ছোটগল্প- বোধ সাদাত হোসাইন

আমি তখন হাফপ্যান্ট পরা টিনটিনে বালক। লম্বা সরুসরু পা। সেই পা দেখে আমার নানী প্রায়ই শ্লোক বলেন-
‘বাঁশের কঞ্চি, কইঞ্চা
হইয়া গেলো ধইঞ্চা
ধইঞ্চা দিয়া বরই পাড়ি
পড়েনা বরই, লারি চারি…’
এতই শুকনা যে তা দিয়ে গাছের বরইও পাড়া যায়না, শুধু নেড়ে চেড়ে দেখা যায়।
ভরা বরষার মৌসুম। বরষা মানে বরষা। কান ঝিম্ মেরে দেয়া বরষা। একটানা পনের দিন বৃষ্টি। রাত দিন একাকার। এই বৃষ্টি যে অদূর ভবিষ্যতে থামবে তার কোন লক্ষণ নেই। টিনের চালের বৃষ্টি- ঝিম্ম্ম্ ঝিম্ম্ম্। একটানা শব্দ। বৃষ্টির তিন দিনের মাথায় সবার কান তব্দা। সেই তব্দা দেয়া কানে একটামাত্র শব্দ, ঝিম্ম্ম্, ঝিম্ম্ম্।
আমার শার্টের কলারের পাশ দিয়ে আমার কন্ঠার হাড় দেখা যায়। সেই উঁচু কন্ঠার হাড়ের ফাঁকে নাকি আধসের চাল ধরে। আমার কাজ হলো টেনেটুনে সেই উঁচু কন্ঠার হাড় শার্টের কলার দিয়ে ঢেকে রাখা। আর সুযোগ পেলেই বড় চাচাদের ঘরে ঢুকে পড়া। ঘরে ঢুকে জানালার ফাঁক দিয়ে আমি আমার টিনটিনে লম্বা পা জোড়া বের করে দেই। ছটাৎ ছটাৎ ইয়া বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে সেই টিনটিনে পায়ে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। আর অবাক হয়ে শুনি টিনের চালে ঝিম্ম্ম্ ঝিম্ম্ম্ একটানা শব্দ।
বৃষ্টির শব্দ। আহা!!
আমাদের বাড়িতে দুটো ঘর। আমাদের আর বড় চাচাদের। বড় চাচাদের ঘরখানা টিনের। এই ঘর শফিক ভাই করে দিয়েছে। শফিক ভাই বড় চাচার ছেলে। ঢাকায় চাকরি করেন। বছরে একবার দু’বার আসেন। শেষ কয়েক বছর আর আসে নি। শফিক ভাইয়ের বউ গ্রামের কাদা জল সহ্য করতে পারে না। তাদের একটা ছেলেও আছে। ছেলের নাম বোধন। বছর তিনেক বয়স। এবার নাকি শফিক ভাইয়ের বউ গ্রামের বর্ষা দেখতে চেয়েছে। খবর শোনার পর থেকে বড় চাচীর আর বিরাম নেই। সকাল-সন্ধ্যা তুমুল আয়োজন। নারকেলের চিড়ে করেন, নানা রকম পিঠে। বড় পাতিল ভর্তি পানি দেয়া জিওল মাছ- শৌল, শিং, কৈ। ফুলতোলা প্লেট, গ্লাস, বাটি, বিছানার চাদর। চাচীর সাথে সমান তালে ছোটে রুবি বুও। রুবি বু শফিক ভাইয়ের ছোট বোন। আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। তবু তার সাথে আমার রোজ ঝগড়া হয়। রুবি বুর বেণী করা চুলের ভেতর আমি কাকরোলের খোসা গুঁজে দেই। রুবি বু রেগে মেগে আমাকে তাড়া করে। কিন্তু টিনটিনে আমি হাওয়ার আগে ছুটি। রুবি বু’র সাধ্য কি ছোয়?
রুবি বু অবশ্য আমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেয় না। সেবার বড় চাচাদের ঘরে দুপুরে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম থেকে উঠে ঘরে আসতেই মা রে রে করে তেড়ে আসলেন। আমিতো অবাক। হয়েছে কি? মা আমাকে টেনে নিয়ে তার হাতের তালুতে আটকানো ছোট আয়নাখানায় মুখ দেখতে দিলেন। আমি হতভম্ব। ঘুমের মধ্যে রুবি বু আমার অর্ধেক মাথা কামিয়ে ন্যাড়া করে দিয়েছে!
সেই রুবি বুও শফিক ভাই আসবে শুনে হরিণীর মতো ছুটছে। দুটো ধবধবে সাদা বালিশের কভারও বানিয়ে ফেলেছে। সেই কভারে লাল-সবুজ সুতোয় লেখা ‘সুইট ড্রিমস’।
আর শফিক ভাইয়ের ছোট্ট ছেলেটার জন্য কি সুন্দর টুকটুকে লাল ছোট্ট একটা বালিশের কভার। তারওপর কাঁচা হাতে লেখা ‘বোধ বাবা’।
রুবি বু বোধনের ‘ন’ দিতে ভুলে গেছে। বোধন হয়ে গেছে বোধ!
বড় চাচাদের ঘরখানা চৌচালা। সামনে পেছনে খোলা বারান্দা। সেই বারান্দায় এখন বড় চাচার হাঁস, মুরগী, ছাগল আর কালো একটা গাই থাকে। এই কুচকুচে কালো গাই। গাইয়ের নাম কালু। কালুর পেট ফুলে ঢোল। আজ কালের মধ্যেই বিয়োবে কালু। বড় চাচা মানত করেছেন, একটা বকনা (মেয়ে) বাছুর হলে ময়দানের মসজিদে দু’খানা ডাব আর চার সের দুধ দিয়ে আসবেন। চাচী দু’রাকাত নফল নামাজও মানত করেছেন। এবারের বরষায় মুরগীর খোপ আর গোয়াল ঘর ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। বড়চাচা তাই সবগুলোকে বারান্দায় তুলে এনেছেন। গাইয়ের চারপাশে যত্ন করে শুকনো খড় বিছিয়ে দিয়েছেন। ভেঁজা স্যাতস্যাতে মাটি যাতে গাইটাকে ছুঁতে না পারে।
আমাদের ঘরখানা ছনের। একটানা দুদিন বৃষ্টি হলেই আর রক্ষে নেই। শুকনো ছনের আড় ভেঙে যায়। বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ে এখানে সেখানে। প্রথম প্রথম সেই জায়গাগুলোতে থালা বাটি পাতেন মা। তার দুদিন পরে গামলা। একসময় গামলাতেও আর কাজ হয়না। বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ে ছনের চাল। বাঁশের বেড়া। কেবল আমার বাবা ভেঙে পড়েন না। তিনি সেই ভাঙা ছনের চাল বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আবার জোড়া লাগান। সাথে জোড়া লাগান প্লাস্টিকের বস্তা। রিলিফের টিন। আমার ঘরে মন বসেনা। স্যাঁতস্যাতে ভেঁজা ঘর। ঘরের মেঝেতে উঁকি দেয় বিশাল কেঁচো। ভাতের প্লেটের ভেতর লাফিয়ে পড়ে ব্যাঙ। আরশোলা। আমি তাই ছটফট করি বড় চাচাদের খটখটে শুকনো ঘরে যেতে। মাথার উপর চকচকে টিনের চাল। সেই চালে ঝিমমম ঝিমমম বৃষ্টির শব্দ। সেই শব্দে আমার কান তব্দা দেয়না। আমি মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনি। সাথে শুনি বড় চাচার পুঁথি পাঠ আর অদ্ভুত সব গল্প।
সেই গল্প পাতার, পাখির, প্রাণের, জীবনের।
বড় চাচা ‘প্রাণের’ মানুষ। ‘অবলা প্রাণের’।
গাছ, পাখি, পশু বড় চাচার প্রাণ। রাস্তায় যে নেড়ি কুত্তাটা সকাল-সন্ধ্যা তারস্বরে ঘেউ ঘেউ করে। বড় চাচার পায়ের শব্দে সেও কুইকুই স্বরে মাথানিচু করে দৌঁড়ে আসে। তারপর বাধ্য ছেলের মতো গুটিগুটি হেঁটে যায় তার পিছু। বড় চাচা প্রতি সন্ধ্যায় পুকুর পাড়ের জামতলায় বসে থাকেন। দশাসই শরীরের কালো গাইটা দড়ি ছিঁড়ে তেড়েফুঁড়ে এসে বড় চাচার পাশে মাটিতে আধশোয়া হয়ে বসে। তারপর মাথাটা এলিয়ে দেয় তার কোলে। বড় চাচা আলতো হাতে ওর মাথায় হাত বুলান, কানে হাত বুলান, ঘাড়ে, পেটে, গলায় হাত বুলান। কালু চোখ বন্ধ করে ঝিম মেরে শুয়ে থাকে। বড় চাচার শক্ত হাত বিলি কেটে দেয় ওর শরীরের কালো চকচকে রেশম লোমে। হাতখানা খানিক থামতেই কালুর মাথা নড়ে ওঠে। আলতো ঢুঁস মারে বড় চাচার কোলে। কালো গাইয়ের শরীর জুড়ে বড় চাচার হাত আবার নড়ে ওঠে।
সে হাতভর্তি মমতা, সে হাতভর্তি ভালোবাসা।
২.
বৃষ্টিটা কমে এসেছে।
কিন্তু দখিনা বাতাসে হু হু করে বাড়ছে নদীর পানি। সেই পানি নদী উপচে ভাসিয়ে দিয়েছে খাল, বিল, মাঠ, ফসলের জমি। পানির উপর ভেসে আছে সবুজ ধানের কচি ডগা। উঁচু রাস্তাও ডুবি ডুবি। ডুবে গেছে উঠোনের অর্ধেক। সেই পানিতে টুপটাপ লাফিয়ে ওঠে খলসে পুঁটির দল। আমাদের ছনের ঘরখানার করুণ দশা। কিন্তু বাবা মা ঘর ছেড়ে কোথাও যাবেন না। সমস্যা যত আমাকে নিয়ে। এই স্যাঁতসেঁতে ভেজা ঘরে আমার মন বসে না। আমি চুপি চুপি বড় চাচাদের ঘরে চলে যাই। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে যেতে না পারলে বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকি আর গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদি।
সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ বড় চাচা তার লম্বা লম্বা পা ফেলে এসে দাঁড়ালেন আমাদের ঘরের সামনে।
তারপর বাবাকে ডাকলেন, ‘মকবুল, মকবুল।’
বাবা তখন চৌকির উপর বসে বিড়ি ফুঁকছিলেন। তড়িঘড়ি করে বিড়িখানায় শেষ টান দিয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ফেলে দিলেন বাইরে। তারপর এসে দাঁড়ালেন বড় চাচার সামনে।
বাবার পাশ দিয়ে উঁকি দেয়া ভাঙা বেড়ার দিকে আঙুল তুলে বড় চাচা বললেন, ‘তোর গোয়ার্তুমি কি এই জনমে কমবো না? এই ঘরে তুই ওই রোগা বউ আর এট্টুক পোলাডারে লইয়া থাকস কোন সাহসে? ওগো কি মাইরা ফেলতে চাস?’
বাবা কাঁধের গামছা দিয়ে মুখ মোছেন। তারপর ভাঙা বেড়ার দিকে মাথা ঘুড়িয়ে তাকান। আবার মুখ ফেরান। কিন্তু কিছু বলেন না। চুপ করে থাকেন।
‘কি, কথা কস না কেন? কিছু একটা ক। এমনে মুখে কুলুপ আইটা কয়দিন থাকবি?’ বাবা এবারো চুপ করে থাকেন। কথা বলেন না। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটিতে অর্ধবৃত্ত আঁকতে থাকেন।
বড় চাচার যেন এবার বাঁধ ভাঙে। তিনি চেঁচান, ‘জীবনে কোনদিন একটা কথাও হুনছোস? হুনোছ নাই। যেইডা কইছি হেইডার উল্টাটা করছোস। এইজন্যইতো আইজ এই দূর্দশা।’ একটু থামেন বড় চাচা। তারপর বাবার হাত ধরে টেনে নিয়ে যান বড় চাচার কালো গাইটার সামনে। ‘দ্যাখ, গাইডারে দ্যাখ।’ বড় চাচা কালুর পেটে হাত বুলান। পেটের আকার বিশাল। আজ-কালের মধ্যেই বিয়োবে কালু।
‘এই একটা গাই, অবলা প্রাণী, এই প্রাণীডা আমারে কোনদিন ঠকায় নাই।’ বড় চাচা থামেন। থুক্ করে একদলা থুথু ফেলেন ভেজা মাটিতে। তারপর ঘুরে দাঁড়ান, ‘অবলা এই প্রাণীগুলা কাউরে ঠকায় না। অরা সব বোঝে, সব।’
বড় চাচা আমার দিকে হাত তুলে দেখিয়ে বলেন, বাবা যখন মারা যায়, ওই অর চেয়ে একটু বড় আছিলাম আমি। এক ফোডা জমি-জিরাতও আছিলো না। এক বেলা খাওনের আছিলো না। তুই তহন মা’র পেডে। বড় মামায় আমারে একটা লাল বাছুর দিয়া কইছিলো, এইডা হইলো লক্ষ্মী। এই লক্ষ্মী দেইখা শুইনা রাখিস। আমি আমার সারা জীবন তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছি। হেই বাছুর থেইকা আমার কতগুলা গাই বাছুর যে হইছে! তোরে এতো কইরা কইলাম, আথালের গাইডা বেঁচিস না। ঘরের লক্ষ্মী। তুই গাভীন (গর্ভবতী) গাইডা টেকার লোভে হারু কসাইয়ের কাছে বেচলি! কেমনে বেচলি? হারু কসাইতো মানুষ না। ও আসলেই একটা কসাই। কিন্না (কিনে) নিয়া গাভীন গাইডার ঠিক মতো যত্ন-আত্মি করে নাই, রাখছে ভিজা চুপচুইপা ঘরে। একটার পর একটা রোগ হইছে গাইডার। শেষমেশ গাইডা যদি মইরা যায় হেই ডরে কাউরে কিছু না জানাইয়া গাইডারে জবাই দিয়া গঞ্জে গোসত বেচছে! গাভীন গাই। গাইডার পেডের মইধ্যে আরেকটা জান আছিলো! অবলা গাইডা কোন কথা কইতে পারে নাই। আল্লাহ! ওহ আল্লাহ!’
বড় চাচার চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসে। হাতের আঙুল মুঠো পাকিয়ে যায়। পাথরের মতো শক্ত চোখেও জল ছল ছল করে, ‘আল্লাহ কেমনে সইবো!, আল্লাহ তুমি মাফ করো। মাফ করো ইয়া মাবুদ।’ বাবা এখনও চুপ করে আছেন। পায়ের গোড়ালিতে ভর দিয়ে ভেজা মাটিতে বুড়ো আঙুল দিয়ে অর্ধবৃত্ত আঁকতে থাকেন। এক পা সামনে এগিয়ে বাবার একদম মুখোমুখি দাঁড়ান বড় চাচা। তারপর আবার বলেন, ‘তুই এই ঘরে থাকবি থাক। তোর বউডারে এই ক্যাদা-বিষ্টিতে মারবি মার। কিন্তু আনু এই বংশের রক্ত। অরে আমি এই ভেজা ঘরে এই বিষ্টি বাদলায় থাকতে দিমুনা।’
বড় চাচাকে আমি পছন্দ করি, খুব খুব পছন্দ করি। কিন্তু বাবাকে যখন বড় চাচা বকেন তখন আমার খারাপ লাগে। বড় চাচাকে মনে হচ্ছিলো একটা খারাপ মানুষ। আর বাবা কি অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন! কিন্তু বড় চাচা যখন বললেন যে তিনি চান না আমি এই ঘরে থাকি তখন মুহূর্তেই আমার মনে হলো, জগতে বড় চাচার মতো ভালো মানুষ আর একটাও নেই। যত ইচ্ছা বকুক বাবাকে। বাবাতো আমাকে ওই ঘরে যেতে দিতেই চায় না। মা-ও না।
কিন্তু আমাদের দুজনকেই অবাক করে দিয়ে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে মিনমিনে স্বরে বললেন, ‘আনু, তোর বালিশ আর জামা-কাপুড় লইয়া ওই ঘরে যা। বাইস্যাকালের (বর্ষাকাল) কয়ডাদিন ওই ঘরেই থাক।’
আমি আর বড় চাচা, দুজনই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি।
বড় চাচা বাবাকে আর কিছু বলেন না। তিনি আমার দিকে তাকান। তারপর দরজার সামনে দড়িতে শুকাতে দেয়া আমার কোঁচকানো হাফপ্যান্ট আর শার্টখানা আমার দিকে ছুঁড়ে দিতে দিতে বলেন, ‘নে, জামা-কাপুড় লইয়া আয়। কাইল বেয়ান বেয়ান উঠতে হইবো। তোর শফিক ভাই আইবো ঢাকারতন। নাও লইয়া হেরে গঞ্জে আনতে যাওন লাগবো। তুই যাবি আমার লগে।’
বড় চাচা কথাগুলো আমাকে বললেও উদ্দেশ্য ছিলো মূলত বাবা। কিন্তু বাবা কোন উত্তর দেন না। তিনি গভীর মনোযোগে বুড়ো আঙুল দিয়ে ভেজা মাটিতে অর্ধবৃত্ত আঁকতে থাকেন।
আঁকতেই থাকেন।
৩.
‘আনু, এই আনু। ওঠ্ ওঠ্।’
বড় চাচার ডাকে আমার ঘুম ভাঙে। আমি তড়িঘড়ি বিছানা ছাড়ি। বাইরে জমাট অন্ধকার। বড় চাচা তার বড় গামছাখানা দিয়ে আমার মাথা, পিঠ, বুক ঢেকে দেন। বাইরে বেরিয়েই চমকে ওঠেন তিনি। একরাতেই বন্যার পানি বেড়ে প্রায় ঘরের দাওয়ায় এসে ঠেকেছে। বড় চাচার মুখে চিন্তার ছায়া। তিনি আপনমনে বিড় বিড় করেন, ‘আল্লাহ, পানি না জানি এইবার আর কতো বাড়ে!
সাবধানে নৌকার গলুইয়ে আমাকে বসিয়ে দেন বড় চাচা। চাচী এবং রুবিবু এখনো ঘুমে। বড় চাচা হাঁক দিয়ে চাচীকে ডাকেন, ‘শফিকের মা, ও শফিকের মা।’
‘হ, কন।’ ভেতর থেকে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে সাড়া দেন চাচী।
‘তুমি খাওন দাওন রেডি করো, আমি শফিকরে লইয়া আসতেছি।’ বলেই ছোট্ট লাফে নৌকায় চড়েন বড় চাচা। অন্ধকারে নৌকার গলুইয়ে বসে আমি বড় চাচার দুলতে থাকা শরীরটা দেখি।
চারদিকে থই থই পানি। এবার নিশ্চয়ই বড় বন্যা হবে। বড় চাচা নৌকা ঘুড়িয়ে বাড়ির পেছন দিকে নিয়ে আসেন। পানি প্রায় ঘর ছুঁই ছুঁই। বড় চাচা বিড়বিড় করে কিছু একটা বলেন। তারপর অন্ধকারেই আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘যুইত কইরা বয় দেহি আনু। দেখি গঞ্জে যাইতে কতক্ষণ লাগে। ঢাকার লঞ্চ আহনের আগেই পৌঁছাইতে হইবো।’
বড় চাচার হাতের বৈঠাখানা নড়ে ওঠে। ‘ঝুপ’ শব্দটা কানে আসে ঠিক তখুনি। কিছু একটা পানিতে পড়েছে কোথাও। কিন্তু বৈঠার শব্দে খুব একটা আলাদা করা যায়না শব্দটা।
‘বড় চাচা, পানিতে কি কিছু পড়লো? শব্দ হুনছেন?’ আমি বড় চাচাকে জিজ্ঞেস করি।
‘হ, হেরামই কিছু একটা হুনলাম মনে হয়।’
‘কি পড়লো?’
পূবাকাশ তখন খানিকটা আলোকিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাড়ির পাশেই ঘন বাঁশঝাড়ে অন্ধকার হয়ে আছে জায়গাটা।
‘এই আন্ধারেতো কিছু দেখা যাইবোনারে। আর তোর ভাইয়ের লঞ্চও চইলা আইবো।’
-‘মাছ টাছ হইবো মনে হয়।’ বড় চাচার তাড়া দেখে আমি তাকে আশ্বস্ত করি।
-‘হ, তাই হইবো। পানি যেমনে বাড়তেছে, গ্রামের সকলের পুকুরই ডুইবা গেছে মনে হয়। পুকুরের মাছ এহন সব বানের পানিতে।’
বড় চাচা দ্রুত বৈঠা মারেন। আমি আধো-অন্ধকারে কালো পানিতে তাকিয়ে থাকি। এলোমেলো ঢেউ। ভোরের নরম হাওয়ায় শরীর কেমন অ™ভুত শীতলতায় আচ্ছন্ন হয়। আমি গলুই থেকে পা বাড়িয়ে আঙুলের ডগায় পানি ছুঁই।
ইশ্ কি ঠান্ডা!
৪.
শফিক ভাই টুপ করে নৌকায় উঠে পড়ে। তার কোলে বোধন।
বড় চাচা কয়েকবার চেষ্টা করলেন নাতিকে কোলে নিতে। কিন্তু বোধন কোনভাবেই গেলো না। সম্ভবত বড় চাচার লম্বা এলোমেলো দাড়ি তার পছন্দ হয়নি। বিপত্তি বাঁধে ভাবীকে নিয়ে। সে শহুরে মেয়ে, কোনমতেই নৌকায় উঠতে পারে না। শেষ পর্যন্ত বোধনকে আমার কাছে দিয়ে শফিক ভাই ভাবীকে প্রায় কোলে করে নৌকায় তোলে। নৌকার পাটাতনে পাতা পাটিতে জড়সড় হয়ে বসে ভাবী। আতংকিত চোখ জোড়া পানিতে। ঢেউ তেমন নেই বললেই চলে। কিন্তু নৌকা খানিক দুলে উঠতেই ভাবীর চোখ মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। শফিক ভাই এবং বড় চাচা, দুজনই ভাবীকে অভয় দেন। কিন্তু ভাবীর ভয় তাতে কিছু কাটে বলে মনে হয় না।
ভাবী এক হাতে শক্ত করে নৌকার পাটাতন খামচে ধরে আছে, আরেক হাতে শফিক ভাইকে। আমি বোধনকে শফিক ভাইয়ের কাছে দিয়ে আবার নৌকার গলুইয়ে গিয়ে বসি। শফিক ভাই কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। আগের সেই হাসিখুশি ভাবটা আর নেই।
আমাকে দেখে কেমন নিরস গলায় বললো, ‘কিরে আনু, কিছু খাস না নাকি? এমন পাটখড়ি হয়ে গেছিস কেন?’
অন্যসময় হলে হয়তো শফিক ভাইয়ের এমন কথায় আমি হেসে গড়াগড়ি খেতাম। কিন্তু শফিক ভাইয়ের এবারের কথা বলার ধরনে কিছু একটা ছিল। আমি কেমন জড়সড় হয়ে গেলাম। কোন উত্তর দিলাম না। শফিক ভাই অবশ্য উত্তর আশা করেছে বলে মনেও হলো না।
সে বড় চাচার দিকে ফিরে জানতে চাইলো, ‘বাবা, তোমার শরীরটা ভালো?’
‘হ, ভালোই। খালি ঠান্ডাডা একটু ঝামেলা করে।’
‘বাবা, বাড়িতে আসতে অনেক ঝামেলা। এই এতো কাদা পানি ডিঙাইয়া বাড়ি আসন যায় কও?’
শফিক ভাই বড় চাচার শরীর নিয়ে আর কিছু বলে না। বছর বছর বাড়ি আসা তার জন্য কতো ঝামেলার তা বোঝানোর চেষ্টা করে সে।
-‘তারওপর দেখছোতো বাবা, তোমাগো বউয়ের অবস্থা, নৌকায় চড়তে পারে না, পানি খাইতে পারে না। বোধনেরও এই পানি সহ্য হয় না, গোসল করতে পারে না।। কি যে করবো আমি!’
-‘কি আর করবি? বুড়া বাপ-মা যদ্দিন আছে, একটু কষ্টতো করতেই হইবো।’ বড় চাচার গলার স্বর নরম। সেই নরম স্বরের কোথায় যেন থইথই কান্না। পাথর জমাট কষ্ট।
‘শোন এইবার তোগো ভাল্লাগবো।’ বড় চাচা নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন। ‘কালো গাইডা দুয়েকদিনের মধ্যেই বিয়াইবো। খাঁটি দুধ খাইতে পারবি। টাউনেতো খাঁটি দুধ বলতে কিছু নাই। কি না কি খাস! তারওপর নতুন বাছুর দেখলে আমার দাদাভাইয়েরও ভাল্লাগবো।’
‘এই গরু বাছুর নিয়া তোমাগো এতো আদিখ্যেতা আমার ভাল্লাগেনা বাবা। পারলেতো দেখি রাইতে কোলে নিয়া ঘুমাও। আর এইগুলার মধ্যে ভুলেও বোধনরে নিবা না বাবা।’
‘কেন রে শফিক, তোর মনে নাই, ছোডবেলায় তুই সাদা ধবধবা বাছুর দেখলে কি করতি?’
বড় চাচার কথা শেষ হয় না। শফিক ভাই চড়া গলায় বলে ওঠে, ‘ওইসব পুরান কাসুন্দি বাদ দাওতো বাবা, ছোড বেলায়তো তোমার মতোন নৌকা বাইয়া গরুর লইগা ঘাস কাটতেও গেছি। এহন কি আর…।’
হঠাৎ থেমে যায় শফিক ভাই। কথাটা বলা ঠিক হয়নি বুঝে মাঝপথে চুপ মেরে যায়।
বড় চাচা ফে ফে করে হাসেন। সেই হাসিতে বড় চাচাকে বড্ড বোকা বোকা লাগে। বড় চাচাকে ভীত, ন্যুজ্ব এক জরাগ্রস্ত মানুষ মনে হয়। একসময় বড় চাচার হাসি থেমে যায়। শফিক ভাই, ভাবী, আমি, আমরা কেউ কোন কথা বলি না। সবাই যেন বুঝে ফেলি এখন নৈঃশব্দের সময়।
অস্বস্তিকর নিরবতায় বৈঠার একটানা ছলাৎ ছলাৎ শব্দ খুব কানে বাজে।
৫.
বাড়ির কাছে আসতে আসতে গনগনে সূর্য তেতে উঠে। টানা বরষা শেষে পরিষ্কার আকাশ। শফিক ভাই আর ভাবী নৌকা থেকে কিভাবে নামবে তাই নিয়ে ভাবছিলাম আমি। বড় চাচা দেখি পুকুর পাড়ের দিকে ঘুড়িয়ে নিয়েছে নৌকা। ওদিকটায় দুটো কাটা খেজুর গাছের অস্থায়ী ঘাট আছে। নৌকা থেকে লাফিয়ে সেই ঘাটের ওপর শুকনো জায়গায় নামা যায়। বড় চাচা খুব সাবধানে সেখানে নৌকা ভেড়ালেন। তারপর নিজে হাঁটু পানিতে নেমে নৌকাটাকে শক্ত করে জামগাছটার সাথে বাঁধেন।
‘মা আর রুবি কই বাবা? আমি আসবো ওরা জানে না?’
শফিক ভাইয়ের গলায় স্পষ্ট বিরক্তি। আমারও খানিকটা অবাক লাগে। শফিক ভাই বউ নিয়ে ঢাকা থেকে আসবে, সাথে আসবে বোধন। এতোদিন ধরে চাচী আর রুবি বু’র এতো আয়োজন, অথচ কই ওরা? ওদেরতো পুকুরপাড় এসে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। বড় চাচাও খানিকটা অবাক হয়েছেন। তিনি কলাগাছের ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে বাড়ির ভেতরটা দেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। কেমন থমথমে চারপাশ। আমার বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। বড় চাচা গলা চড়িয়ে ডাকলেন, ‘রুবিনা, ও রুবিনা। ও শফিকের মা, কই তোমরা?’
কিন্তু কোথাও কোন সাড়া নেই।
বড় চাচা আবারো চেঁচালেন, ‘ও শফিকের মা, ও রুবিনা, কই তোরা? শফিকতো বউ লইয়া আইয়া পড়ছে, আমার দাদাভাইও আসছে।’
কোন সাড়া নেই কোথাও। শফিক ভাই বোধনকে কোলে নিয়ে নৌকা থেকে নেমে দাঁড়ালো। তার ফর্সা মুখ রাগে লাল হয়ে আছে। বড় চাচা কি করবেন বুঝতে পারছেন না। তার কপাল কুঁচকে আছে। তিনি হাঁটু পানি থেকে উঠলেন। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত কাদায় মাখামাখি। সেই কাদা মাখা পা নিয়েই তিনি বাড়ির দিকে এগুলেন, ‘রুবিনা, কই তোরা? তোর ভাইতো আইয়া পড়ছে।’
আমি টুপ করে নৌকার গলুই থেকে নেমে বড় চাচার পিছু নিলাম। শফিক ভাই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার কোলে ঘুমাচ্ছে বোধন। নৌকার উপর শক্ত হয়ে বসে আছে ভাবী। তার আগুন চোখের সামনে শফিক ভাইকে কেমন দিশেহারা লাগছে।
আমি দৌঁড়ে এসে বড় চাচার পাশে হাঁটতে থাকি। বড় চাচা ফের গলা চড়িয়ে ডাকতে যাবেন ঠিক তখনই কান্নার শব্দটা কানে আসে। বড় চাচীর গলা! চাচী চিৎকার করে কাঁদছেন। সাথে আরো কেউ। হ্যা, রুবি বু। এবার স্পষ্ট কান্নার শব্দ। রুবি বু আর বড় চাচী চিৎকার করে কাঁদছে। দৌড়ে সামনের খোলা বারান্দাটা পার হই আমি আর বড় চাচা। পেছনের বারান্দার কাছে এসে থমকে দাঁড়াই আমি। বড় চাচা দৌড়ে যান ছোট্ট জটলাটার কাছে। আমি পায়ে পায়ে আগাই।
পেছনের বারান্দার মেঝেতে রুবি বু দু’পা ছড়িয়ে বসে আছে। তার কোলের ওপর সাদা ধবধবে একটা বাছুর। চোখ দুটো খোলা। নিঃসাড়। বড় চাচী বাছুরের পা দুখানা দুহাতে আগলে ধরে চিৎকার করে কাঁদছেন। পাশে আঁচলে মুখ চেপে বসে আছেন মা। বাবা দাঁড়িয়ে আছেন শূন্য চোখে। বাছুরটার পুরো শরীর জল-কাদায় মাখামাখি। মিইয়ে যাওয়া পশমী শরীর থেকে ঝরছে ফোঁটা ফোঁটা জল। ভিজে যাচ্ছে খড়, বিচালি, মাটির মেঝে। পাশেই সদ্য প্রসূতি কালু রক্তমাখা শরীরে দাঁড়িয়ে আছে। বারবার মাটিতে পা ঘষছে কালু। অস্থির হয়ে আছে পুরো শরীর। ধপ করে মাটিতে বসে পড়লেন বড় চাচা। তারপর ছোঁ মেরে রুবি বু’র কোল থেকে নিয়ে নিলেন বাছুরটা।
রুবি বু চিৎকার করে বড় চাচাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো, ‘বাবা, তুমি যহন বাইর হইছো, তহনই কালু বিয়াইছে বাবা। কালুর বাছুরডা পানিতে পইরা গেছিলো। আমরা কেউ দেহি নাই বাবা, কেউ দেহি নাই।’
মৃত বাছুরটার কাদা-জলে মাখামাখি ছোট্ট শরীর তখন শক্ত হয়ে গেছে। সরু সরু চারখানা টিনটিনে পা ক্রমশই ধনুকের ছিলার মতো টানটান হয়ে আসছে।
বড় চাচা পাগলের মতো জান্তব স্বরে গোঙাতে লাগলেন, ‘না, না, না, না, না…।’ তার শক্ত হাতগুলো ক্রমশই বাছুরটার প্রাণহীন টানটান সোজা পাগুলো ভাঁজ করে দিতে থাকে। কিন্তু মৃত বাছুরটার শরীর সাড়া দেয় না। বড় চাচার মুখ থেকে বের হওয়া গোঙানিও তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে, ‘না, না, না, না…।’
‘বাবা! মা!’
শফিক ভাইয়ের কণ্ঠে সবাই ফিরে তাকায়। বোধনকে কোলে করে পেছনের বরান্দায় এসে কখন দাঁড়িয়েছে শফিক ভাই, আমরা কেউ টেরই পাইনি। পাশে আধভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছে ভাবী। শফিক ভাইকে দেখে যেন বাঁধ ভাঙে বড় চাচার। চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন তিনি, ‘বাবারে, এইডা আমি কি করলাম! এইডা কি করলাম আমি! আমি নিজ হাতে বাছুরডারে খুন করলাম। নিজ হাতে।’
বড় চাচী, রুবি বু, বাবা, মা, আমি, আমরা সবাই অবাক হয়ে যাই, ‘কি বলছে বড় চাচা!’
বড় চাচা বাছুরটার মাথা বুকের সাথে চেপে ধরেন, তারপর চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন, ‘আমি নিজ হাতে তোরে খুন করছি, নিজ হাতে খুন করছি।’
হঠাৎ আমার দিকে চোখ ফেরান বড় চাচা, বাছুরটার মুখের সাথে নিজের গাল চেপে ধরে কেঁদে ওঠেন, ‘আনুরে, ও আনু, বেয়ান বেলা পানিতে কিছু পড়নের যেই আওয়াজ তুই হুনছিলি তহনই ও হইছে, তহনই ও পানিতে গিয়া ঝুপ কইরা পড়ছে রে আনু। আনুরে, আমি তহন কেন গিয়া দেখলাম না, কেন দেখলাম না।’
বড় চাচা দুই হাতে থপাথপ বুক চাপড়াতে থাকেন। আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। মৃত বাছুরটার চোখজোড়া তখনও তাকিয়ে আছে। কাজল কালো জল ছলছলে একজোড়া চোখ।
আমি সেই চোখে তাকিয়ে থাকি। আমি চোখ ফেরাতে পারি না।
বড় চাচা শফিক ভাইকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। বড় চাচার হাত ছাড়িয়ে হঠাৎ কঠিন গলায় চেঁচিয়ে ওঠেন শফিক ভাই, ‘অনেক হইছে বাবা, অনেক হইছে। আমার এই বাড়িতে আসাটাই ভুল হইছে। একটা বাছুরের জন্য তোমরা জীবন দিয়া দিতেছো। আর এইযে আমি এতোদিন পর বাড়িত আসছি। আমার এইটুক ছেলে আসছে, বউ আসছে, তোমাগো কাছে হের কোন মূল্য নাই! আমাগো চেয়ে তোমাগোর কাছে একটা পশুর মূল্য এতো বেশি?’
সব ক’জোড়া চোখ নিমেষে শফিক ভাইয়ের দিকে ফিরে তাকায়। প্রচন্ড রাগে শফিক ভাইয়ের কপালের শিরা ফুলে আছে। শফিক ভাই ঘুমন্ত বোধনকে ভাবীর কোলে দিয়ে বারান্দার মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। তারপর চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘মা, রুবি, তোমরা জানো না আজকে আমি আসতেছি? অগোরে নিয়া আসতেছি, জানো না তোমরা?’
বড় চাচার কান্না পুরোপুরি থেমে গেছে। কালুর সামনে রাখা খড়ের গাদার উপর বসে পড়েছেন তিনি। শূন্য চোখে তাকিয়ে আছেন শফিক ভাইয়ের দিকে।
‘একটা গরু-ছাগলের বাচ্চার জন্য তোমাগো যতোটা মায়া হেইডাতো মনে হয় আমার ছেলের জন্যও তোমাগো নাই। আমার ছেলের জন্য দূরের থাক, আমার জন্যও নাই।’
বড় চাচী, রুবি বু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে শফিক ভাইয়ের দিকে। কারো মুখে কোন কথা নেই। শফিক ভাই রুবি বু’র হাত ধরে টেনে দাঁড় করালো, তারপর ভাবীর কোলে ঘুমন্ত বোধনকে দেখিয়ে বললো, ‘দ্যাখ, দ্যাখ, কেমনে কইরা ঘুমাইতেছে।’ ভাবীকে দেখিয়ে বললো, ‘আর এই মহিলাডারে দ্যাখ, নৌকার তন নামতে গিয়া কেমনে গোসল কইরা উঠছে। আর তোরা এইখানে একটা মরা বাছুর লইয়া পূজা করতেছোস! এই বাড়িতে আমি কেন আসমু? ওরা কেন আসবো?’
রুবি বু, বড় চাচী, বড় চাচা সবাই যেন নড়তেও ভুলে গেছে। স্থির হয়ে আছে প্রতিটি শরীর। শফিক ভাই যেন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন, ‘কি, তোমরা কেউ নড়বা না এইখান থেইকা? পূজা করবা? পূজা? এই মরা বাছুর লইয়া পূজা করবা?’ নিচু হয়ে বাছুরটার একটা কান ধরে মৃত শরীরটা টেনে টেনে বারান্দার এক কোনায় নিয়ে গেলো শফিক ভাই।
কালু কি বুঝলো কে জানে। গলায় বাঁধা দড়িটা ছেড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো। সামনের পা দুখানা সজোরে ঠুকতে থাকলো মাটির সঙ্গে। আকাশ ফাঁটিয়ে চিৎকার করে উঠলো, ‘হাম্বাআআআ!’ সে চিৎকারে কান্না ছিলো, তীব্র কষ্ট ছিলো, আর্তনাদ ছিলো।
আর কি কিছু ছিলো?
বড় চাচা পাথর হয়ে বসে আছেন। যেন কোন মানুষ নন, একটা প্রাণহীন খড়ের গাদা। খোলা বারান্দার মাটির মেঝে ছুঁই ছুঁই বন্যার পানি। তীব্র স্রোতে আরো পানি বাড়ার আভাস। শফিক ভাই তার চকচকে চামড়ার জুতো পড়া পায়ের এক ধাক্কায় বাছুরটার মৃত শরীরটা ফেলে দিলো জলের স্রোতে, ‘নেও, এইবারতো হইছে। পূজা শেষ। এহন ঘরে চলো।’
বাছুরটার শরীর ঝুপ করে পড়লো পানির স্রোতে, তারপর ডুবে গেলো। এবং সাথে সাথেই অদ্ভুতভাবে শান্ত হয়ে গেলো কালু। একদম শান্ত। বোধনকে ভাবীর কোল থেকে নিয়ে শফিক ভাই ঘরে গেলেন। মা বাবা চুপচাপ চলে গেলেন ঘরে। খানিক বাদে রুবি বু, বড় চাচীও। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম বারান্দার বাইরে, আমগাছটায় হেলান দিয়ে। আর বড় চাচা কালুর সামনে খড়ের গাদায় চুপচাপ বসে আছেন। তার শূন্য দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে, বাছুরটার মৃত শরীর যেখানে ডুবেছে, ঠিক সেখানে। কালুও। কালুর বড় বড় চোখ দুটো পলকহীন তাকিয়ে আছে পানির স্রোতে। কান্না কিনা জানি না, তবে ওর চোখের কোল ভিজে আরো কালো হয়ে আছে। কালুর চোখ পৃথিবীর সুন্দরতম চোখ। ওই চোখে আমি রোজ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি।
কিন্তু সেই চোখে আজ চোখ পড়তেই আমি ভয়ে কেমন কুঁকড়ে গেলাম।
৬.
ভোরের এখনো অনেক বাকী।
কিন্তু আমার ঘুম ভেঙে গেছে। শেষরাতে ঠান্ডা পড়েছে বলেই হয়তো। একটা পাতলা কাঁথা হলে ভালো হতো। আরাম করে ঘুমানো যেত। বড় চাচা অবশ্য আরাম করেই ঘুমাচ্ছেন। দেখে ভালো লাগছে। গত দুরাত একফোঁটা ঘুমান নি। বানের পানি বেড়েছে হু হু করে। উঠান ডুবে গেছে পুরোপুরি, বারান্দার খানিকটাও। গতকাল সন্ধ্যায় ঘরের ভেতরও পানি উঠে গেছে। শেষ পর্যন্ত মা-বাবাও এঘরে উঠে এসেছেন। সেদিনের পর, শফিক ভাইয়ের বাছুরের ঘটনা নিয়ে আর কোন কথা বলেনি কেউ। কেউ না।
বড় চাচাও যেন সব ভুলে গেছেন। সারাদিন কাজ, কাজ আর কাজ। উঠোনে বাঁশের উঁচু মাচা বেঁধেছেন। সেখানে তুলে দিয়েছেন হাঁস-মুরগীর খোপ। বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে প্লাস্টিকের নীল পলিথিন দিয়ে সেই খোপ ঢেকেও দিয়েছেন। ধানের গোলা উঁচু করেছেন আরো। ঘরের চৌকিগুলোও। ছোট নৌকাখানা আলকাতরা মেখে শুকাতে দিয়েছেন। বড় বন্যার প্রস্তুতি!
কালুর ঘরেও পানি ঢুকেছে গতকাল। আমাদের ছনের ঘর থেকে চৌকিখানা এনে তারওপর কালুকে তুলে দিয়েছেন বাবা। কালুর কাছে একদিন আর যান নি বড় চাচা।
আমাকে বলতেন কালুর জন্য খড়, খইল, ভূসি দিয়ে দিতে। কালুকে দেখলে আমার কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়। সেটা ভয় না কষ্ট আমি জানি না। আমি কালুর কাছাকাছি যাই না। দূর থেকে কালুকে খাবার দিয়ে চলে আসি। কালু সামান্য খড় মুখে নিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে খড়ের ভেতর। ওর চোয়াল ক্রমাগত নড়ে। ক্ষণে ক্ষণে শরীরটা মৃদু কেঁপে ওঠে। চোখের নিচের অনেকটা জায়গা জুড়ে গাড় কালো ভেজা দাগ। আমি বড় চাচাকে কিছু বলি না। বড় চাচাও আমাকে না। আমরা কেউই কাউকে না।
শফিক ভাই, ভাবি আজ চলে যাবেন। বড় চাচাকে ঘুম থেকে ডাকা দরকার। চাচা বলেছিলেন আলো ফোটার আগেই বের হবেন। নৌকা করে গঞ্জে দিয়ে আসতে হবে শফিক ভাইদের।
আমি বড় চাচাকে ডাকি, ‘চাচা, চাচা, ওঠেন। বেয়ান হইতে চললো মনে হয়।’
আমার আলতো ডাকেই বড় চাচা উঠে বসেন। তার চোখের কোথাও ঘুমের চিহ্ন নেই। বড় চাচা কি তাহলে ঘুমান নি?
‘তুই ঘুমাস নাই আনু?’ বড় চাচার গলা কি শান্ত!
‘ঘুম ভাইঙা গেলো চাচা।’ আমিও উঠে বসি। জামাটা মাথা গলিয়ে গায়ে জড়াই।
‘পানি তো আরো বাড়ছে রে আনু।’ বড় চাচা দড়ির উপর ঝোলানো গামছাটা কাঁধে ফেলেন। তারপর লুঙ্গিটা হাঁটুর উপর তুলে দু’ভাঁজ করে কোমড়ে বাঁধেন। ‘চল, নৌকাটা বাইর করি। আজান দিলে নামাজডা পইড়াই বাইর হইতে হইবো।’
বড় চাচী, রুবি বুও উঠে পড়েছেন। বড় চাচা রুবি বুকে ডেকে বলেন শফিক ভাইকে তুলে দিতে। আমি বড় চাচার হাত ধরে পানিতে নামি। ঠান্ডা! দরজার বাইরে আবছা অন্ধকার। সেই অন্ধকারে পানি ঠেলে আগাই আমরা। পেছনের বারান্দার সাথে আমগাছে নৌকাটা বাঁধা। চাচা আমাকে দুহাতে উঁচু করে নৌকায় তুলে দেন। তারপর বৈঠায় ভর দিয়ে নিজেও উঠে পড়েন। ভাঁজ খুলে হাঁটুর নিচে নামিয়ে আনেন লুঙ্গি। নৌকা থেকে কিছুটা ঝুঁকে বন্যার পানিতেই অজু সারেন বড় চাচা। এখনো আজান হয়নি। খানিকটা আলোকিত পূবাকাশ। সেই আবছা আলোয় আমি পেছনের বারান্দায় তাকাই। সেখানে চৌকির উপর শুয়ে আছে কালু। মৃদু নড়ছে ওর মাথা। বড় চাচা কাঁধের গামছা বিছিয়ে বসে পড়েন আজানের অপেক্ষায়। ভোরের তাজা হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে ওঠে বড় চাচার লম্বা দাড়ি। নৌকার খুব কাছেই টুপ করে লাফিয়ে ওঠে ছোট মাছ। শান্ত পানিতে মৃদু ঢেউ ওঠে। ঢেউগুলো ছড়িয়ে পড়ে পুরো উঠোন জুড়ে। সেদিকে তাকিয়ে বড় চাচা জিজ্ঞেস করেন, ‘বেয়ান তো হইয়া আইলো, এহনো আজান হয় না কেন রে আনু?’
এই সময় চিৎকারটা কানে এলো। আকাশ ফাঁটানো চিৎকার।
‘বোধন! বোধন!!
যেন প্রবল ভয়ে আরো কেঁপে ওঠে উঠোনের ঢেউ। যেন ঝনঝন ভেঙে যায় ঘুমন্ত ভোর। শফিক ভাই, ভাবী, বড় চাচী আর রুবি বু’র চিৎকারের কণ্ঠগুলো আর আলাদা করা যায় না। আমি পাগলের মতো মাথা ঘুরিয়ে তাকাই। খোলা দরজা দিয়ে ঝড়ো হাওয়ার মতো ছুটে আসছে রুবি বু। তার বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরা ভেজা চুপচুপে ছোট্ট এক শরীর। বোধন! বোধনের গা থেকে গলগল করে ঝরে পরছে পানি। কমলা রঙের উলের জামার ভেতর থেকে বোধনের ছোট্ট পেটখানা বেঢপ ফুলে আছে। রক্তহীন সাদা ফ্যাকাশে মুখ। প্রাণহীন!
‘বাবা, বোধন! বোধন! বোধন নাই বাবা! বোধন রাইতে পানিতে ডুবছে বাবা!’ রুবি বু যেন উন্মাদ।
পেছনে পাগলের মতো ছুটে আসছেন বড় চাচী, ভাবী, শফিক ভাই। হতবুদ্ধ বড় চাচা যেন ঘোরের মধ্যে নৌকা থেকে নামেন। ছলকে ওঠা জল ভিজিয়ে দিলো পুরো শরীর। রুবি বু কাটা গাছের মতো ঝাপিয়ে পড়লো বড় চাচার বুকে। বড় চাচার শক্ত হাত দুখানা বোধনের ছোট্ট শরীর বুকে চেপে ধরে।
শফিক ভাইয়ের গলায় জান্তব আর্তনাদ, ‘বোধন, ও বোধন, ও বাবা, বাবা, আমার বোধন, আমার বোধন!’ শফিক ভাই যেন পুরোপুরি উন্মাদ। বড় চাচার গায়ের ভেজা জামাটা শক্ত হাতে ধরে টানছেন আর গোঙাচ্ছেন। বড় চাচা খুব ধীরে, খুব ধীরে বা হাতে শফিক ভাইকে কাছে টানলেন।
আল্লাহু আকবার… আল্লাহু আকবার…
ফজরের আজা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *