ঈদ সংখ্যার ছোটগল্প।। মা মাটি ও ভালোবাসা।। ইলিয়াস ফারুকী

এক

অনেক রাতে যদু বাসায় ফিরে এলো। উসকোখুসকো চুল, বিভ্রান্ত চাহনি। চোখ দুটো জ্বলন্ত অঙ্গারের মত লাল। এতো কিছুর পরেও তার ভেতরে এক ধরনের স্বস্তি কাজ করছিল। নিজেকে মুক্ত স্বাধীন মনে হচ্ছিল। অনেক দ্বিধা ধন্দের পর শেষ অবধি সে কাজটা সমাধা করতে পেরেছে। ঘরে প্রবেশ করেই যদু সোজা ওয়াস রুমে গেল। বেসিনের কল ছেড়ে দিয়ে নিজের চোখে মুখে ও মাথায় অনবরত পানির ঝাপটা দিতে থাকলো। শরীরে কিছুটা শিতল ভাব আসতেই গামছা দিয়ে মাথাটা মুছে নিলো। কোন প্রকারে জুতোগুলো পা থেকে খুলেই অগোছালো বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। যদু ও তার মা এই বাসায় উঠেছে খুব বেশি দিন হয়নি। রমার সাথে পরিচয়ের পরই ওরা বস্তির কলোনির বাসা থেকে এই বাসায় উঠে এসেছে। রমার সাথে পরিচয়ের পর থেকেই বস্তির বাসা নিয়ে তার মাঝে একধরণের হীনমন্যতা কাজ করছিল। ওদের দুজনের পরিচয়েটা এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে। তখন জীবনের এক দোদুল্যমান অবস্থায় যদু। তার নিকট জোৎস্নার চাঁদ তখন তপ্ত দুপুর। সকালগুলো আপোষহীন অস্তিত্ব। মদের নেশায় বুদ যদু পড়েছিল রাজপথে। নিঃশ্বাসের গতি তখন দ্রুত ফুরিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে যদুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করায় রমা। টানা সাতদিন জমে মানুষে টানাহেঁচড়ার পর যদুর জ্ঞান ফিরে। এই দিনগুলোতে রমা নিয়মিত হাসপাতালে এসে খোঁজ খবর রেখেছে। এমনকী তার ঔষধ সহ নানান জিনিসপত্রের খরচটাও যোগান দিয়েছে। যেদিন যদু জ্ঞান ফিরে পেলো সেদিনও রমা এলো। হাসপাতালের সদর দরজায় ঢুকতেই সুখবরটা পেলো সে। আনন্দে এবং উত্তেজনায় তার শরীর তিরতির করে কাঁপছে। দ্রুত পা চালিয়ে হাসপাতালের ওয়ার্ডের সামনে এসেই সে দাঁড়িয়ে গেলো। এক অজানা দ্বিধা তার পা থামিয়ে দিলো। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল রমা, তার এমন হচ্ছে কেন। অজানা অচেনা একটা লোকের প্রতি তার এ কেমন অনুভূতি। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে এনে ওয়ার্ডে প্রবেশ করল। বিছানার পাশে যেতেই তার উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুলে তাকালো যদু। বেশ কিছুক্ষণ অপলক রমার দিকে তাকিয়ে থেকে আবারো চোখ মুদলো। ওর চোখের অনুসন্ধিস্নু দৃষ্টি পড়তে পারলো রমা। নিজে থেকে বললো, – আমি রমা চ্যটার্জী, থাকি দক্ষিণ কোলকাতার বালিগঞ্জ। আপনি অজ্ঞান হয়ে রফি আহমেদ সুলতান রোডে পড়েছিলেন। আমি আপনাকে এনে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। আজ সাতদিন পর আপনার জ্ঞান ফিরলো।

‘আমি সাআআআ..ত দিন….. বলেই চোখ বড় বড় করে তাকালো।’

‘হ্যাঁ, আপনি গত সাত দিন অজ্ঞান হয়ে এই হাসপাতালে আছেন।’

রমার কথা শুনে উঠে বসতে চেষ্টা করল যদু। ব্যস্ত হয়ে উঠল রমা। ‘উঁহু উঠা যাবেনা। আপনি এখনো অনেক দূর্বল, যে ভাবে আছেন শুয়ে থাকুন।’ কাগজ কলম বের করে নিজের ফোন নাম্বার লিখে এগিয়ে দিলো রমা, ‘এই আমার ফোন নাম্বার। প্রয়োজনে ফোন দিবেন। আজ উঠলাম, কিছু জরুরি কাজ সারতে হবে।’ চলে যাবার জন্য ফিরে দাড়াতেই পেছন থেকে শুনতে পেলো ‘শুনুন’ মেয়েলি কন্ঠের ডাক। পেছনে তাকিয়ে রমা জানতে চাইলো, ‘আমাকে বলছেন।’

‘ জ্বী আপনাকে’ নার্সের আহবান।

‘বলুন’

‘না, বলছিলাম আপনার জন্য সুখবর, আপনার স্বামী এখন অনেক সুস্থ। আর দুএকদিনের মধ্যেই ডাক্তাররা তাকে ছুটি দিয়ে দেবে।’

কথাটা শুনে যদু ও রমা দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো কিন্তু নার্সকে কিছুই বুঝতে দিলো না ওরা। রমাই উত্তর দিলো,

‘হ্যাঁ আমারো তাই মনে হচ্ছে। ওর সাথে কথা হয়েছে। আমি নিতে আসবো।’

তারপর ধীর পায়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেলো। এরপর দুইদিন পেরিয়ে গেছে যদুর কোন খবর নেয়ার চেষ্টাও করেনি রমা। তাই বলে সে খুব স্বস্তিতে সময় কাটচ্ছিলো এমনটাও না। হাসপাতাল থেকে বেরোবার পর থেকেই তার ভেতরে যুদ্ধ চলছিলো। তার জীবনে পুরুষের কোন অভাব কোন কালেই ছিলো না। পুরুষের সাথে তার নিজের ইচ্ছেমতো খেলা করা ছিলো তার শখ। কিন্তু আজ তার কী হলো? নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালো সে। ভালো করেই অনুভব করছে তার ভেতরের রাসায়নিক পরিবর্তন। বাস্তবতা তাকে এখান থেকে পালাতে বললেও আবেগ তাকে প্রচন্ডভাবে যদুর পানে টানছে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না য়ঁড়ঃ স্বামী য়ঁড়ঃ শব্দের মাঝে এমন কী লুকিয়ে। সেতো যদুকে হাসপাতালে আনার পর মানবিক কারণে প্রায় প্রতিদিন তাকে দেখতে এসেছে। কিন্তু একবারও তার ভেতরটা আজকের মতন আন্দোলিত হয়নি। যখনি নার্সটা যদুকে তার স্বামী বলে আহবান করলো। তারপর থেকেই তার সকল অনুভূতি সচল হয়ে গেলো। তার হৃদপিন্ডে পিংপং বল হয়ে লাফাতে শুরু করলো। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে প্রবল আবেগের বিদুৎ চমকে উঠলো।

দুই

যদু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে প্রায় দুই মাস হলো। তার রিলিজের সময় রমাই উপস্থিত ছিলো। নিজের বন্ধু বা আত্মীয় কাউকে খবর দেয়নি যদু। বলা যায় ইচ্ছে করেই কাউকে খবর দেয়নি। সেদিন নার্সের কথাটায় তার ভেতরের রসায়নও বিক্রিয়া করতে শুরু করেছে। সেও দেখতে চেয়েছিলো রমা তাকে নিতে আসে কি না। তাকে রিলিজের দিন সে খুবই উদগ্রীব ছিলো। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়নি। তার অপেক্ষার পালা শেষ করে রমা যখন সত্যিই এলো। যদুর ভেতরে যেন ভারত মহাসাগরের মৌসুমি হাওয়া বয়ে গেলো। কিন্তু চেহারায় কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো না। মুখে বললো, – রমা আপনি এসেছেন। আমার জন্য অনেক কষ্ট করলেন। আর কত কষ্ট করবেন।

‘এতে আপনি কষ্ট দেখছেন কোথায়, এতো আমার কর্তব্য। একজনকে অসহায় অবস্থায় তো ফেলে যেতে পারিনা।’ হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই যদু একটা অটো ডাকলো। রমা কিছু বলার আগেই সে বললো, ‘অনেক ধন্যবাদ রমা। আমার জন্য অনেক করেছেন, আর না। শীঘ্রই দেখা হবে।’ বলেই অটো ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলো যাও। রমাকে ছাড়িয়ে আসতেই বললো, ‘উল্টাডাঙ্গা নরেশের বস্তিতে যাও।’ সে যে বস্তির বাসিন্দা এই কথাটা রমা জানুক তা সে চায়না। ঘটনার পর দুই মাস পেরিয়েছে। এই দু-মাসে নিয়মিত না হলেও ওদের দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। বাসা বদলের পর যদূ রমাকে তার বাসায়ও নিয়েছে। কিন্তু কেন যেন রমা কখনো যদুকে তার বাসায় নিতে চায়নি। এমনকী কখনো বাসার ঠিকানা পর্যন্ত জানায়নি।

যদু তার মায়ের কাছে জেনেছে তারা নাকি বাংলাদেশের। একাত্তরে যুদ্ধের সময় যদুকে কোলে নিয়ে বাবা সহ এদেশে চলে এসেছিলো। ওরা আর ফেরৎ যায়নি। শরনার্থী শিবিরই ছিলো তাদের ঠিকানা। বাংলাদেশে যুদ্ধ শেষ হলে এবং দেশ স্বাধীন হলে শরনার্থীরা দেশে ফিরতে শুরু করে। সেই ফেরার মিছিলে যদুর পরিবারও ছিল। বাংলাদেশে যদুর বাবার সামান্য জমি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তাই যদুর বাবা সিদ্ধান্ত নেন থেকে যাবেন এই দেশে। ফেরার মিছিলের সাথে চলতে চলতেই এক সময় নিজের পরিবার নিয়ে নেমে গেলেন উত্তর চব্বিশ পরগনায়। লোকাল বাস ধরে চলে এলেন কোলকাতায়। এক আত্মীয়ের বস্তি বাসায় ঠাঁই নিলেন। পেটের ধান্দা করতে তার বাবা জুতা পালিশ থেকে শুরু করে কুলিগিরিও করেছেন। এদেশে থেকে গেলেও কখোনোই নিজের দেশকে ভুলে যেতে পারেন নাই। একদিন ভিক্ষা করতে গিয়ে মহাজনের হাতে প্রচন্ড মার খেয়ে অজ্ঞান হয়ে সরকরি হাসপাতালে সপ্তাহ খানিক পড়ে ছিলেন। এর পরই তাঁর জীবনে আসে পরিবর্তন। নকশালপন্থী রাজনীতি হয়ে উঠে তার আদর্শ। কমরেড মনমোহন দাস মহাজনদের নিকট হয়ে উঠেন মূর্তিমান আতংক। কিন্তু বেশি দিন টিকলো না তার নকশাল জীবন। সহকর্মীদের ঈর্ষাই হয়ে উঠলো তার জীবনের কাল। রাণাঘাটের ট্রাম স্টেশনে পাওয়া গেলো তার গুলিবিদ্ধ লাশ।

যদু বুঝতে পারে না নিজের দেশ ছেড়ে কেনো তার বাবা এই দেশে থেকে গিয়েছিলেন। আর কেনইবা নকশাল রাজনীতিতে জড়ালেন। দেশেতো নিজেদের জমি ছিলো। নিজেদের ঠিকানা ছিলো। এখানে আজ এতোগুলা বছর পরেও তারা স্বরনার্থী। যদিও তারা এদেশের রেশন কার্ড পেয়েছে, ভোটার হয়েছে। কিন্তু এখনো নাগরিক হতে পারে নাই। এখানকার লোকজনের কাছে যদু একজন বাঙাল বৈ আর কিছু না। ধর্মের কারণে এই দেশে করুণা পেয়েছে। কিন্তু ভালোবাসা পায়নি। নিজেদের জন্য এক টুকরো বসতযোগ্য জমি কেনার অধিকার নেই তাদের। এমনকি কেউ এই বাঙ্গালের কাছে মেয়েকে বিয়ে দিতেও রাজি না। তাইতো চল্লিশ পেরিয়েও এখনো সে একা। জীবনে ছিটেফোঁটা ভালোবাসা না থাকলে ঘৃণাই হয়ে উঠে অবলম্বন। যদুর ক্ষেত্রেও তাই হলো। ঘৃণা তাকে ঘৃণ্য পথে নিয়ে গেলো। ছেড়রা চুরি, মাস্তানি আর নেশাই হয়ে উঠলো তার জীবন। এই জীবনে এসে অন্য কিছু না পেলেও একটা জিনিস বুঝে গেলো সে। লোকজন তাকে প্রচড ভয় পায়। এই ভয়ই তার পুঁজি হয়ে গেলো তার নিজেকে চালিয়ে নেবার।

তিন

হাসপাতাল ছাড়ার পর দিনই মাকে নিয়ে একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে উঠে গিয়েছিল যদু। বাসা পেতে তেমন কোন বেগই পেতে হয়নি তাকে। সে যে এলাকার দাদা। তাকে যে সাথে রাখবে তার অনেকদিক সুবিধা। যদুর জীবনে কাঠিন্য এবং সরলতা যেন সমান্তরালে অবস্থান করে। রমার খোঁজ খবর করে অনেক তথ্য তার হাতে চলে আসে। রমাকে নিয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে দ্বিধার সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে থাকে সে। কঠিন সময় মা তার সব চাইতে বড় ভরসা। অবশেষে মায়েরই শরণাপন্ন হয়ে সে। রমা সম্পর্কে সমস্ত কথাই খুলে বললো। সব শুনে তিনি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় যদুর নিষ্পলক চোখে পানি স্পষ্ট হলো। এতো কঠিন মানুষের ভেতরটা যেনো নড়েচড়ে বসলো। খুব ধীরে সুস্থে তার মা মুখ খুললেন,

‘বাবা মেয়েটাকে আমার সাথে দেখা করতে বল। ওর সাথে কথা বলে আমি তোকে সিদ্ধান্ত দেবো।’

‘মায়ের কথা শুনে চিন্তিত যদু বললো, ঠিক আছে মা, তাই হবে।’

রমার সম্পর্কে যে তথ্য গুলো যদু জেনেছে তা নিয়ে রমার সাথে কোন কথাই বললো না। তাকে জানালো তার মা রমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন। কিছুটা দ্বিধায় থাকলেও অবশেষে যদুর কথায় তার মায়ের সাথে দেখা করতে রাজি হলো রমা। কথামত দুদিন পরেই রমা যদুর মায়ের সাথে দেখা করলো। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি সে যদুর মায়ের সাথেই কাটালো। বিকেলে বেরিয়ে যাবার সময় দুটো সন্তুষ্ট চেহারাকে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিতে দেখলো যদু। মায়ের সিদ্ধান্ত তার এমনিতেই জানা হয়ে গেলো।

রমার অভিব্যক্তিতেই যদু বুঝে নিলো মা তাকে সব কিছুই বলেছে। সুতরাং এবার তার নিজেরও প্রকাশ হবার পালা। পরের দেখাতেই সে রমার সাথে খোলামেলা কথা বললো। একই সাথে তার কাছ থেকে কথা নিলো যা হয়েছে তা এখানেই শেষ। ভবিষ্যতে তারা তাদের নীড়ের পরিকল্পনা করবে। কিন্তু কেউ যদি একবার খারাপ চক্রে পড়ে, সহজে সেখান থেকে বেরুতে পারে না। রমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। সে ওই দুষ্ট চক্র থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলো না। ঘটনা গুলো যত গোপনেই ঘটুক, তা প্রকাশ হয়ে যায়। আর রমা যে যদুর প্রেমিকা। লোকজনের কাছে এই পরিচয় যে অনেক গুরুত্ববহ। কথাটা যদুর কানে আসতে সময় নিলো না। প্রেমিক যদু দাদা হতে খুব বেশি সময় নিলো না। এ্যকশনে যেতে সে খুব একটা দেরি করলো না। যদু দাদাগীরি করে ঠিকই কিন্তু লুচ্চামি না। কথাটা সবাই জানতো। এমনকি এলাকার সবাই তাদের স্ত্রী, কন্যার নিরাপত্তায়ও নিশ্চিন্ত ছিল। সুতরাং রমার বিপদটাই তাকে বাধ্য করলো চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে।

চার

একত্তরের কোলের শিশু তার জন্মভূমির কথা মনে থাকার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু নাড়িরটান বলে কথা। এ দেশে থাকলেও যদুর মা দেশকে ভুলেননি কখনো। মায়ের কাছে ছোটকাল থেকেই নিজের গ্রামের কথা, দেশের কথা শুনতে শুনতে দেশের খুব সচ্ছ একটা ছবি তার ভেতরের ফ্রেমে বাঁধা হয়ে আছে। একা থাকলেই যদু দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। যেন এক জেদি মৌমাছি কিংবা ভনভনানো নীল মাছি তাকে ব্যাস্ত রাখছে তার জন্মভূমিকে মনে রাখতে। তেরো কী চৌদ্দ বছর বয়সে সে বাংলাদেশের একটি ছবি দেখেছিল। ছবিটার নাম ছিল ”জীবন থেকে নেয়া” ছবিটাতে এক অভিনেতা একটি নারকেল বাগানে প্রতিবাদী গান গাচ্ছিলেন। চমৎকার একটা গান ছিল সেটা। কিন্তু যদুকে গানের চাইতে বাগানটাই বেশি টানছিল। কারণ মায়ের মুখে সে প্রায়ই তাদের বাড়ির আশেপাশে লাগানো নারকেল গাছের কথা শুনতো। তার সেই ছবির নারকেলের বাগান দেখে মনে হতো এটাই তাদের সেই বাগান। এক্সিডেন্টের কারণে রমার সাথে পরিচয় তার জীবনকে নতুন ভাবে চিনতে শেখালো। দেশের টান এবং ভালোবাসার টান যদুকে বিভ্রান্ত করলেও হতাশ করল না। যদু একটি বিষয় নিশ্চিত রমা তাকে সত্যিই ভালোবাসে। কিন্তু সে চক্র থেকে বেরোতে পারছে না। যা তাকে প্রচন্ড মর্মপীড়ায় ভোগাচ্ছে। নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। সে সব কিছু যদুকে খুলে বললো। রমাকে রক্ষা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যদু একই সাথে মাতৃভুমিও তাকে টানছে। যদু মায়ের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিলো রমাকে রক্ষা করবে এবং তাকে নিয়েই দেশে ফিরবে ওরা। নিজের মাতৃভুমিতেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন করবে। যাবার আগে আর একটা কাজ শেষ করতে হবে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো যদূ। তার এই সিদ্ধান্তের কথা অন্য কাউকেই বুঝতে দিলো না সে। এতো সহজেই কাজটা সেরে ফেলতে পারবে বুঝতে পারেনি যদু। কাজটা সেরে সোজা বাসায় চলে এসেছিল সে। টানা ঘুমে বিভোর ছিল। ঘুমের মধ্যেই কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। এর মাঝেই তাকে খাওয়ার জন্য কয়েক দফা তাগাদা দিয়ে গেছেন তার মা। ঠিক দুপুর একটায় ঘুম ভাঙল যদুর। গোসল সেরে সোজা খাবার টেবিলে গিয়ে বসল। মা ও রমাকেও ডাকল। খেতে খেতেই ঘোষণা দিল, শুনো তোমরা, মা ও রমা। আমরা আজ রাতে চীরতরে এই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তোমরা তোমাদের যা যা প্রয়োজনীয় শুধু সেই জিনিস গুলো নেবে অন্য কিছুই নয়। যদুর কথা শুনে থ হয়ে যায় দু’জন।

‘হঠাৎ তোর এই সিদ্ধান্তের কারণটা বলবি, জানতে চাইলেন যদুর মা।’ প্রায় তখুনি রমাও জিজ্ঞেস করল, ‘আমি! আমিও কী তোমাদের সাথে যাবো ?’

‘এখানে তোমার কী কেউ আছে যার কাছে তুমি থাকবে।’

কিছুক্ষণ আমতা আমতা করলো রমা, তারপর সমস্ত দ্বীধ্বা ঝেড়ে বললো , ‘হ্যাঁ আমিও যাবো।’

– ঠিক আছে সবাই তৈরি থেকো ঠিক রাত এগারোটায় বেরুবো আমরা। এরপর আর কেউ কোন প্রশ্ন করেনি তাকে। সবাই দৈনন্দিন জীবনের সাথে মিশে যায়। এই বাসায় একটু পূর্বে যে জীবন বদলের এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে তা বোঝার উপায় কারোরই নেই।

পাঁচ

বিকেলে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে বেরুলো যদু। হাঁটতে হাঁটতেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পেছন দিকে অর্থাৎ বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে চলে এলো সে। আনমনে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করা ছোট কাঠবেড়ালীদের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকলো। মনে মনে ভাবলো কী সুন্দর নিশ্চিত মনে খেলা করছে ওরা। ওদের নেই কোন ধর্ম বর্ণ বা গোত্র। ওদের কোন সিমানা নেই। নেই কোন কাঁটাতারের বেড়া। ওরাইতো সত্যিকারের স্বাধীন। হঠাৎ একটা কাঠ বেড়ালি যদুর পায়ের পাতায় চড়ে এলো। কি যেনো বুঝতে চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ পরেই আবার ঝট করে পাশের গাছটায় উঠে গেলো। এবার উল্টো যদুই ভয় পেয়ে গেলো। তবে কী কাঠ বেড়ালিটা কিছু বুঝতে পেরেছে। সে শুনেছে বোবা প্রাণীরা অনেক কিছু বুজতে পারে। তড়িৎ সে তার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত হেঁটে মেমোরিয়ালের বাগানের পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে প্রধান সড়কে চলে এলো। প্রচন্ড উত্তেজনায় তার হৃদপিন্ডটা ক্রমাগত ডুগডুগী বাজিয়ে চলেছে। যদু আরো দ্রুত পা চালিয়ে হাসপাতাল রোডে নেমে এলো। কুইন্স রোড ধরে সোজা গড়ের মাঠের নিকট এসে থামলো। মাঠে প্রবেশ করেই একটা বড় গাছের কান্ডে হেলান দিয়ে বসে পড়লো। গত রাতের ঘটনার পর সারাটা দিন তার ঘোরের মধ্যেই কেটেছিল। বিকেলে ঘোর কেটে যখন স্বাভাবিক হলো তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে। অনেক দিনের তার আবাসের এই শহর শেষ বারের মত প্রিয় জায়গা গুলো ঘুরে আসবে। কিন্তু তার হিসেব পাল্টে দিলো কাঠ বেড়ালি। তার শরীরের গন্ধ শুঁকে ছুটে পালানোটাই তাকে মনে করিয়ে দিলো তার কাছে মানুষের রক্তের গন্ধ পেয়েছে ওটা। গত রাতে নেশায় ছিল সে। এখন পুরোপুরি হুঁশে রয়েছে। তাই ভেতরের প্রতিক্রিয়া মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। বেশ কিছুক্ষণ বসে থেকে সুস্থ বোধ করায় হেঁটে কোনাকোনি মাঠটা পেরিয়ে খিদিরপুর রোডের মাথায় চলে এলো। সেখান থেকে টেক্সি নিয়ে সোজা বাসায় চলে এলো। বাসায় ফেরত আসতেই ঘড়ির কাঁটা রাত আটটা পেরিয়ে গেলো। ঠিক রাত নয়টার সময় যদুর ঠিক করা টেক্সি নিয়ে রওয়ানা হলো ওরা। বাড়ির মালিককে পূর্বেই বলা ছিল তারা দুই মাসের জন্য নিকট আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাবে। সেই অনুযায়ী দুই মাসের ভাড়া পরিশোধ করাই ছিলো। নিরাপত্তার কারণে উত্তর চব্বিশ পরগনায় যদুর এক বন্ধুর বাসায় এসে ওরা টেক্সি ছেড়ে দিলো। বন্ধুর বাসায় আধা ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে আবার রওয়ানা হলো ওরা। বোর্ডার পর্যন্ত পৌঁছতে রাত বারোটা বেজে গেলো। হরিদাসপুরের মাইল কয়েক দক্ষিণে আঙ্গরাইল দিয়ে বর্ডার পার হতে হবে। আঙ্গরাইল পর্যন্ত এসে নির্দিষ্ট করা জায়গায় অপেক্ষায় থাকলো ওরা। পনের মিনিট পর একজন এসে দেখা করলো। সাংকেতিক ভাষার আদান প্রদান করে নিশ্চিত হলো যে ওই সঠিক ব্যাক্তি। বর্ডারের পঞ্চাশ গজ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়াই লোকটার দায়িত্ব। বাকি পথ ওদের নিজেদের দায়িত্বেই পেরোতে হবে। বর্ডারের কাছাকাছি পৌঁছতেই থমকে গেলো ওরা। সার্চ লাইটের তীব্র আলো পুরো এলাকাকে দিনের মতো করে রেখেছে। সবাইকে নিয়ে একটা গাছের পেছনে আড়াল নিলো ওরা। এদিকে বি এস এফের পেট্রোলে অনেকক্ষণ লক্ষ্য রাখলো সে। বেশ কিছুক্ষণ নজর রাখার পর সে ওদের গতিবিধি বুঝতে পারলো। ওরা যখন পেট্রোলে থাকে তখন সার্চ লাইট অন্যপাশে কাভার দেয়। সৈন্যরা যখন সরে যায় তখন পুরো এলাকা সার্চ লাইটের আওতায় থাকে। আরো একটা বিষয় তার নজরে পড়লো। এই পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে কুড়ি মিনিটের মতো প্রয়োজন হয়। মনে মনে একটা হিসাব কষে দেখলো, দুইজন নারীর চলার গতি হিসেব করলে নোম্যানস ল্যান্ডে পৌঁছতে তাদের পনের মিনিট লেগে যাবে। এই সমযের মধ্যে ওপারে যেতে পারবে না। মাঝ পথেই আবার একটা আশ্রয়ের প্রয়োজন পড়বে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। কিছুটা হতাশ দেখালো যদুকে। কী যেন চিন্তা করে ওদেরকে নড়তে নিষেধ করে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসবে বলে চলে গেল। তিন মিনিটের মাথায় ফিরে এলো। ওদের উদ্দেশ্য বললো,

‘আমাদেরকে আর একটু উত্তরে যেতে হবে। ওদিকে নোম্যানস ল্যান্ডে একটা ছোট পুকুরের মতো দেখেছি। ওদিকটায় আমাদের সুবিধা হবে।’

সার্চ লাইট সরে যেতেই ওরা অনেকটা দৌড়েই ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে এলো। একটা আড়াল নিয়ে ওরা বসে পড়লো। সবারই কমবেশি ক্ষিদে ছিল। বাসা থেকে নিয়ে আসা খাওয়া থেকে সবাই অল্পবিস্তর খেয়ে কিছু খাওয়া পরবর্তী সময়ের জন্য রেখে দিল। যদুর ভেতরের একটা আবেগ অনেকক্ষণ থেকে চাপা দিয়ে রেখেছিল হঠাৎ তা চোখের পানি হয়ে বেরিয়ে এলো। এই মুহুর্তে সে দোটানায় পড়েছে। জন্মভূমির টান তাকে উথাল পাতাল করে দিচ্ছে। শৈশব, কৈশোর বা যৌবন যেখানে কেটেছে তার টানওতো কম না। হঠাৎ মার কোলে মাথা রেখে ডুকরে কাঁদতে থাকে সে। পরম আদরে মা তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,

‘উঠ বাবা, এভাবে কাঁদতে নেই। যে মাটিতে তোর মা, বাবার জন্ম। যে মাটিতে তোর নিজের জন্ম আমরাতো সে মাটিতেই ফিরে যাচ্ছি। ওই মাটি যে আমাদের সবার মা, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। চল উঠ্ দেখ আলো চলে গেছে। আমাদের যাবার সময় হয়েছে, নে উঠ্ তাড়াতাড়ি এগোতে হবে।’

‘আমরা প্রত্যেকে একে অপরের হাত ধরে এগোবো। কোন অবস্থাতেই কেউ যেন কারো হাত না ছাড়ি। প্রথমে আমরা পুকুরের ঢালুতে থামবো। পুকুরের ওপাড় থেকেই নোম্যানস ল্যান্ড। সেন্ট্রি আসার আগেই আমাদের দৌড়াতে হবে।’

পরিকল্পনা মতে সবাই একে অপরের হাত ধরলো। হঠাৎ যদু সীমান্তের দিক থেকে ঘুরে দাঁড়ালো। বিড়বিড় করে কী যেন বললো। ওরা বুঝতে পারলো শেষ বিদায় জানাচ্ছে তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের শহরকে। যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল তেমনি আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত সিমান্তের দিকে হাঁটতে শুরু করল। সেন্ট্রিকে এড়িয়ে পুকুরের কিনারায় পৌঁছতেই সার্চ লাইট ঘুরতে শুরু করলো।

‘ঝাঁপ দাও’ নীচু কিন্তু খুব স্পষ্ট ও কঠিন স্বরে নির্দেশ করল। একই সাথে মায়ের ধরে রাখা হাত চেপে ধরেই ঝাঁপ দিলো সে। সে নীচে পড়তেই তার উপর হুমড়ি দিয়ে পড়লো তার মা ও রমা। ঠিক তখনই তাদের পূর্বের দাঁড়ানো স্থানে সার্চ লাইটটা ঘুরে গেলো। নিজেদেরকে সামাল দিয়ে সবাইকে চুপ থাকার ইশারা করলো যদু। বুঝতে পারলো ডান পাটা বিশ্রী ভাবে মুচড়ে গেছে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিলো না।

‘এই জায়গায় কুড়ি মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।’ বললো যদু। নিজের হাত ঘড়িটা দেখলো। ভোরের আলো ফুটতে আর মাত্র ঘন্টা খানেক বাকি। হিসেব করে দেখলো এখানে কুড়ি মিনিট কাটালে হাতে মাত্র চল্লিশ মিনিট সময় থাকবে। এই চল্লিশ মিনিটে তাকে সীমান্ত পেরোতে হবে। ঠিক কুড়ি মিনিট পরেই আবার অন্ধকার হয়ে গেলো। নিচু পাড় ধরেই অন্য পাড়ে এগিয়ে গেলো ওরা। এর মাঝেই বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেলো। পাড়ে ওঠার আগে সবাইকে শেষ বারের মতো বুঝিয়ে দিলো যদু। পাড়ে উঠেই দৌড়াতে হবে। কোন অবস্থাতেই কেউ যেন কারো জন্য অপেক্ষা না করে। তিনজন একসাথে পাড়ে উঠেই দৌড়াতে শুরু করলো। সামনে যদুর মা ও রমা পায়ের ব্যথার কারণে একটু পিছিয়ে গেলো যদু। মাত্র মাঝ পথে এসেছে তখনি শুনতে পারলো একটা বিকট চিৎকার ‘হল্ট’ । হল্ট শোনার সাথে সাথেই যদু চিৎকার দিলো, ‘এঁকে বেঁকে দৌড়াও।’ কথাটা শুনতে পারলো ওরা। আবার হল্ট শুনলো যদু কিন্তু ততক্ষণে ওর মা এবং রমা সিমান্ত পেরিয়ে গেছে।

পায়ের ব্যথা নিয়ে দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছিল যদুর। ভোরের আলো স্পষ্ট হতে শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎ গুলির আওয়াজ হলো। মুহুর্তে সামনে সিমান্ত রেখা লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিলো যদু। বুঝতে পারলো গুলি তাকে ছুঁতে পারেনি। সিমান্ত রেখা আর মাত্র এক হাত দুরত্বে। সে বুঝতে পারলো এই জায়গায় সে ওপেন ও সহজ টার্গেট। গুলির আওয়াজ শুনে ওরা দুজন সিমান্তের দিকে এগিয়ে আসতেই ইশারায় নিষেধ করলো এগুতে। নিজের জায়গায় দাঁড়িয়েই আবারো ঝাঁপ দিলো, একই সাথে গুলির আওয়াজ তার কানে এলো। সোজা মায়ের পায়ের নিকট এসে পড়লো। দাঁড়াতে চেষ্টা করলো সে। পারলো না। মনে হলো রাজ্যের ঘুম এসে জড়ো হচ্ছে। বসে পড়ে যদুর মাথা কোলে তুলে নিলেন ওর মা। রমা পিঠের পেছনে গুলি লাগা জায়গায় চেপে ধরলো। হেঁচকি নেয়া শুরু হয়েছে। প্রচন্ড কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ওর মা ও রমা। মা, ডাক দিলো যদু, ‘মা আ-মা-কে অ-নে-ক আদর করে দাও। রমাকে দেখে রেখো। আমাকে বাড়িতে নিয়ে যেও মা। আমার ঘুম পাচ্ছে মা, আমি একটু ঘুমাতে চাই মা। তুমি কাঁদছো কেন মা। আমিতো ভাগ্যবান। আমি যে একসাথে দুই মায়ের আদর পাচ্ছি।’ কথাটা বলেই ঘুমিয়ে পড়লো যদু। ওরা কেউ বলতে পারে না যদুর এই ঘুমের গভীরতা কতটুকু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *