ঈদসংখ্যার ছোটোগল্প।। জলশিহরন।। কানিজ পারিজাত

অদ্ভুত এক শিহরনে ঘুম ভাঙে রায়হান সাহেবের। ইদানীং প্রায়ই ঘটছে এমন। ভেতরের চাপ চাপ উত্তেজনা একটু পরপর শিহরন তৈরি করছে। শিহরনের সাথে সাথে আরো একটা ব্যাপার ঘটছে। তিনি একধরনের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন, জলের শব্দ। ছল-ছল-ছলাৎ।
ভোর হয়ে এসেছে। বিছানা থেকে নেমে তিনি ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। কী মিষ্টি ঠান্ডা বাতাস। আহা! ভেতরটা যেন জুড়িয়ে গেল! হঠাৎ ব্যালকনির একপাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের বনসাইয়ের ওপর নজর যায়। রায়হান সাহেব খেয়াল করলেন─ তিনি যেন গাছটির দিকে সরাসরি তাকাতে পারছেন না। কেমন এক ধরনের লজ্জামাখা আড়ষ্টভাব আসছে─ ধ্যাৎ!
বিষয়টা শরিফের জন্যই হয়েছে। শরিফ এমনভাবে গতকাল বিষয়টা নিয়ে কথা বলছিল─
─বুঝলে রায়হান, পাতাগুলো ছেঁটে দিতে হবে। যখনই দেখবে একটু বড়ো হচ্ছে─ জল চায়, আলো চায়, হাওয়া চায়─ অমনি কাটো। ডাল কাটো, পাতা কাটো─ জল হাওয়া কমিয়ে দাও!
রায়হান সাহেব বলেছিলেন─
─এভাবে কষ্ট দেব?
─এটাই নিয়ম। না হলে বেড়ে উঠবে যে─ ডালপালা দিয়ে তোমায় পেঁচিয়ে ধরবে!
পেঁচিয়ে ধরার কথায় রায়হান সাহেবের কেমন লজ্জামাখা আড়ষ্টতা এসেছিল। কেমন একটা শিহরন! তিনি শুনতে পেয়েছিলেন শব্দ─ জলের শব্দ─ছল-ছল-ছলাৎ!
বেশ খানিকটা আড়ষ্টমুখে কৃষ্ণচূড়ার বনসাইয়ের দিকে তাকিয়ে রায়হান সাহেব ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। ভেতরের ঘর থেকে শাহানার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। ইদানীং ব্যাপারটা বেড়েছে। আসলে গত কিছুদিনের ঝড়ে ঘরের পরিবেশটা গুমোট হয়ে আছে। শাহানার মেজাজ তিরিক্ষি─ অবশ্য শাহানার মধু মেজাজের আবেশ ভুলেছেন তিনি বহু আগেই। পঁয়ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনের শুরুতে মিষ্টি আমেজ দিয়ে শুরু হলেও মধ্য ও শেষভাগে এসে ঝাল আর তেতোটাই প্রকট হয়েছে।

─খালু আপনার নাশতা কি এখনই দিয়ে দেব? কাজের মেয়েটা এসে দরজায় দাঁড়ায়।

─রায়হান সাহেব ‘হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন।

ঘরের ভেতরে মুখের ভাব স্বাভাবিক রাখতে হবে─ কিছুতেই তার মনের ভাব যেন মুখে ফুটে না ওঠে। রায়হান সাহেব নাশতার টেবিলে আসতেই শাহানা ঝামটা দিয়ে বলে উঠল─

─আমরা কি কিছুই করব না?

─এইভাবে চুপ করে বসে থাকব?

রায়হান সাহেব নিশ্চুপ।

শান্ত মুখে বলেন─ ফারহান কোথায়?

─তুমি কি ছেলের কথা ভাবো? সেই সময় আছে তোমার? অশান্তিতে অশান্তিতে ছেলেটার কী হাল হয়েছে দেখেছ? রায়হান সাহেব কথার উত্তর দিলেন না। চিরটাকাল এসব অশান্তি থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন। খুব সুন্দর এক শিহরনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন তিনি─ এক অদ্ভুত গভীর অনুভূতি। জাগতিক হালকা ও তিক্ত বিষয় দিয়ে মনের এই সুন্দর অনুভূতিটুকু নষ্ট করতে চান না।

টুং করে একটা মৃদু আওয়াজ হলো─ রায়হান সাহেবের মুঠোফোনে। নীল রঙের ওয়াটারপ্রুফ স্মার্ট মুঠোফোনটি রায়হান সাহেবের দারুণ প্রিয়। এ যেন এক জাদুর বাক্স─ রহস্যের ভুবন! আবার টুং─ রায়হান সাহেব শিহরিত হচ্ছেন─ আবার জলের শব্দ─ ছল-ছল-ছলাৎ।

দুই

বন্ধু শরিফের অফিসটা অভিজাত এলাকায়─ একটি প্রোডাকশন হাউজ। শরিফ তার বাল্যবন্ধু। তিন সন্তানের পিতা শরিফ পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। বেশ কয়েকটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে তার। তবে ইদানীং এই বিজ্ঞাপন নির্মাণের অফিসটার প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছে─ অনেকটা সময় দেয় এখানে। রায়হান সাহেবের আজ এখানে আসার কথা ছিল না; তবু চাপা শিহরন আর উত্তেজনার স্রোতে ভাসতে ভাসতে চলে এসেছেন─ শরিফের সাথে বিষয়টা নিয়ে একটু আলাপ করা দরকার।

─তুই দেখছি এখনও সাদাকালো যুগে আছিস’’’─শরিফ একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে। ভাইরে উত্তম আর প্রদীপ কুমারের যুগ শেষ─ যুগ এখন এমরান হাশমীদের।”

রায়হান সাহেব উত্তর না দিয়ে লজ্জামাখা হাসি হাসেন।
শরিফ আবার মুখ খোলে─
─আরে ভাই, আমার যদি তোর মতো এইরকম চেহারা─ এমন সুঠাম শরীর থাকত, আমি তো সমানে খালি ছক্কা পিটাতাম। রায়হান সাহেব আবার মৃদু হাসেন। শরিফ মিথ্যে বলেনি, আর্কষণীয় চেহারার সাথে মেদহীন পেটানো শরীর রায়হান সাহেবকে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। ষাটের কোটায় এসেও তিনি যেন তেজি চল্লিশ। রায়হান সাহেবের হাতের মুঠোফোনে মিষ্টি একটা আওয়াজ হলো─ টুং; শব্দটা শোনামাত্রই রায়হান সাহেবের মুখে উজ্জ্বল আলো খেলে গেল যেন। সেদিকে তাকিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হাসি দিয়ে শরিফ বলে ওঠে─
─তুমি তা হলে এক ঘাটেই নোঙর ফেললে?
রায়হান সাহেব কেমন এক আবেশী গলায় বলে উঠলেন─
─ঘাটের উপর মায়া পড়ে গেছেরে শরিফ। নোঙর তুলতে পারছি না।
─এইটা তোর একটা দোষ। যেকোনো একটা কিছুকে আঁকড়ে ধরা, একজায়গাতে আটকে যাওয়া। আরে, এত আবেগের কী আছে? উই অল আর রানারস। আমরা সবাই দৌড়াচ্ছি─ এই দৌড়ে থেমেছ কি মরেছ। একদম ট্র্যাক থেকে ছিটকে পড়ে যাবে। আমাকে দ্যাখ, একট্র্যাকে বেশিদিন দৌড়াই না, আর তুই! তুই একটা চিজরে ভাই! এক ট্র্যাকে পাঁচ মাস কীভাবে আটকে আছিস বল তো।
─কী করব, বড্ড মায়া পড়ে গেল যে! রায়হান সাহেব একটু গাঢ় গলায় বললেন।
─মায়া? মাই ফুট! চিনলি না, দেখলি না, কথা বললি না─ অমনি মায়া পড়ে গেল?
─কথা তো হয়।
─কী কথা হয়? ঐটাকে কথা বলা বলে? মেসেঞ্জারে কথা বলছিস; তাও লিখে লিখে, কেউ কাউকে দেখিসনি পর্যন্ত, এতেই মায়া পড়ে গেল? রায়হান সাহেব ভাবালু চোখে তাকালেন, তারপর উদাস গলায় টেনে টেনে বললেন─
─ওর ভিতরে কি যেন একটা আছে জানিস, খুব টানে আমায়! তা ছাড়া ও খুব দুঃখী!
─কে তোর ঐ জলপরী?’ হা-হা-হা─ তা জলে যেহেতু বাস─ মৎসকন্যা, দুঃখী তো হবেই।
অদ্ভুত এক হাসি দিয়ে বলে শরিফ।
রায়হান সাহেব আরও গাঢ় স্বরে বলেন─
─সত্যিই খুব দুঃখীরে, ডিভোর্সি, একটা স্কুলে পড়ায়। ত্রিশোর্ধ্ব এক মহিলা, একাকী কত স্ট্রাগল করে সে টিকে আছে! ক্যান ইউ ইমাজিন!
শরিফ বলে─

─তাতো বটেই! তবে তোরা দুজনই কিন্তু ফেইক, ‘জলপরী’ নিশ্চয়ই তার আসল নাম নয়; আর ‘অর্ণব আকাশ’ নামে তোর ফেইক আইডি তো আমিই খুলে দিলাম! তোরা কিন্তু সেইভাবে কেউ কাউকে চিনিস না বা দেখাও দিসনি।

─দেখা দেবে। রাজি হয়েছে। একটু গাঢ় গলায় উত্তর দেন রায়হান সাহেব।
কে দেখা দেবে, জলপরী?─ বাহ্! জল থেকে তা হলে ডাঙায় উঠে আসছে! ─ ব্যবস্থা করব
নাকি? রিসোর্টে নাকি ফ্লাটে?”
─না, না, যতটুকু বুঝেছি, ও তেমন নয়, আর আমিও─ বুঝিস তো, মানে─ সেভাবে এখনো অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি…

─আরে অভ্যস্ত হতে আর কয়দিন? তবে তোকে একটা কথা বলি─ বেশি ডুবে যাস না! এসব জলপরীদের কোনো ভরসা নেই, একবার ঘাড়ে চেপে বসলে আর নামাতে পারবি না। আর এইজন্যই তো আমি ‘বনসাই থিওরি’ ফলো করি। যতক্ষণ ভালো লাগে আলো দেই, জল দেই, হাওয়া দেই─ যেই দেখি বেড়ে উঠছে, আমাকে লতাপাতা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরতে চায়, তখনই কাটি─ ডাল কাটি, পাতা ছাঁটি।

─মানে

─আরে মানেটা সহজ─ ব্লক করি। সিম চেঞ্জ করি, নাম্বার ব্লক করি─ পারমানেন্ট ব্লক করে দেই।

─রায়হান সাহেব একটু চুপ হয়ে যান।

দরজায় টোকা পড়েছে, পি.এ. এসে জানায়, একজন ম্যাডাম দেখা করতে এসেছেন। শরিফ ভেতরে আনতে ইশারা করে। ভেতরে যে এসে ঢুকল সে উনিশ-বিশ বছরের উঠতি তরুণী। পোশাক ও প্রসাধনীর আড়ালে চাপা পড়েছে আসল সৌন্দর্য। মেয়েটি ঘরে ঢুকে সালাম দিয়ে খুব অভ্যস্তভাবে অফিস রুমে লাগোয়া অন্য একটি রুমে ঢুকে গেল। শরিফ এক অদ্ভুত হাসি মুখে নিয়ে রায়হান সাহেবকে বলল–

─বিজ্ঞাপনের মডেল হবে, ভাইভাটা একটু নিয়ে আসি।

পাশের রুমটা শরিফের ’বিশ্রাম-কক্ষ’ ছিল বলেই জানতেন রায়হান সাহেব; সেটা যে এখন

‘ভাইভা রুম’ হয়েছে তা আজ জানলেন। সেইসাথে ইদানীং প্রোডাকশন হাউজটার ওপর শরিফের ঝুঁকে পড়ার কারণটাও বুঝলেন।

তিন

শরিফের দেরি দেখে রায়হান সাহেব বেরিয়ে এসে গাড়িতে ওঠেন। শাহানার ফোন এসেছে, বাসায় যেতে হবে তাড়াতাড়ি। পঁচিশ বছর বয়সে হাত ধরে ছিলেন বছর ঊনিশের শাহানার। ভেবেছিলেন একসাথে দাঁড় টানবেন জীবনের– অথচ জীবন কী বিচিত্র! উজানে যে দাঁড় টেনেছিলেন দাপটের সাথে, ভাটিতে এসে সে দাঁড় আর চলে না। পাশাপাশি চলতে চলতে কখন যে দুটো চেনা মানুষ একে অন্যের অচেনা হতে লাগলো, একই ঘরে দুটো রুম আলাদা হলো, দুজনের পছন্দ-অপছন্দে ভিন্নতা এলো। পেশাগত জীবনে সফল রায়হান সাহেব একটি বহুজাতিক কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। সাফল্যের পেছনে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ একটা সময়ে রায়হান সাহেবের কেমন দমবন্ধ লাগতে শুরু হলো, ঐশ্বর্য আর বস্তুগত সমৃদ্ধির খোঁজ রাখতে রাখতে শাহানা সে দমবন্ধের খোঁজ আর নিতে পারেনি। রায়হান সাহেবের মনে হতো তিনি যেন এক ধূ ধূ বালির মরুভূমিতে একা-তৃষ্ণার্ত,জলতেষ্টায় বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে! জলের খোঁজ করতে করতেই ‘জলপরীর সন্ধান লাভ’ হাতের মুঠোয়─ নীল রঙের ডিভাইসে।

বন্ধু শরিফ, ফিরোজ, বেলায়েতরা এপথে হাঁটছিল বেশ কিছুদিন─ শরিফের কৃপাতেই এই নতুন রঙিন ভুবন─ জলপরীর ভূবন! আহা! জলপরী─ জলকন্যা─ জলে ডোবে─ জলে ভাসে─

আমারে ভাসিয়ে নাও তোমার সাথে,

ঐ দূর মোহনার নীল জলে─ ঐ উজান স্র্রোতে।

অদ্ভুত এক শিহরনে চোখ বন্ধ করে আছেন রায়হান সাহেব। জলের শব্দ─ ছল-ছল-ছলাৎ! ঝাঁকুনিতে ঘোর ভাঙে রায়হান সাহেবের। গাড়ি থেমে গেছে─ বাসায় পৌঁছে গেছেন তিনি। রায়হান সাহেব ড্রইং রুমে ঢুকে দেখেন শাহানার সাথে তার শ্যালিকা রুবিনা ও শ্যালক মাহতাব বসে আছে। জরুরি বৈঠক বোঝা যাচ্ছে। শাহানাই প্রথম মুখ খুলল─

─আমি তো কবে থেকেই বলছিলাম, তোমার তো গায়েই লাগে না।

রায়হান সাহেব গম্ভীর মুখে বলেন─ বিষয়টা কী?

─ঐ ডাইনিটা, ঐ শয়তানিটা নাকি আমার ছেলের নামে মামলা করবে! ও নাকি ফারহানকে বলে দিয়েছে─ ফারহানের সাথে নাকি আর নয়, এবার করবে মামলা! কী যেন─ ও হ্যাঁ, ‘ডমেস্টিক ভায়োলেন্স’ না কি যেন বলে, এই নিয়ে নাকি সে মামলা করবে; শোনো, এইবার আমরাও দেখিয়ে দেব। পাঁজি, বজ্জাত, ছোট লোকের মেয়ে; ওর জিব আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলব। আমার ছেলে তো ওরে ঠিকমতো সাইজ করতে পারে নাই। এইবার আমি ওরে সাইজ করব। তাকে থামিয়ে দিয়ে মাহতাব বলে ওঠে─

─আহ্! তুই থাম্! মাথা গরম করিস না, আমাকে একটু বুঝিয়ে বলতে দে─ বিষয়টা ডমেস্টিক ভায়োলেন্স শুধু না; তারা যদি যৌতুক বা ফিজিক্যাল বা মেন্টাল টর্চার বা খোরপোষের দাবিতে মামলা ঠোকে তাও আমাদের ফারহানের কিন্তু ভোগান্তি আছে।

রায়হান সাহেব ধীরস্থির ভাবে বলেন─ ন্যান্সিরা কি আসলেই মামলা করেছে?

তাকে থামিয়ে দিয়ে মাহতাব বলে ওঠে─ দুলাভাই, এইসব কেইসে আগে থাকতেই প্রটেকশান নিতে হয়। ধরেন, মেয়েপক্ষ যদি আমাদের ফারহানের নামে নারী নির্যাতনের কোনো একটা ধারায় মামলা করে দেয়, তাইলে ফারহান কিন্তু পুরাই ধরা। ভোগান্তির আর শেষ থাকবে না। বাংলাদেশের আইন কিন্তু মেয়েদের পক্ষে, তাই আমাদের আগে থাকতেই ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রিভেনশান ইজ বেটার দ্যান কিওর।

রায়হান সাহেব একটু বিরক্ত মুখে বলেন─ ব্যবস্থাটা কী?

শ্যালিকা রুবিনা যেন এক কঠিন রোগের টোটকা দিচ্ছে এমন ভঙ্গিতে বলল─

─আমরা আগেই ওদের নামে মামলা করে দেব। শোনেন দুলাভাই, এত ভাবছেন কেন, ঐ শয়তান মেয়ের নামে আপনারা একটা চুরির কেইস ঠুকে দেন, সোনাদানা, টাকা চুরি─ বাসা ভাংচুর! ও─হ্যাঁ, আরো একটা পয়েন্ট লাগালে কেইসটা জোরালো হবে, ‘মেয়েটা ক্যারেকটারলেস’ এইটা উল্লেখ করতে হবে। আমার চাচাতো দেবর─ ওরা তো এইরকম করছে; আগে থাকতেই মেয়ে পক্ষের নামে দিছে এক মামলা ঠুকে।

─রায়হান সাহেবের কেন যেন এই কথাবার্তাগুলি ভাল লাগছে না। তিনি শান্তভাবে বললেন─

মেয়েপক্ষ এখনও তো মামলা করেনি, দ্যাখা যাক কী হয়? বাকি তিনজন ‘হা হা’ করে সমস্বরে প্রতিবাদ করে উঠল। রায়হান সাহেব এখানে দাঁড়ানো সমীচিন মনে করলেন না, পেছন থেকে শাহানার উচ্চকণ্ঠ ভেসে এল─

বলেছিলাম না, একে বলে কোনো লাভ নাই, যা করার আমাদেরই করতে হবে। রায়হান সাহেব দ্বিধান্বিত মুখে বেডরুমের ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। ফারহান তার একমাত্র ছেলে, মেয়েটা বড়ো। মেয়ের জন্মের বেশ অনেক বছর বাদে ছেলেটা পৃথিবীতে আসে। বড়ো আদরে মানুষ─ সব সময় পেয়ে পেয়ে অভ্যস্ত ছেলেটা কাউকে কিছু দিতে শেখেনি─

কেমন জেদি হয়েছে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন একদিন এসে জানাল, একটা মেয়ের সাথে প্রেম জুড়ে দিয়েছে। একবছর না গড়াতেই জেদ ধরল মেয়েটাকে বিয়ে করবে।

অবশ্য ন্যান্সি মেয়েটা শুরুতে অত মন্দও ছিলো না। বিয়ের আগে নিয়মিত তাদের বাসায় আসতো ─ এক টেবিলে বসে খেয়েছে কত। শাহানার সাথেতো রীতিমতো গলায় গলায় ভাব ছিল। একসাথে শপিংয়ে যাওয়া, শাহানার আলমারি গুছিয়ে দেওয়া, বিছানার চাদর বিছিয়ে দেওয়া, বিভিন্ন অকেশনে গিফট দেওয়া─ ছেলে যেমন পাগল ছিল, ছেলের মাও তেমনি পাগল ছিল! শাহানা তো রীতিমতো ঘোষণাই দিয়েছিল, ন্যান্সি ছাড়া আর কোন মেয়ের সাথে ফারহানের বিয়ে দেবার কথা ভাবলে সে গলায় দড়ি দেবে। রায়হান সাহেবেরও ন্যান্সিকে খারাপ লাগতো না, ফুলের মতো মিষ্টি একটা মেয়ে; গায়ে খুব মিষ্টি এক সুগন্ধি মেখে এসে দাঁড়াতো। মাঝে মাঝে রায়হান সাহেবের বুক সেলফ গুছিয়ে দিত। সব বদলে গেল বিয়েটা হবার পর─ শাহানা যেন অস্তিত্বের সংকটে পড়ল, সংসারের কর্তৃত্ব নিজের হাতের মুঠোয় রাখতে সবসময় অযাচিত হস্তক্ষেপ করত, বউ-শাশুড়ি যুদ্ধ গিয়ে ঠেকল জামাই-বউ যুদ্ধে। রায়হান সাহেবের কানে এলো, ফারহান নাকি ন্যান্সির গায়ে হাতও তুলেছে কয়েকবার। ফলাফল─ ন্যান্সির বাপের বাড়ি গমন। এখন দুই পক্ষের কাদা ছোঁড়াছুড়ি, আক্রমণ- পাল্টা আক্রমণ লেগেই আছে। বরাবরই এসব থেকে দূরে ছিলেন রায়হান সাহেব─ কিন্তু ফারহান তার বড়ো আদরের কলিজার টুকরা ছেলে─ পঁচিশ বছর বয়েসেই ছেলেটার ওপর এমন ঝড়-ঝাপটা! মেয়েটাও দেখি আচ্ছা পাঁজি; তার ছেলেকে ভোগান্তি দিতে চায়! বাইরের একটা মেয়ের জন্য তার ছেলের ভোগান্তি তো আর তিনি মেনে নিতে পারেন না। করুক, যা ভালো মনে হয়, শাহানা আর ওরাই করুক।

চার

টুং করে মুঠোফোনে আওয়াজ হলো─ জলপরী। রায়হান সাহেব শিহরিত হলেন!

জলপরী : কেমন আছেন?

অর্ণব আকাশ : ভালো, আপনি?

জলপরী : ভালো না!

অর্ণব আকাশ : কেন?

জলপরী : আমার প্রব্লেমগুলোর কোনো সলিউশান নেই; আমার এক্স আমাকে থ্রেট করেছে এর মধ্যে!!!

অর্র্ণব আকাশ : কী বলেছে?

জলপরী : বলেছে আমাকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে─ কঠিন শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে!

অর্ণব আকাশ : হাউ ডেয়ার হি ইজ!! এনি ওয়ে, হোয়াই ডোন্ট ইউ ফাইল এ কেইস অ্যাগেনিস্ট হিম? আমি কি কোনোভাবে আপনাকে হেল্প করতে পারি? আমার কিছু লিংক, আই মিন, আমার ফ্রেন্ডস আছে। চাইলে আপনাকে লিগালি প্রটেকশান দিতে পারব।

জলপরী : না! না! আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমার এই ক্রাইসিসে আপনি যেভাবে মেন্টালি হেল্প করছেন, সেটাই অনেক।

অর্ণব আকাশ : আমাদের দেখাটা কি হচ্ছে?

জলপরী : হচ্ছে!

অর্ণব আকাশ : আমার খুব টেনশান হচ্ছে।

জলপরী : কেন???

অর্ণব আকাশ : মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত আপনাকে দেখতে পাব কি না?

জলপরী : হা-হা-হা, এত উতলা হচ্ছেন কেন, বললাম তো দেখা হবে পরশু─ ডোন্ট ওরি। রায়হান সাহেব এবার লেখেন : আরো একটা ভয় হচ্ছে!

জলপরী : কী?

অর্র্ণব আকাশ : আমাকে সামনা সামনি দেখে যদি আপনার পছন্দ না হয়?

জলপরী : আপনি কি ভূত না প্রেত যে পছন্দ হবে না?

অর্ণব আকাশ : জানেন, এই কয়দিনে আপনি আমার এত কাছে চলে এসেছেন! আই কান্ট থিংক এ সিঙ্গেল মোমেন্ট উইদআউট ইউ!

জলপরী : বাব্বা! এত মুগ্ধতা! অর্ণব আকাশ, আমার নিজেরই ভয় করছে, আপনারও যদি আমাকে দেখে পছন্দ না হয়???

অর্ণব আকাশ : কি যে বলেন, আপনার লেখাগুলো, আপনার কষ্টগুলো আমাকে ইমোশনালি টাচ্ করে, আই রিয়েলি ফিল ফর ইউ, আমার এক এক সেকেন্ড যেন কাটছে না─

জলপরী : ডোন্ট ওরি বেবি, উই আর গোয়িং টু মিট ভেরি সুন! এখন গুডবাই দেন, পরে আবার লিখব!

রায়হান সাহেব আবার লেখেন─ যাবার আগে প্লিজ, আর একবার, ডু ইউ রিয়েলি হ্যাভ এনি ফিলিংস ফর মি?

জলপরী : অফকোর্স আই হ্যাভ! অ্যান্ড হোয়াট এবাউট ইউ?

অর্ণব আকাশ : সো ডু আই─ অ্যান্ড ভেরি ভেরি ডিপলি।

জলপরী : বাই…

কয়েকটা হার্ট চিহ্ন পাঠিয়ে জলপরী বিদায় নিল। রায়হান সাহেব গুডবাই লিখতে পারলেন না, মুঠোফোনটি হাতে চেপে ধরে চোখ বুঁজে কিছুক্ষণ বসে থাকলেন; অদ্ভুত এক আবেশ আসছে তার! শিহরনের আবেশ─ জলস্র্রোতে ভেসে যাবার আবেশ!

পাঁচ

শহরের এক প্রান্তে বেশ কিছু চাইনিজ রেস্টুরেন্ট পাশাপাশি দাঁড়ানো─ তারই একটির সামনে বেশ অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রায়হান সাহেব। তিনি এসেছেন জায়গাটা রেকি করতে। ঠিকানাটা শরিফের দেওয়া। জলপরীর সাথে দেখা করার জন্য একটি নিরাপদ ও নিরিবিলি জায়গা খুঁজছিলেন তিনি। রায়হান সাহেবের কেমন একধরনের অস্বস্তি হচ্ছে। পরিচিত কেউ দেখে ফেলবে না তো? বেশ খানিকটা অস্বস্তি মুখে নিয়ে, দ্বিধাযুক্ত পায়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢোকেন তিনি। ভেতরে ঢুকে বিব্রত মুখে একপাশে দাঁড়ালেন। কেমন একধরনের চাপচাপ অস্বস্তি হচ্ছে─ মনে হচ্ছে রেস্টুরেন্টের ওয়েটার, ম্যানেজার, কাস্টমার সবাই যেন জানে; তিনি কে? কী জন্য এখানে এসেছেন? একজন ওয়েটার এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘স্যারের কি গেস্ট আছে? কয়জন?’ রায়হান সাহেব আমতা আমতা করে বললেন, ‘না, ইয়ে মানে কফি হবে?’ ওয়েটার কিছুক্ষণ রায়হান সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর বলে─ ‘স্যার, এইদিকে আসেন, আরও ব্যবস্থা আছে!!’

রায়হান সাহেব দ্বিধাযুক্ত পায়ে ওয়েটারের পেছনে পেছনে গেলেন। আসলে তিনি শরিফের কাছে একটি নিরাপদ-নিরিবিলি জায়গার খোঁজ করছিলেন; শরিফ এই রেস্টুরেন্টের নাম বলে দিয়েছিল। রায়হান সাহেব বলেছিলেন, ‘রেস্টুরেন্ট কী করে নিরিবিলি হয়?’ তার উত্তরে তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত দিয়ে শরিফ বলেছিল, ‘গেলেই বুঝতে পারবি!’ ওয়েটারের পেছন পেছন রায়হান সাহেব একটা সরু করিডোরের ভেতর এসে দাঁড়ালেন। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই এখানে এতখানি স্পেস! অদ্ভুত ব্যাপার হলো রেস্টুরেন্টের অন্য অংশের আলো-আঁধারের চেয়ে এই অংশে আঁধারের পরিমাণ বেশি। সেই আঁধারে চোখ সয়ে এলে রায়হান সাহেব দেখলেন এক পাশ দিয়ে সারি সারি বেতের ঝাঁপি দিয়ে ঘেরা ছোট ছোট শেডের মতো─ আসলে টেবিলগুলোর জোড়া জোড়া মানুষ গুলোকে আড়াল করে রেখেছে এই বেতের ঝাঁপিগুলো। মানুষগুলো যেনো পার্থিব জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের একান্ত অপার্থিব ভুবনে ডুবে যেতে পারে তার জন্য কি নিঁখুত এই ব্যবস্থা! সত্যিই অসাধারণ! অন্ধকারেই বেশ দারুণভাবে শিহরিত হলেন রায়হান সাহেব! বন্ধু শরিফের প্রতি কৃতজ্ঞ হলেন, কৃতজ্ঞ হলেন রেস্টুরেন্টের প্রতিও।

ছয়

সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই রায়হান সাহেব পৌঁছে যাবেন তার গন্তব্যে, সেই রেস্টুরেন্টে─ যেখানে জলপরী অপেক্ষা করছে তার জন্য। রায়হান সাহেবের বুকটা ঢিপ ঢিপ করছে। তিনি মাঝে মাঝেই শিহরিত হচ্ছেন। জলের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন বারবার। আহ্! কী অপূর্ব এই জলশিহরন!

রায়হান সাহেব সরু করিডোরের প্রান্ত ধরে হাঁটছেন। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড! তারপরই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! এক অপূর্ব ঐন্দ্রজালিক মাহেন্দ্রক্ষণ। শেষ ঝাঁপিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি।
এখানেই আছে জলপরী তার অপেক্ষায়─

অন্ধকার সয়ে এলে রায়হান সাহেব দেখলেন জলপরী উঠে দাঁড়িয়েছে। তার গা থেকে খুব পরিচিত মিষ্টি একটা ঘ্রাণ এসে রায়হান সাহেবের নাকে লাগল। অন্ধকারে দাঁড়ানো জলপরীর অবয়বটা রায়হান সাহেবের খুবই চেনা─ন্যান্সি!!

ঘন সন্ধ্যার সেই অন্যায় অন্ধকার পৃথিবীর দুটি মানুষকে নিশ্চল পাথরের মূর্তি বানিয়ে দিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *