অণুগল্প।। নেপথ্যের কাহিনী।। তৃণা পালিত

পড়ন্ত বিকেল, সূর্য অস্ত যাবে। এবার শীতে গ্রামে ফিরে ভালোই হলো, শীতের আসল সৌন্দর্যকে উপভোগ করা গেলো। কে জানে এই ইট- কাঠ- পাথরের শহুরে ব্যস্ততার অবসান হলে আবার সবুজ, শ্যামল গ্রামের বুকে আসতে পারবো। আমার কেন জানি মনে হয়—বাংলাদেশের আসল রুপ তার গ্রামে। গ্রামে যে সরলতা আছে শহরগুলোতে তা অনুপস্থিত।
সে যাই হোক, মোল্লা বাড়ির পাশ দিয়ে যেতেই দেখি এক বৃদ্ধ মহিলা পাতা কুড়োচ্ছে!! শরীর টা একদম কাঠের মতো, পড়নে একটি মলিন সাদা শাড়ি, চামড়া কুচকানো, যৌবনে বৃদ্ধা বেশ সুন্দরী ছিলেন দেখেই বোঝা যায়। উনার হাতে অনেক জিনিস থাকায় ঠিক সামলাতে পারছিলো না, আমি গিয়ে ধরতেই বলে—
কে তুমি মা? তোমায় তো আগে দেখিনি।
আমায় আপনি চিনবেন না, শহরে থাকি। গ্রামে কবে এসেছি মনে পড়ে না। চলুন এগিয়ে দিয়ে আসি।
হাঁটতে হাঁটতে দেখি গ্রামের মানুষ কেমন যেনো আড়চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে। আমি কিছু বুঝতে না পারলেও বুড়ি বুঝতে পারে। তিনি বলেন— আমার সাথে হাঁটছো তো তাই। আমি চুপ করে চলতে থাকি সাথে সাথে। বুড়ির ঘরের সামনে যেতেই বলে, বসো এখানে৷
ঘরটা পুরনো কুড়ে ঘরের মতো। বুড়িকে জিজ্ঞেস করি— ঘরে কেউ নেই?
আমি আছি মাগো, আর বাকি সবাই আমারে মুক্তি দিয়া গেছে।
-কই গেছে?
-জান্নাত জাহান্নাম যদি কিছু থাকে সেখানে।
-মানে?
-যুদ্ধে মাগো আমার সবই গেলো। ছাওয়াল, মাইয়া, সোয়ামী লইয়া সোনার সংসার আসিলো, সব এহন স্বপ্ন লাগে।
-কেন? কি হয়েছিলো তাদের?
-মোর তিনি ছিলো এক ছোট্ট দোকানদার, ছাওয়াল ছিলো ১৯ বছরের, মাইয়াডা ১৫ বছর। এই রহম এক শীতের দিনে সেনাবাহিনী আসে, আইস্যা সে যে মা কি তান্ডব ।

  • তোমার স্বামীকে মেরে ফেলে? -জীবন্ত পুড়ায়া মাইরা ফেলে দোকানের ভেতর ।
    -হায় হায়!
    দেখতে শুনতে খারাপ আছিলাম না, আমার মাইয়া ছিল আমার মতো। গ্রামের ঐ জোয়াদ্দার সাহেব আমাগো বাড়ি দেখায় দেয়। পাক বাহিনী উইঠ্যা আসে মা। আমার সামনে আমার মাইয়া রে তারা…
    -থাক আর বলতে হবে না। বুঝতে পেরেছি।
    আমার মাইয়া রে প্রথমে, তারপর আমারে।
  • কিন্তু তোমার ছেলে কই?
  • আমার মাইয়ারে আমার সামনে মাইরা ফেলে। আর আমারে রাইখা যায়। পোলায় আসে রাতে। দেখে আমাগোরে পোলায় কয় তার বাপরে মাইরা ফেলায়সে।
    -একটু হেসে বুড়ি বলে—গ্রামের মানুষ সেই দিনের পর আমারে এক ঘর কইরা দেয়। আমি বুঝবার পারি না আমি করছিটা কি। তবে একটা কাম করছি। যাদের জন্য আমার মাইয়া আর সোয়ামীরে হারাইসি, তাদের জন্য পোলারে যুদ্ধে পাঠায়সি।
  • তাহলে সে কই?
    -নাই মা, আর ফিরে আসে নাই। একা আমি একায় ছিলাম।
    -কিন্তু আপনার তো দোষ নেই। তাও গ্রামের মানুষ এখনো একঘর করে রেখেছে কেন?
  • কপাল মাগো কপাল।
    এদিকে সন্ধ্যে হয়ে আসছে আমি বুড়িকে বলি—যাই মা, সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে। দেখি বুড়ির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে! কাল ১৬ই ডিসেম্বর। দূর হতে যেন ভেসে আসছিলো, ওরা আসবে চুপি চুপি…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *