ছোটগল্প।। তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।। মণীশ রায়

দুদিন কেটে গেল। তবু হিল্লির কানে খবরটা পৌঁছায়নি কেউ। ভেবে এখন মন খারাপ হচ্ছে খুব।
অবশ্য ওর যা অবস্থা তাতে নিজে থেকে আর কারো খবর নেবার সুযোগও নেই। শরীর ভারি, ঝিমুনি আসে যখন তখন। দুই-আনা তিন-আনা অনুভূতি শরীরের কোষে কোষে, হাত-পা-কোমর ম্যাজম্যাজ করছে সারাক্ষণ। বারবার আড়মোড়া ভেংগেও এর থেকে নিস্তার মিলছে না কিছুতেই।

শীতটাও পড়েছে খুব। ক্ষণে ক্ষণে কড়া রোদে ঝলকে উঠতে চায় হিল্লির মন ও শরীর। অথচ সারাদিন ধরে আকাশের মুখ গোমড়া, একফোঁটা রোদের দেখা নেই কোথাও। ভোরবেলায় যত হিমকুচি ঝরেছে আকাশ থেকে, সেই রেশ এখন দিনভর। কম্বল মুড়ানো জবুথবু শীতকাল, কাটতেই চায়না। শরীর যেন পাথর, একটুখানি নড়তেও চায় না!

লালু মাঝে মাঝে কাজের ফাঁকে এসে ওর খবর নিয়ে যায়। খুব ব্যস্ত, মনিবের সঙ্গে সুপার-গ্লু হয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকা নিষ্ঠ সেবক সে। আসলে সে ভালো করেই জানে কিভাবে মনিবের মন জয় করে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে হয়।

যেখানে মোরগ-মুরগির কেনাবেচা ও থাকার জায়গা, এর পাশেই পুরনো কম্বল-কাপড় মুড়ানো ওদের অনুপম বাসস্থান। রোজ সকালে গু-মুত পরিষ্কার করে ওদের থাকার জায়গাটা সাফ-সুতরো রাখে কাজের বুয়া। তাতেই ওরা বেজায় খুশি, অন্যদের তুলনায় নিজেদের রীতিমতো রাজা-রানি বলে মনে হয়।
প্রতিবেশী মোরগ-মুরগিগুলোর পায়ে-পায়ে লাল পিঁপড়ের মতো ভয়-ডর। চোখ মেলে তাকালেই মালিকের সরাসরি এজেন্ট লালুর গম্ভীর চেহারা; বেশি চেঁচামেচি করার সাহস নেই একদম। পাছে ঘাড় মটকে দেয়, সারাক্ষণ সেই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে বেচারারা। ইচ্ছে থাকলেও আগের মতো প্রাণ খুলে খুব একটা লাফ-ঝাঁপ দেয়া বা নিজেদের ভেতর কথাবার্তা-ঝগড়াঝাঁটি করতে চায় না। আগে তো প্রায়ই এক-দুজন অতি উৎসাহী, সৌভাগ্যের আশায় কিংবা আসন্ন মৃত্যুভয়ে, বেড়ার ফাঁক-ফোকর গলিয়ে একেবারে বাইরে হারিয়ে যেত। মালিকের হিসাবে গড়মিল হত পরদিন সকালে। ভুরুতে কুঞ্চন দেখা দিত যখন তখন। এখন লালুকে থাকার জায়গা করে দেবার পর সেসব অযাচিত লোকসান থেকে রেহাই পেয়েছে মালিক; সেজন্য বড়ই প্রীত ভুলু মুন্সী ওদের উপর। ভুলু মাঝে মাঝেই লালুর ঘাড়ে-গর্দানে আর গলার তলায় আদর দিয়ে মিষ্টি সুরে বলে,‘ দেহিস, রক্ষক য্যান ভক্ষক না হইয়া পড়ছ আতকা। তাইলে কৈলাম খুন কৈরা ফেলামু।
’লালু কুঁইকুঁই শব্দ করে লেজ নেড়ে উত্তর দেয়,‘ অত খাওন দ্যান, অত আরামে রাখছেন আমরারে আর আমরা করুম আপনের অপকার? ছিঃ। ’বলে সে তীব্রভাবে মাথা নাড়ে। কিন্তু ভুলু মুন্সী তা বুঝতে পারে না।

সে ল্যাজ-নাড়ানোকে প্রভুভক্তি হিসাবে ভেবে নিয়ে হৃষ্টচিত্তে কাজে চলে যায়। লালু তার পিছু-পিছু ঘুরে বেড়ায়।
প্রতিদিন প্রচুর মোরগ-মুরগি বিক্রি হয় এ দোকানের। তালতলা মার্কেটে সবচেয়ে চলতি দোকান বলতে ভুলুর দোকানটাকেই বোঝায়। টিনের চালার নিচে খোপ বানিয়ে সোনালি-দিশি-ফার্মের মুরগি বিকি-কিনি হয়। যে যেটা পছন্দ করে, একবার দেখিয়ে দিলে, মালিক কিংবা মালিকের লোক সেটা ধরে এনে কলেমা পাঠ করে হালাল মতে জবাই দিয়ে দেয়। এজন্য ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো এখানেই ছুটে আসে মাংস নিতে।

অবশ্য অন্য দোকানের চাইতে দাম সামান্য বেশি এখানে। কারণ সে যেমন মাপে কম দেয় না তেমনি মোরগ-মুরগিগুলোও দেখতে-শুনতে বেশ তরতাজা। চোখ গেলেই লকলকিয়ে ওঠে মাংসাশী মানুষের লোভী চোখ। ঘোষপট্টির মিষ্টির দোকান মাতৃভাণ্ডারের মতো সবার একটা বিশ্বাস এসে গেছে মধ্যবয়স্ক পরহেজগার ভুলুর উপর। সকালের দিকে মুরগি খেকোদের রীতিমতো লাইন লেগে যায় দোকানের সামনে ।

দুপুরের দিকে নাড়িভুড়ির পাহাড় জমে পাশে। কত আর খাবে হিল্লি? মাঝে মাঝে নিমন্তন্ন পাঠায় পুরনো বন্ধুদের। এর ভেতর বাঘা রয়েছে। বাঘাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সে এখন ওদের সমাজপতি। যেকোন বিপদে সে পাশে এসে দাঁড়ায়। লালু ওর সাকরেদ। বিপদে পড়লে বাঘার পরামর্শ ছাড়া ওর চলেই না।
শুধু গাপ্পুর ব্যাপারে লালুর বারণ রয়েছে। শুরুর দিকে বেশ কবার ঝগড়া বেধেছিল গাপ্পু আর লালুর ভেতর। হিল্লির কাছে লালুকে কিছুতেই ঘেঁষতে দেবে না সে। ওকে গলিতে ঘোরাঘুরি করতে দেখলেই অকারণে সে ঘেউ ঘেউ করে উঠত।
দুজনার ভেতর প্রেম তখন সবে পাকতে শুরু করেছে।

বিচক্ষণ গাপ্পু শুরুতেই লালুর মতলবটা ধরতে পেরেছিল। হিল্লির আশকারা পেয়ে নাছোড় লালু একেবারে দিওয়ানা তখন। যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব অন্তরে। যে করেই হউক হিল্লিকে সে উদ্ধার করবে বুড়োর আস্তানা থেকে।

হিল্লির কাছে বুড়ো গাপ্পু বড়ই একঘেয়ে তখন। সারা শরীরে ঘা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর বড় বড় কথা বলে মুখে। কবে কোনকালে সে ঢাকায় রাজার হালে ছিল এসব শুনে শুনে কান পঁচে গেছে হিল্লির। চরম বিরক্তিকর সব কথা-কাহিনি। মুখ খুললেই এসব; নইলে মন খারাপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে একঠায়। সে নাকি দার্শনিক, বড় চিন্তক ওদের সমাজের। তাতে ওর কী যায় আসে? সে এটুকু বুঝতে পারছে, এর সঙ্গে থাকলে যে-কটা দিন হেসে-খেলে বাঁচতে পারত, তাও ঘুচে যাবে। ফাঙাস পড়ে যাবে মনের খাঁজে খাঁজে– এ ব্যাপারে নিশ্চিত সে।

একসময় পেটের তীব্র ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে হয়তো গাপ্পুকে মেনে নিয়েছিলে। তখন দুঃসহ করোনাকালের সবে শুরু। প্রাণভয়ে ভীত মানুষের দল কাজ-কর্ম ফেলে শীতের পোকা-মাকড়ের মতো ঠাঁই নিয়েছে ঘরের ভেতর। একফোঁটা খাদ্য নেই কোথাও, হোটেল-রেস্তোরাঁ সব বন্ধ। বেঁচে থাকাটাই তখন সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। তাই বলে কি সারাজীবন এই উজবুকটার সাথে থাকা যায়?

আরেক ফ্যাসাদ হল কদিন থেকে গাপ্পু ওকে নিজের প্রেমিকা ভাবতে শুরু করেছে। দগদগে শরীর নিয়ে কেবল ওর সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি করতে চায় যখন তখন। শরীরে একফোঁটা তাগদ নেই। তবু কিছুতেই ছাড়তে চায় না, মনের জোরে যেন বেধে রাখবে সব। তাই রেগেমেগে একদিন সোজাসুজি চলে এসেছে লালুর কাছে। এখন অনেক সুখি সে। সে যা চেয়েছিল, নিশ্চিন্ত-নির্ভাবনাময় সুস্থির-সচ্ছল জীবন, তা-ই পেয়েছে। ওর এখন আর আফসোস নেই।
এখন সবাই ওর সামান্য করুণা পেতে ঘুরঘুর করে আশেপাশে। অফুরন্ত খাদ্যের মালিক সে। সপ্তাহে-সপ্তাহে পার্টি দেয় লাঞ্চ-ডিনারের।

গর্বিত রাশভারী চালচলন এখন হিল্লির। লালুকে ভালবেসে ওর সন্তানের মা হবে কদিন পর। তাই সমস্ত মন জুড়ে মাতৃত্ব অর্জনের অপার প্রশান্তি। শরীর চলে না তবু ভালোবাসার বুদ্বুদ অন্তরে।

এরকম সময়ে বাঘা ওর কানে কানে বলে উঠল, ‘জানিস, গাপ্পু আর নেই।
’সঙ্গে সঙ্গে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে হিল্লি,‘ফালতু কথা কইছ না তো। মেজাজ খারাপ অয়। যুবতী দেইক্যা একটা বেডি আইনা দে বুড়ারে। দেখবি, লাফ দিয়া উঠব। তহন সব এক্কেরে ঠিক। ব্যাটা নামে পণ্ডিত, আসলে ফটকা। সুযোগ পেয়ে ইচ্ছেমতন গাপ্পুকে ঝাড়ে সে। একনিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে সে হাঁপাতে থাকে। আজকাল বেশি কথাও বলতে পারে না হিল্লি, আইঢাই লাগে।

আসলে সে বুঝতেই পারে না গাপ্পুর মৃত্যুর সত্যতা। ভাবে বাঘা মশকরা শুরু করেছে গাপ্পুকে নিয়ে। এখনও কাছাকাছি বসলে পুরনো রঙ্গরসিকতা ভর করে ওদের উপর। এটা ওদের পুরনো আদত। হয়তো সেরকম কিছু একটা।

’তোর বিশ্বাস হচ্ছে না রে হিল্লি? সত্যি বলছি, বেঁচে নেই আমাদের গাপ্পু আংকেল। দুষ্টু মানুষগুলো খাওয়ার সাথে বিষ দিয়ে মেরে ফেলেছে তারে। আমি লাশটাও দেখতে পারি নাই। শালারা ট্রাকে করে নিয়ে চলে গেছে দূরে। ইদানীং মানুষগুলো ক্ষেপে উঠেছে আমাদের উপর। আমরা নাকি কারণ ছাড়াই কামড়াই ওদের, সেজন্য কাতারে কাতারে আমাদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। পারলে মানুষগুলান তো পুরা দুনিয়াটারে খাইয়া ফেলবার চায়। আমরারেও খাওনের তালে আছে। ’এসময় অসহায় একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে বাঘার ভেতর থেকে।
সহসা হিল্লির চোখের সামনে সবকিছু ফাঁকা হয়ে যায়।

মনে হচ্ছে একটা কাঁটাওলা জিগা গাছ ছিল মাথার উপর; কোনও কাজে লাগত না। মাঝে মাঝে বড় বড় বিছা ঘুরে বেড়ায় এর ডালে আর পাতায়। তবু প্রচণ্ড গরম পড়লে ঐ কাঁটাগাছটার নিচে দুদণ্ড জিরানো যেত; সেটুকুও সাঁঝবেলার মেঘলা আকাশের ঘোলা বকের মতো শূন্যে মিলিয়ে গেল। ভাবতেই ওর বুকের ভেতরে পদ্মার পাড় ভাঙার হতাশা ভর করে। গাপ্পুর জন্য কখনও এরকম লাগবে তা সে ভাবেনি। সাহচর্যের ছায়াগুলো মায়া হয়ে কি এভাবেই মুখ ঢেকেছিল ওর ভেতরে?

কদিন থেকেই ভাবছিল একদিন দেখতে যাবে গাপ্পুকে। বুড়োর উপর রাগটা পড়ে গেছে ওর, আগের মতো আর নেই, শীতের বেলার প্রথম রোদের মতো গাপ্পু ধীরে ধীরে মায়া ছড়াচ্ছে ওর ভেতর। নিজে মা হবে; মনটা তুলতুলে কাদা হয়ে আছে। যা ভাবে তাই গেঁথে যায় ভেতরে। যখন তখন চোখে জল আসে আবেগে। লালুকে কথাটা জানাতেই সে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। কিন্তু গর্জন দিয়ে না বলেনি। তাছাড়া ওর চরম দুঃসময়ে গাপ্পুই তো ওর একমাত্র ভরসা ছিল। নিজের খাবারটুকু ভাগ করে দিত ওকে। নইলে এদ্দিনে সে না খেতে পেয়ে নিশ্চয় রাস্তায় ঢলে পড়ত। সেরকমই দশা হয়েছিল করোনা-শুরুর দিকে।
হিল্লি ফ্যালফ্যাল করে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকে বাঘার দিকে। তারপর একসময় কোন এক গায়েবী শক্তির জোরে যেন বলে উঠল, ‘তোরা কিছুই করলি না?
কিছুই করার ছিল না তোদের?’

’আমি তো আংকেলকে মানা করেছিলাম। কেউ আদর করে খাবার খাওয়াতে এলে বিশ্বাস না করতে বলেছি। তবু কেন যে উনার মতো বিচক্ষণ প্রাণী এরকম করলেন? বুঝতে পারলাম না। ব্যাপারটা, রহস্যই থাইকা গেল।’

’হয়তো ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে মারা যাবে জেনেও খেয়ে নিয়েছে। ক্ষুধার জ্বালা যে কি ভয়ংকর আমি জানি বাঘা। হাড়ে হাড়ে জানি আমি তা। হয়তো আমার কারণেই মারা গেল গাপ্পু। কোনদিন তো এখানে ডাকিনি। এত খাবার চারপাশে তবু গাপ্পুকে খেতে দিই নাই। অথচ একদিন ওর মুখের খাবার খেয়ে আমি বেঁচেছি। তখন লালুরা কোথায় ছিল? ’বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল হিল্লি। বুকটা ওর ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। গাপ্পু কেন মারা গেল তা যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে হিল্লি। একদম স্পষ্ট!

দীর্ঘসময় থেকে গাপ্পুকে হিল্লি জানে। ভাবুক আর অভিমানী প্রকৃতি তার। শরীরের শক্তি তলানিতে, লড়ে খাবার যোগাড় করার তাগদ নেই। করোনায় ম্যাডামের মৃত্যুর পর কে আর এখন ওর মুখের সামনে খাবার বেড়ে দেবে? এরকম সজ্জন মানুষ তো আর ভুরিভুরি মেলে না, কালেভদ্রে এক-আধজন। তাঁর তিরোধানের সাথে-সাথে আদর্শ-বিশ্বাসগুলোও ফুঁস। তাই হয়তো দিনের পর দিন উপোস দিয়েছে গাপ্পু, সহ্য করতে না পেরে মারা যাবে জেনেও বিষ মিশানো খাবার খেয়েছে সে। ভাবতেই বুক উগড়ে উথাল-পাতাল কান্নার ঢেউ হিল্লিকে বেসামাল করে তুলছে। ওর এখানে কত খাবার পঁচে যায়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ময়লার গাড়ি এসে তুলে নেয় সেসব। আর সামান্য খাওয়ার অভাবে গাপ্পু আত্মহত্যা করল?

লালু সব শুনে থ। হিল্লিকে নিয়ে গাপ্পুর সঙ্গে ওর বিরোধ ছিল সত্যি কথা। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে সে অত্যন্ত উঁচু ঘরানার জীব। সংবেদনশীল, উদার ও চিন্তাশীল প্রকৃতি তার। কারো উপকার করতে পারলে সে বর্তে যেত। এমন বড় আত্মা যার, সে কিনা মারা গেল মানুষের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে? পুরো পার্টির পরিবেশটাই পাল্টে গেল চোখের নিমেষে। সবাই একবাক্যে এধরনের জঘণ্য স্বভাবধারী রাক্ষুসে মানুষগুলোর নিন্দা করতে শুরু করে দেয়।

‘বাঘা বলল, ‘এটুকুতেই এর ইতি টানা উচিৎ হবে না। গাপ্পু আংকেলের মতো শত শত আত্মীয়-বন্ধুরা গুটিকয় মানুষের নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে প্রতিদিন। কাতারে কাতারে তারা মারা যাচ্ছে, সামনে আরো যাবে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।’

’লালু উত্তর দিল, ‘এটা মানুষ শাসিত গ্রহ, আমাদের নয়। আমরা পরাক্রমশালী মানুষের উপর নির্ভরশীল এক প্রভুভক্ত প্রাণী। তাদের খেপিয়ে আমরা কী আর করতে পারবো, বল বাঘা?’

’সবাই তো আমাদের মারতে চায় না লালুভাই। অনেকেই জানের চেয়ে ভালবাসে আমাদের । আদর করেন নিজেদের ছেলে-মেয়ের মতন। আমাদের নিয়ে ভাবেন। তাদের সঙ্গে নিয়েই দুষ্টুদের রুখতে হবে।’

লালু চুপ করে থাকে একথায়। কেন যেন ওর এসমস্ত কথা খুব একটা জুতসই বলে মনে হচ্ছে না। এদেশে আলোকিত মানুষের সংখ্যা আর কত? বেশিরভাগ মানুষই এদের দেখতে পারে না। স্যুট-কোট পরা ভদ্রলোক চা পান করে গরম তলানিটুকু গায়ে ছুড়ে দেয় কিছু না ভেবেই, ঠ্যাং লুলা করে দেয় আঘাত করে। বয়স্করা তো বটেই, বাচ্চারা পর্যন্ত এই হিংস্র মানসিকতার বাইরে নয়। এরকম দুর্বিসহ এক সমাজে এই কজন মানুষ কিভাবে স্তূপিকৃত সব অসভ্যতাকে দূর করবে? এ কি আদৌ সম্ভব?
লালুর ছোটভাই ভিমরু খানিকটা বেয়াড়া গোছের। মাথা বেশ গরম। সামান্য বিরক্ত হলেই মানুষের দিকে তেড়ে যায় কামড়াতে। রাগে ঘরঘর করে সবসময়। সে বলে উঠল,
‘ওসব হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিয়ে কিছু হবে না রে বাঘাদা? ওরা হিংস্র। আমাদেরও হিংস্র হয়ে উঠতে হবে।’
‘কিভাবে? ’
‘যেগুলো বিষ মিশানো খাবার নিয়ে আমাদের তাড়া করছে বিভিন্ন মহল্লায়, তাদের আমরা ধাওয়া করব। দেখবেন ভয়ে এগোতে চাইবে না। দুষ্ট মানুষের অন্তরে ভয় বেশি।’
ভিমরুর কথায় সবাই নিশ্চুপ। কারো মুখে কথা নেই। নানারকম সংশয়ে বিদ্ধ সবাই। মানুষের সঙ্গে পেরে ওঠা অসম্ভব; কষ্টকল্পনা ছাড়া কিছু নয়। ওদের খেপিয়ে কি থাকা যাবে ওদেরই গড়া এ নিষ্ঠুর গ্রহে? ওরা শক্তিশালী, প্রতিশোধপ্রবণ। দরদী মানুষও রয়েছে পাশাপাশি। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে খাওয়া গুজে দেয় মুখে, চিকিৎসা করায় রোগ বাসা বাধলে শরীরে। এখনও এটুকু ভালবাসা, মমতা, সহানুভূতি হারাবার ভয়ে অনেকেই অস্থির এখানে। ভেতরের কথা বুঝতে দিচ্ছে না কেউ, বিশেষ করে লালু।

সহসা হিল্লি গর্জন দিয়ে বলে উঠল, ‘আমরা দুভাবেই এগোব। ভাল মানুষের পিছনেও থাকব আবার দুষ্টদের শায়েস্তা করারও চেষ্টা করব।’

হিল্লির গর্জনে বাঘা রীতিমতো চমকে ওঠে। ওকে বাঘা দীর্ঘদিন থেকে চেনে। এককালে ওর গার্লফ্রেন্ড হিসাবে পরিচিত ছিল সবার মাঝে। বনিবনা না হওয়ায় দুজন পৃথক হয়ে পড়েছে। হিল্লি বরাবরই উচ্চাকাঙ্ক্ষী, রোমান্টিক ঘরানার এক জীব। কখনও হুজ্জোতিতে জড়ায় না। হাসি ছাড়া কান্না ভাল লাগে না ওর। সবসময় হেসে, খেলে, মৌজ-মাস্তিতে ব্যস্ত থেকে জীবনটা কাটাতে চায় সে। সেই হিল্লির মুখে এসব বিপ্লবী কথাবার্তা? স্বামী লালু যেমরকম মুখচোরা আর সংস্কারাচ্ছন্ন, তাতে তো ওর মুখ তোলারই কথা নয় । তাহলে এমন উদার ও প্রগতিশীল হয়ে ওঠার কারণটা কি হিল্লির? গাপ্পু?

পরদিন সকালেই বাধল মহাগোল। খিলগাঁও চৌরাস্তায় পিকআপ ভ্যানটা এসে সবে দাঁড়িয়েছে। ড্রাইভার তখনও স্টার্ট বন্ধ করেনি পিক-আপের। ভ্যানটার খোলা পিঠে বিষ মিশানো মাংসের ডেকচি। সেখান থেকে ধোঁয়ার দড়ি কুয়াশার সঙ্গে মিতালি পাতিয়ে আকাশে মিশছে।

পিক-আপ থেকে নেমে এল দুজন গাট্টাগোট্টা গড়নের লোক। বেশ কিছুক্ষণ চারপাশটা খুনি চোখে পরখ করে দেখার পর তারা গাড়িতে হেলান দিয়ে আয়েস করে সিগারেট টানতে শুরু করে।

দুজনকেই বেশ নিশ্চিন্ত দেখায় এসময়। ওরা ভালোই জানে নিধন-পর্ব চালাতে ওদের অহেতুক কসরতের দরকার হবে না এখানে। দুঃসহ করোনার সময়ে খাবারের লোভে এক-এক করে ওরা ঠিকই চলে আসবে কাছে। রাজনৈতিক চামচার মতো ঘুর ঘুর করবে ল্যাজ নেড়ে। সুযোগ পেলে ভাঁপ ওঠা মাংস মুখ দেবে। তারপরই নেতিয়ে পড়া লাশে ভরে যাবে রাস্তা। ভ্যানের যেখানটায় গরম মাংশের ডেকচি ছিল, একটু বাদে সেখানটা নিষ্প্রাণ-নিস্পন্দ লাশে ভরে যাবে। সেগুলো নিয়ে ওরা হাসতে হাসতে কেটে পড়বে।

কাজ সেরে ওরা অফিসে ফিরে ওদের মেজাজ-গরম বসকে জানাবে, ‘আইজগা হেভি কাম অইছে স্যার। একশটা খতম। ’বলার সময় কণ্ঠ থেকে ঝরবে হিংস্র আত্মপ্রেম আর উল্লাস।‘

গুড। এ নিয়ে খুব চাপে আছি। প্রায়ই এসব নেড়ী কুত্তাগুলো বসদের বাচ্চাদের ভয় দেখাচ্ছে। কেউ কেউ কামড় পর্যন্ত খেয়েছে। লজ্জায় স্যারদের সামনে চেহারা পর্যন্ত দেখাতে পারি না। দেখা হলেই এক প্রশ্ন, কী করেন, সামান্য কুকুর শায়েস্তা করতে পারেন না? আসলে শহরে থাকার উপযুক্ত নয় এগুলো। ফিনিশ করে দেন সবকটারে। বসের চেহারা ওদের চেয়েও কঠিন দেখায় এসময়।

‘কোন চিন্তা করবেন না স্যার। আর কদিন সময় দেন। সবকটারে মাটির সঙ্গে মিশিয়েই তবে ঘরে ফিরব। ইনশাল্লাহ।‘
গুড। ভেরি গুড। ’বসের চোখেমুখে থাকবে তৃপ্তির হাসি, যা দেখে অধঃস্তনরা হবে গদগদ। মাখনের মতো নরোম-কোমল সৌহার্দ্রের বাতাবরণ বইবে এ অফিসে। আহ, কী প্রশান্তি!
সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে যখন ওদের মাথায় এসব চিন্তা-ভাবনা উষ্ণ রক্তধারার মতো ফিনকি দিয়ে উঠছে তখনই ভিমরুর চোখে পড়ে লোকগুলোকে। এর আগের সপ্তাহে বুদ্ধি করে পিক-আপ ভ্যানটার টায়ারে হিসু ঝেড়ে রেখেছিল সে। কাছে গিয়ে নাক লাগাতেই ধেই-ধেই করে সে নেচে উঠল,‘এটাই বদমায়েশদের গাড়ি। কোন ভুল নাই।’
ভিমরুর কাছ থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে বাঘা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে তীব্র বিদারী স্বরে সবাইকে জানিয়ে দেয়, ‘ঘেউ, ঘেউ, ঘেউ। তোরা তাড়াতাড়ি ছুটে আয়। বদমায়েশদের চিনতে পেরেছি। দৌড়ে আয়। এমনভাবে আইবি য্যান কেউ বুঝতে না পারে।’

ভোরের সূর্য পূর্ণ হয়ে ওঠার আগে থেকে এ ডাকটির জন্য সবাই মুখিয়ে ছিল এতক্ষণ। সঙ্গে সঙ্গে নেকড়ের ভয়ংকর রূপ ধারণ করে নেয় ওরা। তারপর বিভিন্ন অলিগলি ছেড়ে তীব্র বেগে তেড়ে এল পিকআপ ভ্যানটার দিকে। ওদের দৃষ্টিতেও বীভৎস খুনের মাতম।
অঘ্রান মাস, মাকড়শার জালের মতো ঘন কুয়াশার আস্তরণ চারপাশে। সামান্য দূর থেকেও কেউ কাউকে চিনতে পারছে না। শীতের হিমনাচ ভালোই টের পাচ্ছে রমিজ আর ফুরকান। তা সত্ত্বেও বুকের ভেতর সুখ সুখ এক অনুভূতি। একটু পর নিরীহ নেড়ী কুত্তাগুলো নেতিয়ে পড়বে রাস্তার পাশে। সেগুলো নিয়ে ওরা বীরদর্পে ফিরে যাবে। একটা যুদ্ধ জেতার আনন্দে ওরা ডগমগ। সশস্ত্র পাক হায়েনারা যেরকম সুখ পেত নির্বিচারে অসহায় বাঙালিদের হত্যা করে, অনেকটাই সেরকম।

সহসা রমিজ আর ফুরকান সামনে তাকিয়ে চমকে ওঠে। দুজনার চোখ একই সময়ে বিস্ফারিত। ম্যালারিয়া জ্বরের কাঁপুনি সারা অঙ্গে। মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা ফেটে বেরিয়ে আসবে ভেতর থেকে। এ-ও কি সম্ভব ? চারপাশে শতশত কুকুর ধেয়ে এসে ওদের ঘিরে ধরেছে, কণ্ঠে সম্মিলিত ঘেউ-ঘেউ। রাগে ঘরঘর শব্দ বেরুচ্ছে গলা থেকে। ক্ষুধার্ত জিহ্বা থেকে টপটপ করে জল ঝরছে, চোখেমুখে লকলক করছে লোভ আর জিঘাংসা একসঙ্গে।

দৃশ্যটা এতই ভয়ংকর যে রমিজ-ফুরকান তা সহ্য করতে পারে না। মুহুর্তের ভেতর বাঁচার জন্য মরিয়া দুজন গাড়িতে উঠে পড়তে চায়। কিন্তু তার আগেই ভীত-সন্ত্রস্ত ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
দিশাহারা রমিজ আর ফুরকান এবার ছুটতে শুরু করে সামনের দিকে। জীবন বাঁচাতে ভুড়িওলা দুজন ছুটছে আর ছুটছে। একসময় জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় নেতিয়ে পড়ে।
জ্ঞান ফিরার পর ওরা নিজেদের আহত অবস্থায় আবিষ্কার করে হাসপাতালের বেডে। হাতে-পায়ে প্লাস্টার, সারাশরীরে ব্যথা। ড্রাইভার দুর্ঘটনা বাধিয়ে আরো সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে পাশে। অরিরাম গোঙানির শব্দ তার মুখে। কাঁপুনি ভরা অস্ফুট স্বরে একই কথা বারবার, কুত্তা।
বসের মুখখানা তেঁতুল পাতা হয়ে ওদের ম্রিয়মান চোখের উপর ঝুলছে, ভুরুজোড়া চরম বিরক্তি আর ক্ষোভে কোঁচকানো।
‘কী ব্যাপার? দৌড়াচ্ছিলে কেন?’
‘শত শত কুত্তা স্যার। আরেকটু অইলে আমরা ফিনিশ অইয়া যাইতাম স্যার। ’রমিজের গলায় ভয়, সন্ত্রস্ত ফুরকান কঁকিয়ে ওঠে। পাশ থেকে। ড্রাইভারের মাথাও ডানে-বাঁয়ে দোল খায়। কথা বলার তাগদ নেই দেহে। শুধু ড্যাবড্যাব করে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে সেলাইনের বুদ্বুদের দিকে।
‘তাই?
ভেরি স্ট্রেঞ্জ। ’বলে আজমল সাহেব প্রশ্নবোধক মুখ তুলে তাকালেন ডাক্তারের দিকে।
ডাক্তার সাহেব ঝটপট উত্তর দিলেন, ‘সিনোফোবিয়া আজমল সাহেব। কুকুর নিধন করতে গিয়ে দুজনই এ রোগে আক্রান্ত এখন।’
ভেরি স্যাড। ’মুখে একথা বললেও নিমেষে মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। এপর্যন্ত একটাও প্রজেক্ট ওকে দিয়ে সুসস্পন্ন হল না– এ খোটাটা না দিয়ে কি ছাড়বেন আজমল সাহেবের বস?
গজগজ করতে করতে তিনি নিচে নেমে এলেন। প্রাণ খুলে ভেতরের রাগটাও উগড়ে দিতে পারছেন না রমিজ-ফুরকানের উপর। হাত-পা ভাংগা অপারগ বেআক্কেলগুলোর উপর কিভাবে রাগ ঝাড়বেন তিনি? মানবিক একটা ব্যাপার আছে না?
অগত্যা নিজের ছ্যাপ নিজে গেলার মতো ভেতরকার বলক তোলা তীব্র উষ্মাটুকু হজম করে নিচে নেমে গাড়িতে উঠে বসলেন তিনি। সহসা এসময় মনে হল একটা মিশমিশে কালো রঙের কুকুর ওর দিকে জুলুজুলু চোখে তাকিয়ে রয়েছে। চাহনিটা কেমন যেন বেপরোয়া ও বিষাক্ত।
গাড়ির ভেতর বসেও স্যুট-কোট পরা হৃষ্টপুষ্ট বস আজমল সাহেবের বাঁ ঠ্যাংটা কেঁপে উঠল। কুকুরটা চোখ দিয়ে যেন গেঁথে ফেলতে চাইছে ওকে। দ্রুত কাচ তুলে দেন তিনি। বেওয়ারিশ কুকুরটার দিকে সরাসরি তাকাতে সাহস হচ্ছে না তার। তাহলে কি রমিজ-ফুরকানের রোগটা তাকেও?
বাঘা জায়গা থেকে নড়ে না। হিজ মাস্টারস ভয়েসের ছবির মতো সে তাকিয়েই থাকে পরিকল্পনাকারী কুচক্রী এ লোকটার দিকে। উদ্দেশ্য খারাপ কিছু নয়, সামান্য মশকরা করা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *