ছোটগল্প

ছোটগল্প রক্তাক্ত নক্ষত্র- মোজাম্মেল হক নিয়োগী

ধাবমান ঘূর্ণিবায়ুর মতো শিষ দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ছয় ক্রোশ দূরে এসে শিমুল গাছে বসা ঈগলটিকে তীরবিদ্ধ করে তৈমুর বুক ভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ঈগলটি তীরবিদ্ধ হয়ে প্রথমে প্রচ- গতিতে আকাশের দিকে উড়াল দিয়ে অনেকটা উপরে উঠলে শক্তি ফুরিয়ে এলে রক্তাক্ত অবস্থায় ঝপাৎ করে মাটিতে পড়ে—বরকতউল্লাহর সামনে।
বরকতউল্লাহ বারান্দায় বসে ফরসি হুঁকোয় সুগন্ধি তামাক টানছিল। সে ক্রদ্ধ, উদ্বিগ্ন—মুখম-লে কালো ছায়া, তবে ঠোঁটের কোণে ক্রূর হাসি। ধীর অথচ দৃঢ়ভাবে বলল, তাহলে আবু নাসের আমার কথায় কান দেয়নি তাহলে? সে তার কর্মকা- বন্ধ করবে না?
বরকতউল্লাহর সামনে মাটিতে নত শিরে বসে আছে তিনজন, তাদের একজন বলল, না, হুজুর।
বরকতউল্লাহ ধীরে সুস্থে হুঁকোর নলে দম দেয়। সাদা লুঙ্গি, সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত দীর্ঘকার উজ্জ্বল গৌর বর্ণের বরকতউল্লাহ এই এলাকার একমাত্র জমিদার। তার কথায় এ-এলাকার বাঘে-মোষে এক ঘাটে জল খায়। শক্তির দাপটে এলাকার মানুষেরা তটস্থ। শুধু ব্যতিক্রম একজন—আবু নাসের, তাকেই বাগে আনতে পারলেই সে রাজাধিরাজ।
বরকতউল্লাহ চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে খুব ধীরে ধীরে হুঁকো টানছে, ধোঁয়া বের হয় কি হয় না বোঝা কঠিন। অকস্মাৎ ঝপাৎ শব্দটি কানে আসাতে বরকতউল্লাহ চোখ খুলে দেখে—ঈগলটি তড়পাতে তড়পাতে ঝিমিয়ে পড়ে। তীরে ঈগলটির বুক এ-ফোঁড় ও-ফোঁড়। বিস্ময়ের সঙ্গে ঈগলের দিকে তাকিয়ে থেকে বরবকউল্লাহ বলল, কোথা থেকে এলো পাখিটি? এ কীসের আলামত?
তার সামনের লোকগুলো উঠে দাঁড়িয়ে মৃত ঈগলটির কাছে যায়। একজন পাখা ধরে আগলিয়ে বরকতউল্লার দিকে নিয়ে এসে বলল, হুজুর এ কীসের আলামত?
সবার চোখে-মুখে বিস্ময়! কে তীরবিদ্ধ করেছে? আশপাশে তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
সংশয়বাদী মানুষের মনে নানা রকম ভয় থাকে, থাকে নানা রকম দুর্ভাবনা। বরকতউল্লাহ সে-রকম সংশয়বাদী। তাছাড়া নিজের কর্মসম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন থাকায় শত্রুর ভয়ও মাঝে মাঝে তাকে ত্রস্ত করে তোলে, যদিও সে নিজেকে পরাক্রমশালী মনে করে, তার জমিদারি চৌহদ্দিতে পরাস্ত করার কোনো মানুষের এখনও জন্ম হয়নি—তবে আজ তীরবিদ্ধ ঈগলের দিকে তাকিয়ে সে দ্বিধাগ্রস্ত, সন্ত্রস্ত। তবে কি কোনো শত্রু এখানে জন্মগ্রহণ করেছে? তীরবিদ্ধ ঈগল কি বিপদের কোনো ইঙ্গিত? না, তা কী করে হয়, হলে তো জানতাম, মনে মনে ভাবে, শত্রু তো একজনই আছে—আবু নাসের। তবে সে শক্তির শত্রু নয়। আদর্শের তাত্ত্বিক শত্রু। হুম, তাত্ত্বিক শত্রুরাও ভয়ঙ্কর হয়, মানুষকে উসকিয়ে দিয়ে ধ্বংস করতে পারে। তার কাছে যাওয়া-আসা করে তরুণ সমাজ। তরুণ সমাজকে সে দিকভ্রান্ত করছে। তরুণ সমাজ কোনো দিন তার বিরুদ্ধে দাাঁড়াতে পারে এমন ধারণা সে সব সময়ই পোষণ করে।
মুহূর্তের মধ্যেই ধাবমান কালো মোষের মতো এক যুবক এসে ঈগলটি ছোঁ মেরে হাতে নিয়ে সিনা উঁচু করে বরকতউল্লার সামনে দাঁড়ায়।
বরবকউল্লাহ যুবকের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কে, হে যুবক?
আমি তৈমুর। তৈমুর আন্দালিব।
বাহ, চমৎকার নাম তোমার।
প্রশংসার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
তুমি সুন্দর ও সুপুরুষ, হে যুবক। তোমার সাকিন কোথায়?
আমার সাকিন অনেক দূর। ওই যে দূরের পাহাড়ের ওপারে।
তুমি এই ঈগলটিকে শরবিদ্ধ করলে কেন?
এটি উদ্ধত, দুর্বিনীত। তাই ছয় ক্রোশ পথ দৌড়ে এসে একে শরবিদ্ধ করে এর ঔদ্ধত্যের হিসেব চুকে দিলাম। আমার কাছে কোনো ঔদ্ধত্য ক্ষমার্হ নয়। তাই তাকে শরবিদ্ধ করি, আর কোনো কারণ নেই, জনাব।
বরকতউল্লাহ বুঝতে পারে এমন এক যুবক তার প্রয়োজন। এই যুবক যদি বশ্যতা স্বীকার করে তাহলে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাকে স্পর্শ করার স্পর্ধা এ তল্লাটে কারও থাকবে না। যেভাবেই হোক যুবককে বশে আনতে হবে। ওকে দিয়ে পথের কাঁটা সরানো সম্ভব। গম্ভীর হয়ে ভাবতে থাকে কী করে একে বশে আনা যায়। ভাবে, এমন যুবক পৃথিবীতে আর ক’টি জন্মায়!
যুবকের কথায় মনে হয় বরকতউল্লাহর ধ্যান ভাঙে। আমি এখন আসছি জনাব, বলল তৈমুর।
বরকতউল্লাহ কোনো রূপ ইতস্তত না করেই বলল, হে যুবক, তুমি সাহসী। বীর। আমার আতিথেয়তা গ্রহণ করে কি আমাকে কৃতার্থ করা যায়? আমি খুব প্রীত হব যদি তুমি আমার অতিথিশালায় কয়েকদিন থেকে যাও।
কিন্তু আপনি কেন আমাকে আতিথ্য গ্রহণ করতে বলছেন, তা পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন।
তোমার বীরত্ব দেখে আমি মুগ্ধ। বীরের কদর করে আমি সম্মানিত হতে চাই।
বরকতউল্লার সামনের মানুষগুলো এতোক্ষণে সমস্বরে বলল, জী, হুজুরকে সম্মানিত করুন। তিনি অতিশয় অতিথিবৎসল। ওনার আতিথ্য গ্রহণ করলে আমরাও ধন্য হই।
যুবক রাজি হয়ে বরকতউল্লাহর আতিথ্য গ্রহণ করে। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় অতিথিশালায়। অপূর্ব সুরম্য প্রাসাদ। দেয়ালে সাজানো পুরনো বিখ্যাত শিল্পীদের কয়েকটি শিল্পকর্ম। বিশাল কক্ষটির মাঝখানে ঝুলছে চোখ-ধাঁধানো মূল্যবান ঝাড়বাতি। বিদেশী টাইলস ঝকঝক করছে। একপাশে একটি সোফা। নরম তুলতুলে বিছানা। তৈমুর সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। অতিথিশালার উত্তর পাশে সুবিস্তৃত বাগান। ফুল, ফল ও ঔষধি গাছের বিপুল সমারোহ। জানালা খুলে বাইরে তাকায় তৈমুর। ঝিরঝিরে উত্তরা হিমেল বাতাস শরীর জুড়িয়ে দেয়। হঠাৎ তার চোখে পড়ে এক অষ্টদশী তন্বী, অপূর্ব সুন্দরী, লাল শাড়ি পরিহিতা। বাগানে হাঁটছে। পদ্মের পাপড়ির মতো পায়ে রুপোর নূপুর, হাতের সোনার কাঁকন, কোমর অব্দি ছড়ানো ঘন কালো চুল—মুগ্ধতায় প্রায় অচতন তৈমুর— নিবিড় ও গভীর চোখে তাকিয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ। মেয়েটি বাগান থেকে গোলাপ তুলে চুলের ভাঁজে গুঁজে দেয়। তৈমুর মনের অজান্তেই বলে, অপূর্ব! অপূর্ব!
কিছুক্ষণ পর মেয়েটিও তৈমুরকে দেখতে পেয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে আসে জানালার কাছে। ব্রীড়ানত চোখ, জিজ্ঞেস করে, অতিথিকে চিনতে পারলাম না। আপনার পরিচয়?
আমার পরিচয় বলতে তেমন কিছু নেই। আমি ওই পাহাড়ের ওপাশে থাকি। এটুকুই জেনেই প্রীত হও।
দুজনই চোখে-চোখ রাখে—কেটে যায় কয়েকটি মুহূর্ত, আর সেই সঙ্গে এক অভূতপূর্ব জৈবিক রসায়নে মনের ভেতর শুরু হয় আকর্ষণ-বিকর্ষণের তোলপাড়। চারপাশে নেমে আসে বরফের মতো শীতল স্তব্ধতা। তৈমুর সেই স্তব্ধতা ভেঙে একবার জিজ্ঞেস করে, তুমি কি অপ্সরী? নাকি কোনো মানবকন্যা?
খিলখিল করে হাসে মেয়েটি। আমি অপ্সরী নই। মানবকন্যা। বরকতউল্লাহ আমার পিতা। আমার নাম হাসনা বানু। আপনি কি এখানে কিছুদিন থাকবেন?
তোমার বাবা বলল, তার আতিথ্য গ্রহণ করার জন্য। আমি রাজি হয়ে গেলাম। এখন মনে হয়েছে আতিথ্য গ্রহণ না করলে এ জীবন ব্যর্থ হয়ে যেত।
এমন কথা বললেন কেন? আতিথ্য গ্রহণের সঙ্গে জীবনের ব্যর্থতা আর সার্থকতার কী সম্পর্ক থাকতে পারে?
আজ তোমাকে দেখে আমার দুচোখ ধন্য হলো। চোখ দুটি সার্থক হলো। আমার দুচোখ দিয়ে আর অন্য কোনো নারীর মুখ দেখার বাসনার দীপ আজ নিভে গেল। এমন সুন্দরী নারী এই জীবনে আর কোনোদিন দেখেনি। আর এখানে যে কয়দিন থাকব যদি তোমার সান্নিধ্য পাই তাহলে জীবনও সার্থক হবে।
হাসনা বানু কোনো কথা বলেনি। তৈমুরের চোখে চোখ রেখে আনমনা ভাবতে থাকে নানা বিষয়। সেও মনে মনে বলে, তোমাকে দেখে আমার দুচোখও সার্থক হয়েছে আজ। এমন রূপবান মোহমুগ্ধময় যুবক আমিও এর আগে কখনও দেখিনি। অতিথি তুমি এখানে আজীবন থেকে যাও।
কী ভাবছো হাসনা বানু? তৈমুরের কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় হাসনা বানু।
ভাবছি, কতদিন তাহলে থাকবেন এখানে—আমাদের অতিথি হয়ে।
দেখি কতদিন থাকা যায়। মন বলছে জীবনটাই এখানে কাটিয়ে যাই।
অতিথিশালার দরজায় টোকা পড়ে। হাসনা বানু পাশ কেটে অন্দর মহলের দিকে পা বাড়ায়। তৈমুর দরজা খুলে দেয়। বিরাট রেকাবি ভর্তি খাবার নিয়ে হাজির হয় খানসামা।
সালাম সাহেব, খানসামা বলল।
সালাম।
আপনি মর্জি ফরমাইলে আপনার খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারি। হুজুরের হুকুম।
অবশ্যই। তুমি তোমার কর্তব্য পালন করে যাও। আমার কোনো ওজর-আপত্তি নেই।
কসুর মাফ করবেন, সাহেব। আপনার খানাপিনা যখন যা প্রয়োজন হয় শুধু গোলামকে হুকুম করবেন।
তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। তোমার আপ্যায়ন অতি উৎকৃষ্ট।
তাহলে এখন আমাকে ধন্য করুন, সাহেব। আপনি তৈরি হয়ে বসুন, আমি খাবার পরিবেশন করব।
তৈমুর খেতে বসে। এ-রকম আয়োজন করে খাওয়া তৈমুরের জীবনের প্রথম ঘটনা। জীবন কাকে কোথায় নিয়ে যায় তাই সে ভাবে ক্ষণকাল। খেতে খেতে বলে, এই আয়োজন আমার জন্য অর্ঘ। আমি বিমোহিত।
আপনার সেবায় কিছু করতে পেরে আমি ধন্য। কোনো কসুর হলে মাফ করবেন, জনাব।

দুপুরে খাওয়ার পর তৈমুর লম্বা ঘুম দিয়ে বিকেলে আগমোড় ভেঙে জেগে ওঠে। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই দরজায় টোকা পড়ে। তৈমুর দরজা খুলে দেখে দুপুরের সেই খানসামা বিকেলের নাশতা নিয়ে দাঁড়িয়ে। রোদের তেজ নেই। বাড়ির চারপাশের ঘন গাছগাছালি। ঝিরঝিরে স্নিগ্ধ বাতাস শরীর জুড়িয়ে যায়। বরকতউল্লাহর রুচিবোধ দেখে তৈমুরের মনোজগতে মুগ্ধতা সুস্পষ্ট প্রভাব ফেলে। একদিনের আপ্যায়নেই বরকতউল্লাহ তৈমুরের মন জুড়ে স্থান করে নেয়। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে হাসনা বানু।
বিকেলের নাশতা খেয়ে তৈমুর অতিথিশালা থেকে বের হয়ে বাগানে গিয়ে একটি দোলনায় বসে। বকুল ফুলের মিষ্টি সুবাস বাতাসে ভাসছে। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত বাগানের চারপাশ মুখরিত। দোলনায় বসে ধীর লয়ে দোল খায় তৈমুর। এক অভূতপূর্ব আবেশে জড়িয়ে যায় তার শরীর ও মন।
এভাবে কেটে যায় দিন তিনেক। কয়েকটি দিন।
প্রতিদিনই হাসনা বানুর সঙ্গে দেখা হয়। কথা হয় নির্জন নিবিড় বাগানের পরিবেশে। যত না কথা হয়েছে মুখের ভাষায় তার চেয়ে ঢের বেশি কথা হয়েছে চোখের ভাষায়। দুজন গভীর মনোযোগে পাঠ করেছে দুজনের চোখের হাজার বছরের নিগূঢ় পঙতিমালা। অব্যক্ত ভাষা হয়ে ওঠেছে বাঙ্ময়।
আজ বিকেলের হিঙুল রোদ্দুর ক্রমে নিভে যায়। পূর্ণিমার তিথি। পুবের আকাশ রাঙিয়ে বৃত্তাকার চাঁদটি প্রথমে লালচে থাকলেও সে ভাবটি ধীরে ধীরে কেটে যায় সন্ধ্যার পর পরই, তারপর নির্মেঘ আকাশে রুপোর থালার মতো শাদা ঝকঝকে অমলিন চাঁদ পাহাড়ের চূড়ার ওপর দিয়ে উঁকি দেয়। কিছুক্ষণ পরেই ধবল জোছনায় চারপাশ থৈ থৈ করতে থাকে। শরীর ও মন জুড়ানো হিমেল বাতাস। তৈমুর মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে।
দোলনায় বসে মোহাচ্ছন্নতায় কতটা সময় কাটে সে দিকে খেয়াল নেই তৈমুরের। এক সময় নূপুরের রিনিঝিনি শব্দে চমকে যায় তৈমুর। তবে মুহূর্তে আরও ঘোরের মধ্যে পড়ে। সে বিস্ময়ে বিমূঢ়। আকাশ থেকে নেমে আসা যেন এক পরি, শাদা কাপড় পরিহিতা হাসনা বানু তৈমুরের সামনে দাঁড়িয়ে মিটিমিট করে হাসছে। অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও যখন তৈমুরের ঘোর কাটে না তখন হাসনা বানু বলল, অতিথি কি খুব বেশি অবাক হলেন?
হ্যাঁ। খুব অবাক হয়েই দেখছি আর ভাবছি আকাশের চাঁদ কী করে মর্ত্যে নেমে এলো! এই নির্জন বাগানে জোছনা রাতে এক অচেনা অতিথির সামনে তুমি দাঁড়িয়ে আছো, কলঙ্কের শঙ্কা নেই বুঝি?
আকাশের চাঁদের যদি কলঙ্ক থাকতে পারে তাহলে মর্ত্যরে চাঁদের কলঙ্কের শঙ্কা থাকার কি কোনো কারণ আছে? তাছাড়া, যার মনের খবর পেয়েছি তাকে আর ভয় কীসে?
মনের খবর পেয়ে গেছো?
আমি সবই বুঝি। আপনার চোখ দুটি আমি নির্ভুল পাঠ করেছি এই ক’দিন। আপনি বলুন, আমার পাঠ কি নির্ভুল নয়?
অবশ্যই নির্ভুল। তবে সে পাঠই কি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে?
হ্যাঁ। ঘরে টেকা বড় কঠিন হয়ে গেছে। আমার মন চায় এই ভরাট পূর্ণিমায় থৈ থৈ করা জোছনায় একটি রাত এই দোলনায় বসে কাটিয়ে দিই। এমন ধবল জোছনা কি আর সব মানুষের কপালে আছে যে দেখে! তাই ছুটে এলাম। একটি জীবনকে স্মৃতিময় করার জন্য এই ভরাট জোছনা আর নৈঃশব্দ্যের ভিতরে বাঙ্ময় পঙ্তির অনুসন্ধান করা জীবনের জন্য কি অমূল্য অর্ঘ্য নয়?
তোমার আর কোনো শঙ্কা কি নেই?
আর কীসের শঙ্কা?
তোমার মা, বাবা, সমাজ?
আমার মা নেই। বাবাই সব। তবে যতটুকু বুঝি বাবা আমার মতের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নিবে না। এখন শুধু অতিথির পূর্ণ সাড়া পেলেই আমার সমস্ত অস্তিত্ব সমর্পণ করতে পারি। প্রাণে প্রাণ ছুঁয়ে পাড়ি দিতে পারি জীবনের দীর্ঘ নদী।
আমার চোখ তুমি নির্ভুলইভাবেই পাঠ করেছো। তবে আর ভণিতা কেন? এসো হাসনা বানু। এসো আমার পাশে এই ধবল জোছনায় কিছুটা সময় দুজনে পাশাপাশি বসি। চাঁদকে বলে দিই, হাসনা বানু, আরেক চাঁদ আমার পাশে।
হাসনা বানু তৈমুরের পাশে দোলনায় বসে ধীরে ধীরে দোল খায়। এক সময় হাসনা বানু তৈমুরের হাত ধরে বলে, বলো, কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের মতো কোনো তিমিরে হারিয়ে যাবে না।
তৈমুরের শরীর ও মন শিহরিত হয়। সে বলল, আমার একটাই জীবন, এ জীবন শুধু তোমারই। তোমাকেই দিলাম। আমার প্রতিজ্ঞা।
আমারও প্রতিজ্ঞা, এ-জীবন তোমাকেই দিলাম।

গাঢ় অন্ধকারের প্রাচীর ভেদ করে সীমাহীন ঠাণ্ডা আকাশে নাকফুলের মতো রুপালি নক্ষত্রগুলো দৃষ্টি টেনে নেয়। অতিথিশালার বাইরে ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে বরকতউল্লাহ আকাশের দিকে তাকিয়ে রাত্রির প্রহর ঠাহর করার চেষ্টা করে। তারপর, ফটকের কড়া নাড়ে। ভিতর থেকে ফটক খুলে সামনে দাঁড়ায় তৈমুর। কিছুটা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, এতো রাতে আগমন, জনাব? আমাকে হুকুম করলেই আপনার কাছে যেতে পারতাম।
যুবক, তুমি কেমন আছো? জমিদারির কাজে সদরে গিয়েছিলাম, তাই তোমার খোঁজ-খবর নিতে পারি নি। আপ্যায়নে কি কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে?
জি না, জনাব। আমি খুব উপভোগ করছি। চমৎকার সব ব্যবস্থা। আপনার অতিথি পরায়ণতার কোনো তুলনা নেই।
তোমার কথা শুনে প্রীত হলাম, যুবক। দাঁড়িয়ে কথা বলব তাহলে? বরকতউল্লাহর কণ্ঠে ঠা-া ক্ষোভ প্রকাশ পায়।
জি, না, না। আসুন। আসুন। আমি কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম, তাই ভুলে হয়ে গেছে। ক্ষমা করবেন জনাব।
বরকতউল্লাহ ভিতরে গিয়ে সোফায় বসে। সামনের আরেকটি সোফায় তৈমুর। মাথা নত করে বসে কথা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে বরকতউল্লাহর দিকে।
বরকতউল্লাহ গম্ভীর হয়ে বলল, যুবক, তোমার সাহস আর বীরত্বের তারিফ করতেই হয়। তুমি যদি আমার একটা উপকার করে দাও তাহলে তোমার মনোবাসনা পূরণ করার জন্য প্রতিজ্ঞা আমি করতে পারি। আমি তোমার মনোবাসনা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছি।
বলুন, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি? শুধু হুকুম করুন।
হুকুম করার আগে তোমাকে বুঝতে হবে। আমি চেয়েছিলাম আমার জমিদারির চৌহদ্দিটা নিষ্কণ্টক থাকবে। কিন্তু একটি কাঁটা বড় ঝামেলা করছে। মতাদর্শগত কারণে সে এলাকার যুবসমাজকে ক্ষেপিয়ে তুলছে যা ভবিষ্যতে আমার জমিদারি, জীবন এবং সম্পদের বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এই কাঁটাটা তুলে ফেলতে হবে।
হুকুম করুন, জনাব। কে সে?
তার নাম আবু নাসের। আবু নাসের একটি মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। একটি তীব্র অশান্তির নাম।
জনাব, আমাকে হুকুম করুন।
তুমি এখনই যাবে। এই নাও ছোরা। নাসেরের রক্তে ছোড়াটি রাঙিয়ে আমাকে উপহার দেবে। আর আমি তোমার মনোবাসনা পূরণ করার জন্য প্রতিজ্ঞা করলাম। তুমি ফিরে এলেই সব ব্যবস্থা পাকা করা হবে।
আবু নাসেরের সাকিন কোথায়, বিস্তারিত বলুন জনাব।
নন্দবিলের দক্ষিণেই দেখবে একটি ছোটখাটো বাড়ি। বাড়িটি বৃক্ষশোভিত, নানাজাতের গাছে পূর্ণ। সেখানেই তার বসবাস।

বরকতউল্লাহর বাড়ির কিছুটা দক্ষিণ দিকেই বিশাল বিল। বকের পালকের মতো ধবল জোছনা বিলের পানিতে থৈ থৈ করছে। বিলের পশ্চিম পাশে প্রশস্ত গোচারণ ভূমি। স্থানীয়রা বলে ‘গোপাট’। সেই গোপাট ধরে তৈমুর ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই পৌঁছে যায় আবু নাসেরের বাড়ির আঙ্গিনায়। বাড়িটি জরাজীর্ণ। চারপাশে গাছগাছালি। মাঝে একটি টিনের ঘরের ভিতরে হ্যারিকেনের টিমটিমে আলো। তৈমুর এগিয়ে যায় ঘরের দরজার কাছে।
দরজাটা সামান্য ফাঁক করা। তৈমুর ঘরের ভিতরে তাকিয়ে দেখে বই আর বই। হাজার হাজার বই। কয়েকটি আলমারি, কয়েকটি রেক, আর অসংখ্য বইপত্র মাটিতে। মাঝখানে একটা টেবিল, তার ওপর একটি খোলা বই। টেবিলের পাশে দুতিনটি চেয়ার। তৈমুর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দেখে বৃদ্ধ খোলা বইটির পাতায় মগ্ন পাঠকের মতো ঝিম ধরে পড়ছে। শরীরটা রোগা, ফ্যাকাশে, হালকা-পাতলা গড়ন। গায়ে হালকা একটি গেঞ্জি। তৈমুর ভাবে, এই লোককে খুন করব কেন? সাধু পুরুষ। জ্ঞানতাপস। ওকে খুন করতে আমাকে কেন পাঠাল? দ্বিধাগ্রস্ত তৈমুর ঘরের ভিতরে ঢুকে আবু নাসেরর পাশে দাঁড়ায়। আবু নাসের পাঠে এতোটাই মগ্ন যে, তৈমুরের আগমন টের পর্যন্ত পায় নি। বেশ কিছুক্ষণ পর তৈমুর আবু নাসেরের সামনে ছোরাটা ধরে।
বৃদ্ধ আনু নাসের শান্ত চোখে ছোরাটার দিকে তাকিয়ে তৈমুরের দিকে ফিরে ঠাণ্ডা ও দরাজ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, কী চাই, যুবক?
আমি আপনাকে খুন করতে এসেছি।
অবিচলিত কণ্ঠে আবু নাসের বলল, খুন করতে এসেছো, ভালো কথা। যুবক, তুমি বসো, আমি এখনই আসছি।
আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
তোমার জন্য চা করে আনি। চা খেয়ে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করবে। ঠাণ্ডা মাথায় খুন করলে ভবিষ্যতে ধরা পড়বে না।
হতভম্ব তৈমুর পাথরের মতো চেয়ারে বসে। একি মানুষ নাকি অন্য কোনো প্রাণী, নাকি দেবতা, তৈমুর ভাবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আবু নাসের দুকাপ চা নিয়ে এসে চেয়ারে বসে। আবু নাসের খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল, চা খাও।
তৈমুর হতবিহ্বল, দ্বিধাগ্রস্ত। আবার ভাবছে চায়ে বিষ মিশিয়ে দেয়নি তো!
তৈমুরের চা নিতে ইতস্তত করলে আবু নাসের ধমক দিয়ে বলল, কী হলো? চা খাও।
তৈমুর ভয়ে কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দেয়। তার চোখ দুটি চকচক করে। ভাবছে যতই মতলব দেখাও তুমি, মনে করো না বেঁচে যাবে। আমার মনোবাসনা, হাসনা বানুর জন্য তোমার মতো দশটি জ্ঞানতাপসকে খুন করতে পারি। যদিও তৈমুরের ক্রোধ কিছুটা প্রশমিত হয়ে আসে তবুও কৃত্রিম ক্রোধ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে।
আবু নাসের বলল, আমাকে কেন খুন করতে চাও?
আপনি বরকতউল্লাহর মতাদর্শের বিরোধী। তার বিরুদ্ধে তরুণদের ক্ষেপিয়ে তুলছেন। আপনি তার প্রভাব ও প্রতিপত্তির প্রতিদ্বন্দ্বী। এজন্য আপনাকে খুন করা হবে।
আবু নাসের বলল, পৃথিবীর সব মানুষের মতাদর্শ এক হয় না যুবক। তুমিই বলো, শুধু গোলাপ দিয়ে কি বাগান হয়? শুধু এক প্রকার বৃক্ষ দিয়ে কি পৃথিবীকে সুশোভিত করা যাবে? আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখো, কত ধরনের গ্রহতারানক্ষত্র! বৈচিত্র্যই মাধুর্য। আর এই মাধুর্যই সৃষ্টির ঐশ্বর্য। আর এখানেই সৃষ্টির রহস্য। আমি এক জীবন ধরে সাধনা করে একটি গাছের পাতার সৃষ্টির রহস্যও উদঘাটন করতে পারিনি। তুমি পারবে একটি মাত্র পাতার সৃষ্টির রহস্য উদঘাটন করে দিতে? তাহলে অন্তত মরার আগে আমি শান্তি পেতাম এই ভেবে যে, আমার সাধনা সফল হয়েছে।
তৈমুরের সত্তায় নাড়া পড়ে। একি বলে এই বৃদ্ধ তাপস! একথার রহস্য কী? তিনি কী বোঝাতে চান?
চেয়ারের পিছনে হেলান দিয়ে বৃদ্ধ আবু নাসের বলল, বরকতউল্লাহ তোমাকে বিভ্রান্ত করেছে। তার সঙ্গে আমার কখনও মুখোমুখি বৈরিতা হয়নি। আমি চলি জ্ঞানের পথে। সে চলে অজ্ঞতার পথে। জ্ঞান আমার সম্পদ আর সহায়। ওর সহায় হলো প্রভাব আর প্রতিপত্তি। আমি তার প্রভাব ও প্রতিপত্তির প্রতিদ্বন্দ্বী কখনই নই। মতাদর্শ বৈরিতা বলতে এটুকু বোঝায়। তবে রবকতউল্লাহর অন্যরকম মতলবও আছে। আমার সামান্য কিছু সম্পদ আছে তা গ্রাস করতে চায় আমাকে নিশ্চিহ্ন করে। তোমাকে ভ্রান্ত ধারণা দিয়ে আমাকে খুন করতে পাঠিয়েছে। যুবক, তোমাকে বাধা দিয়ে আমি নিজেকে রক্ষা করতে পারব না। তাই পরাজয় মেনে নিয়ে বলছি, তুমি আমাকে খুন করো।
বৃদ্ধ চেয়ারের পিছনে মাথা হেলান দিয়ে চোখ দুটি বন্ধ করে মনে হয় পরম আরামে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কৃশকায়, ফ্যাকাসে মানুষটিকে গভীর চোখে দেখে তৈমুর। তার অন্তরাত্মায় ঝাঁকুনি লাগে। ভাবতে ভাবতে সে অজানা রহস্যময় একপ্রকার ঘোরের মধ্যে ডুবে যায়। তার এই ঘোর সহজে কাটে না। এক সময় সে চেয়ার ছেড়ে উঠে ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে আসে।
গোপাট ধরে ধীর পদবিক্ষেপে তৈমুর এগিয়ে যায়। ক্ষয়িষ্ণু অলস ক্লান্ত চাঁদের ধবল জোছনা ম্লান হয়ে আসে। হঠাৎ তার বুকে একটি বল্লম এসে বিদ্ধ হয়। যুবক তৈমুর গোপাটের কোমল ঘাসের ওপর পড়ে যায়। বুকের ক্ষত থেকে প্রবল বেগে রক্ত ক্ষরণ শুরু হয়। চিৎ হয়ে শুয়ে সে আকাশের অসীমতার দিকে তাকিয়ে থাকে স্থির দৃষ্টিতে। লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র রুপোলি আগুন জ্বালিয়ে মিটমিট করছে। তৈমুরের চোখ বন্ধ হয়ে আসে, সে দেখতে পায় রুপোলি নক্ষত্রগুলো ক্রমে রক্তের মতো লালাভ থেকে লাল টকটকে হয়ে আকাশে ঝুলছে, সে অনুভব করে, এই পৃথিবী নামক গ্রহটি কোটি কোটি গ্রহতারার পানে ছুটছে ক্ষিপ্র গতিতে। ছুটতে ছুটতে পৃথিবী একটি বালুর সাগরে একটি বালুর কণা হয়ে মিশে গেছে।

পরে যুবক তৈমুরের মৃত্যুর খবর হাসনাবানু শুনতে পায়। এই মৃত্যুবার্তা হাসনাবানুকে এতোটাই বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত করে যে, সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে নি।
পরদিন ভোরে দেখা যায় বিয়ের সাজে হাসনা বানু বাগানের দোলনায় বসে আছে। হাসনা বানু বসে আছে বটে তবে তার দেহে কোনো প্রাণ ছিল না

One thought on “ছোটগল্প রক্তাক্ত নক্ষত্র- মোজাম্মেল হক নিয়োগী

  • Morshed

    রূপক চরিত্রের এই গল্পটিতে মনে হচ্ছে এক প্রতিভাবান যুবককে রূপসী কন্যা আর বিলাসী জীবনে প্রলুব্ধ করা হয়। অন্যদিকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত এক বৃদ্ধকে হত্যা করতে চেয়েছে অজ্ঞ-গৃধ্নু জমিদার। লেখক এখানে হয়তো দেখিয়েছেন, জ্ঞানের কাছে অজ্ঞতার পরাজয়। কিন্তু প্রশ্ন আসতে পারে, যুবককে কেন হত্যা করা হলো? কে হত্যা করল? উত্তরটি পাঠককে খুঁজে নিতে হবে। এভাবেও ভাবা যায়, যে, প্রলোভনের ফাঁদে আটকে গেলে সেখান থেকে বের হওয়া যায় না। যুবকের পরিণতিতে তাই প্রতীয়মান হলো। আবার কে হত্যা করল? যেহেতু যুবকের বুকে তীর বিদ্ধ হলো তাই স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, এটি সেই জমিদার বা তার পোষ্যদের কাজ। পিছন দিক থেকে হলে বোঝা যেত, জ্ঞানী ব্যক্তি দ্বারা যুবককে খুন করা হয়েছে। রূপসী কন্যা কেন আত্মহত্যা করল? গল্পটি তো যুবকের খুনের পরেও শেষ হতে পারত! হয়তো লেখক বুঝিয়েছেন, যে মেয়েটিকে লোভ দেখিয়ে যুবককে প্রলুব্ধ করা হয়েছে সেই মেয়েটি ছিল সত্যিকারের ভালোবাসায় সিক্ত। এবং অজ্ঞ-গৃধ্নু ব্যক্তির কবল থেকেও সে মুক্ত হতে চায়। মুক্তি নিল আত্মহত্যা করে।
    একজন পাঠক হিসেবে, আমার পড়া একটি অত্যন্ত ভালো লাগা গল্প। এই গল্পটির গভীরে কী আছে তা লেখকই ভালো বলতে পারবেন; তবে আমার দৃষ্টিতে এ-রকমই মনে হয়েছে লেখকের শিল্পসম্মত লেখাটিতে।

    Reply

Leave a Reply to Morshed Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *