ছোটগল্প।। মূল্য।। সাঈদ আজাদ

তাহের উঠানের কোণে বসে মন দিয়ে কবুতরের খোপ বানাচ্ছে। যখন কোনো কাজ করে তাহের, তখন কোনো দিকে খেয়াল থাকে না তার। স্বভাবটাই এমন ওর। যে কাজ করে সেটাতেই চোখ-মন চিন্তা নিমগ্ন থাকে। এখনো তাই। খুব মনোযোগ দিয়ে তক্তায় মাপ মতো খোপের দরজা কাটছিল। বারবার ফিতা দিয়ে মেপে সাবধানে করাত চালাচ্ছে কাঠে। করাত চালনোর ব্যাপারেও খুব সতর্ক তাহের। হাত কেঁপে করাত সরে গেলে কাঠ কাটা সোজা হবে না। সবগুলো দরজা মাপে সমান না হলে খোপ দেখতে সুন্দর হবে না। সে কারণে তীক্ষ্ণ চোখে করাতের দিকে তাকিয়ে কাঠ কাটে তাহের।

খোপের দরজা অর্ধেক কাটার পর কাঠটা চোখের সামনে থেকে একটু দূরে ধরে, এক চোখ বন্ধ করে দেখে তাহের। দেখে সন্তুষ্টই হয়। না, ভালোই হয়েছে কাটা। তিনটা দরজাই সমান মাপের হয়েছে। ঊনিশ-বিশ যদি হয়েও থাকে, অন্তত খালি চোখে দেখে বোঝার উপায় নেই। দরজা কাটা কাঠটা লাগিয়ে খোপের সামনের অংশ তারকাঁটা দিয়ে আটকে দেয়।

মেয়ে মণি এতক্ষণ বাপের পায়ের কাছেই খেলছিল। সাবিনা মেয়েকে রেখে বোধহয় গোসল করতে গেছে পুকুরে। যাওয়ার সময় অই রকমই কী যেন বলছিল। গেছে যে গেছেই, ফেরার আর নাম নেই। আর সব কাজে সে ভালো; করেও ঝটপট। কিন্তু এই এক কাজে গেলে সময়ের প্রতি খেয়াল থাকে না। দুপুরে গেলে বিকাল হলে ফেরে। খেলতে খেলতে কখন যে মণি উঠানের এককোণে ছাইগাদার কাছে চলে গেছে, খেয়াল করেনি নিজ কাজে মগ্ন তাহের।

সাবিনা উঠানে পা দিয়েই চিৎকার করে উঠে, ‘হায়, হায় রে! আমার মাইয়্যাডা পুইড়া মরলো! কেমন বাপ আপনে! আপনের কাছে রাইখ্যা উট্টু পুস্কুনিত গেলাম গাও ধুইতে। কী সর্বনাশটা অইল!’ বলতে বলতে সাবিনা দৌড়ে গিয়ে মণিকে ছাইয়ের গাদা থেকে টেনে বের করে। মায়ের সাথে সাথে তিন বছরের মণিও চিৎকার করছে। ছাইয়ের গাদা থেকে বের করার পর দেখা গেল, মণির ফর্সা গা লালচে হয়ে গেছে। এখানে ওখানে ফোসকা। এতক্ষণ কেন কাঁদল না মেয়েটা। আশ্চর্য তো! কান্নার শব্দে মেয়েটাকে ছাইগাদা থেকে আগেই তুলতে পারতো তাহের।

‘হায় হায় রে, কী সর্বনাশটাই না অইলো! ছেরিডার সারাডা শইল পুইড়া কী অইছে! ঘাও শুকাইলেম এই দাগ যাইব ছেরির শইল্যেত্তে? কেমন বাপ আপনে! জন্ম দিছেন, তেও মাইয়্যাগ প্রতি উট্টু মায়া নাই। এই দাগে ছেরির বিয়া দিতেও সমস্যা অইব। এমন বাপ জন্মে দেহি নাই। চোউখ্যের সামনে নিজের ঝি পুইড়া মরে, আর হেয় আছে কবুতরের খোপ লইয়্যা। নিজের ঝিয়ের চেয়ে আপনের কাছে দুই পইশার কবুতরের দাম বেশি অইল! কান্দিস নারে মা, কান্দিস না। যেই পোড়া কপাল লইয়্যা জন্মাইছস, সারাজীবনই সামনে পইড়া আছে কান্দনের লাইগ্যা।’

সাবিনার চিৎকারে পড়শিদের কেউ কেউ এসে দাঁড়িয়েছে উঠানে। কিন্তু তাহেরের কোনো হেলদোল নেই। একবার মাত্র তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। আবার নিজের কাজে মন দেয়। খোপ বানানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু খোপটাতো চালের নিচে শক্ত করে বাঁধতে হবে। মই দরকার। মই ছাড়া অতো উঁচুতে হাত যাবে না। মইটাতো উঠানেই থাকে। আজ কোথায় গেল? এদিক ওদিক তাকায় তাহের। সাবিনা তার মতো চেঁচিয়েই যাচ্ছে। মেয়েদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা স্বভাব হয়ে গেছে তার। মেয়ে খেলতে গিয়ে উঠানে একটু আছাড় খেলেও চেঁচিয়ে সারা গ্রামের লোক জড়ো করে বাড়িতে।

ধান সিদ্ধ করার পর যে ছাই হয়েছে, তাই-ই উঠানের একপাশে স্তুপ করে রাখা হয়েছে। মণি বোধহয় সে ছাইয়ের গাদায় পড়েছে। ধান সিদ্ধ করা হয়েছে সকালে। নাড়া আর পাতা কুটার ছাই। তাতে কতক্ষণ আর তেজ থাকে? একটু আধটু পুড়েছে বোধহয়। তাতে বিচলিত হওয়ার কি আছে! বাচ্চা কাচ্চারা অমন একটু আধটু ব্যথা পায়ই। ওসব নিয়ে এতো আদিখ্যেতা করতে নেই- সে কথা কে বুঝাবে সাবিনাকে? আর মেয়ে মানুষের জীবন হলো গে’ বিড়ালের জীবন। সহজে হয় না কিছু। জনমভর কম তো দেখা হল না। এসব ভেবে জটলা থেকে উঠে মইয়ের খোঁজ করতে যায় তাহের।

দাদাকে চোখে না দেখলেও, জন্মের পরপর দেখেছে বাড়িতে দুই দাদি। দাদা নাকি মরেছিল তিরিশ বছর বয়সে। সাপের কামড়ে। বাপ জব্বার আলীর মুখে শোনা। কিন্তু দুই দাদি বেঁচেছিল বহু বছর। দুজনেই প্রায় একশ বছরের মতো হায়াত পেয়েছিল। বাড়ির সবাইকে জ্বালিয়ে খেয়েছে দুই বুড়ি। তারপর একটু বয়স হলে তাহের দেখেছে, দুই ফুপু বিধবা হয়ে ফিরে এসেছে বাপের বাড়িতে। কলেরা হয়ে গ্রামের প্রায় সব পুরুষ মরলো। তাহেরদের বাড়ির পুরুষরাও মরে সাফ হয়ে গেল। ফুপুদের কিছু হল না! তাহেরও বোধহয় গ্রামে থাকলে বাঁচতো না। তখন নানির বাড়িতে ছিল তাহের।

ছাগলটা কখন থেকে চেঁচাচ্ছে। মাঠ থেকে আনতে যেতে হবে। রোদের মধ্যে অতক্ষণ বাঁধা। তার উপর গাভিন। যখন তখন বিয়াবে ছাগলটা। আহা অবলা জীবটার কষ্ট হচ্ছে খুব। বাড়ি আনা দরকার। এনে খইল ভুসি দিতে হবে। বোধহয় এতক্ষণ রোদে থেকে পিপাসাও পেয়েছে। এদিকে মইটাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কেউ নিলো না তো। সাবিনার এই আরেকটা খারাপ স্বভাব। কেউ কিছু চাইলেই হল, হুট করে দিয়ে দেয়। বাড়িতে জিনিসটার প্রয়োজন আছে কিনা, একবার ভেবেও দেখবে না। একবার তাহেরকে জিজ্ঞেসও করবে না।

তা সাবিনার ভালো মানুষিটা খালি বাইরের মানুষের সাথেই। নাহলে তাহেরের সাথে কবে মিষ্টি স্বরে দুটো কথা বলেছে? বিয়ের পর থেকে একরকম দেখে আসল। যেন মনের মধ্যে সবসময় গনগন করছে আগুন। সুযোগ পেলে তাই উগরে দেয়। প্রতিবেশীরাও তার খারাপটাই দেখে। সাবিনার কোনো দোষ তারা পায় না।

মনের মধ্যে আগুন তাহেরেরও জ্বলে। সব সময়। তুষের আগুন…। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে কালো ছাই। কিন্তু একটু নাড়া দিলেই ভেতরে দেখা যাবে লালচে আগুন। কেউ কি তার খবর রাখে? রাখে না। আর তাহেরইবা কখন বুঝতে দিয়েছে, সে আগুনের কী তাপ! নিজের বউ সাবিনাই তার মনের খবর রাখে না। অন্যের কথা ভেবে আর কী লাভ? এক সময় এসব নিয়ে খুব দুঃখ হতো তার। সে বিয়ের কয়দিন পরের কথা। কিন্তু কবে সেসব দুঃখ মাটি চাপা দিয়েছে তাহের। দুঃখ নিয়ে এখন আর দুঃখ করে না।

তাহেররা চারবোন, একভাই। বাপের ছেলে বলতে তাহেরই। চার বোনের ছোট সে। জীবনভর চার মেয়ে নিয়ে হিমশিম খেয়েছে তাহেরের বাপ জব্বর আলী। চার মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে জমিজমা সবই খুয়েছে। ধারদেনাও হয়েছে মেলা। আর বোনরা সব কালো ছিল বলে বিয়ের সম্বন্ধ আসলেই ফিরে যেত। পাত্রপক্ষ কিছুতেই পছন্দ করতো না তাদের। তারা সবাই মানুষ হিসেবে ভালো ছিল। তাদের চেহারা সুরত খারাপ না। কিন্তু পুরুষ মানুষ আগে দেখে গায়ের রং; না হলে বাপের টাকা আর জমি। সেসব মিললে তারপর তারা দেখে মন।

নিজের জমিজমা যা ছিল, সব বেচে তবে মেয়েদের পাত্রস্থ করেছে জব্বার আলী। অনেক ধারদেনাও হয়েছে মানুষের কাছে। বাপের মৃত্যুর পর বহু খেটে বাপের করে যাওয়া ধারদেনা শোধ করেছে তাহের। আবার সংসারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছে। জমি কিনেছে। বন্ধকী ভিটা ছাড়িয়েছে। সে জমি আর ভিটা এখন কে ভোগ করবে? না, মেয়ের জামাইরা! পরের ছেলের জন্য শরীরের রক্ত পানি করে কামাই করার মানে হয়! কিন্তু করতে হচ্ছে। অতগুলো মেয়ে যার, তার ভবিষৎ তো সুখের হওয়ার কথা না। মেয়েগুলোকে যেমন করে হোক পরের বাড়িতে পাঠাতে তো হবে।

একেই বলে কপালের ফের। বাপ নিঃস্ব হয়েছিল বোনদের বিয়ে দিতে গিয়ে। তাহের নিঃস্ব হবে মেয়েদের বিয়ে দিতে গিয়ে।

পরপর তিনতিনটা মেয়ে হওয়ার পর আবার যখন সাবিনার পেটে বাচ্চা এলো, আশা ছিল ছেলে হবে। আশা করার কারণও ছিল। বাচ্চা পেটে আসার আগে কদমতলির বড় হুজুরের কাছ থেকে পড়াপানি এনে খাওয়ানো হয়েছিল সাবিনাকে। পানিপড়া খাওয়ার পরপরই পেটে বাচ্চা এলো সাবিনার। হুজুরও এমনই বলেছিলেন। পানি খাওয়ার দুসপ্তাহ পরেই পেটে বাচ্চা আসবে। সবাই জানে বড় হুজুরের পড়াপানি অব্যর্থ। ফল ফলবেই। এবার গর্ভ হওয়ার পর সাবিনার চেহারা আর স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মা-চাচিদের কাছে ছোট থেকে প্রবাদ শুনেছে তাহের- ‘মাইয়্যার মা সুন্দরী, পোলার মা বান্দরী।’ সে হিসাবে সাবিনার চেহারা খারাপ হওয়ারই কথা।

প্রতিবেশী মা-খালারাও বলেছে, সব লক্ষণ মিলে, এবার ছেলেই হবে সাবিনার। তাহের অনেক রাত ভেবে ভেবে ছেলের নাম ঠিক করে। বাদশা! ছেলের নাম বাদশাই সই। তার জমিজমার অভাব নেই। খাটতে পারে খুব। জমিও বাড়ছেই। ছেলে না হলে এসব ভোগ করবে বারোভূতে। আর সবচেয়ে বড় কথা, ছেলে হল বংশের বাতি। সাবিনা আর সে চলে গেলে দুনিয়াতে তাদের নাম টিকিয়ে রাখবে ছেলেই। জব্বার আলীকে মানুষ তাহেরের বাপ বলেই তো জানে। বোনরাও যে বাপেরই সন্তান, কয়জন সেকথা বলে!

পানিপড়া খাওয়ার কারণেই হোক, আবার প্রতিবেশীদের কথাতেই হোক, সাবিনারও ধারণা ছিল এবার তাদের ছেলে হবে। তা যে মা গর্ভে দশমাস সন্তানকে ধরে, সে মা কি আর জানতে পারে না তার গর্ভে ছেলে কী মেয়ে! এসব ভেবেও যেন তাহেরের আশা বাড়ছিল।

কিন্তু অত আশার পরে তার হল কিনা যমজ মেয়ে। আগে তো তিন মেয়ে ছিলই। এখন হল পাঁচজন। সান্ত্বনা এইটুকু যে, কোনো মেয়ে কালো ও কুৎসিত হয়নি। আর যাই হোক, সাবিনাকে কেউ অসুন্দরী বলবে না। মেয়েগুলো সব পেয়েছে মায়ের গায়ের রং।

বাড়ি থেকে বের হয়ে কোথাও গেলে তাহেরের আর ফিরতে ইচ্ছা করে না বাড়ি। ফিরবে কী? দিনরাত পাঁচ মেয়ের হৈহল্লায় কোনো কাজ কি ঠিকমত করার জো আছে! না আছে একটু স্থির হয়ে বসার বা আরামের সুযোগ।

নাহ, আজকে আর খোপটা বাঁধা হবে না। মইটা বাড়ির কোথাও নেই। সাবিনা নিশ্চয়ই কাউকে দিয়েছে। ইচ্ছে করছে বউকে কয়টা কড়াকথা শোনাতে। অন্য সময় হলে শোনাতোই। কিন্তু আজকে এমনিতেই মণি ছাইয়ের গাদায় পড়েছে বলে সাবিনার মেজাজ ঠিক নেই। আবার মই নিয়ে কথা বললে হয়তো রাতের রান্নাই বন্ধ রাখবে।

ছাগলটা ডাকছে খুব। আবার সেদিনের মতো কুকুর ঘিরে ধরেছে কিনা কে জানে? গ্রামের কুকুরগুলো হয়েছে এক বিপদ। খাবার না পেয়ে বাড়ির হাঁসমুরগি সব ধরে ধরে খাচ্ছে। গেরস্থের বাড়ি এখন আর কোনো কুকুর ঢুকতেই পারে না। সবাই চোখে চোখে রাখে নিজেদের হাঁসমুরগি। সে কারণেই কিনা, এখন আবার ছাগলের পেছনে ঘুরঘুর শুরু করেছে বজ্জাত কুকুরগুলো। খেতে না পারুক, ছাগলটাকে কামড় দিলেও তো মহা বিপদ। বাঁচানো যাবে না। তিনদিন আগেই শরিফদের দুটো ছাগলের বাচ্চা খেয়েছে কুকুরেরা মিলে।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার মুখে সাবিনা চিৎকার করে, ‘শোনেন, এমন দোফর বেলায় যান কই? ছেড়িডায় লজেন্সের লাইগ্যা কানতাছে। সালামের দোকান থাইক্যা কয়ডা লজেন্স কিন্যা দিয়া যান।’

বউয়ের চিৎকারে সাড়া না দিয়ে তাহের বের হয়।

আজকে বহু টানাটানিতেও ছাগিটা বাড়ি ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না কেন জানি! জোর করে টানতে গেলে ভারী পেট নিয়ে বসে পড়ে। তাহের হিসাব করে দেখে, বিয়ানোর সময় ঘনিয়ে এসেছে ছাগিটার। হয়তো দুইএক দিনের মধ্যেই বিয়াবে। বাড়ির বাইরে যখন যেতে চাচ্ছে না, কী আর করা! থাক, বাড়িতেই…। উঠানের কাছে বরই গাছে ছাগলটাকে বেঁধে কাঁঠাল গাছের একটা ডাল মুখের সামনে ঝুলিয়ে ঘাস আনতে বের হয় তাহের।

দুই আঁটি ঘাস নিয়ে ফিরে এসে তাহের দেখে, শুয়ে আছে ছাগিটা। ভঙ্গিটা কেমন অসহায়। ভালো মতো খেয়াল করে দেখে, পানি ভাঙছে ছাগিটার। দেখে খুশি হয় তাহের। ভাগ্য ভালো বলতে হবে। জোর করে ছাগলটাকে মাঠে খুঁটি দিয়ে আসেনি। মাঠে বিয়ালে বাচ্চা হয়তো কুকুরে টেনে নিত। … আহা, কেমন অসহায়ভাবে ঘন ঘন লেজ নাড়ছে ছাগলটা। বাড়ির লোকজন কেউ নেই আশেপাশে। বউ আর মেয়েরা সবাই জানে, তাহের ছাগলটাকে পছন্দ করে, যত্ন আত্তি করে। তাই আর কেউ ছাগলটার ধারে ঘেষে না। আসলে তাহেরের সাথে পারে না। তাই অবলা জীবটাকেই অবহেলা।

বাচ্চার খুর বের হচ্ছে। খালাস করতে মাটিতে বসে পড়ে তাহের। দুই পা আর মাথা বের হতেই সাবধানে টেনে বাচ্চাটাকে বের করে। পা ফাঁক করে দেখে, ছাগি। খুশি মনে বাচ্চাটাকে মাটিতে আলতো করে শুইয়ে রাখে। পরেরটারও পা বের হচ্ছে। একটু অপেক্ষা করে মাথা দেখতেই দেহটা ধীরে ধীরে টেনে বের করে তাহের। এটাও ছাগি বাচ্চা। যাক, এতদিনে খোদা মুখ তুলে চেয়েছেন। কতজন এই ধাড়িটার বাচ্চা চেয়েছে। ছাগিটা আকারে যেমন বড়, দুধও দেয় অনেক। তবে, মানুষজন চায় এর মাদি বাচ্চা নিতে। নিজেরাও পালবে। এবার নিয়ে তিনবার বিয়ালো ছাগিটা। তা এমনই কপাল, প্রথমবারের দুইটা বাচ্চা ছিল পাঠা, দ্বিতীয় বারের তিনটা বাচ্চার একটা ছিল ছাগি, দুইটা পাঠা। তা সে ছাগিটাও বর্ষাকালে পানিতে ডুবে মরল।

সবাই কিনতে চায় ছাগি বাচ্চা। পাঠাতো পনেরো দিন পরে বিচি ফেলে খাসি করতে হবে। খাসি যে ফেলনা, তা নয়। কুরবানির সময় ভালো দামে বেচা যায়। কদিন আগেইতো গেল কুরবানির ঈদ। বছর খানেক বয়সের দুইটা খাসি বেপারিরাই বাড়ি এসে কিনে নিয়ে গেল পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকায়। কম টাকা! তাও বেপারিদের কাছে না বেচে, হাটে নিয়ে বেচলে আরো হাজার পাঁচেক টাকা বেশি পেত নির্ঘাত। ছাগলটার জাত যেমন ভালো, তাহের যত্ন আত্তিও করে জীবন দিয়েই। তবে ছাগি বাচ্চা হলে খাসির অর্ধেক বয়সে একই দামে বেচা যেতো। ভালো একটা ছাগি হল গে সম্পদ। বাড়ির এককোনায় পড়ে থাকবে। আর বছরে দুইবার বিয়াবে। হিসাব করলে খাসির চেয়ে লাভ অনেক। হয়তো খাওয়ার খরচ আর যত্নের কষ্টটা আছে। কিন্তু যে গরু দুধ দেয়, তার লাথি তো সইতেই হয়।

পরের বাচ্চাটাও ছাগি! আনন্দ যেন ধরে না তাহেরের। বাচ্চাগুলোর হয়েছেও হৃষ্টপুষ্ট। ধাড়িটা হাপাচ্ছে খুব। প্রসবের ধকল যায়নি। তবে উঠে দাঁড়িয়েছে। ফুলটা ঝুলছে পেছন দিকে। এর মাঝেই বাচ্চাদের জিভ দিয়ে চেটে নিচ্ছে। গায়ের ময়লা মুছে দিচ্ছে। আহা, মা যে।

খাবার দেওয়া দরকার ধাড়িটাকে। বড় একটা গামলায় লবণ পানি দিয়ে ভুসি গুলে আনে তাহের। আজকে আর বের করবে না মা ছাগিটাকে। বড় পয়া ছাগলটা। একসাথে তিন তিনটা মাদি বাচ্চা প্রসব করেছে। যত্ন করতেও ভালো লাগে। ছাগিটার ফুল পড়েনি এখনো। গামলটা মুখের সামনে নিয়ে ধরে তাহের। মুখ ডুবিয়ে ভুসি খেতে থাকে ছাগিটা। মাঝে মাঝে খাওয়া থামিয়ে বাচ্চাদের দেখে।

তাহের বলে, ‘অত চিন্তা করিস না। তর বাচ্চারে কেউ নিবো না। আমি আছি না। রাইতে একটা মশারি টাঙ্গাইয়্যা দিমু তরে আর তর তিন বাচ্চারে। আরাম কইরা ঘুমাইস। অনে ভুসি খা, পেট ভইরা। বাচ্চারে দুধ খাওয়াইতে অইবো না! নিজে ঠিক মতো না খাইলে বাচ্চার দুধ অইবো কই থাইক্যা? … নাকি কাঁচাঘাস চাস? তাঅ দিমু আইন্যা। এই বেলা ভুসি দিয়াঅই চালা।’

‘আব্বা, তুমি কার লগে কতা কও? আমিদ কাউরে দেহি না!’

মুক্তা পেছন থেকে এসে বাপের গলা জড়িয়ে ধরে। তাহের অন্য সময় হলে ধমক দিয়ে মেয়েকে দুরে সরিয়ে দিত। কিন্তু এখন সে মেয়েকে কিছু বলে না। মন ভালো বলে মেয়েকে দুষ্টমি করতে দেয় তাহের।

মুক্তার বয়স আট। তাহেরের বড় মেয়ে। মেয়েটার মুখের গড়ন সবাই বলে নাকি তাহেরের মত। মাঝে মাঝে তাহেরেরও তেমনই মনেহয়। আর মুক্তার খুব বুদ্ধিও। এই যে এখন মুক্তা তার গলা জড়িয়ে ধরেছে, মেয়ে জানে এখন তাহেরের মন ভালো। মেয়েটা সব সময় দূর থেকে তাকে খেয়াল করে। যে কাজই করুক সে, মুক্তা আড়ে আড়ে দেখে। মজার কথা হল, মেয়েটা বাপের করা কাজ পরে নিজে নিজে করতে চেষ্টাও করে। অনেক সময় পারেও। এইতো গতকালই বাকল দিয়ে কবুতরের খোপ বানানোর চেষ্টা করছিল; দেখেছে তাহের।

মুক্তা তাহেরের গলা ধরে দুলতে দুলতে ফের জিজ্ঞেস করে, ‘কইলা না আব্বা, কার লগে কতা কও?’

‘ছাগলটার লগে কতা কই।’

‘ছাগলে কি মানুষের কতা বুঝে আব্বা?’ মুক্তা এবার তাহেরের কাছে এসে বসে।

‘বুঝে। আদর কইরা কতা কইলে ছাগলেঅ বুঝে। তুই আউজ্জা মাদ্রাসায় যাস নাই পড়তে?’

‘গেছিদ আব্বা। অনে মাত্র আইলাম।’

মুক্তা বোঝে বাবার মন আজ ভালো। কারণটাও সে জানে। কিন্তু বাপকে বলার সাহস পায় না। যদি তাহের রাগ করে। বাপতো তাদের খুব একটা কোলে টোলে নেয় না, অন্য বাবাদের মতো চুমু খায় না, আদরও করে না। কাছে গেলে বকাঝকা করে। সামনে থেকে চলে যেতে বলে। মুক্তাও অন্য বোনদের মত বাবাকে ভয় পায়। তবে, অন্যদের চেয়ে কম। কেন কম ভয় করে বলতে পারবে না মুক্তা। বাপকে মুক্তা খুব ভালোভাবে খেয়াল করে। সবসময়। বাপ কী খেতে পছন্দ করে, কখন ঘুমায়? কবুতর বাপের খুব পছন্দ, এমনকি এই ছাগলটাও। এসব জানে মুক্তা। এমন অনেক কিছু জানে মুক্তা। মুক্তা বুঝে, বাপের মন এখন ভালো। কাছে বসে থাকলে, এটা সেটা জিজ্ঞেস করলে তাহের বিরক্ত হবে না। তাই সে বাপের আরো কাছ ঘেঁষে বসে।

মুক্তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, ছাগলের বাচ্চাগুলোকে কেমন আদর করছে তার বাপ! কালো বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে পুরোনো গামছাটা দিয়ে বাচ্চাটার গা মুছে দিচ্ছে। আবার বাচ্চাটার মাথায় হাত দিয়ে আদর করছে গামছাটা দিয়ে। গোসল করে মুক্তা ও তার ছোট বোনেরা গা মুছে এই গামছাটা দিয়ে। সেটা দিয়ে তার বাপ এখন ছাগলের বাচ্চার গা মুছছে। কেমন অবাক হয় মুক্তা।

‘আব্বা, তুমি বাচ্চাটারে অনেক ভালোবাসছ, তাই না? অনেক আদর করছ, তাই না?’

তাহের খুশি খুশি গলায় বলে, আদর করমু না? কস কী! ছাগলটা কতো দুধ দেয়। ছয় মাস গেলে দুইটা তিনটা বাচ্চা দেয়। বাচ্চা বেচলে ভালা দাম পাওয়া যায়। আদর যত্ন না করলে কি আর ঠিকমতো দুধ দিবঅ।

‘বাচ্চা কি সবডি ছেলে বাচ্চা, আব্বা?’

‘নাহ্। ছেলে না। সবডিঅই মেয়ে। ছেলে বাচ্চা অইলেদঅ বাজারে নিয়া বেইচ্চা লাইতে অয়। না অইলে জবো কইরা খাইতে অয়। মেয়ে বাচ্চারে মানুষ আদর কইরা পালে। বড় অইলে এই মা ছাগীটার মতন মেয়ে বাচ্চারা দুধ দেয়, বাচ্চা দেয়।… তুই বাড়ির ভিত্রে যা। বইনগ লগে খেলগা।’

‘তোমার কাছে আর উট্টু থাকি আব্বা। কী অয় তোমার কাছ থাকলে?’

‘থাক। তই বেশি কতা কইস না!’

‘আইচ্ছা।’

আচ্ছা বললেও বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারে না মুক্তা। ঠিকই প্রশ্ন করে বসে বাপকে। ‘আব্বা, ছাগলের বাচ্চারেও কি গামছা দিয়া গাও মুছাইয়্যা দিতে অয়? যেমন আমরা গোছল করার পর গাও মুছি।’

‘নাহ্। তাহের বিরক্তির স্বরে বলে। এরা নতুন জন্মাইলদঅ, এর লাইগ্যা শইল্যের বিজলা মুইচ্ছা দিতাছি গামছা দিয়া।’

‘আইচ্ছা আব্বা…’

‘আবার কী? কইলাম না বইনগঅ লগে গিয়া খেলগা!’

তাহের আরেকটা ছাগল ছানাকে কোলে তুলে নিয়ে পরম যত্নে মুখটা মুছে দেয়।

তারাদঅ সবাই ঘুমায় আব্বা।’ মুক্তা তাহেরের পিঠে আঙুলের খোঁচা দিয়ে বলে, ‘শোনো না। একটা কতা!

‘কী কইবি ক। শোনতাছি। এইডাই কিন্তু শেষ। আমারে জ্বালাবি না। ঘরে যা।’

‘আঙ্গরে বাজারে বেচন যায় না আব্বা? আঙ্গ পাঁচ বইনরে?’

‘কী কস উল্টাপাল্টা কতা! মানুষ বেচন যায়?’

‘যদি বেচন যাইতো কত ভালা অইত না আব্বা? অনেক টাকা পাইতা তুমি। বেচন গেলে কত আদর করতা আঙ্গরে। কোলে নিতা, গোসল করনের পর গাও মুইচ্ছা দিতা, চুল আঁচড়াইয়্যা দিতা, চুমা দিতা। না আব্বা? তুমিদঅ আঙ্গরে দেখলে খালি ধমক দেও। উট্টুঅ আদর কর না। খালি গালি দেও। মাইর দেও। ছাগলের মেয়ে বাচ্চা অইলে ভালা, আর মানুষের মেয়ে বাচ্চা অইলে খারাপ। না আব্বা?’

তাহের মেয়ের প্রশ্নের জবাব দেয় না। দিতে পারে না। ছোট্ট মেয়েটার মুখের কথা শুনে কেমন জানি আনমনা হয়ে যায়। কোল থেকে ছাগলের বাচ্চাটাকে নামিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। বাচ্চাটা ছাড়া পেয়ে টলোমলো পায়ে হেঁটে মায়ের ওলানে গিয়ে মুখ দেয়। তাহের দেখে, মুক্তা উঠে যাচ্ছে। উঠান ছেড়ে বাড়ির ভেতরে যাবে বলে হাঁটা শুরু করেছে, দ্রুতপদে। মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে সাহস পায় না তাহের। সে বুঝে, মেয়েটা তার ভয়েই দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে।

মুক্তার কোমল দুটো পায়ের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে তাহের। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার প্রবল ইচ্ছা হয়, মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করতে। কিন্তু কে যেন তাকে আটকে রাখে মাটির সাথে। বসেই থাকে তাহের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *