মোহিত কামাল এর ছোটগল্প মরমি ডাক

গাছটির দুটি ডাল প্রসারিত দুই বাহুর মতো আগলে রেখেছে চারপাশ। সবুজ পাতার ওপর আছড়ে পড়ছে রোদ। নিচের জমিনে নড়ছে ছায়া। কোথাও আলো কোথাও ছায়া। গাছ আর তার সজীব পাতায় ছায়াঘেরা বাগিচায় প্রকৃতি এমন মমতার বিছানা উপহার হিসেবে বিছিয়ে রেখেছে কেন! কে শুয়ে আছে এমন সজীব শুভ্র মাটিতে? ইরাবতী নদীর কূল থেকে উজানের দিকে অগ্রসর হতে হতে সুডো প্যাগোডা সড়ক ও ফ্রাসের রাস্তার কোনায় সুন্দর গাছটির পাশে এসে থমকে দাঁড়ানোর পর এমন প্রশ্নই উঠে এল মশির মনে। পাতা আর ফুলের বিছানা পাতানো জমিনের একটু দূরে একটা নামফলকে কিছু বাণী লেখা আছে। সেটা দেখে বেশ কৌতূহল নিয়ে পড়ল মশি এবং তার অর্থ অনুভব করে চমকে উঠল :
কে আমার গরিব কবরে ফুল দিতে আসবে?
কে আসবে অন্ধকারে প্রদীপ জ্বালাতে?
কে আসবে সুমধুর ফাতেহা করতে পাঠ?
এই তো আমার মতো অভাজনের নিঃসঙ্গ স্মৃতিসৌধ।
বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল মশির। কোন কবি শুয়ে আছে এখানে? কে রচনা করেছেন এমন হাহাকারধ্বনি? কৌতূহল আরো বেড়ে গেল তার। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে খুঁজতে লাগল ঠিকানা-ফলক। বাঁয়ে ঘুরতেই পেয়ে গেল কাক্সিক্ষত ঠিকানা লেখা সাইনবোর্ড ৫/৬ নম্বর থিয়েটার রোড, রেঙ্গুন। ঠিকানা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভূমণ্ডল কেঁপে উঠে আবার মনে প্রশ্ন হানা দিল এটাই কি তবে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধি?
মশির এই নীরব প্রশ্নের উত্তরে ওপর থেকে ঝুরঝুর করে পড়তে লাগল গাছের সবুজ পাতা। ওপরের দিকে ভালো করে তাকিয়ে ভুতুড়ে অনুভবে শিউরে উঠল তার রোমকূপ। গাছ থেকে ঝরে পড়ছে কুল। এটা কি কুলগাছ? হলদে বিবর্ণ হলে পরে গাছের পাতা ঝরে, এখন তাহলে ঝরছে কেন সবুজ পাতা? কুলই বা ঝরছে কেন অসময়ে? এটা কি তাহলে অলৌকিক কোনো ক্ষমতার কারসাজি? মারফতি কিংবা মরমি শক্তি?
মাটির নিবিড় স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করছে মশির। জুতো খুলে খালি পায়ে হেঁটে সে চলে এল পাতাবাহারের ঝোপে ঘের দেওয়া সীমানাপ্রাচীরের ভেতর সমাধিস্থলে। আকস্মিক কেঁপে উঠল কুলগাছ, কেঁপে উঠল সমাধিস্থল। দুই ভাগে চিরে ফাঁক হয়ে গেল মাটি। বিস্ময় নিয়ে মশি দেখল, কবরের ভেতর থেকে উঠে আসছে আভিজাত্যে ভরা নান্দনিক এক সিংহাসন। আসনে বসে আছেন শ্মশ্রমণ্ডিত এক সম্রাট, তাঁর মুখে লেগে আছে চোরা হাসির রেখা। সিংহাসনে বসেই তিনি প্রশ্ন করলেন ‘হে তরুণ! আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করলে তুমি?’
‘জি! কে? কী বলছেন আপনি?’
‘আমি শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর বলছি, যা বলেছি ঠিকই বলেছি। ভেবেছিলাম, আমার মতো অভাজনের স্মৃতিসৌধে কেউ কখনো আসবে না, কেউ প্রদীপ জ্বালাবে না আঁধার রাতে!’
‘আপনি কি কবি জাফর! বাহাদুর শাহ জাফর! শেষ মোগল সম্রাট? আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন। কে বলেছে আপনি অভাজন? কে বলেছে আপনার সৌধ ডুবে থাকবে আঁধারে? আমি তো দেখছি আপনি অমর, আলোয় ঝলমল করছে এখনো আপনার সিংহাসন!’
মশির তেজোদীপ্ত ধারালো কথা শুনে কিছুটা থমকে গেলেন বাহাদুর শাহ। সম্রাটকে বাকরুদ্ধ করে দিতে পেরে পুলক বোধ করল মশি। তবে সম্রাটের মনে দুঃখ দিতে চাইল না সে। তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিল তাঁরই একটি শ্লোক ‘আত্মসম্মানের সৌরভ ইমান যত দিন পর্যন্ত মুক্তিসংগ্রামীদের অন্তরে থাকবে তত দিন ভারতের দাপট একদিন না একদিন পৌঁছবেই লন্ডনে।’
স্মৃতিকথার ঝাঁপি খুলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিস্তৃত হতে লাগল সম্রাটের সিংহাসন। নিজের হাতে চেপে ধরলেন তিনি মশির হাত। তারপর তৃপ্ত স্বরে বললেন, ‘ঠিকই বলেছ তুমি। ইংরেজ মেজরের বিশ্বাসঘাতকতা আর ধূর্ত কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়েছিলাম আমি। বংশধরদের সবাইকে নিয়ে হুমায়ুনের সমাধিতে আশ্রয় নেওয়া আমি চতুর মিথ্যাচারে গলে গিয়ে ধরা দিয়েছিলাম মেজর হাডসনের হাতে। সে ছিল উর্দু কবিতার সমঝদার। শ্লোক বেঁধে বলেছিল, “ভারতের জীবনে এখন শ্বাস নেই, এখন শুধু নিজের প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন। আহা জাফর, ভারতের তরবারি এখন প্রাণহীন।” জবাবে সেই শ্লোকটি ছুড়ে দিয়েছিলাম তার দিকে।’
‘ঠিকই তো বলেছিলেন। ব্রিটিশরা কেবল ভারতবর্ষই ছাড়তে বাধ্য হয়নি, নানাভাবে তারা পরাস্ত হচ্ছে ভারতবর্ষীয়দের হাতে।’
কথাটা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন সম্রাট। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর মুগ্ধতা কেটে গেল। সম্রাটের মনে পড়ে গেল হাডসনের অমানবিক নিষ্ঠুরতার কথা। বিনা বিচারে সে গুলি করে হত্যা করেছিল শাহজাদা আর পৌত্রদের, গ্লাসে ভরে তাদের রক্ত তুলে দিয়েছিল নিজের হাতে। সেই রক্ত পান করতে বাধ্য করেছিল নিজেকে।
স্মৃতির ঝাঁপি খুলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছ থেকে ঝরতে লাগল রক্তফল। কুলের রং হঠাৎ লাল হলো কীভাবে? জুজুর কাণ্ড না তো? এজন্যই কি এ অঞ্চলে গাছটির নাম জুজুবাগাছ? কুলগাছকে জুজুবাগাছ এ কারণেই কি বলে থাকে এই অঞ্চলের মানুষ?
সম্রাটকে হঠাৎ বিমর্ষ হয়ে যেতে দেখে মশি বলতে লাগল, ‘ফলকের তথ্যানুযায়ী ১৭৬৮ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন আপনি, আর দিল্লির শেষ মোগল সম্রাট হিসেবে মসনদে ছিলেন ১৮৩৭ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত, ৭ নভেম্বর ১৮৬২ সালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন এই মুহূর্তে ১৯১৬ সালে তো দেখছি একই রকম উজ্জ্বলতা নিয়ে সিংহাসনে বসে আছেন আপনি? কী করে সম্ভব হলো এই অসম্ভব ঘটনা? কী করে কথা বলছেন? কীভাবে সমাধির মাটি চিরে বেরিয়ে এলেন আপনি? আমি ভুল দেখছি না তো? কল্পনা করছি না তো? আমি অসুস্থ হয়ে যাইনি তো?’
সম্রাটের শোকাতুর মনের খোলস ঝরঝর করে ঝরে গেল। খোলসের ভেতর থেকে বেরিয়ে নতুনরূপে নিজেকে উপস্থাপন করলেন তিনি :
কবরে দিও না কেউ ফলক দারুর
জীর্ণ হোক ধসে যাক চিরন্তন সবই,
আর যত বিভ‚ষণ ঐশ্বর্য সম্রাজ্ঞীর
কালের আবর্তে হয় বিলীন সকলই
মিলায় সুদূরে দুনিয়ার তামাম নজির।
সম্রাটের কণ্ঠে উচ্চারিত অসাধারণ কাব্যছন্দের জাদুতে পুনর্বার চমকিত হলো মশি, বিস্ময়ের নতুন চাদরে ঢেকে গেল সে। ঘোরের ভেতর থেকে হঠাৎ বেরিয়ে কাব্য-ধ্যানমগ্ন সম্রাটের হাতে চাপ দিয়ে বলল, ‘আমি তো প্রশ্নের উত্তর পাইনি! মৃত মানুষের সঙ্গে কীভাবে কথা বলছি? কীভাবে দেখছি বাস্তবের সম্রাটকে? কীভাবে কবর থেকে উঠে এলেন আপনি? নামফলক না দেওয়ার শ্লোক বেঁধেছেন, আবার দেখছি ফলকে রয়েছে খোদাই করা তথ্য সব, এত বৈপরীত্য কেন আপনার সিংহাসন ঘিরে?’
উত্তর পাওয়ার আগেই মশি দেখল অন্যরকম আলোর ঝলক। পাশে, একটু দূরে, পাশাপাশি দুটি কবর থেকে বেরিয়ে আসছে দুই আলোর মানবী। অল্প বয়সি মানবীর আলোর দেহ হঠাৎ মানবদেহের রূপ নিল। মশি দেখল, এক তরুণী তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এমন রূপের তুলনা জানা নেই মশির, কেবল মুগ্ধ হয়ে দেখছে তাকে। হাঁ হয়ে গেছে সে। রূপের অহংবোধ নেই তরুণীর। ‘শরীরই একমাত্র কাঞ্চন’ এমন আগুনে ভাবনারও লেশমাত্র নেই এই অপ্সরীর চোখে। শ্রদ্ধা আর মুগ্ধতার মিশেলে তরুণীটি বলল, ‘তোমাকে অভিনন্দন! সুদূর ঢাকা থেকে এসেছ মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন শহর থেকে দূরে ক্যান্টনমেন্ট এলাকা পেরিয়ে এই জুজুবাগাছের তলে। তোমার অন্তরের মারফতি সংগীতই তোমাকে নিয়ে এসেছে এখানে। অন্তরের আলোয় আলোকিত তুমি। সম্রাট শুধু সম্রাটই ছিলেন না। কবিও ছিলেন। তোমার মধ্যেও আছে কবিসত্তা। এ দুই সত্তার মধ্যে মেলবন্ধন ঘটে গেছে। সম্রাটের জীবনঘনিষ্ঠ কাব্যসত্তা আগে থেকেই আন্দোলিত করে রেখেছিল তোমাকে। ঐতিহাসিক কবি আর বর্তমানের কবির মধ্যে ঘটে গেছে প্রত্যক্ষ সংযোগ। সেই সংযোগের তীব্র টানে কবর থেকে উঠে এসেছেন তিনি। এটা এক ধরনের মিস্টিসিজম। মিস্টিসিজমের অধিকারী ছিলেন আমার দাদা।’
‘আমার দাদা’ শব্দ দুটি ইতিহাস ফুঁড়ে আকস্মিক মশির চোখের সামনে ভাসিয়ে তুলল রেডফোর্ড তথা দিল্লির লালকেল্লা; লালকেল্লার ভেতর সম্রাট-সম্রাজ্ঞীর জৌলুসপূর্ণ জীবনের আদ্যোপান্ত। আর সম্রাটের ছোট বেগম জিনাত মহলের গর্ভে জন্মানো শাহাজাদা মির্জা জওয়ানের কথা। প্রিন্স জওয়ানের এক মেয়ে ছিল, সম্রাটের কবরের পাশে দাদির কবরের সঙ্গে জোড়া কবরের একটি হচ্ছে পৌত্রী প্রিন্সেস রওনকের কবর এই তথ্য জানা ছিল মশির। এই কবর থেকেই উঠে এসেছে এই আলোক মানবী? এই কি তবে প্রিন্সেস রওনক? শেষের দিনগুলোতে সম্রাট দাদার পাশে থেকেছে, আর পরবর্তীকালে দাদার কবর সুরক্ষার জন্য মামলা-মোকদ্দমা করেছে। কোর্ট পর্যন্ত ‘দৌড়িয়েছে। এই পৌত্রীই কি লাগিয়েছে কবরের নামফলক? নামফলকের বিষয়ে সম্রাটের না-বোধক চেতনা থাকলেও পৌত্রীর কারণেই তবে লাগানো হয়েছে এই ফলক? শ্রদ্ধায় গলে গিয়ে তাই মশি জিগ্যেস করল, ‘আপনিই কি তবে প্রিন্সেস রওনক? আপনিই কি সম্রাটের আদরের পৌত্রী?’
সামনে দাঁড়ানো অপরূপ জ্যান্ত মানবী তার মুখের হাসির রেখা বিস্তৃত করে বলল, ‘আমার নামও মনে রেখেছ, ইতিহাসের পাতায় কি আমার নামও খোদাই করা হয়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ, আপনিই আমাদের সম্রাটকবির আদরের নাতনি, আপনার কথা বাদ দিয়ে কি ইতিহাস রচনা হতে পারে?’
প্রিন্সেস রওনক মুগ্ধ হয়ে গেল মশির কথা শুনে। পুরো মানবীয় সত্তার পূর্ণাঙ্গ জাগরণের বিভা ছড়িয়ে বলল, ‘ইচ্ছা করছে তোমার বয়সে ফিরে যাই, ইচ্ছা করছে আমার মানবীয় জীবনের পূর্ণতা পেতে। রেঙ্গুনে চিফ কমিশনারের সচিব ক্যাপ্টেন নেলসন ডেভিসের অধীনে কারাজীবনে কেবল দুর্দশার মধ্যেই কেটেছিল সময়। কোনো তরুণের দেখা পাইনি। ভালোবাসা পাইনি ১৯২১ থেকে ১৯৩০ সালে আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পিতামহ-পিতামহীর কবর দেখাশোনা করেছি। সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর সমাধিতেই ঢেলে দিয়েছি আমার জীবনের সব মমতা। আর কোনো ঐশ্বর্যই নেই আমার জীবনের।’
বিমুগ্ধ মশি বলল, ‘কে বলল আপনার আর কিছু নেই, যুগ থেকে যুগে অন্তরের ভালোবাসা ঢেলে, আপন জীবন উৎসর্গ করে যেভাবে সমাধি রক্ষা করেছেন, যেভাবে শ্রদ্ধাপূর্ণ মমতা আর ভালোবাসার জয়গান গেয়েছেন, তার কি তুলনা আছে পৃথিবীতে? আপনি তো আরেক অবিস্মরণীয় যুগের কাব্যধ্বনি। সেই ধ্বনিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে আমার মতো হাজারো তরুণের হৃদয়, জানেন আপনি?’
আনন্দে হু হু করে উঠল রওনকের মন। পরপারের অলঙ্ঘনীয় ব্যারিকেড ঠেলে রওনক আরো কাছে এল। মশির হাত ছুঁয়ে আবৃত্তি করতে শুরু করল তার দাদা সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের পঙক্তি :
ফুলের রং থাকবে না, সুগন্ধ ফুরিয়ে যাবে,
এমন কি তার নিজস্ব বৈভব ও মহিমা ফুরাবে,
আমি শুধু পড়ে থাকব বসন্তের সুখ-স্মৃতি নিয়ে
যে ঠান্ডা হেমন্ত তাকে করেছে প্রবলভাবে দলিত।
‘প্রিন্সেস রওনক, আমি আপনার মুখে শোকাতুর পঙ্ক্তি শুনতে চাই না, চাই আশার বাণী।’ বলল মশি।
সম্রাটের পৌত্রী আবার গেয়ে উঠল সম্রাটের শ্লোক :
মহানুভবে মনের মাধুরী এখানে আছে ঘুমিয়ে
যতদিন আকাশ থেকে ঝরবে তারার দীপ্তি চুমিয়ে।
‘হ্যাঁ মাধুরী! হ্যাঁ মহানুভবতা! হ্যাঁ কাব্যধ্বনি! হ্যাঁ থাকবে অমর হয়ে।’ আবারও বলল মশি।
এবার আলোর বিম থেকে মানবমূর্তি ধারণ করে পেছন থেকে এগিয়ে এলেন সম্রাজ্ঞী জিনাত মহল। মশির মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘রওনক ঠিকই বলেছে, মশি। তুমিই হচ্ছ তারার দীপ্তি। এসে চুম দিয়ে গেলে সম্রাটকে। জাগিয়ে দিয়ে গেলে আমাদের। সম্রাটের মরমি সত্তা ঢুকে বসে আছে তোমার মস্তিষ্কে, তোমাদের অনেকের আত্মার জাগতে। এ জগৎ থেকে সম্রাটের বিলীন হওয়ার সুযোগ নেই। তাই এই মুহূর্তে অলৌকিকভাবে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে এই পবিত্র সিংহাসন, সেই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত সম্রাটকে দেখার সুযোগ পেলে তুমি। সম্রাটের মারফতি আর মরমি সত্তার টান ফুরাবে না, মিলিয়ে যাবে না। বুঝেছ? এখন অনেক রাত হয়েছে। যাও ফিরে যাও। তুমি তো এসেছ ইয়াঙ্গুনে দেশের হয়ে কাজ করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাদকবিরোধী মিটিংয়ে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছ, তাই না?’
এ খবর কীভাবে জানলেন জিনাত মহল! ভেবে চমকে উঠল মশি। সম্রাজ্ঞীর কথার পিঠে প্রশ্নের খই ফুটিয়ে বলল, ‘তাহলে কি আপনি ১৮৬২ সালে নেই? ২০১৬ সালে বসেই আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি আমি?’
‘তুমি অতীতে যাওনি। তোমার সুন্দর মনের মৌলিক টানেই অতীত থেকে বর্তমান উঠে এসেছেন সম্রাট, আমিও। আমার সুন্দরী পৌত্রী রওনকও অতীতে নেই, অতীতের তারুণ্যময় বয়স ধরে রেখেই চলে এসেছে তোমার সময়কাল ২০১৬ সালে, বর্তমানে। তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাচ্ছে। মায়া জাগছে তার মনে, মায়ার রশিতে আটকে যাচ্ছে সে। তুমিও। মরমি জগতে থেকে আত্মার স্পন্দনে একে-অপরকে আটকানো ঠিক হবে না তোমাদের। বাস্তবে ফিরে যাও। শূন্য হাতে যেয়ো না, পূর্ণ হাতে যাও মগজে ভরে নিয়ে যাও আমাদের শুভ কামনা, বুকের মধ্যে লালন কোরো সম্রাটের মরমি ডাক।’
রওনকের হাত ধরে আবেগের ঘূর্ণি সামাল দিয়ে কোমল কণ্ঠে মশি বলল, ‘ফুলে সুগন্ধ থাকবে, রংও থাকবে, বৈভব মহিমা সবই থাকবে, কিছুই বিলীন হবে না আমার মস্তিষ্ক থেকে।’
ফিরে আসছিল মশি।
ঝটিতি পেছন থেকে এগিয়ে এসে রওনক ধরল মশির হাত। টিনএজ কিংবা তারুণ্যে এমন করে কোনো তরুণের হাত ধরার সৌভাগ্য হয়নি তার। ঘোর থেকে সৃষ্ট অদৃশ্য টানে অতলে ডুবে যাচ্ছিল সে। প্রকৃতির এ চৌম্বক টানে কেঁপে উঠল চারপাশ, কেঁপে উঠল মশি।
হঠাৎ নাড়া খাওয়ার কারণে ছুটে গেল হাত মানবী সত্তা থেকে আলোর স্তম্ভে বদলে যেতে লাগল রওনক।
আশাবরী রাগিণীতে মরমি সংগীতের সুর তুলে মন-খারাপের রং ছড়িয়ে উধাও হয়ে গেল সিংহাসন, দুই রমণীও।

২ thoughts on “মোহিত কামাল এর ছোটগল্প মরমি ডাক

  • সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৯ at ৯:২২ অপরাহ্ণ
    Permalink

    কাব্যশীলন এ ঢুকলাম।পড়বো গল্প কবিতা।ধন্যবাদ প্রিয় লেখক

    Reply
  • সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৯ at ৪:১৭ পূর্বাহ্ণ
    Permalink

    ঐতিহাসিক টপিক নিয়ে সুন্দর লেখাটি ভালো লাগলো। প্রথম দিকে ১৯১৬ উল্লখ করা হয়েছে, ওটা সম্ভবত টাইপো, শেষে ২০১৬ উল্লেখ করা হয়েছে।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *