ছোটগল্প।। আনকাহি।। শফিক নহো র

খসে পরা দেয়ালের বিবর্ণ রং চটা একটি বিল্ডিং আমার স্কুল। পাশেই আধপাকা পুরাতন কালি মন্দির, পিছন ডোবার ধারে জেলে পাড়া, বাচ্চা –কাচ্চাদের নিয়ে অসহায় ভোলা কাকা । সবসময় দ্বিধা-দ্বন্ধে থাকে, সংসারের হিসেব নিকেশ নিয়ে । অনেক গুলো ছেলে-মেয়ে। স্কুল ঘরের পিছন ঘেঁসে একটা জাম্বুরা গাছ, তার পরেই মিনুদের বিশাল বাড়ি। সুপারি-গাছের বাগান, নারকেল-গাছ, বাড়ির প্রবেশ পথে অনেক বড় ধানের গোলা, আমি প্রতিদিনের মতন আজও স্কুল শেষ করে সোজা বাড়িতে চলে আসলাম। কলপাড়ে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে খাবার খাবো, ঠিক এই মহুর্তে কে যেন বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার নাম ধরে ডাকছে, আমি একটু দেখার চেষ্টা করলাম পাটশোলার বেড়ার ফাঁক দিয়ে কিন্তু কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঘরে এসে প্লেট ভর্তি সকালের রান্না করা ভাত। আমি একটা কাঁচামরিচ আর পেঁয়াচ নিয়ে খেতে শুরু করলাম ।গরমের দিনে পানি দিয়ে ভাত রেখে দিতো আমার জন্য । যাতে সহজে ভাত নষ্ট না হয়ে যায় গরমে। তখন শুধু আমাদের না গ্রামের কারো বাড়িতে ফ্রিজ ছিল না। পান্তা ভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বের হব ঠিক সে সময় মোস্তফার সঙ্গে দেখা । ওকে নিয়ে চলে গেলাম ক্রিকেট খেলার মাঠে। খেলা শেষ করে চলে যেতাম; মিনুদের বাড়িতে। মিনুদের বাড়িতে না গেলে আমার পেটের ভাত হজম হত—না কখনো।

মিনুর মা’ আমাকে তার আপন ছেলের মত ভালবাসে, বিশ্বাস করে। শ্রদ্ধেয় আমার মাথা-নত হয়ে থাকে সবসময়।, পর মানুষ গুলো আপনের চেয়ে আপন মনে হয়। মিনুর মাকে না দেখলে বিশ্বাসটা আমার চিরদিনের জন্য মানুষের উপর থেকে হারিয়ে যেত। আমি তার অবাধ্য ছিলাম না কখনো। বিশেষ কোন আয়োজনে, ঘরোয়া কোন অনুষ্ঠান হলে আমি থাকতাম সবার আগে মিনু এবার ক্লাস নাইনে পড়ছে, আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা দিব, মিনুর সঙ্গে আমার সখ্যতা বেড়ে উঠছে -ধীরে-ধীরে। মিনুকে ভীষণ ভাল-লাগে, আমার মনের গহিনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব চলছে; মিনু কি আমার মনের ব্যাকুলতা বুঝবে ?’ আমার মনের ভেতরে প্রশ্ন আসে খোলা জানার বাতাসের মতো। আমি অনেক সময় বোকা মানুষের মতোন উদাস হয়ে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি।
মিনুর জন্মদিনে একটি বই উপহার দিব ভেবে থানা শহর থেকে বইটি কিনেছি; বইটি দিতে আমার
প্রচণ্ড ভয় কাজ করেছিল। যদি ওর মাকে উল্টা-পাল্টা কিছু বলে দেয়! আমি সাত পাঁচ ভেবে কিছুক্ষণ গেটের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকি। একটা সময় মন সায় দিল তখন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম। হুমায়ূন আহমেদের বৃষ্টি ও মেঘমালা বইয়ের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লিখে দিয়েছিলাম ‘মিনু তোমার সঙ্গে বিশেষ একটা কথা বলতে চাই তবে গোপনীয় !’
সেই বই হাতে পেয়ে মিনুর মায়ের কড়া নির্দেশ ছোট-মানুষের এ সব বই পড়তে নেই। মিনু আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে ছিল। ওর ঠোঁটের কিনারে অপ্রকাশিত হাসির জোয়ার। আমি লাজুক দৃষ্টিতে দ্রুত প্রস্থান করি সেদিন। কাকীর বিরূপ দৃষ্টি-ছিল আমার দিকে। তবে মিনুর মা একসময় নিজের স্বার্থের কারণে আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। সে বিষয় গুলো আমি তখন বুঝতে পারতাম।
সেদিন রাতে বাড়িতে ফিরে আসবার পর, মিনুর জন্য আমার প্রচণ্ড মায়া হতে লাগল। নিজেই নিজেকে বারংবার প্রশ্ন করছি ?’ মিনু তোমার জন্য আমার এত খারাপ লাগছে কেন?’ আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, আমি স্মৃতির পাতায় হিসাব কষতে থাকি বেমালুম।
আমি সংসারের একমাত্র ছেলে, দুই বোন আমার। বাবা, ছোট বোনটা পৃথিবীর আলো বাতাস দেখার আগেই বিদায় নিয়েছে; অজানা ঠিকানায়। জমিতে যা চাষাবাদ আমাদের সংসার চলে যায় কোন মতো। পুকুরের মাছ, আর বাড়ির আঙিনায় মায়ের হাতে লাগানো বিভিন্ন ধরণের তরকারি- তে চলে আমাদের সংসার। মাধ্যমিক শেষ না হতেই দুই বোনকে বিয়ে দিতে হয়েছে ; তার পরেও ছেলের বাড়ির লোকজন বলেছে , মেয়ের অনেক বয়স ! আমি কোন মতন উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকায় চলে আসি । এ শহরে পাখির বাসা করতে হয়তো একদিন লাগে , মানুষের একটা নিজস্ব ঠিকানা করতে মাস লেগে যায় । এ যেন সত্যিই যাদুর শহর ।

মিনুর বাবার ট্রান্সফার হবার কারণে , অনেক আগেই ঢাকা চলে আসে । আমার সঙ্গে মিনুর কোন প্রকার যোগাযোগ নেই । অনেক বার মিনুকে ভুলতে চেয়েছি ,পারিনি । আমার লেখাপড়া শেষ। ভাল একটা চাকরি , খুব প্রয়োজন । ‘ মা ’ সারাদিন বাড়িতে একাকী থাকে । বাড়ি থেকে প্রচণ্ড চাপছিল বিয়ে করবার জন্য । মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে হয়েছে ; তবে আমার সেখানে বিন্দু মাত্র অভিযোগ নেই । তার বিশেষ কারণ হল ছালমা মার্জিত ,নম্র ,শিক্ষিত এবং সংসারি । আমার লেখা পড়া শেষ করে নিজের জন্য এই শহরে নিজে এক প্রকার ব্যর্থ হয়েই ছিলাম । তকদির মানুষের কাছেই থাকে তা হয়তো ভাগ্যরেখার মতে ঘুরে যায় কখনো কখনো । সংসার জীবনে বিস্তার পরিবর্তন এসেছিল একমাত্র গুণী একজন মানুষের কারণে । খুব সহজ করে বললে বরতে হয় সংসার সুখের হয় দুজনার গুণে নিজের গুণকীর্তন করা ঠিক না তবুও আমি একটু করলাম ।

বাড়ি থেকে বেশ ক’য়েক দিন খুব ফোন বাড়ি আসতে হবে গাছের আম ফুরিয়ে যাচ্ছে ।
মা না-কি আমার জন্য পথের দিকে চেয়ে থাকে । যদিও ছালমা মাকে বলেছে ; আগামি বৃহঃপ্রতিবার অফিস করে ফিরবে তবুও মা পথেরে দিকে চেয়ে থাকেন আমি কখন বাড়ি আসব । হয়তো পৃথিবীর সব মা এমন , মায়ের মন বলে কথা ।
অফিস শেষ করে আমি ব্যাগ নিয়ে বের হয়েছি ; হঠাৎ একটা পুরনো স্মৃতির মায়াজালে কেমন ভেসে গেলাম ।এত বছর পার হয়ে গেল । আজো মিনুর সঙ্গে কোন যোগাযোগ করতে পারলাম না । স্মৃতির পাতায় ভেসে আসে আমার সোনালী পুরনো দিনের ব্যথার রঙিন ক্যাম্পাস ।

আরিচা লঞ্চঘাটে অপেক্ষা করছি ; কিছু সময়ের মধ্যে হয়তো লঞ্চ ছেড়ে দিবে । একটা আদা পুরানো মুখ আমাকে দেখে কেমন শাড়ির আঁচল টেনে ধরল; আমি তেমন কোন গরুত্ব না দিয়ে আমার নিদিষ্ট সিটে গিয়ে বসলাম । কিছুক্ষণ পরে আবারও সেই একই দৃশ্যপটের পুনরাবৃত্ত আমি একটু আগ্রহী হয়ে এগিয়ে গেলাম ।

  • আমাকে চিনতে পারছো তুমি ?’
  • সরি , আমাকে বলছেন ?’
    যদিও আমি প্রথমে মিনুকে চিনতে পারিনি। এত বছর পর দেখা ! মিনু কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলছিল ,
    -‘আমি মিনু ?’ তোমার দেওয়া হুমায়ূন আহমেদের ‘বৃষ্টি ও মেঘমালা’ বইয়ের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় যা লেখা ছিল! আমি তা পড়েছিলাম কয়েক বছর পরে ।
    -‘একটা প্রশ্ন করি ?’
    -তুমি কী আমাকে ভালবাসতে ?’
    আমি পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলাম ! অনেকক্ষণ পরে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলাম ।
    আমার চোখ সহসায় ঝাপসা হয়ে গেল । কথার শেষ না হতেই— মিনুর স্বামী এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে ঠিক তখনই
    আমার মোবাইল ফোনে রিংটোন বেজে উঠল; আমি তখন নগরবাড়ি ঘাটে । লঞ্চ থেকে লোকজন নামতে শুরু করেছে , ওপাশ থেকে মৃদু কণ্ঠে ভেসে আসছে।
  • আজ তোমার সব প্রিয় খাবার রান্না করছি ।মা সেই সকাল থেকে তোমার জন্য পথের দিকে তাকিয়ে আছে । সাবধানে এসো , আজ বাড়ি আসবার পর তোমাকে একটি গুড নিউজ দিব ।

One thought on “ছোটগল্প।। আনকাহি।। শফিক নহো র

  • এপ্রিল ২১, ২০২০ at ১০:২২ অপরাহ্ণ
    Permalink

    দারুন গল্প। পড়ে ভালো লাগলো।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *