বুলবুল চৌধুরীর// ছোটগল্প// মাছ

নতুন জোয়ারের জল থাকে কাঁচের মতো। টেবিলে কিংবা ঘাসের ওপর, বা যেখানেই স্থাপন করা হোক না কাচ, তা ভেদ করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নিচে কী আছে, এমনকি ধূলিকণা পর্যন্ত। প্রথম প্রথম জোয়ার উঠে আসার কালে নজর করা যায়, নিচে কী মাছ চলাফেরা করছে, কী জলজ ঘাস বেড়ে উঠছে, শাপলা মাথা তুলতে কত সময় নেবে। আর একটা কথা, জোয়ার এলে তা অনুক্ষণ পিলপিল পায়ে উঠে আসে ওপরের দিকে? নদী ভরে যায় ও স্রোতময় হয়। জমিজমাও জলে ডুবে যায়, একসময় ভিটেবাড়ির কাছে লুটিয়ে আসে জল।

তাছাড়া বর্ষাকালে অন্তরীক্ষে থাকে ভেজা বাতাস। রাত্রি শব্দহীন হলে সেই বাতাস বৃক্ষের শাখাপত্র, ঘাসের ডগায় খেলে যায় মগ্ন চৈতন্যে। উঁকি দেয় ঘরের জানালায়, বেড়ার ফাঁকে এবং কখনো কখনো জল থেকে মাছের আঁশটে গন্ধ বয়ে এনে প্রবল ঝাপটা মেরে যায়। মনে হয়, যত মাছ এসেছে এবারে, পাট ক্ষেতের ভেতর, কি ছন জমিনের ভেতর, কি সবুজ ধানের ফাঁকে ফাঁকে? যেখানে যত রকম, যত মাছই থাক না কেন, সব ভেসে উঠছে শরীরের আঁশটে গন্ধ বাতাস তুলে নিয়ে যাবে বলে। তাছাড়া মাছের এখন যৌবনপ্রাপ্তিও। আজ হচ্ছে কালরাত্রি। পেরিয়ে দিচ্ছে কোনো রকমে, কানকোয় পিছল নিয়ে, চোখ লাল করে, অনমনীয় দ্রুততা নিয়ে ঘুরছে-ফিরছে মাছ। একটা অন্যটাকে স্পর্শ করছে? মুহূর্তের জন্য তাও।

কালরাত্রি হলেও সেখানে নিশ্চিত সৌরভ থাকে। অনন্য সুর থাকে। টুপটাপ মিষ্টি শব্দপাত হয় স্নায়ুতে। কিন্তু যে রাতে এ রকম কিছুই ঘটে না, পাশে অস্তিত্ব থাকতেও সাড়া আসে না, শবের মতো সটান শায়িত থাকে মাত্র, আর কখনো শীতলতা বিলিয়ে দিয়ে যায়, সেই রাতটা কী!

ইদ্রিস অন্ধকারে ডান হাত বউয়ের গলায় রাখল। বেড়ার ফাঁকে ভেজা বাতাস উঁকি দিচ্ছে। ঘরের ঝাঁপ খোলা থাকলে এই বাতাসটা সরাসরি ভেতরে ঢুকে যেত। খেলত দুজনকে ঘিরে। অথবা চুপচাপ বুঝত, কি হচ্ছে।

আয়চান ঘুমিয়ে গেছে। তার ভয় হচ্ছিল। হয়তো বউ তার ঘুমিয়েছে ঠিকই, তবে সে ডাকলেই ফুঁস করে উঠবে। সাপের মতো ফণা তুলবে সহজেই। ভাবতেই সারা শরীর হিম হয়ে যাচ্ছিল ইদ্রিসের। তবুও, অনেক ইচ্ছেতে সে ডাকল, আয়চান!

ভয় বাড়ল তাতে। এই ভয়টা অচেনা নয়, তারই, কিন্তু জ্বরগ্রস্ত ইদ্রিসের। এবং সেই সঙ্গে পিপাসা? পিপাসায় কাতর হয়ে উঠছিল সে।

আয়চান একবার নড়েও উঠল না। মরণ ঘুম ওকে নিয়ে নিয়েছে। তাহলে মৃতার পাশে শুয়ে আছে ইদ্রিস! স্ত্রীর মৃতদেহের পাশে! গুলিয়ে এল সব। আর যেন পৃথিবীর কিছু কোনোদিন সে দেখতে পাবে না।

অনেকক্ষণ পর সে যখন উঠে বসল, তখন মনে হলো, কেউ যেন অপেক্ষা করছে। জিজ্ঞেস করল, কেডা?

আসলেই কি কেউ! সে তা জানে না। তবে মনে হলো, এক্ষুণি কেউ হাঁটবে বাইরে। সেই সঙ্গে তার নাম ধরে ডাকবে। সে হাঁটুর ওপর থুতনি চেপে রেখে বসে থাকে। কোনো দিকে না তাকিয়ে ইদ্রিস চুপচাপ বসে থাকে কারো ডাক শুনবার আশায়।

যায়, সময় গড়িয়ে যায়, তবুও কেউ ডাকে না। কোনো শব্দই মনে হয় না অনেকক্ষণ। তারপর গোয়ালঘরে গরুটা মশার কামড় খেয়ে লেজ ঘোরায়। দীর্ঘশ্বাস ছুড়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঊর্ধ্বের আকাশ দেখে ইদ্রিস। সজিনা গাছের ওপরে মেঘলা আকাশ। বাতাস পেয়ে সেই গাছের ডালা মৃদু দোলে। আর কোথাও কিচ্ছু নয়। পাশে আয়চান ঘুমুচ্ছে। বালিশের নিচে দিয়াশলাই।

কিন্তু বাতি জ্বালবে কেন সে? বাতি জ্বাললেই আয়চানের মুখ দেখতে পাবে। দেখা যাবে, আয়চানের মুখ বৃষ্টিভেজা শাপলার মতো ফুটে উঠেছে।

তারচেয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকো, ঘুম আসুক।

ঘুম আসুক। অথচ ইদ্রিস জানে ঘুম আসবে না। চারদিতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল সে। বেড়ার ফাঁকে ফাঁকে বাতাস আছে? মাছের আঁশটে গন্ধ ভরা। সেই বাতাস তাকে ফিসফিস স্বরে ডাকল, আইও, জব্বর জোয়াইরা মাছ উডছে!

মাছ? ইদ্রিস কম্পিত হাতে দিয়াশলাই বের করল। গত বছর মাছের জন্য টেঁডা বানিয়েছিল সে। এই দিনে মাছ না উঠে যায় কই!

কিন্তু আয়চান হারিকেন রেখেছে কোথায়? কুপি জ্বেলে খানিক খোঁজাখুঁজি করতেই ঘরের পুব কোনার তাকের কলসির কাছেই পেয়ে গেল হারিকেন। টেঁডা আছে গোয়ালঘরে। কিন্তু খালুই? খালুইয়ের সেটা যে ভাঙা!

চিমনি মুছে, কেরোসিন ভরে, হারিকেন জ্বেলে, ঘরের ঝাঁপ খুলল ইদ্রিস। সিরাজের বোধহয় খালুই আছে।

সাবধানে, যাতে কোনো রকম শব্দ না হয়, ঘুম নষ্ট না হয় আয়চানের, তেমনিভাবে ঝাঁপ বন্ধ করে গোয়ালঘর থেকে টেঁডা বের করে হাতে নিল সে। সন্ধ্যাবেলা কিছু বৃষ্টি হয়েছিল। তারপর থেকেই আকাশ বুকে মেঘ নিয়ে খেলছে। ওপরের দিকে তাকিয়ে ইদ্রিস বুঝতে চাইল, বৃষ্টি এক্ষুণি নামবে কি না। মেঘ দ্রুত উত্তরের দিকে চলে যাচ্ছে। তবে অন্ধকার দারুণ। গাছপালা, পথ, জলরেখা আলাদা করা যায় না। পথও পিছল, কাদাও জমেছে যত্রতত্র। সারা বর্ষা এমন থাকবেই, শুকোবে না মাটি। বৃষ্টি এখন শিশুর কান্নার মতো, যখন-তখন।

কেনুর টেকে শিয়াল ডাকছে। ডাকছে তো না, কাঁদছে। দূর এলাকায় আত্মীয় মরার খবর শুনলে যেমন কাঁদে মানুষ, তেমন কাঁদছে।

বাঁশের সাঁকো পেরুতে পেরুতে রাত কত তা অনুমান করতে চাইল। আকাশ দেখে তো কিছু বোঝা যাচ্ছে না। মাঝরাতও হতে পারে। হতে পারে, কিছুক্ষণের মধ্যে একেবারে ফরসা হয়ে যাবে চারদিক।

সাঁকো পেরিয়েই টানের বাড়ি সিরাজের। কয়দিন আগে সিরাজের বউ বাপের বাড়িতে বেড়াতে গেছে। ভালো আছে শালা। বউ যখন পাশে নেই, তখন শালার ঘুম আটকায় কে? ইদ্রিস তার আঙিনায় দাঁড়িয়ে ডাকে, সিরাজ, ও সিরাইজা, সিরাইজা রে…।

কোনো জবাব আসে না। সিরাজ নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। ইদ্রিসের কাছে অবাক লাগে। এদিকে শালায় ভুবন বলে মাছে ভরে গেছে আর শালা ঘুমোচ্ছে। ঘুমোচ্ছে বড় ডুবে ডুবে।

দরজায় সে ধাক্কা দেয় জোরে জোরে। ডাকে, সিরাইজা রে, সিরাইজা…।

নাক ডাকা বন্ধ করে লোকটা জেগে ওঠে। জিজ্ঞেস করে, কেডা?

দরজাডা খোল দেখি!

একটুক্ষণের মধ্যে দরজার খিল খুলে সামনে দাঁড়ায় সিরাজ। আলো দেখে চোখ কচলায়। তারপর বিছানায় গিয়ে বসে পড়ে।

বাইরে দাঁড়িয়ে ইদ্রিস বলে, বইলে চলতো না। ধরবি যদি, উইঠা আয়, জব্বর জোয়াইরা মাছ উডছে।

মাছ? যে লোকটা ঘুমের প্যাঁচে টলছিল, এখন সেই লোকটা সিধে হয়ে ইদ্রিসের হাতে থাকা বাতির দিকে তাকাল। স্পষ্ট ঘুমতাড়িত কণ্ঠে সে বলে উঠল, হাইনজার সোময় জব্বর মেঘ হইছিলো না? উডতেও পারে, তাইলে মাছ উডতেও পারে।

ইদ্রিস বলল, তরতরি খালুইডা লইয়া আয়। দুইজনে মিল্লা এক চক্কর মারি গিয়া।

সিরাজ উঠে গিয়ে রান্নাঘর থেকে খালুই বের করে আনল।

আকাশের মেঘ এখন উত্তরে যাচ্ছে। অন্ধকার এখনো গাঢ়।

খালুই হাতে চলতে চলতে সিরাজ জানতে চাইল, আসমানে হাজ জমছে। মেঘ নামবোনি?

ইদ্রিস উত্তর করে দেখস না, উত্তরের ফাই কাইড্ডা যাইতাছে মেঘ। ওইতে ঢল নামবো মোন কয় না।

বিন্দাছড়ির কাঁচা সড়কে উঠে সিরাজ জিজ্ঞেস করল, কোফাই যাবি? কেনুর টেকে দেইখা আইছি চুপচুপা জোয়ার বাইতাছে। হেফি ঘুরন দিলে পাবি তো মাছ।

ইদ্রিস খানিক ভেবে নিয়ে জবাব দিল, কেনুর টেকে যাবি? আইচ্ছা, আয় যাই তাইলে হেইদিকে।

ঘাটের দিকে নেমে গিয়ে কোন্দায় চাপল তারা। হারিকেন ও টেঁডা হাতে ইদ্রিস বসে থাকে সামনে। সিরাজ লগি ঠেলে।

রাতের আঁধারে টলটলে বর্ষার জলও ঠেকে কি কালো। জলজ ঘাস, ধানি জমি সব এখন কালো আর কালো। যেন আয়চানের মতো, ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, মরার মতো একটানা পড়ে থাকে।

আইজ গোলাপীরে যাইয়া আননের কথা আছিলো। তাও আমার যাওন হইলো কই?? সিরাজ যেন অন্তঃস্বর শোনাল। কাকে শোনাল সে কথাটা? নিজের বউকে নিয়ে আসার কথা ছিল আজ। যেতে পারেনি। সিরাজ বোধহয় নিজের কাছেই নিজেকে দায়ী এবং দুঃখী করতে চাইল।

ইদ্রিস তখন আয়চানের কথা ভাবছে। আয়চানের নয় মাস যাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে ওর। বিছানায় শুয়ে পড়ার সময় কেমন খুলে খুলে যায়। কেনুর টেকে কোন্দা এসে থামতেই সিরাজ তাড়া লাগায়, নাইমা আয়।

হারিকেন হাতে জোয়ারের পানি পেরুতে গিয়ে হঠাৎ ইদ্রিস দাঁড়িয়ে গেল। মেয়েমানুষ শুয়ে থাকবে পাশে, তবুও তুমি হাত রাখতে পারবে না শরীরে। ভরা শরীর আয়চানের। ঠোঁট ভরা কথা। সেই আয়চানও কেমন যেন হয়ে গেছে। বর্ষার মতো শুধু বেড়ে আসে, শব্দ করে না। আবার ঠিকঠাক ধরাও যায় না বর্ষাকে।

ডান দিকের জমি নিলুজিতে ভরা। আধ হাত জল সেই জমিতে। আলো ফেলে ফেলে মাছ খোঁজে ইদ্রিস, ডান হাতে টেঁডা ধরে রাখে।

লাল রঙের একটা বড় শিং লেজ নাড়তে নাড়তে আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছিল। তক্ষুণি সেটা গেঁথে নিল ইদ্রিস।

কী রে?

হিং! বাজাইয়া লইছি।

মাছ তাইলে উডছে!

ততক্ষণে ইদ্রিস বেশ বড় আকারের টাকি মাছ গেঁথে ফেলেছে। বলল, হেমুনডাই লাগে।

তারা উলুছনের ফাঁকে ফাঁকে মাছ দেখল। মাছ, প্রচুর মাছ উঠেছে। তারই আঁশটে গন্ধ নিয়ে বাতাস মেতে উঠেছে। হারিকেনের আলো বাতাসের ঝাপটা খেয়ে মধ্যেমধ্যে নিবু নিবু।

সিরাজ জিজ্ঞেস করল, বাত্তি নিববো?

হারিকেন দোলাতে দোলাতে কেমন অচেনা কণ্ঠে ইদ্রিস জবাব দেয়, নিবুক বাতি।

কেনুর টেকের চারদিকেই জল। শুধু মাঝখানের ছন জমিটাই ডোবেনি। কেনুর টেকের ঝোপ-জঙ্গলও তলিয়ে গেছে। তারা ঘুরে-ফিরে মাছ ধরে। মাঝে ইদ্রিস কি একটা কথা বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল। সে বোধহয় খবরটা নিতে চাইছিল, তর বউডারে এত্তোদিন হউর বাড়িত ফালাইয়া থুইলি?

কিন্তু পরে ব্যাপারটা ভুলে গেল বড় একটা জাগুর মাছ জুইত্তা গাঁথা করতে গিয়ে।

কিছুটা পেছন থেকে সিরাজ বলল, ইস, বাতাসডায় কী জার জার! পিরানডাও লইতে গিয়া ফালাইয়া আইলাম ভুলে।

ইদ্রিসের মধ্যে তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে। তার মনে হচ্ছে, বাতি ছাড়াই ঘোর অন্ধকারের মাঝেও সে মাছ গাঁথতে পারে। ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে ঘন অন্ধকার জেঁকে বসেছে। আকাশ থেকে শুরু করে তা জলের গভীরেও একই রকম, একই ধারায় শুয়ে আছে।

সিরাজের ভালো লাগছিল না আর। ইতোমধ্যে খালুই প্রায় ভরে উঠেছে মাছে। তবুও দ্রুত ঘুরে-ফিরে জুইত্তায় মাছ গাঁথছিল ইদ্রিস। বাতাসের গন্ধও ভালো লাগছে না। বাতিটাও নিভবে যেন। গোলাপী ঘরে থাকলে স্বামীকে ধরে রাখত। গোলাপী থাকলে বুকের সাথে, আঁচলের নিচে তার মুখটা জাপটে ধরে রাখে। সে ভেবে পেল না, কি কারণে বউকে আনতে যায়নি আজ। চারদিকে ভালো করে তাকানোর পর সিরাজের খানিক ভয় ভয় হলো কেন জানি। সে ডাকল, ইদ্রিস!

ইদ্রিস কোনো জবাব দেয় না। সিরাজ আর চলতে পারবে না মনে হচ্ছে। সে মনে মনে সঙ্গীকে গাল দিচ্ছে, শালারে যেমুন মাছে পাইছে!

সেই মুহূর্তে এক ঝটকা বাতাস এল। তারপর আর এক ঝটকা বাতাস আসতেই নিভে গেল আলো।

ভয় পেয়ে গেল সিরাজ। অস্ফুট শব্দ করল, ইদ্রিস রে!

আশ্চর্য! কোনো জবাব না দিয়ে হারিকেন ফেলে টেডা হাতে মাছ গেঁথে চলে ইদ্রিস।

সিরাজ ফের জোর চিৎকার করে ওঠে, ইদ্রিস রে…!

লোকটা দ্রুত ছুটে যায় সামনের অন্ধকার থেকে আরো গভীরতর অন্ধকারের দিকে। যেন তার পাশে কেউ নেই। কেউ আসেইনি সাথে। সিরাজ তখন নিজের মধ্যে নিজেই কেমন যেন গুটিয়ে যাচ্ছে। ইদ্রিস কেনুর টেকের ঝোপ-জঙ্গলের দিকে হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। শেষবারের মতো সে চিৎকার করল, ই-দ্রি-সা-রে…!

তার সেই চিৎকারে কালো জল, মেঘময় আকাশ, ধানি জমি একটুও প্রকম্পিত হলো না তাতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *