সুখপাঠ্য গল্পগ্রন্থ অমরলোকের প্রত্যাগত।। আফিফ জাহাঙ্গীর আলি

‘আহা, শৈশবের দৈর্ঘ্য কেন এত খাটো হয়!’
‘ও তো বুনো ফুল, মানুষ ওদের পায়ে দলে হেলেও ওরা আবার হেসে ওঠে।’
ঠিক তেমনি অতৃপ্ত পাঠক যে, সুখপাঠ্যে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে আনন্দ পাবেন? পাঠ শেষে এ কথা যে কেউ নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় একবাক্যে বলতে পারবেন। তেমনি মনে হলো আমার সুখপাঠ্য গল্পগ্রন্থ ‘অমরলোকের প্রত্যাগত।’

মলাটবদ্ধ ৮ টি গল্পে ‘অমরলোকের প্রত্যাগত’ লেখকের গভীর অনুভব চৈতন্ত আক্রান্ত একটি গল্পগ্রন্থ। যা ২০২১ বাংলা একাডেমি গ্রন্থমেলায় কাকলী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। প্রত্যেকটি গল্প পাঠক প্রিয়তার দাবি রাখে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলা সাহিত্যের মানদণ্ডে নিশ্চিত সম্মুখ সারির প্রত্যেকটি গল্প। তাছাড়া মানদণ্ডে অগ্রগণ্য হয়েই গল্পগুলো ইতোমধ্যে দৈনিক, অনলাইন ও ম্যাগাজিনের সাহিত্য সাময়িকীকে প্রথম প্রকাশিত হযেছে। পাঠকের জন্য এটি একটি নির্ভাবনার জোগান এবং অবশ্যই বাড়তি পাওয়া। আর গ্রন্থাকারে প্রকাশ মানেই পাঠকের জন্য পাঠের অবারিত সুযোগ।
গল্পগুলো ঝরঝরে এতো নিপুণভাবে নিজস্বতার স্বাক্ষরে নির্মাণ যে, পৃথিবীর যে কোন ভাষায় অনূদিত হলে, সাহিত্যবিশারদরা পাঠে আগ্রহী হবেন।শুধু আমি নই, পাঠ শেষে যে কেউ বলবেন। মননশীল ও সাধারণ পাঠক যারা গ্রন্থটি পাঠ নিয়েছেন তাদের ভাবনা আমার চেয়ে আরো গাঢ় হতে পারে। এবার নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে—গল্পের রচয়িতা কে? কবিতা, গল্প, ভ্রমণকাহিনি ও প্রবন্ধে লেখকের নিজস্ব স্বতন্ত্রতা আছে। যা লিখেন তথ্য বৈচিত্র্যে ভরপুর নিজের কল্পনা শক্তিতে নিজের মতো করে। আমরা যেমন ভেজালের দৌরাত্ম্যে নির্ভেজাল খুঁজি; তেমনি এই লেখকের নিজস্ব স্বকীয়তার গণ্ডি প্রসারিত। নতুন বিষয়বস্তু ও শব্দশৈলির তথ্যভাণ্ডার উর্বর। নানা দেশ ভ্রমণ করে করে সংগ্রহ করেন সাহিত্য সাধনার খোরাক। এই গ্রন্থের পরতে পরতে পাঠকরা ভিনদেশি স্বাদ পাবেন লেখকের লেখার গভীরতায়।

তিনি পাঠক প্রিয়তায়ও পিছিনে নেই? বাংলা একাডেমির গ্রন্থমেলায় ‘অমরলোকের প্রত্যাগত’ লেখকের গ্রন্থ প্রকাশের ২/১ দিনের মধ্যেই পাঠকের ক্রয়চাপে প্রথম মুদ্রণ শেষ হতে দেখেছি। বই সংগ্রহ করতে গিয়ে আমার নিজেরই দ্বিতীয় মুদ্রণের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল একবার। তিনি সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে একেবারে ব্যতিক্রম? ক্লিন ইমেজের অধিকারী। লেখককে নয়; লেখাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। পাঠকরা এখনো না চিনলেও, লেখকরা বুঝে গেছেন তিনি কে! তিনি আমাদের সবার প্রিয় কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক মিলু শামস। তিনিই’ অমরলোকের প্রত্যাগত’ গ্রন্থে স্রষ্টা। এই গ্রন্থের প্রথম গল্প—উত্তরসূরি। বংশ লতিকা মজবুদের ঘুরপাকে মাদকতায় নিয়ে যায়। গল্পের গভীরতা বাড়ে। ‘এক ঝড়ের রাতে ফল ধরে।’ কিন্তু বসন্তের আগে ‘ফাগুনেরকালে ঝড়টা ছিল কৃত্রিম।’
বুঁদ হয়ে পড়ার মতো গল্পটি এভাবে এগিয়ে গিয়ে লোমহর্ষক সমাপ্তি। তবে বাংলা সাহিত্যে এমন গল্প দুঃসাহসিক। গভীর কল্পনা শক্তির বিচ্ছুরণ!
দ্বিতীয় গল্প—চিৎকার। এই গল্পের প্রধান চরিত্র ‘কায়সার’। অনেক বিমর্ষ সন্ধ্যা আর ক্লান্ত দুপুর সে কাটিয়েছে ম্যাথু-মার্সেল ও দানিয়েলের ত্রিমুখী সম্পর্কের ব্যবচ্ছেদ করে। বিশ্বযুদ্ধকে নিয়ে লেখা উপন্যাসের কাহিনি অবলম্বনে গল্পের ডালপালা বেড়েছে। শরীর যে বিপজ্জনক হতে পারে মেয়েদের জন্য সে মেসেজ পরিস্কার। প্রথম গল্পটির মতো এই গল্পেরও শেষে লোমহর্ষক।
তৃতীয় গল্পের নামে গ্রন্থটির নামকরণ ‘ অমরলোকের প্রত্যাগত’ এই গল্পে পাঠকের নজর একটু বেশিই থাকবে। আর পাঠক নিশ্চয়ই পাবেন আগ্রহের প্রাপ্তি।
গনগনে দুপুরে গাছগুলোর লাল বর্ণ ফুল অগ্নিশিখার মতো জ্বলত। আমি আনন্দ আর উত্তেজনায় হারিয়ে যেতাম…।
চতুর্থ গল্প ‘সেক্সপিয়ার এসেছিলেন।’ উইলিয়াম সেক্সপিয়ার। যার জীবনে রহস্য, মরণেও রহস্য। তাকে নিয়েই গোছানো বাস্তব নির্ভর চুম্বক আকর্ষণীয় তরজমা। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের অনেক কাজে আসবে এই গল্প।
পঞ্চম গল্প’ কালো মেঘ ও অথবা খুনে ডাকাতের বাঁশি’
ঘটনার মধ্যেই তাদের বসবাস।কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে ভেবে তারা শঙ্কিত…। কোনো কেনো জ্বর যেমন রোগ নয়, রোগের লক্ষণ। মাটির গভীরে শেকড় প্রোথিত নয় বলে সহজে চোখে বিভ্রমের কাজল এঁকে…। কবিতার পঙক্তির মতো সাজানো এই গল্পের দৃশ্য ত্রিমাত্রিক।
ষষ্ঠ গল্প ‘সাদার্ন ভিউ’। কর্পোরেট বাণিজ্যের ধরণ ও কৌশল উন্মোচন করে লেখা। ‘আকাঙ্ক্ষা উস্কে দেয়ার মধ্যেই আসল ব্যবসা’। ‘মানুষের মনে স্বপ্ন বোনা।’
‘সময়ের সুরকে সঠিকভাবে ধরতে পারাই সফল ব্যবসায়ের অন্যতম শর্ত’। গল্পে ব্যবহৃত ভাষা শৈলীতে গল্পটির ওজন বোঝা যাচ্ছে নিশ্চয়ই! গভীর কল্পনা শক্তি সাহিত্যের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ‘সাদার্ন ভিউ’ গল্পে পেলাম।
সপ্তম গল্প ‘একজন ব্যাঞ্জো বাদক।’ ভূমিদস্যু লোভী, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হৃদয়স্পর্শী একটি বয়ান।
‘বাপের ভিটা যেন থাকে, দেখিস খলিল।’ স্বাধীনতার পর বদলে যাওয়া দৃশ্যপটের সঙ্গে বদলে যায় হৈমপাশা গ্রাম। লতিফের দাপট ক্রমশ বাড়ে।
অষ্টম গল্প বা গ্রন্থের শেষ গল্পের নাম ‘দণ্ডকারণ্য।’ আশ্চর্য এক জংশন যেন এই মোড়ে। এখানে দাঁড়িয়ে কেউ ঢ্যাঁরা পেটালে, এমনকি চিৎকার করলেও গোটা শহরেই যেন তা পৌঁছে যায়। গুজবের আদর্শ স্থান এটিই উত্তম।খুব সহজে একটি শহর গুজবে গ্রাস হয় এখান থেকে। গল্পটি হরর মুভির কাহিনীর মতো লেখকের তীব্র কল্পনা শক্তিতে আঁকা। সুখপাঠ্য গল্পগ্রন্থ অমরলোকের প্রত্যাগত গ্রন্থ বহুল পাঠক নন্দিত হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *