ছোটগল্প //উত্তরজীবী// ইলিয়াস ফারুকী

ছুটির দিন মন ছুটে যেতে চায় তেপান্তরে। অনেক স্বপ্ন বুনে হৃদয়। কিন্তু সব কিছুই অসমাপ্ত থেকে যায়। অধরা স্বপ্নেরা শুধু লোভ দেখায়, কিন্তু ধরা দেয় না। ছয় দিনের ক্লান্তি আর পড়ে থাকা ব্যক্তিগত কাজ দুপুর পর্যন্ত আমাকে এমনিতেই ব্যস্ত রাখে। দুপুওে নামাজ সেরে খাওয়া দাওয়া শেষে শুরু হয়ে আমার একান্ত দিন। কিংবা বলা যায় দিনের খন্ডাংশ। ঘটনার দিনও দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর ক্যাসেটে মেহেদি হাসানের গজল শুনছিলাম। পাঠক মনে হয়ে কিছুটা চমকে উঠলেন। ধরেই নিয়েছেন লেখক হয়ত পাগল কিংবা মান্ধাতা¡ আমলের বুড়ো ভাম। বিশ্বাস করুন আমি পাগল ও নই ভাম ও নই। তবে হ্যাঁ এ কথা অবশ্যই বলা যায় যে আমি বুড়ো। বুড়ো হলেও আমার মাথা ও স্মৃতি শক্তি একদম সঠিকভাবে কাজ করে। তাইতো ১৯৮৪ ইং সালের কথা এই ২০১৯ ইং তে লিখতে বসেছি।
আমি তখন একটি ঔষধ কোম্পানীতে চাকরী করতাম। মাঠকর্মী মানে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। ছুটির দিন ও যেদিন শহরে কাজ থাকতো সেদিন দুপুরে আরাম করার সুযোগ পেতাম। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর মেহেদি হাসানের গজল শুনা ছিল আমার ভালোলাগা। আমি থাকতাম রাস্তার পাশেই একটা ব্যাচেলার কক্ষে। দুপুরে ভাত ঘুমের অভ্যাস কখনোই ছিল না। তাই যখনই দুপুরের অবসর পেতাম কিংবা ছুটির দিন পেতাম। সুরই ছিল আমার প্রধান বিনোদন। সেদিন ক্যাসেটে বাজছিল “মেরি জিন্দেগী মেরে পাস আ, মেরি বেরুখী কী না দেয় সাজা” চোখ বন্ধ করে নিজে নিজেই এর অর্থ করছিলাম। নিজে নিজেই মুগ্ধ হচ্ছিলাম যে আমি পারছি এর অর্থ করতে। ধীরে ধীরে গজলের সুরের মাঝে ডুবে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কিছু একটা পতনের শব্দ কানে এলো। বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে দেখি আমারই কক্ষের খোলা দরজার চৌকাঠ মাঝামাঝি একটা উস্কো খুস্কো এবং জীর্ণশির্ণ মেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। এরই মাঝে দুই একজন পথচারিও উৎসুক হয়ে দাড়িয়ে গেল। মেয়েটির পরনে ময়লা ছেড়া ফ্রক জাতীয় পোশাক এবং ততোধিক নোংরা পায়জামা। বেশ দূর্গন্ধ বেরোচ্ছিল তার শরীর থেকে। ভিড় করা পথচারিদের কাছ থেকে বিনে পয়াসায় ইতিমধ্যে উপদেশ বর্ষন শুরু হয়ে গেছে। কারো মতে পুলিশকে খবর দেয়া উচিৎ। কেউ কেউ মত দিচ্ছে আশে পাশের কোন মহিলাকে ডাকা উচিৎ। কিন্তু এসব কাজের জন্য কেউ এগিয়ে আসছে না। এদিকে আমি কী করব ভেবে আমার তখন ত্রাহী অবস্থ। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ওই পথ দিয়ে এক ভদ্র মহিলা যাচ্ছেন। ভদ্র মহিলাকে দেখে কিছুটা আশার ঝিলিক উঁকি দিলো। তাঁকে উদ্দেশ্য করে এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ পথ রোধে তিনি সম্ভবত কিছটা বিব্রত কিংবা ভীত হলেন। বিনয়ের সাথে তাঁকে আমার সমস্যার কথা বললাম।
‘আপা বিপদে পড়েছি। আপনার সাহায্যে প্রয়োজন।’ ভদ্র মহিলা যখন বুঝতে পারলেন বিপদ তার না আমার। আমি সাহায্য প্রার্থী এবার যেন তিনি আমুল বদলে গেলেন। যেমনি অসহায় বোধ করছিলেন, তেমনি হঠাৎ ক্ষেপে উঠলেন।
‘আপনি বিপদে পড়েছেন তো আমি কী করতে পারি। এমন হঠাৎ অভব্য ভাবে কোন নারীকে কেউ রাস্তায় দাঁড় করায়। এতোগুরো পুরুষ মানুষ দাড়িয়ে, তাদের সাহায্য নিতে পারনে না।’ মনে মনে বললাম এইতো আমাদের দেশের নারী। প্রথমে ভয় পেলো। যখন বুঝলো তার বিপদের কিছু নেই। উল্টো অসহায় তার সামনের ব্যক্তিটি, তখন তাকেই নিয়ে নিলো একহাত।
অতি বিনয়ের সাথে বললাম, ‘দেখুন এটা পুরুষের কাজ না। তাহলে আমি নিজেই পারতাম। বিষয়টা আর একটা মেয়েকে নিয়ে।’
‘অসুস্থ তো ডাক্তার ডাকুন। অন্য কিছু হলে পুলিশ ডাকুন।’
‘প্রয়োজনে সবাইকে ডাকা যাবে। আপাতত আপনি একটু সাহায্য করলে ভালো হয়।’ ভদ্র মহিলা সেকেন্ডের জন্য কী যেন চিন্তা করলেন, তারপর কিছুটা নরম কন্ঠে বললেন, ‘চলুন তো দেখি কী হয়েছে।’ লোকজনকে সরিয়ে জায়গা করে তাকে আমার কক্ষের দরজার সামনে নিতেই থমকে গেলেন। সম্ভবত তিনি বিষয়টা বুঝতে পারলেন।
‘একে উঠাতে হবে। এর শুশ্রসা দরকার। আপনি কী আমাকে নার্স পেয়েছেন। আর যে নোংরা অবস্থা ওর শরীরে তো হাত দেবার রুচি আমার নেই।’ বলেই আঁচল দিয়ে নাকে চেপে ধরলেন। সরাসরি জানিয়ে দিলেন, ‘এটা আমার কাজ না, আমি চললাম, আপনার যা করার করেন।’ বলতে বলতে তিনি তাঁর পথ ধরলেন।
শেষ চেষ্টা হিসেবে বললাম, ‘দেখুন একটা পুরুষ হয়ে কী করে একটা নারীর শরীরে হাত দেই।’
‘সে আমি বুঝি না আপনারা যা ইচ্ছে তা করুন। ওর শরীরে হাত দেবার মত অবস্থায় নেই মেয়েটা।’ বলেই হন হন করে চলে গেলেন।
আমি পড়লাম মহা ফাঁপড়ে। এখনকার মতন তখন কোন মোবাইল ব্যবস্থা ছিল না যে তৎক্ষণাৎ এ্যাম্বুলেন্স ডাকবো। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। সবার উদ্দেশ্যে একটা ছোট বক্তব্য রাখলাম। নিজেকে হিরো হিরো মনে হতে লাগল। বললাম, ‘আপনারা সব কিছু দেখেছেন জেনেছেন। এখন আপনারা আমাকে অনুমতি দিলে আমি হাত লাগাই। আর আপনাদের মধ্যে থেকে দুইজনকে আমার দরকার। বলুন কী করব।’
সবাই সমস্বরে বলে উঠল, ‘ঠিক আছে, কিছু করার নেই। আমরা সাক্ষী আপনার কোন বদ উদ্দেশ্য নেই। আপনি একটা কিছু করুন।’ ভিড়ের মাঝ থেকেই দুজন এগিয়ে এলো, ‘বলুন কী করতে হবে।’ উপস্থিত সবার সমর্থণ পেয়ে এবার বেশ জোরের সাথে বললাম যাতে সাবই স্পষ্ট বুঝতে পারে
‘মনে হচ্ছে মেয়েটা বেশ কয়েকদিন থেকে অভুক্ত। তার চিকিৎসা এবং শুশ্রসা দুটোই প্রয়োজন। আপনাদের মধ্যে একজন এ্যাম্বুলেন্স খবর দিন।’ একজনকে কিছু টাকা দিয়ে বললাম, ‘গ্লুকোজ ও কিছু খাবার নিয়ে আসেন।’ এতোক্ষণ এতো কিছু ঘটে গেলেও মেয়েটা সেই উপুড় অবস্থায়ই ছিল। কোন নড়াচড়া ছিল না। শুধুমাত্র তার পিঠ উঠানামা দেখে বোঝা যাচ্ছিল তার জীবন এখনো চলছে। যে দুজনকে দায়িত্ব দেয়া হলো ওরা ওদের মতো করে কাজে চলে গেল। আমি এবার মেয়েটাকে চিৎ করলাম। ক্ষনিকের জন্য স্তব্দ হয়ে গেলাম। এতো জীর্ণ শীর্ণ শরীর, চেহারায় উসকো খুসকো ভাব সত্বেও তার রূপ কথা বলছিল। একজন পানি এনে দিলে তার চোখে মুখে ছিটা দিলাম। কোন সাড়া পেলাম না। সময় নিয়ে হাত পায়ের তালু মালিশ করলাম। অনেক্ষণ পরে নড়া চড়া লক্ষ্য করলাম। জ্ঞান ফিরতেই বলল, ‘আমার ক্ষুদা লাগছে, ভিষণ ক্ষুদা।’ জানতে চাইলাম উঠে বসতে পারবে কী না। সে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। বুঝতে পারলাম সম্ভব না। এভাবে ফেলে রাখাও যায় না। নিজেই কোলে করে তুলে বিছানায় শোয়ালাম। ইতি মধ্যেই গ্লুকোজ ও কিছু খাওয়া নিয়ে একজন ফিরে এলো। দ্রুত একটা গ্লাসে গ্লুকোজ গুলিয়ে তাকে খেতে দিলাম। সে চেষ্টা করল কিন্তু উঠে বসতে পারল না। লক্ষ্য করলাম হাত পা কাঁপছে। মাথার নিচে হাত দিয়ে একটু উঠালাম। অনেক্ষন সময় নিয়ে পুরো গ্লাস গ্লুকোজ পান করলো। আবার শুইয়ে দিয়ে এ্যাম্বুলেন্সের অপেক্ষায় থাকলাম। মেয়েটাকে নিয়ে কী করা যায় অন্যমনস্ক ভাবে তাই ভাবছিলাম। হঠাৎ একটা দূর্বল হাত আমার হাত ধরল। কিংবা বলা যায় স্পর্শ করার চেষ্টা করল। তার দিকে ফিরে দেখি চোখে পানি টলটল করছে। জানতে চাইলাম। এখন কেমন লাগছে। মাথা নাড়িয়ে কোন রকমে জানালো ভালো। বললাম কিছু খাবার দেবো। আবারো হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। তাকে ডাল ভাত মাছ দিয়ে যত্নে সহকারে নিজের হাতেই খাওয়ালাম। তাকে সেবা যত্নে দিতে দিতে খেয়াল করলাম তার শরীরের গন্ধ কখন যে আমার সহ্য হয়ে গেছে বুঝতেই পারলাম না। এলাকায় প্রভাব রয়েছে এবং আমার সাথে খাতির সাইফুল নামে একটা ছেলেকে ডেকে আনলাম। ততক্ষনে উৎসুক জনগণ যার যার পথে চলে যেতে শুরু করেছে। এদিকে বিকেল হয়ে গেছে। কী করব না করব তাই ভাবছি। তখনি মেয়েটা খুব ক্ষীণ কন্ঠে বলল। বাথরুম যাবো। কথা বলতে পারায় একটু স্বস্তি পেলাম অমি। বুঝতে পারলাম কিছুটা চাঙ্গা হয়েছে। বললাম এখন হেঁটে যেতে পারবে। বললো একটু আগাইয়া দেন। বাথুরুমের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। প্রায় আধা ঘন্টা পর বেরিয়ে এলো। অনেকক্ষণ সময় নেওয়ায় এবং কোন সাড়া শ^দ না পাওয়ায় আমি ভেতরে ভেতরে টেনশনে ছিলাম। ওয়াশরুমের দরজা খোলার সাড়া পেলাম। বেরিয়ে এসেই আমার দিকে হাত বাড়িয়ে সাহায্য চাইল। নিয়ে এসে আবারো বিছানায় শোয়ালাম। গ্লুকোজের বাকিটা গুলিয়ে আরো দুই গ্লাস দিলাম। এবার নিজের হাতে গ্লাস নিয়ে ধীরে ধীরে সবটুকু পান করল।
এদিকে আমি এম্বুলেন্সের অপেক্ষায় অস্থির। অনেকক্ষণ পেরিয়ে যাবার পরও যখন এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ছেলেটা এলো না তখন আশা ছেড়ে দিলাম। ঘন্টা খানিকপর বাকী মাছ ভাত আবারো খেতে দিলাম। এবার নিজেই গোগ্রাসে গিলতে শুরু করল। সন্ধ্যা হয়ে আসছিলো। আমার মাথার দুশ্চিন্তাও বাড়ছিল। মেয়েটাকে নিয়ে কী করব। জিজ্ঞাসা করলাম তোমার কে কে আছে। বাসা কোথায়। আর এ অবস্থা কেন। কোন উত্তর না দিয়ে চোখের লোনা জলের পানির বর্ষণ ঘটিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
‘তুমি কিছু না বললে তোমাকে নিয়ে কী করব বলতো। এখানে তো তোমাকে রাখতে পারব না।’
আবারো নিরুপায় মেয়েটা। ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
‘ঠিক আছে কেঁদো না।’ সান্ত¡না দিলাম। ‘তোমার কে কে আছে? বাড়ী কোথায়। তোমাকে তোমার বাড়ী পৌছে দেই।’
আঁতকে উঠল যেন মেয়েটা। বলল, ‘তার চেয়ে আমারে মাইরা ফালান তাই ভালা। বাড়ীর কথা কইয়েন না।’
‘আচ্ছা বাড়ীর কথা বলবো না। কী হয়েছে সব খুলে বলো।’
মেয়েটা অনেকক্ষণ মাথা ঝুকিয়ে থাকলো। মনে মনে হয়তা চিন্তা করছে। সব কিছু বলা ঠিক হবে কী না তাই ভাবছে। আমি তাকে ভাববার অবসর দিলাম। সাইফুলকে কিছু টাকা দিয়ে মেয়েটার জন্য একটা তোয়ালে ও একসেট মেয়েদের কাপড় আনতে অনুরোধ করলাম। ইতি মধ্যেই সাইফুলের আরো দ’বন্ধু চলে এলো। চিন্তা করলাম ভালই হলো।
মহল্লা এলাকায় থাকি। এলাকার উঠতি মাস্তান টাইপের ছেলেদের সাথে ইচ্ছে করেই সম্পর্ক রাখি। তাই আমার কক্ষে দুপুর থেকে একটা মেয়ে রয়েছে এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন করার সাহস পায় নি। যদিও মেয়েটার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সবাই অবহীত।
হঠাৎ মেয়েটা নীরবতা ভাঙ্গঁল। নিজ থেকে বলতে শুরু করল। ‘আমার নাম সম্পা। পড়ছি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। আমার বয়স যখন আট তখনই আমার মা মারা যায়। এক বছর না যাইতেই বাবায় আবার বিয়া করল। আমার বাবায় চাষী। জমি চাষ ছাড়া আর কিছু বুঝে না। সৎ মা আমার লেখাপাড়া ছাড়াইয়া বাসার কাজে লাগাইয়া দিল। আইজ দশ বছর সৎ মায়ের সংসারে কাজের মাইয়ার লাহান কাম করছি। কোন আপত্তি করি নাই, চিন্তা করছি মাথায় ছাদ তো আছে।’ তার কথা শুনে আমি চমকে গেলাম। বলে কী মেয়েটা। মনে মনে ভাবলাম তাহলে মেয়েটার বর্তমান বয়স আঠারো। মানে পূর্ণ যৌবন। এতোক্ষণ মেয়েটার শারীরিক গঠন দেখে মনে করেছিলাম সম্পার বয়স হয়ত বারো কী তেরো। মনে মনে চিন্তা করলাম সেই দুপুর থেকে আমি আমার কক্ষে আস্ত একটা বোমা নিয়ে বসে আছি।
সম্পা তার কথা বলে যাচ্ছে। ‘আমার সৎ মায়ে বাবারে ভেড়া বানায় রাখছিল। হঠাৎ কয়েক দিন থেকে দেখি বাড়িতে নতুন নতুন ব্যাটাগো আনা গোনা। প্রথম প্রথম বুঝি নাই। পরে একটা কথায় বুঝলাম সৎ মায়ে কী যেন একটা বিক্রী করার দাম দস্তর করতেছে। দুই তিন দিন ধইরা রাতেও বাবার সাথে ঝগড়া করে। মনে মনে চিন্তা করলাম যেই বাপ আমার সৎ মায়ের মুখের উপর কোন কথা কয়না হঠাৎ তার কী হইল। মুখে মুখে তর্ক করে। আবার ঝগড়াও করে। ইচ্ছা কইরাই তাগো ঝগড়ার কারণ জানার জন্য একদিন কান পাতলাম। সৎ মায়ের কথা শুইন্যা আমার তো কাঁপাকাঁপি অবস্থা। আমাগো ঘরে যে সব বেটারা আইয়ে আমারে তাগোর কাছে বেইচ্যা দিবো। কথাটা শুইন্যা আমার মাথা ঘুরাইয়া গেল। সৎ মায়ের টাকা কই রাখতো আমি জানতাম। রাতে হেরা ঘুমাইয়া গেলে টাকা গুলা চুরি করলাম। ভোরে হেরা ঘুমের থিকে জাইগ্যা উঠার আগেই আমি বাসে উইঠ্যা এই শহরে চইল্যা আইছি।’
ইতি মধ্যেই সাইফুল জামা কাপড় ও তোয়ালে নিয়ে এলো। এগুলো সম্পাকে দিয়ে বললাম ‘যাও। ভালো করে গোসল করে এই কাপড় গুলো পরে নাও। তোমার বাকী কথা পরে শুনব।’
দূর্বল শরীর নিয়ে আমার কথা মতো মেয়েটা বাথরুমে চলে গেলো। সাইফুলকে বললাম। ‘রাত হয়ে আসছে। ওকেতো আর এখানে রাখা যায় না। কী করি বলতো।’
‘ভাই আমাদের পাড়ার যে মহিলা মাদ্রাসা আছে না। ওটার সুপার আমার আপন খালা তার সাথে কথা বলে দেখবো।’
আমি তখন তীর হারা মাঝি। হঠাৎ যেন তীরের খোঁজ পেলাম। বললাম, ‘তাহলেতো খুবই ভালো হয়। খালাকে বুঝিয়ে আপাতত পাঁচ সাত দিনের থাকার ব্যবস্থা কর। তার পর না হয় কিছু একটা ব্যবস্থা করব।’ সাইফুল তখনি বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্পা গোসল সেরে এসে হাজির। ভিজে চুলে মাথা তাওয়েল পেঁচিয়ে রেখেছে। আমি তো তাকে দেখে ’হা’। এ কাকে দেখছি। কিছুক্ষণ আগের পেত্নী যেন তার রূপ পাল্টেছে। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মনে হলো সম্পার সুপার সেন্স চালু হয়ে গেল। সে আমার অনুভ‚তি বুঝতে পেরে কিছুটা লাজুক হয়ে উঠল। নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম, ‘বসো, বলো তারপর কী হলো।’
জড়তা কাটাতে সম্পা কিছুটা সময় নিল। স্বাভাবিক হতেই আবার শুরু করল। ‘শহরে আইস্যা সোজা এক বড় লোকের দরজায় কাজের জন্য হাজির হলাম। শুনছিলাম বড় লোকগো নাকি কাজের মানুষ লাগে। গেট থিকা দেখি একজন বুড়া মানুষ গাছে পানি দিতাছে। হেরে ডাক দিলাম। কী মনে কইরা বুড়া মানুষটা আগাইয়া আইলো। কইলাম বাবা আমি বিপড়ে পড়ছি। তারপর হের কাছে সব ভাইঙ্গা কইলাম। তার এই বাড়িতে কাজ লইয়া দিতে কাইলাম। বুড়া মানুষটা কইল, খাড়াও আমি কাজ শেষ করি। এখনতো মেম সাহেব ঘুমায় তুমি এখানে কই থাকবা। আমারে বাবা ডাকছো। এই বেলা আমার লগে আমার বাড়ীতে চলো। পরে মেম সাহেবের লগে আলাপ কইরা কাজে লাগানোর চেষ্টা করুম। বুড়া বাবায় হের কাম শেষ কইর‌্যা আমারে সাথে কইর‌্যা তার বাসাতে লইয়া গেল। সৎ মায়ের চুরি কইর‌্যা আনা তিন হাজার টাকা বুড়া বাবারে দিয়া কইলাম। বাবা এই টাকা তোমার কাছে রাখো। পরে লাগলে নিমুনি। বুড়ার বাসাত গিয়া দেখি বুড়ার এক পোলা, এক মাইয়া। পোলাটা আমার থাইক্যা একটু বড়। আর মাইয়াটা আমার হমান। মাইয়াটার লগে খাতির হইয়া গেল। দিনটা ভালই গেলো। বস্তির ঘরে বুড়ার পোলা মাইয়া লইয়া কোন রকমে থাকে। ঘরটার মাঝখানে একটা পুরান কেঁথা দিয়া পর্দা দিয়া রাখছে। একদিকে বাপ পুতে ঘুমায় অন্য দিকে মাইয়াটা। আমারে হের মাইয়ার লগে জায়গা দিল। রাতে খাইয়া ঘুমাইয়া পড়ছিলাম। হঠাৎ মনে হইল আমার উপর যেন পাথরের চাপ। দম বন্ধ হইয়া আইতাছিল। প্রথমে মনে করলাম ছোট জায়গা বুড়ার মাইয়া হয়ত ঘুমের মধ্যে আমার উপর উইঠ্যা গেছে। মাথায় হাত দিয়া দেহি ছোট চুল। বুঝলাম কোনো বেটা। চিৎকার দিয়া উঠতেই লোকটা আমারে ছাইড়া পালাইলো। আমার চিৎকারে সবার ঘুম ভাইঙ্গা গেল। বাত্তি জ্বালাইয়া দেখি বুইড়ার পোলা ঘরে নাই। ঘটনাটা বুইড়্যাও বুঝল। শুধু কইল আইজ হারামজাদারে আমি দেইখ্যা লমু।আমি সকালের অপেক্ষায় রইলাম। সকালে বুড়ায় কাজে গেল। আর হের মাইয়া কলতলায়। হেই সময় আমি চুপচাপ পালাইয়া আইলাম।’ বলেই থামলো সম্পা।
আমিও তাকে ধাতস্ত হবার কিছু সময় দিয়ে আবার জানতে চাইলাম। ‘এতোক্ষণ যা বললে সবই বুঝলাম। কিন্তু মাঝের কয়েক দিন তুমি কোথায় ছিলে?’ সম্পা আবার বলতে শুরু করল।
‘আমার মায়ের যখন ভীষণ অসুখ। আব্বা তখন মায়েরে হাসপাতালে ভর্তি করাইছিলো। তখন রাতে হাসপাতালে আমি মায়ের লগে থাকতাম। তখন থিকাই জানতাম হাসপাতালে বেটিগো থাকার লিগা আলাদা ঘর থাকে। আমি বুড়া বাবার ঘর থিকা বাইর হইয়া মাইনষেরে জিগাইতে জিগাইতে হাসপাতালে গেলাম। দিনে বেলা মহিলাগো ঘর দেইখ্যা আইলাম। সারাদিন চেষ্টা করলাম খাওন আর কাম জোগাইতে। পারলাম না। রাইতে চুপচাপ বেটিগো ওয়ার্ডে ঢুইক্যা এক রুগীর বিছানার কাছে বইয়া রইলাম। হাসপাতালের আয়া আর হকলতে মনে করল আমি হের লোক। কেউ কিছু কইলো না। রাইতে ওই রুগীর খাওন দিলে হেরে যত্ন কইরা খাওয়াইলাম। যা বাইচ্চা গেলো হেইয়া আমি খাইলাম। হেই রোগীর কোন লোক আছিলো না তাই আমি দুই দিন এইভাবে রইলাম। তৃতীয়দিন সকালে হের লোক আইলো আর আমি ধরা খাইলাম। হাসপাতালের আয়ায় আমারে চোর কইয়া মাইরা বাইর কইরা দিলো। হের পর থিকা আর কিছু খাই নাই। এইখান দিয়া হাইট্যা যাইতেছিলাম। আপনার ঘরের দরজা খোলা দেইখ্যা চিন্তা করলাম খাওন চামু। আইয়া দেহি কি সুন্দর সুরে গান চলতাছে। আর আপনে ঘুমাইতাছেন। এতো সুন্দর গান শুইন্যা খিদা ভুইল্যা গেছিলাম। কতক্ষণ গান শুনছি জানিনা। হঠাৎ মাথাটা ঘুইরা উঠল, আমি পইড়া গেলাম।’
সম্পা কথা শেষ হবার বেশ কিছুক্ষণ আগেই সাইফুল চলে এসেছিল। তার উজ্জল চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কিন্তু সম্পার কথায় মনোযোগ ছিল বলে তাকে কিছু বলিনি। সম্পার কতা শেষ হতেই সাইফুল জানালো, ‘ভাই খালার সাথে কথা হয়েছে। খালা সব কথা শুনে ওকে নিয়ে যেতে বলেছেন। সাথে আপনাকেও যেতে বলেছেন। খালা ওকে এতিম হিসাবে মাদ্রাসায় ভর্তি করে নেবেন। তবে একজন স্থানীয় অভিভাবকের দরকার হবে। পুরো ঘটনা শুনে খালা আপনাকেই ওর অভিভাবক হিসাবে দেখাতে চান। কয়েকটা ফর্মে আপনার সই লাগবে।’
আমার বয়স এখন ষাট। আমি এখন দুই কন্যা এবং এক ছেলে সন্তানের জনক। একই সাথে আমি এখনো সম্পার অভিভাবক হয়ে বেঁচে আছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *