে পারবে না। বাচ্চা হওয়ার পর অন্তত দুই বছর বাচ্চাকে দেখশোনা করতে হবে। তারপর না হয় কাজের প্রশ্ন। আমার একার আয়ে বাসা ভাড়া বাচ্চার খরচ কি করে সামলে উঠব? মিতালি বলে দেশে চলে আয়। রিনির ছূটি নিয়ে পরে যেয়ে রিনি পি এইচ ডি শেষ করবে। মুক্ত বলে আচ্ছা দেখি। বাচ্চা হওয়ার দুই মাস পরে মুক্ত বলে মা আমি দেশে আসতেছি। মিতালি মহা উৎসাহ নিয়ে মুক্তর নবজাতক পুত্রের জন্য কাঁথা সেলাই করায়। সময় বেশি নেই। নাড়ু বানাচ্ছে আড়ং যেয়ে জামা কিনেছে। মুক্ত এসেই দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। মোট দুইটা ফ্ল্যাট আর চার কাঠা জমি। একটা ফ্ল্যাট আর জমি বিক্রি করে প্রায় আড়াই কোটি টাকা হয়। আর পঞ্চাশ লক্ষ মিলে একটা বাড়ি আমেরিকা হয়ে যাবে। দুইদিন পর আদ্রিতাকেও আসতে বলেছে। এবার সরাসরি মিতালির সাথে কথা বলছে মা, আমি একটা ফ্ল্যাট আর জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সম্পদ তো প্রয়োজনের জন্যই আর আমি তো একমাত্র ছেলে। আর এই ফ্ল্যাট টা আমি আদ্রিতাকে দিতে চাচ্ছি। আদ্রিতা তোমার দেখাশোনা করবে। তাছাড়া আমি তোমাকে মাঝে মাঝে টাকা পাঠাব। এই ফ্ল্যাট টা তোমার পেনশনের টাকায় শেষে কেনা। তুমি আর বাবা শেষ অব্দি এখানেই থেকেছ। এটা তাই আদ্রিতাকে দিলাম। আদ্রিতা দেখেশুনে রাখবে। আমার আর চার দিন পরে ফিরে যাবার ফ্লাইট। 

মুক্ত চলে যাবার পর একদিন আদ্রিতা আসে বলে মা তোমার জামাই এই ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে চায়। ওটা ওর বাবার দেয়া ফ্ল্যাট ও ওখানেই থাকতে চায়। আমি বলেছিলাম সবাই মিলে এখানেই থাকি কিন্তু কিছুতেই আমি পারলাম না। তোমার খাট, বুক সেল্ফ আর আলমিরা আমি বলেছি নিয়ে যাব। তাছাড়া তোমার জামাই বলে, মা একা একা থাকে আবীরের সাথে থাকবে। মিতালির মনে পড়ে সেই পাঁচ লক্ষ টাকার চেক যেদিন আসিফের প্রথম বুকে ব্যাথা ধরা পড়ে সেদিন হাতে দিয়ে বলেছিল, শুধু তোমার বিপদের দিনের জন্য। কাউকে দেবে না। মনে পড়ে বহু আগের এক রাতের কথা,যেদিন আদ্রিতার জ্বর হলে মিতালি বলেছিল একজন আশ্রিতার জন্য আমি আমার ক্যারিয়ারের ক্ষতি করতে পারব না। সেদিন আসিফের অনুহ্য কথাটা কি ছিল! দেখ তোমাকে না একদিন ওর আশ্রিতা হতে হয়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *