ঈদ সংখ্যা ২০২১-এর ছোটগল্প।। ভাইভাগ।। শফিক নহোর

সন্ধ্যায় পাখির নীড়ে-ফেরা ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে, আমার ক্লান্তি দূর হয় না। ছোটবেলা থেকে আমি মনমরা হয়ে থাকতাম। কারো সঙ্গে তেমন সখ্য বা কথা বলতাম না। আমার তেমন কোনো ভাল বন্ধু ছিলনা,যার কাছে মনের সব কথা খুলে বলা যায়। আমাদের বাড়ির পাশে পোদ্দার বাড়ি সেখানে খুব বড় একটা জঙ্গল ছিল। আমি প্রায়-দিন রাতে একাই জঙ্গলে চলে যেতাম। এবং ফিরে আসবার সময় বিভিন্ন স্বর্ণ অলংকার , নিয়ে ফিরে আসতাম। মা এ সব একদম পছন্দ করতো না। মা বলতো তোর অমঙ্গল হবে। রাজা তুই আর কখনো জঙ্গলে যাবি না। মায়ের মন বলে কথা। আমি মাকে সান্ত্বনা দিতাম। কিন্তু কোন লাভ হতো না। সকালে ঘুম থেকে উঠে মা বাড়ির কাজে ব্যস্ত হয়ে যেত, আমি আমার সমবয়সীদের সঙ্গে বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণ করতে গেলেও আমাকে কেউ খেলায় নিতে চাইতো না। তার বিশেষ কারণ,আমার কান পচা ছিল বলে। সংসারের অভাব ছিল না কিন্তু অবহেলা ছিল আমার প্রতি। বাবা আমাকে মোটেও সহ্য করতে পারতো না। আমার অপরাধ কি? আমি জানি না। বাবার না কী খুব আউস ছিল আমার একটা ভাই থাকবে। আমার যমজ ভাই হয়েছিল, কিন্তু চেহারা মানুষের মতো না দেখতে। কেমন বলে একটা ছোট পোকার মতো । মা বলে ছিল, এতোদিন পেটে ধরেছিলাম ঠিকই একজন মা বলে ডাকে অন্যজন সেই যে চোখের আড়াল হলো জনমের মতন। ওরে আর চোখের দেখাটাও দেখলাম না । পরাণটা ওর জন্য কাঁদে। দাই বেটি মাকে বলেছিল , রুমা তোর না পেট থেকে রাক্ষুস না কী একটা সাপের মতো জরায়ুর ভেতর থেকে বের হলো।
তখন তুই সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাইছিস লো ‘ম্যাগি।’
তোর স্বামীর তো সংসারে অভাব নাই , শহরে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে পারে।
মানুষ মরে গেলে কি টাহা কব্বরে নিয়া যাবি। তোর কপাল ডা সত্যি লো খারাপ। যমজ বাচ্চা জন্ম দিলি। একটা সাপের মতো কিলবিল করে ঘরের ফাঁসা দিয়ে চলি গেল। আমি ধরবো আমার সারা হাতে রক্ত। বাড়ির বারান্দায় রফিকের মা বাঁশের খুঁটির সঙ্গে হেলান দিয়ে পান চিবিয়ে আলাপ করছে , মায়ের সঙ্গে তাও অনেকদিন আগের কথা।
আমি পোদ্দার বাড়ির জঙ্গলে বিভিন্ন গাছের পাতা কুড়িয়ে বাড়ি নিয়ে গেলে। মা সেই গাছের ঝরাপাতা দিয়ে ভাত রান্না করত ; আমি গাছের ডাল ভেঙে মায়ের হাতে দিলাম। মা চুলার ভেতর দিল ধাও ধাও আগুন জ্বলছে। চুলার ভেতরে গাছের তাজা ঢাল দিলে মনে হয় গাছের ঢালপালা আরো সবুজ হচ্ছে।
আমি মাকে বললাম, মা দেখ। গাছের ঢাল কেমন তরতাজা হয়ে চুলার ভেতরে জ্বলছে , মা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলছে ,
কখনো মিথ্যা কবি না কচ্ছি ? হারামির জাত। তোর বাপের মতো হারামি হচ্ছিস দিনদিন। তোর বই দিলে চোখের দিকে তাকালে আমার কাছে অপরিচিত মনে হয় নিজের ছাওয়াল পলের প্রতি মানুষের মায়া হয়। ভালবাসা তো দূরের কথা তো গরে প্রতি আমার বিতৃষ্ণা লাগে। গাছের পাতার মতো মনের রস আমার দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছেরে রাজা
‘আমি তোর মা না-কি এ ঘরের দাসী বাদীর মতো খেটে অমানুষ হলাম।
বাবা বৃদ্ধ বয়সে এসে মায়ের পেটে আর একজন অনাগত পৃথিবীর আসামি রেখেই বাবা দুনিয়া থেকে বিদায় নিলো। সারাবাড়ি শোকের মাতম মা কেঁদে কেঁদে কখনো জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। আমার চোখ ভেজা , মুখেও কথা নেই। বাড়ি ভর্তি মানুষ সাপের মতো কিলবিল কিলবিল করছে , পেটে ক্ষুধা লাগছে কেউ এসে বলছে না। রাজা চল আমাদের বাড়িতে আজ দুপুরের খাবার আমাদের সঙ্গে খাবি। দিনদিন মানুষের প্রতি মানুষের সম্পর্কের সংকীর্ণতা দেখে আমার প্রচণ্ড লজ্জা লাগে। এর চেয়ে তো আমাদের বাড়ির উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে যে দরজার পাশে রাত জেগে আমাকে পাহারা দেয় নিঃস্বার্থ ভাবে আমি কী তাঁর কাছে ঋণী নই। হাড়হাবাতে মানুষ ভরে গেছে গলির পথ থেকে পোদ্দার বাড়ির শ্মশান ঘাট পর্যন্ত। জোনাকি পোকার মতো আলো নিভে আর জ্বলে বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে বৃষ্টির দিনে সুরু ,পিচ্ছিল পথ বেয়ে বিদ্যুৎ গতিতে একটা সাপ আমার পায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো!
আমি মাটিতে আছি না-কি বেহুশ হয়ে মাটিতে পরে গেছে ঠিক বুঝতে পারছি না। কেউ একজন আমাকে বলছে , রাজা তুই এমন করছিস কেন? আমার চোখেমুখে পানির ছিটা দিয়ে বলল, আমাকে কে যেন এখানে থামিয়ে দিল। চারিদিকে ভাল করে দেখে আমাকে আবার বলছে , তোর মাথায় কি সমস্যা হলো। আমি জানি সাপ অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে তার অলিক একটা মায়া কাজ করছে, বিভিন্ন সময় সে আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমি এ কথাটি কাউকে বলতেও পারি না।আবার আমাকে কেউ বিশ্বাস করবে এমন মানুষও পাচ্ছি না।
আমি একদিন স্বপ্নে দেখলাম , সাপ তার জবান দিয়ে বলছে ,
আমি তোমার ভাই, ‘খাজা !’ মাকে পরের দিন সকালে প্রশ্ন করেছিলাম ; মায়ের বিষণœ চোখে পুত্র হারানোর বিবর্ণ? চাহনি আর ভেজা চোখের পাপড়ির জলোচ্ছ্বাস আমাকে জানান দেয়। সাপ মানব আমার-মায়ের-ওরস জাত সন্তান।
মায়ের নীরব ভূমিকা আমাকে আত্মদহনে ধাবিত করে। একটা সময় সংসারের হাল ধরতে হয় আমাকে। জমি জমা , টাকা পয়সা আমার একার রাজত্ব সেখানে কেউ এসে ভাগ বসাবে, আমার মন কোন ভাবেই সায় দেয়নি। মানুষ আড়ালে আবডালে কানাঘুষা করে ,বাপ মা খারাপ কাজ করেছিল জীবনে তাই মধু শেখের বউয়ের পেটে সাপ জন্ম নিয়েছে। এ কথা আমার কাছে গরম তরল কাঁচের মতন মনে হয়। যেন কেউ আমার বুকে ঢালছে। মা জীবনে খুব কষ্ট করেছে, সংসার ছেলে-মেয়ে স্বামীর সেবা করতে করতে। মনের ভেতরে একটা ভয় কাজ করতো সবসময়। সত্যি সত্যি একদিন উঠোনে সকাল বেলা বারান্দায় ভাত খেতে বসছি, পায়ের কাছে দিয়ে সাপ কিলবিল করে ঠিক প্লেটের কাছে এসে ফণা ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। আমি মা বলে ডাকতেই মা সাপকে জড়িয়ে ধরল। ঠিক তখনি সে মানুষ রূপে রূপান্তরিত হলো। আকাশের নীল রঙ কেমন ফ্যাঁকাসে হয়ে গেল। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ মিনিটে ম্লান হয়ে গেল। চারিদিকে কেমন নিঃসঙ্গ
একটা পরিবেশ। বুকে আয় খাজা বুকে আয় আমি যখন তোকে পেটে ধরেছিলাম; ‘তখন থেকেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম। আমার যমজ সন্তান হলে তোদের নাম রাখবো রাজা, খাজা। এতদিন আমি শুধু মা হয়ে দোয়া করেছি তোর জন্য। আমার পেট থেকে যে জন্ম নিয়েছে সে যেন ভাল থাকে। রাজা আমাকে মা বলে ডেকেছে কতো ‘ এবার তুই আমাকে একবার মা বলে ডাক দে খাজা।’

One thought on “ঈদ সংখ্যা ২০২১-এর ছোটগল্প।। ভাইভাগ।। শফিক নহোর

  • মে ২২, ২০২১ at ৫:০৭ অপরাহ্ণ
    Permalink

    চমৎকার বন্ধু

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *