কাব্যশীলন ঈদ সংখ্যা ২০২০ এর গল্প।। রাতের এক প্রহরে।। আহমেদ আববাস

বিগত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝমাঝি। সেসময় আমি ময়মনসিংহ সরকারি নাসিরাবাদ কলেজে পড়াশুনা করি। সতের বছরের তেজি তরুণ। কোনোকিছুতেই ভয় নেই। তালগাছ থেকে নেমেই ডুমুর গাছের মগডাল পর্যন্ত উঠে সেখান থেকে নদীতে অবাধ ঝাঁপ দেয়া কিংবা কোথাও মারামারি হলে সবার সামনে অগ্রসরমান থাকা, এসবই নির্ভয়ে করতাম। এমনকি তখন গ্রামে-গঞ্জে বিদ্যুতের বালাই না থাকলেও রাতের অন্ধকারে একাকী পথ চলতে কখনো ভয় ছিল না। যদিও ঐ সময় আমাদের গ্রামখানা ঝোপ জঙ্গলে একাকার ছিল ।

ঈদে কলেজ বন্ধের কারণে ছুটিতে গ্রামে এসেছি। প্রায় ছ’মাস পরে বাড়িতে ফেরা। আমার আগমনকে কেন্দ্র করে যেন বাড়িতে পিঠা উৎসবের ধুম পড়ে যায়। সবাই শীতের পিঠা খাওয়ানোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এক সন্ধ্যেয় নানাপদের প্রচুর পিঠা খেয়েছি। ফলে মাঝরাতে পেটে গোলমাল শুরু হয়ে যায়। তৎকালে গ্রামে সেভাবে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার গড়ে ওঠেনি। যা ছিল বাড়ির বাইরে ফাঁকা জায়গায় টিনের ছাউনিতে বাঁশকাঠ নির্মিত কাঁচা শৌচাগার। হঠাৎ গভীর রাতে পেটে গন্ডগোলের কারণে ঘুম ভেঙ্গে যায়। সময় দেখার জন্যে তখন হাতঘড়িও প্রাপ্তিসাধ্য ছিল না। প্রতিদিন সকাল ন’টায় দম দেয়া আমার একটি ঘড়ি থাকলেও হঠাৎ আড়া’য় গেলে আর কোনো বিকল্প ছিল না। ফলে আকাশের নক্ষত্র দেখে নির্ভূল না হলেও কাছাকাছি সময় আমরা আন্দাজ করতে পারতাম। তখন হয়তো রাত দুটো কিংবা আড়াইটে হতে পারে।

পরিপূর্ণ চাঁদের আলোয় স্বচ্ছ দিগন্ত। চারদিকে জোসনার আলো এতই উজ্জল যে, দৃশ্যমান সবকিছুই দিনের আলোর ন্যায় পরিস্কার। এমনি আলোয় পাকস্থলির চাপে নিঃসঙ্গভাবেই ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ি। বাহ্যকর্ম শেষ করে চন্দ্রকিরণের উজ্জলতা দেখার জন্যে বাড়ির পশ্চিম দিকে অবারিত শস্যক্ষেত্রের দিকে একটু এগিয়ে যাই।

বাড়ির অবস্থান অনেকটা এরকম। লোকজন ও গরুর গাড়ি চলাচলের রাস্তার পশ্চিম পাশেই বাড়ি। প্রায় ২০ শতাংশ জায়গায় ওপর এলোমেলোভাবে চার-পাঁচখানা টিন ও টালির ঘর। চারদিকে নানা ফলজ গাছপালায় ঘেরা বাড়িটি। বাড়ির পশ্চিমদিকে শৌচাগার। এবং তার সামনে প্রায় তিন একর ফসলি জমি। জমির পশ্চিমে আমবাগান এবং অবিন্যস্ত বাঁশঝাড়। এসবই পিতৃপুরুষের। তারপর কালের গতিধারায় বহমান আত্রাই নদী ।

খেসারি কলাই চাষের জমির ভেতর মাঝেমাঝে সরষে গাছে হলুদ ফুল। ভরাট চন্দ্রিমার আলোয় বিমুগ্ধ হয়ে ধীর পদক্ষেপে জমির আলপথ ধরে হাঁটতে থাকি। তারপর সহজবোধ্য এবং স্বচ্ছ দৃষ্টিগ্রাহ্যতায় যতদুর চোখ যায় একাগ্রমনে চারদিকের জোসনালোকিত শোভা দেখতে থাকি। একবার পুবদিক ফিরে যখনই দৃষ্টি পশ্চিমদিকে নিয়েছি তখনই চোখে পড়ে- জমির পশ্চিম প্রান্তের আমবাগান থেকে বেড়িয়ে একজন শ্বেতবসনা রমনী ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। সফেদ শুভ্র শাড়ি পরিহীতা অগ্রসরমান মহিলাটি অপেক্ষাকৃত অনুচ্চ এবং বেঁটে। আমি স্থির দাঁড়িয়ে থাকি। পরবর্তী অধ্যায় জানবার জন্যে। জমির আলপথ ধরে প্রথমে মন্থরগতিতে মাঝে দ্রুতপদে এবং শেষে একটু নিকটবর্তী এসে ক্রমশ আস্তে আস্তে ও শান্তভাবে আমার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আমি ভেবেছিলাম, হয়ত কোনো নারী স্বামীর ঘর থেকে পালিয়ে ছদ্দবেশ ধারণ করে এভাবে আসছে। এ কারণে সাহস নিয়েই দাঁড়িয়েছিলাম। দেখি সে কোথাকার মহিলা! শ্বেতবসনা নারী একসময় আমার খুব কাছাকাছি চলে আসে এবং সমীপবর্তী হবার পূর্ব থেকে তার চলার গতি একেবারে কমিয়ে ফেলে। আমার নিকট থেকে প্রায় দশহাত অবস্থানে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কে তুমি! এতরাতে এখানে?’
সে নেকোগলায় বলে, ‘আঁমি কেঁউ নাঁ।’
‘কেউ না আবার কি! দিব্যি একজন মানুষের মত দেখছি। আবার নাকের ভেতর কথা বলছ কেন?’
‘আঁমরা এঁভাবেই কঁথা বঁলি।’

দ্বিতীয় বাক্যটি শোনামাত্র আমার সারা গা ছমছম করে উঠে এবং তৎক্ষণাৎ জমির ভেতর গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। বাবার মুখে শুনেছি, কেউ নিজের জমিতে থাকলে জ্বিন-ভূত কাছে আসে না। আর এ অবস্থায় কারো পক্ষে চোখ বুঁজে থাকাও সম্ভব নয়। তাই লক্ষ করতে থাকি, আমার দিকে আগত নারীমূর্তিটি কী করে! কিন্তু না সে আর আমার দিকে এগোয় না। সে যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকেই ১৮০ ডিগ্রি আবর্তন করে উল্টোঘুরে জমির আলপথ ধরেই হাঁটতে থাকে। আচানক চোখে পড়ে, প্রায় এক বিঘত শূন্যের ওপর দিয়ে সাদাশাড়ি হাঁটছে। তার পা কোনোভাবেই মাটিতে পড়ছে না। আমাদের বাগানের বড় আমগাছটার গোড়ায় গিয়ে সে মিলিয়ে যায়।

তারপরও আমি লক্ষ করতে থাকি। মূর্হুতেই আবার দৃশ্যমান হয়। গাছের গোড়া থেকে আবার সে জমির আলপথ ধরে সোজা ইদিলের তালগাছে গিয়ে ওঠে। আমি সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাই। কিছুক্ষণ সেখানে থাকার পর সেই শ্বেতবসনা নারীমূর্তিটি সোজা জমির আলপথ ধরে চলে যায় নিমাইএর বিশালাকার শিমুলগাছে । সেটি আমার দৃষ্টিসীমার ভেতরেই কিন্তু বেশদুরে।

বিষয়টি বাড়ি এসে জানালে বাবা উঠে চারদিকে তাকিয়ে দেখেন সবশান্ত, অনবলোকিত এবং চাঁদতারার নির্মল দীপ্তিতে সবকিছু দিবালোকের ন্যায় খোলাসা। তখন বাবা বলেন, ‘ও কিছু নয় তোর চোখের ভুল।’
তখন ঘুম থেকে অনেকেই উঠে পড়েছে। বড়ভাবি ব্যতিব্যস্ত হয়ে আমার অগ্রজ বোনকে বললেন, ‘এই শিউলি যা তাড়াতাড়ি সোন্চার (শৌচাগারের) মাটির কলসিটা নিয়ে আয়।’
মাটির কলসি আনা হলে ভাবি ঐ শৌচাগারে ব্যবহারের পানির কলসি থেকে একমগ পানি আমাকে খাইয়ে দেয় আর অবশিষ্ট পানি দিয়ে গোসল করিয়ে দেয়। যাতে পরবর্তীতে ভীতি এসে আমার মনে ভর না করে।

এ ঘটনার তিনদিন পর। একদিন মাঝরাতে আকবর ভাই পেশাব করার জন্যে বাইরে গেছে। হঠাৎ বাড়ির পশ্চিম দিকে তাকিয়ে দেখতে পায়, একজন ছোটোখাটো মহিলা জমির মাঝ বরাবর থেকে খেতের প্রান্তপথ ধরে সাদাশাড়ি পড়ে পশ্চিম দিকে হেঁটে যাচ্ছে। একসময় সেই সাদাশাড়ি আমাদের আমবাগানের বড় গাছটির নিচে গিয়ে অলক্ষিত হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর দেখা যায় সেই গাছ থেকে চাপ চাপ আগুনের টুকরো নিচে পড়ছে। আকবর ভাই বাবাকে ডেকে ভীতিকর দৃশ্যের বর্ণনা দিলে বাবা উঠে দেখলেন- সবকিছু প্রশান্ত, কোলাহলশূন্য এবং দৃষ্টিসীমার ভেতরে প্রতিটি বস্তু বাধাহীন আর কাকচক্ষুর ন্যায় পরিষ্কার। তাই এবারও তিনি বললেন, ‘ওসব কিছু না। হয়ত আলেয়ার আলো।’
আমরা সবাই বাবাকে চন্দ্র সূর্যের ন্যায় বিশ্বাস করতাম। বাবা ছিলেন নির্ভীক, সাহসী, প্রচন্ড ধার্মিক এবং সত্য প্রতিষ্ঠায় আপোসহীন একজন একনিষ্ঠ ব্যক্তি। বাড়ির বাইরে একটা আটচালা কুঠুরি। সামনের দিকে প্রায় অর্ধাংশ খোলা দরজাবিহীন সেই বৈঠকখানার ঘরে বাবা একাকীই থাকতেন। তখন ঐ বাড়িতে বিজলির বাতি ছিল না। চারদিকে গাছপালা পরিবেষ্টিত নিকষ কালো অন্ধকার। সন্ধের পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শেয়ালের নিরবচ্ছিন্ন হুক্কা হুয়া ডাকাডাকি। আর তার ভেতরেই ছিল বাবার পৌরুষপূর্ণ এবং নিরাতঙ্ক আবাসন।

কিছুদিন পর ঈদুল-আজহা এলো। বাবা নির্ধারিত এবং প্রচলিত স্থান বাদ দিয়ে ঐ আমগাছের গোড়ায় গরু জবাই করলেন। এরপর থেকে আর ঐ আমগাছে কখনো আলোর ছটা দেখা যায়নি কিংবা কোন শ্বেতবসনা নারীমূর্তিকে জমির আলপথে হাঁটতে দেখা যায়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *