ছোটগল্প//কালো কাক//তোফায়েল হোসেন

সার্জেন্ট জ্যাক জামালপুর থেকে ঢাকা যাচ্ছে। বাসে তার পাশের সিটে বসা বোরকাপরা এক মেয়ে। মেয়েটি কাঁদছে। নেকাবের উপর দুইচোখের পানিতে লম্বা দাগ পড়ে গেছে। মেয়েটি মোবাইলে মাকে বলছে- তোমার অযোগ্য মেয়ে আমি তোমাদের কোন কথাই রাখিনি, পারলে তোমরা আমাকে ক্ষমা করো। হঠাৎ জানালা দিয়ে বাতাস এসে মেয়েটির নেকাব মুখ থেকে মাথার উপর চলে যায়। এক পলক মেয়েটির মুখ দেখতে পায় সার্জেন্ট জ্যাক। আর ভাবে। জীবন অনেক সুন্দর এক সাজানো বাগান। যেখানে পাখি গান গায়, ফুল ফোটে, প্রজাপতি ওড়ে, সন্ধ্যায় জোনাকি জ্বলে। চাঁদ-তারা-সূর্য তাদের নিয়মমেনে গতিপথে চলতে থাকে। কখনোসখনো আকাশ মেঘে ঢাকে, বৃষ্টি নামে, কালবোশেখি ঝড়ও বয়ে যায়। তবুও তারই মাঝে প্রতিদিনই জমা হয় মুঠোমুঠো প্রেম, ভালোবাসা ও ভালোলাগা। কখন কাকে ভালো লেগে যায় তা বর্ষাকালের আকাশের মত হঠাৎ চিরচেনাও অচেনা হয়ে যায়, আবার মেঘের চাদর সরিয়ে যখন সূর্য হাসে তখন পৃথিবীও অট্টঠাসি হাসে। তেমনি ভালোলাগারাও একত্র হয়ে কাউকে ভালোবাসতে প্ররোচিত করতে পারে।

ময়মনসিংহ পর্যন্ত কোন কথাই হয়নি। জানালার গ্লাস খুলতে গিয়ে মেয়েটির হাতের দিকে চোখ পড়ে সার্জেন্ট জ্যাক এর। মেয়েটিকে স্বাভাবিক করতে পরিচয় জিজ্ঞেস করলে সুন্দরভাবে পরিচয় দেয় এবং জ্যাক কে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে জ্যাক নিজের পরিচয় দেয়। কিছুক্ষণ পর বাস যাত্রাবিরতি দিলে সার্জেন্ট জ্যাক বাস থেকে নেমে তার প্রিয় চিপস্ মিঃ টুইস্ট ও সেভেন আপ দুইটি করে নিয়ে আসে। মেয়েটিকে একটি চিপস্ ও একটি সেভেন আপ এগিয়ে দিলে মেয়েটি নিতে অস্বীকার করলে সার্জেন্ট জ্যাক বলে তোমার বড় ভাই দিলে না করতে? মেয়ে আর কোন কথা না বলে চিপস্ এবং সেভেন আপ নেয়। হঠাৎ জ্যাক জিজ্ঞেস করে তার হাতে অত কাটাকুটি দাগ কেন? মেয়েটি উত্তর দেয়ার আগেই মোবাইলে রিং বেজে উঠে আড়চোখে সার্জেন্ট জ্যাক তাকিয়ে দেখে ‘কালো কাক’ নামের কেউ একজন ফোন করেছে। কথা শেষ হলে জ্যাক জিজ্ঞেস করে- কালো কাক কে? জুলিয়া হেসে জবাব দেয় আমার হাসবেন্ড। আর হাতের কাটাকুটির কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন না? আর বাসে বসে মাকে মোবাইল ফোনে যে কথাগুলো বলেছিলাম আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন?
হ্যাঁ শুনেছি। তাহলে শুনেন বিস্তারিত বলছি, যেহেতু আপনি আমাকে ছোটবোন বলে ডেকেছেন।
জুলিয়া বলতে শুরু করে।
দীপ দরিদ্র ঘরের ছেলে হলেও স্কুল জীবন থেকেই দীপ’কে ভালোবাসি আমি। তবে দীপ’কে ভালোবাসার কথা বলা হয়নি কখনো। স্কুলে যাওয়া আসার পথের বাঁকে দাড়িয়ে থাকে দীপ। দীপ তখনও বুঝতে পারেনি আমার ভালোবাসা। একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে দেখি দীপ আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ দীপকে জিজ্ঞেস করি- কেমন আছেন ভাইয়া? আর ওভাবে তাকিয়ে কী দেখছেন? দীপ হঠাৎ করেই সম্বিত ফিরে পায়। তবে আমি কি প্রশ্ন করেছি তা মনে করতে পারছেনা। আমি আবারও জিজ্ঞেয়া করি, কেমন আছেন ভাইয়া? দীপ জবাব দেয়-

এইতো ভালো আছি, তুমি কেমন আছো? প্রশ্ন শুনে তাড়াতাড়ি ভালো আছি জবাব দিয়ে আবারও প্রশ্ন করি ওভাবে তাকিয়ে কি দেখতেছিলেন? প্রশ্ন শুনে প্রেমিক মন দুরুদুরু কাঁপছে, কন্ঠস্বর যেন কেউ খামচে ধরেছে, ঠোঁট ও জিহ্বা একসাথে বিদ্রোহ করেছে, তারা কোনও কাজই করতে প্রস্তুত নয় মনে হলো। ঝাড়া একমিনিট পর স্বাভাবিকতা ফিরে এলে বুকে সাহস সঞ্চার করে বলেই ফেললো, তোমাকেই দেখছিলাম। একথা শুনে হেসে দিলাম। ওই হাসিতে হৃদয় দোলে উঠে, ফুল ফোটে উঠে মনের বাগানে, নজরুলের মনোমুগ্ধকর গান ‘আমারও পরাণ যাহা চায় তুমি তাই তুমি তাই গো’ বেজে উঠে হৃদয় বীণার সুরে, আলোকিত হয় অন্ধকারে পরিপূর্ণ তার দেখা পৃথিবীটা। তাই মনে হলো দীপের।
জিজ্ঞেস করি-

কেন দেখছিলেন? জবাবে দীপ বলে- তোমাকে ভালোলাগে তাই তাকিয়ে ছিলাম। দীপ এর ভালোলাগার কথা শুনে আমি খুশি হলেও আর কথা না বাড়িয়ে স্কুলের দিকে হাটতে থাকি। আমার চলার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে দীপ। তারপর সেও পিছুপিছু হাটতে থাকে। যে যার ক্লাশে চলে যাই। দীপ এর ক্লাশে মন বসেনা। মনে কি এক অস্থিরতা কাজ করছে। মঈনুল স্যার দীপের অমনোযোগিতা লক্ষ্য করলেন কিন্তু ক্লাশে কিছু বললেন না। ক্লাশ শেষে দীপকে স্যারের সাথে অফিসে সাক্ষাত করতে বললেন। ক্লাশ শেষে দীপ মঈনুল স্যারের সাথে সাক্ষাত করতে ছালাম দিয়ে স্যারের রুমে প্রবেশের অনুমতি চাইতেই স্যার ইশারায় কাছে যেতে বললেন। দীপ দেখতে পেলো স্যারের হাতের কাছে নতুন একটা বেত, কিছুক্ষণ আগে যখন ও স্যারের রুমের সামনে দাড়ানো ছিল তখনি স্কুলের প্রবীণ দপ্তরি সামছুল হক দীপ এর সামনে দিয়েই এসে স্যারের কাছে দিয়ে গেছে। দীপ মনেমনে স্রষ্টাকে ডাকছে আর ভাবছে তার কোন ভুলের জন্য স্যার ডাকছেন? স্যারেরা সবাই দীপকে ভালোবাসেন। দীপ এর মুখের দিকে তাকিয়ে স্যার বুঝতে পারলেন দীপ ভয় পেয়েছে, তাই স্যার নিজের স্বভাবী ভঙ্গীতেই জিজ্ঞেস করলেন- পুরো ক্লাশেই কেন অমনোযোগী ছিলে? দীপ ভয়েভয়ে মিথ্যে জবাব দেয়, গতকাল রাত থেকে মাথা ব্যথা স্যার। স্কুলে আসার পরে মাথাব্যথা আরো বেড়ে গেছে স্যার তাই ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারিনি। এমনটা আর হবেনা স্যার। স্যার বললেন- ঠিক আছে যাও, মাথাব্যথা বেশি হলে এপ্লিকেশন জমা দিয়ে বাড়ীতে চলে যাও। দীপ কিছু না বলে স্যারকে ছালাম দিয়ে বের হয়ে আসে এবং এপ্লিকেশন লিখে জমা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে গাছের নিচে বসে যায় আর জুলিয়াকে নিয়ে সুখের ভাবনা ভাবতে থাকে।

দীপ যখন দশম শ্রেণীতে পড়ে তখন আমি সবেমাত্র সপ্তম শ্রেণীতে। একটু চোখাচোখি ও ভালোবাসাময় হাসির বিনিময়েই তুষ্ট থাকি দুজন। সামাজিক রীতিনীতি সব মেনে চলতে হয়। যদি কেউ দেখে ফেলে তাহলে কলংক রটে যাবে। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হঠাৎ কখনো সবার অলক্ষে দেখা হয়ে যায়, কথা হয়ে যায়। সংক্ষিপ্ত কথা আবেগী ও অতৃপ্ত জীবন কিছুটা পূর্ণতা পায়, পায় জীবনে চলার ছন্দ। চিঠি চালাচালি আমাদের প্রতিদিনের কাজ। একটা চিঠির অপেক্ষায় কাতরচোখে তাকিয়ে থাকে বটগাছটার ছোট্ট কুঠুরিতে। খুশিতে আত্মহারা হয় প্রেমিক হৃদয়। একই চিঠি শতবার পাঠ করলেও প্রতিবারই নতুনের মতো লাগে। আসলে ভালোবাসা এমনই হয়। ভালোবাসলে পাখিগান গায়, ফুলফুটে উঠে, আকাশে সাদা মেঘের দল উড়ে যায়। আর এসব ভাবতেভাবতেই সময় পেরিয়ে যায় সময়ের নিয়মে।

দীপ এসএসসি পাশ করে জামালপুর সরকারী আশেক মাহমুদ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়। এদিকে আমার ও দীপের মধ্যে প্রতিদিনের দেখা করা চিঠি আদানপ্রদান কমে যাওয়ায় একে অপরের প্রতি ভালোবাসাটাও বেড়ে যায় দুজনেই দুইপ্রান্তে ছটফট করতে থাকে। দেখতে দেখতে দুইবছর পার হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে দীপ বাড়ীতে গেলে রাস্তায় দাড়িয়ে দুয়েক মিনিট কথা হয়। জমাপড়ে থাকে হাজারো না বলা কথা। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে দীপ ঢাকা শহরে চলে যায় জীবিকার তাগিদে। দরিদ্র পরিবারের মা-বাবার মুখের দিকে তাকালে দীপের কষ্টে বুক ফেটে যায়। হঠাৎ একদিন পত্রিকায় পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করে এবং প্রাথমিক নির্বাচনের জন্য ময়মনসিংহ পুলিশলাইন্সে অংশগ্রহন করে। প্রাথমিক নির্বাচনে টিকে যায় এবং পরবর্তীতে চুড়ান্ত নির্বাচনেও যোগ্য হয়ে এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে যায়। এই খবর সবার আগে জানায় আমাকে। খুশিতে আত্নহারা হয়ে আর নিজের ঘরের দরোজা বন্ধ করে কাঁদতে থাকি। আর ভাবতে থাকি এবার আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে।

দীপ মৌলিক প্রশিক্ষণের জন্য পুলিশ একাডেমিতে যোগদান করে। দুজনের মনেই স্বপ্নবুনে। স্বপ্ন দেখে তাদের একে অপরের কাছাকাছি যাওয়ার। দীপ প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে শুধুমাত্র শুক্রবার মোবাইলে দশমিনিট কথা বলার সুযোগ পেতো। এই দশমিনিটের মধ্যে চার পাঁচ মিনিট মা-বাবা ও ভাইবোনদের সাথে শুধু কুশল বিনিময় করে আমাকে ফোন দিতো। কতকথা জমা তা কেবল নিজেরাই জানে, কিন্তু নিয়মের কাছে হার মেনে বিদায় নিতে হয়। আমি ছটফট করতে থাকে ডানাভাঙা পাখির মতো। কতদিন কেটে গেছে দীপকে না দেখে তার হিসেব কে আর কবে রেখেছে?
ছোটভাই রাকিব ও মা-বাবা সহ আমাদের পরিবারে সদস্য সংখ্যা মাত্র চারজন। উচ্চবিত্ত পরিবারে কোন কিছুরই অভাব বোধ করেনি, কখনো ও কোনও দিনই। দীপ’দের পরিবার একেবারে অসচ্চল। আমাদের ব্যাপারে সবাই জানলেও মেনে নিতে চায় না। ভালোবাসা ধনী-গরীব, শ্রেণীভেদ কিছুই মানে না। জামালপুর শহর থেকে কিছুটা দূরেই আমাদের বাড়ী। মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে বাড়ীতে এলে আবার দেখা হয় এবং লুকিয়ে কথাও হয়। মোবাইলে তাদের নিত্যদিনই কত কথা হয় তা তারা ছাড়া আর কেউ জানেনা। আমি দীপকে ভেবেভেবে প্রিয় কবির কবিতার বই হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতেই চোখে পড়ে ‘এ শহর তার সবই জানে’ শিরোনামের নিচের কবিতাটি-

একটা হাতের প্রয়োজন- যে হাত নির্ভার ও বিশ্বাসী,
সুপ্ত প্রেম হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসুক কপাট খুলে,
চলে আসুক অসুখের গান গেয়ে পরিরণ সুখগুলো,
তুমি ফেরারী বলতেই নিজেকে ফেরারীদের দলে ভিড়িয়েছি,
হাঙরে স্বভাবেরা চারিদিকে উৎফুল্ল, ভয়ানক হিংস্র,
বিরিয়ানীর ঘ্রাণে অগ্রহায়ণের আগমনীর অপেক্ষায়,
চোখে চোখ রাখার জন্যে হলেও আজ একজন চাই,
ক্ষুধা নয়, ক্ষুদ্র পিয়াসে একটা বিষের পেয়ালা চাই,
শুধু নির্ভেজাল একটা হাতের প্রয়োজন, যে বিশ্বাসী।

কামনার আগুনে বসে গুনগুনিয়ে গান গেয়ে উঠা পালকহীন একটা কালো কোকিল হলেই চলবে,
এর বেশি? না তা আর কখনো চাইবো না।
নির্মল রাত, একাকী চাঁদ, আর একখন্ড নীলাকাশ সৃষ্টির চোখে মহামূল্যবান- ঠিক তোমারই মতো,
ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে ভেঙে যাক সরস নদীর কূল,
উত্তরীয় হাওয়ায় ভেসে যাক মেঘের সকল কালো,
শুধু- পড়ে থাকুক এলোমেলো কাশফুলের বিছানা,
তুমি জানো আর নাইবা জানো তাতে কোন আফসোস নেই,
শুদ্ধতম প্রেমে পুড়তে পুড়তে এখন নিঃস্বপ্রায়,
তোমাকে পেলে আর কখনোই এই ইট পাথরের শহরে ফিরবোনা, এশহর তার ষোল আনা জানে।।

এদিকে মা জেনে যায় আমার ও দীপ এর মধ্যে হৃদয়ঘটিত ব্যাপারটি। মা, অনেক বুঝালেন কিন্তু আমার এককথা- বাঁচলে দীপ এর সাথে বাঁচবো আর মরলেও দীপ এর সাথেই মরবো। মা মেয়ের মনের কষ্ট বুঝতে চেষ্টা করেন এবং বলেন সময় হোক, পারিবারিকভাবে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবেন অর্থাৎ বিয়ের কথা (ঘটক) পাঠাবেন কিন্তু আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে যেন আর সময় সইছেনা। দীপ এর সাথে কথা বলে তারা গোপনে বিয়ে করে ফেলে এবং দীপদের বাড়ীতে গিয়ে উঠে। দীপদের পরিবার মেনে নিতে না চাইলেও দীপ এর দিকে তাকিয়ে এবং জুলিয়াদের পরিবারের সচ্ছলতার দিকে তাকিয়ে মেনে নেয়। তিন মাসের মতো শ্বশুরালয়ে থাকে এবং যে আমি বাবার বাড়ী থাকতে কোনওদিন মায়ের সাথে রান্নাবান্নার কাছে যায়নি সেই আমিই এখানে পুরোদস্তর গৃহিনী।

আপোসের কথা বলে এবং সামাজিক ভাবে বিয়ের স্বীকৃতি দিবে বলে বাবা ও কাকা মিলে দীপ এর বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠায় এবং আমাকে তাদের বাড়ীতে নিয়ে যেতে চায়। এতে দীপ এর বাবা রাজী হন এবং আমাকে বাবা-কাকাদের সাথে তার বাপের বাড়ীতে পাঠিয়ে দেন। রাতে আমাকে বাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার পর সবাই মিলে অমানুষিক নির্যাতন করে এবং দীপকে তালাক দিতে বলে। পুরুষশাসিত সমাজের ষোলআনা ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়। কে না জানে ভালোবাসা কোন অপরাধ নয়! কিন্তু আমরা মেনে নেই তা ক’জনে? আমার ভাগ্যেও তাই হয়েছে। রাতভর নির্যাতন ও ভয়ভীতির শেষে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরলে আবারও নির্যাতন চালায় কিন্তু শত নির্যাতনের পরেও দীপ’কে চাই বলে একই দাবী। কয়েকদিন এভাবে চলার পর, মা বাবা-কাকাদের হাতেপায়ে ধরে রাজী করান দীপ এর কাছেই তুলে দিতে। তারপর তাদেরকে আবারও বিয়ে পড়ানো হয়। এবং সকলেই তাদেরকে মেনে নেন। আমিও শ্বশুরবাড়ী যাই। এবার তার কপালে জুটে অমানুষিক নির্যাতন। কারো সাথে কথা বলতে পারিনা আমি। উঠতেবসতে শ্বশুর শাশুড়ি বাঁকা কথা বলে এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। বাবা মেয়ের সুখের কথা ভেবে মনের সকল দুঃখকষ্ট মেনে নিয়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি ফার্ণিচার থেকে শুরু করে ফ্রিজ, টিভি পর্যন্ত পাঠিয়ে দেয়। এছাড়া সময় পেলেই মেয়ের জন্য বাজার থেকে মেয়ের পছন্দের খাবার কিনে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু সেসব শুধু জুলিয়া দেখেই যায়, তার জিহ্বা কখনো চেখে স্বাদ নিতে পারেনি। বাবা-মা ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলেই বলে হ্যা মা খেয়েছি, হ্যা বাবা খেয়েছি। চোখের জল লুকিয়ে একশহর কষ্ট বুকে পুষে বলে ভালো আছি।

হঠাৎ করেই দীপ এর আচরণ পাল্টে যেতে থাকে। কথায় কথায় সেও গালিগালাজ করে। শুধু গালিগালাজেই শান’ত হয়নি সেদিন তো ইচ্ছেমতো প্রহার করলো। সবাই চেয়েচেয়ে দেখলো কিন্তু কেউ দীপকে বাঁধা দিলোনা। দীপ এর পরিবারের সভাই মুখ টিপে হাসলো, যা দেখে নিজেকে খুবই অসহায় মনে হলো। কয়েকদিন পর দীপের খারাপ ব্যবহারের মাত্রা ভীষণরকম বেড়ে গেলো এবং বললো আমার সাথে সংসার করতে চাইলে বাবার বাড়ী থেকে দশলাখ টাকা নিয়ে আয়। নইলে তোকে তালাক দেবো। জুলিয়া তা আনতে অস্বীকার করলে আবারো ইচ্ছেমতো প্রহার করে এবং তারপরের দিন একরকম জোর করে বাবার বাড়ীতে রেখে আসে।

প্রচণ্ড ভালোবাসি দীপ-কে। সেই কিনা কষ্ট দিলো! সেদিন রাতে শোয়ার রুমে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শেষরাতের দিকে পড়ার টেবিলের ড্র‍্যয়ারে থাকা জ্যামিতি বক্সের কাঁটাকম্পাস দিয়ে বামহাতের কব্জির উপর থেকে কনুই পর্যন্ত খুঁচিয়েখুঁচিয়ে আঁকতে থাকি। কমপক্ষে একশোটা দাগ টানার পর জ্ঞান হারায়। রক্তক্ষরণ হয়। রক্তে বিছানা ভিজে যায়। সকালে মা ডাক দেয়। সাড়া না পেয়ে বাবাকে ডাক দিতে বলেন। বাবার ডাকেও সাড়া না দিলে বাবা দরোজা ভেঙে দেখেন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছি। সাথে সাথে জামালপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তারগণ জানান জ্ঞান ফিরতে দেরী হবে। প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হয়েছে হাসপাতালে এই গ্রুপের রক্ত নাই। জরুরী ও+ (পজিটিভ) রক্ত লাগবে। আমাদের পরিবারের কারও রক্তের গ্রুপই ও+ (পজিটিভ) নয়। তারা রক্তের সন্ধানে আত্মীয়স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করতে থাকে। কিন্তু সবার কাছ থেকেই জানতে পারে তাদের রক্তের গ্রুপের মিল নাই। মা-বাবা কান্নায় ভেঙে পড়েন।

দীপ এর পোস্টিং হয়েছে ঢাকায়, আজ ছুটি শেষ। কিছুক্ষণ পরেই চলে যাবে। সে ব্যাগগুছিয়ে খাবার জন্য টেবিলে যাবে এমন সময় দীপ এর মোবাইলে ফোন আসে জুলিয়ার নম্বর থেকে। রাগে দুইতিনবার ফোন কেটে দেয়। তারপর রিসিভ করতেই তার শ্যালক রাকিব কান্নাকাটি করে বলতে থাকে- দুলাভাই, আপা মনে হয় বাঁচবেনা। আপাকে জামালপুর সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে বলেই ফোন কেঁটে দেয়। দীপদের বাড়ী থেকে মোটর সাইকেলে বিশমিনিট লাগে জামালপুর শহরে আসতে। দীপ মোটর সাইকেলে সেন্ট্রাল হাসপাতালে এসে রিসিপশনে খোঁজ নিলে জানায় জুলিয়া ৪ তলায় ৪১২ নম্বর রুমে আছে এবং এও জানায় রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন, আধা ঘন্টার মধ্যে রক্ত না পেলে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব না।

সরাসরি ডাক্তারের কাছে গিয়ে জুলিয়া সমন্ধে জানতে চাইলে ডাক্তার রক্তের কথা বললে দীপ বলে আমার রক্তের গ্রুপ ও+(পজিটিভ)। ডাক্তার তড়িত দীপকে জুলিয়ার কাছে নিয়ে যায়। জুলিয়াকে দেখে দীপ এর বুকে কাঁপন ধরে। ফ্যাকাশে মুখ দেখে ভয় পেয়ে যায় দীপ। হাতের ব্যান্ডেজ দেখে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলে ডাক্তার বলেন তার ফিরিস্তি। দীপের বুকের ভিতর দুমড়েমুচড়ে একাকার হয়ে যায়। দীপ এর রক্ত দেয়ার দুইঘন্টা পর জ্ঞান ফিরে। চোখ মেলে তাকাতেই দেখি হাত ধরে বসে আছে দীপ। অভিমানে চোখ ফিরিয়ে নেই। নিজের প্রতি ঘৃণায় আড়ষ্ট হয়ে নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চায় দীপ। জুলিয়া দীপের হাত জোরে চেপে ধরলে দীপ কান্নায় ভেঙে পড়ে।

স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা বলে এয়ারপোর্ট থানায় অফিসার ইনচার্জকে দুই দিনের ছুটি বাড়াতে অনুরোধ করে দীপ। অফিসার ইনচার্জ ছুটি মঞ্জুর করেন। পরেরদিন হাসপাতাল থেকে জুলিয়ার বাবা বাড়ীতে নিয়ে যায়। সাথে দীপও যায়। দীপ তার ভুল বুঝতে পেরেছে বলে ‘সরি’ বলে ক্ষমা চায় এবং বলে তুমি সুস্থ হলে আগামী সপ্তাহেই আমার কাছে নিয়ে যাবো। কিন্তু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা। আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নেয় দীপ। আমিও খুশিতে ফুঁপিয়েফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকি। ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে বলতে পারেনা।

নারীর মন কভু অশান্ত কভু শান্ত। একটু ভালোবাসা পেলেই নারী খুশি হয়, অশান্ত নদী শান্ত হয়, একটু ভালোবাসা পেলেই নারী সাজিয়ে তুলে ফুলেল পৃথিবী তার আপন মহিমায়। হাজারো কষ্ট একনিমিষেই মুছেগেছে যেন। দীপ আমাকে আরো জোরে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলে তোমাকে এভাবেই ধরে রাখবো আর কখনো ছেড়ে যাবো না।

ভাইয়া, এই হলো আমার কালো কাকের ভালোবাসার দান’। হঠাৎ বাসের হেলপার এয়ারপোর্টে এয়ারপোর্ট বলে চিক্কুর দেয়। জুলিয়া বলে নামতে হবে ভাইয়া। বলে এয়ারপোর্ট ওভারব্রীজ এর একটু আগেই নেমে যায় জুলিয়া। নামার সময় জ্যাক বলে ‘ভালো থেকো, সুখি হও বোন’। বাস থেকে নেমে হাত নাড়িয়ে জুলিয়া। বলে ‘ভালো থাকবেন ভাইয়া’। সার্জেন্ট জ্যাক গভীর ভাবনায় তলিয়ে যায়। আর ভাবতে থাকে প্রেমের কত রূপ…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *