বই আলোচনা

নিষিদ্ধশয্যাঃ ভাগ্যহত নারীর সংগ্রাম ও ঘুণে ধরা রাজনীতির আখ্যান।। মর্তুজা হাসান সৈকত

হানা ক্যাথারিন মুলেন্সের (১৮২৬-৬১) লেখা ‘ফুলমনি ও করুণার বিবরণ’ হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস। প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮) এর মধ্যে উপন্যাসের লক্ষণ দৃষ্টিগোচর হলে সাহিত্য সমালোচক মহলে আলোচনা হয় এটিও একটি উপন্যাস। তবে প্রায় সবাই একবাক্যে মেনে নিয়েছেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-৯৪) ‘দুর্গেশ নন্দিনী’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস। তিনি প্রকৃতপক্ষে আধুনিক বাংলা উপন্যাসের স্রষ্টা। তাঁর উপন্যাসে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে সমাজের নানা অসংগতি, ব্যক্তির কামনা, বাসনা, বেদনা ও দ্বন্দের প্রাসঙ্গিতা। তবে, ক্যাথারিন, প্যারীচাঁদ ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পথ ধরেই এগিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। গল্প ও উপন্যাসে তিনি ঈর্ষণীয় অবস্থানে নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন। ব্যক্তির মন ও মননের অপূর্ব সমন্বয়ে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলো অসাধারণত্ব অর্জন করেছে। যেখানে বঙ্কিমের উপন্যাসে সমাজ ও পারিপার্শ্বিক চাপে কিংবা দ্বন্দ্বে ব্যক্তি তার আত্ম অবস্থান তুলে ধরতে কিংবা সফল হতে পারেনি, কেন্দ্রীয় চরিত্র সীমাহীন দুর্ভোগ ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে, সেখানে রবীন্দ্রনাথে এসে দেখা গেল নতুন কালের নারী ও পুরুষের অন্যরকম ব্যাঞ্জনা। যারা মানবিক উৎকর্ষতার দীক্ষায় প্রচলিত সামাজিক বিধান শুধু অস্বীকার করে থেমে থাকে না, নারী-পুরুষের সমানাধিকারের ভিত্তিতে চেয়েছে আত্মপ্রতিষ্ঠা। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভাঙতে চেয়েছে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা। তাই ভাষার নিরীক্ষা, চরিত্র চিত্রণ, কাহিনি নির্মাণ, যুগের প্রতিফলন, মনোবিশ্লেষণ ইত্যাদি দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ উপন্যাস কালজয়ী।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও (১৮৭৬-১৯৩৮) একই পথে হেঁটে সমাজ- বাস্তবতার নিরীক্ষায় বাঙালির গৃহকাতরতা এবং আবহমান পারিবারিক আবেগের ওপর নির্ভর করে লিখেছেন- চরিত্রহীন, গৃহদাহ, দেবদাস, দেনা-পাওনা, শ্রীকান্ত’র মতো তুমুল জনপ্রিয় উপন্যাস। তবে, বাংলা উপন্যাসের ধারা ও প্রকৃতিতে পরিবর্তন কিংবা বিবর্তন শুরু হয় মূলত তিন বন্দ্যোপাধ্যায়- তারাশঙ্কর (১৮৯৮-১৯৭১), বিভূতিভূষণ (১৮৯৪-১৯৫০) এবং মানিক (১৯০৮-১৯৫৬) বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। আর মানিকের উপন্যাসের পাতায় পাতায় দুটি দিক স্পষ্ট হয়েছে- প্রথমত মার্কসবাদের পটভূমিতে ধনী-দরিদ্রের মধ্যকার দ্বন্দ্ব দ্বিতীয়ত ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণের আলোকে নর-নারীর জটিল সম্পর্ক। ঔপনিবেশিক শাসনের

দ্বারা জর্জরিত মানুষের জীবনের ছবি তার উপন্যাসে সমানভাবে উজ্জ্বল।

তাঁর বিখ্যাত ও কালজয়ী উপন্যাস ‘পদ্মানদীর মাঝি, পুতুল নাচের ইতিকথা’য় স্পষ্টভাবে দৃশ্যায়ন হয়েছে গ্রামীণ বাস্তবতার চিত্রায়ন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনীতে আমরা পেয়েছি আবহমান বাংলার প্রাকৃতিক মুগ্ধতা, পল্লী অঞ্চলের স্নিগ্ধ ও শান্ত রূপ, গভীর অরণ্যের দৃশ্যকল্প, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়। যে পাহাড় উপমহাদেশের মানুষের আত্মার আত্মীয়, আমাদের জীবন প্রণালীকে করে নিয়ন্ত্রণ।

এইসব মনোটোনাসের পথ ধরে ‘পথের পাঁচালী’ আমাদেরকে নিয়ে যায় সতিকারার্থে অন্য এক জগতে। মানিক ও বিভূতিভূষণের মতোই তারাশঙ্করও বেছে নিয়েছেন ভিন্ন এক পথ। যে পথে গেলেই দেখা মিলে অতীতের গৌরব আর ঐশ্বর্য হারানো জমিদার। নিম্ন অঞ্চলের নিম্ন শ্রেণির বিচিত্র পেশার সাধারণ মানুষের জীবন। অথচ, এরা আমাদের হাজার বছরের পরিচিত জন। যাদের জীবন আখ্যান এর পূর্বে কেউ গভীরভাবে তুলে ধরার প্রয়োজন অনুভব করে না। তারা হলেন চিরচেনা শ্রমিক, যাত্রাশিল্পী, মৃৎশিল্পী, বৈষ্ণবী, কবিয়াল, বেদে, সাপুড়ে, বাজিকর।

দীর্ঘ বয়ানের পথ চিনে পরবর্তীতে এদের হাত ধরে এসেছেন- জগদীশ গুপ্ত, সতীনাথ ভাদুড়ী, কমলকুমার মজুমদার, শওকত ওসমান, আবু ইসহাক, আবুল মনসুর আহমেদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, শহীদুল জহির, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, দেবেশ রায়, মহাশ্বেতা দেবী, সেলিনা হোসেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ুন আহমেদ ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। তাঁরা সবাই ঔপন্যাসিক হলেও ধারা ছিল ভিন্ন। কেউ লিখেছেন- গ্রামীণ পটভূমিকে অবলম্বন করে, কেউ লিখেছেন নগর জীবনের পটভূমিতে, আবার কেউ কেউ লিখেছেন আঞ্চলিক ও বিশেষ জীবনধারার মনস্তত্ত্ব ও দর্শনকে পুঁজি করে, কেউ ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্রের আশ্রয়ে। সেই ধারাবাহিকতায় নগর জীবনের পটভূমি কিংবা পরম্পরা অক্ষুণ্ণ রেখে কবি ও কথাসাহিত্যিক জব্বার আল নাঈম নিয়ে এসেছেন উপন্যাস ‘নিষিদ্ধশয্যা’। এ উপন্যাসে সমাজ ও বাস্তবতার নিরীক্ষায় পিছিয়ে পড়া কিংবা অবমূল্যায়িত একজন যৌনকর্মীর টিকে থাকার সংগ্রামকে যেমন তুলে এনেছেন লেখক তেমনই মিথ, ইতিহাস, ইসলামি তত্ত্ব, সমকালীন রাজনীতি এবং চলমান ঘটনাপ্রবাহকে জড়ো করে যেভাবে অসংখ্য টুকরো টুকরো গল্পকে একসাথে গেঁথেছেন তাতে আমার মনে হয়েছে- দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েই জব্বার নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে এসেছেন। তাছাড়া, মাটির পৃথিবীতে বাস করেন এমন কোনো লেখক যতই নান্দনিকতার দোহাই দিক না কেনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হলেও তারা যে রাজনীতির বৃত্ত থেকে মুক্ত হতে পারেন না জব্বার এ উপন্যাসে জোর দিয়ে জানিয়ে গেছেন সেটাও।

২.

নারীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা, সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখা ও জোর খাটিয়ে ব্যবহার করার মতো ব্যাপারগুলো সভ্য জগৎ ব্যবস্থার প্রতি কঠোর কশাঘাতস্বরূপ। তা সত্ত্বেও আমাদের এখানে রয়েছে নারীকে নিপীড়ন-নির্যাতনের এক করুণ ইতিহাস, যা দিয়ে গল্প-উপন্যাস লেখার মতো প্রচুর তথ্য-উপাত্তও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এমন একটি প্রেক্ষাপটকেই নিষিদ্ধশয্যা উপন্যাসে উপজীব্য করেছেন জব্বার। নামকরণের কারণে বইটি নিয়ে আগে থেকেই আমার বিশেষ উৎসাহ ছিল। তবে পড়তে পড়তে যুগপৎভাবে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছি। একজন যন্ত্রণাক্লিষ্ট নারীর অসহায়ত্ব আর মর্মবেদনা অনুভব করার পাশাপাশি তার বেদনায় আক্রোসে ফুঁসেও উঠেছি বহু জায়গায়। এর পাশাপাশি আলেয়ার চরিত্র অঙ্কন করতে যেয়ে পতিতাদের জীবনের চরম অমোঘ নিয়তিকে যেভাবে তুলে এনেছেন জব্বার- তাতে আমার মনে হচ্ছিল, এতো কেবল ভাগ্যের কাছেই হেরে যাওয়া!

আমাদের এখানে প্রচলিত আছে- পুরুষ লেখকদের কথায় নারীর কথা থাকলেও, নারীর একান্ত অনুভব আর অভিজ্ঞতার যা- পুরুষ লেখকরা তার বাস্তব রূপ সহজে আঁকতে পারেন না। ‘নিষিদ্ধশয্যা’ উপন্যাসটি পড়ার পর সেই ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। পুরো উপন্যাসজুড়ে লেখক একজন স্বার্থক নারী চরিত্রই নির্মাণেই প্রাধান্য দিয়েছেন। এখানে যেমন লেখক উপন্যাসের প্রধান চরিত্র স্বপ্নার মর্মবেদনা ফুটিয়ে তুলেছেন তেমনই তুলে ধরেছেন তার জীবনের নানা সংকট, সংশয় ও টানাপোড়েনও। জব্বার রাজনীতি সচেতন লেখক, রাজনীতিকে প্রত্যক্ষ করেছেন একেবারে কাছে থেকে। ফলে একজন যৌনকর্মীর জীবনের সমস্ত গ্লানি ও কষ্টকর দিকগুলো তুলে ধরতে যেয়ে সমকালীন নোংরা রাজনীতিকেও অত্যন্ত চমৎকারভাবে লেখনীর অনুষঙ্গ করে তুলেছেন। এখানে সেই সময় আর রাজনীতিকেই তুলে এনেছেন লেখক- যেখানে নারীর চলার পথ কন্টাকাকীর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে তার লেখায় সাবলীলভাবে উঠে এসেছে রাজনৈতিক দলের প্রধান সেলিম ঠাকুর, তার অনুগত এমপি আলাউদ্দিন মিজি, মখলেস চেয়ারম্যানের মতো নেগেটিভ চরিত্রগুলো। যারা তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, ক্ষমতায় যাওয়ার সিড়ি হিসেবে বিভিন্নভাবে স্বপ্নাকে ব্যবহার করেছেন বা করতে চেয়েছেন অথচ প্রয়োজন শেষে ছুড়ে ফেলতে দু’বার ভাবেন নি। সবমিলিয়ে লেখক নিষিদ্ধশয্যায় যে ঘুণে ধরা রাজনীতি তুলে ধরেছেন তা আমাদের কারো কাছে অচেনা নয়। শুধু সাহস করে বলার মতো মানুষটি অচেনা ছিল। আবার অনেকেই সাহস করে এভাবে তুলে আনেন নি, যেটা তিনি করেছেন। তাই বলে বলা যাবে না, নিষিদ্ধশয্যার চরিত্রগুলো বাস্তবতার বাইরে কিংবা কাল্পনিক। আবার চরিত্রগুলো আমাদের ছাড়িয়েও নয়। কারণ, জব্বারের লেখার প্রধান বিশেষত্বই হলো, তিনি বাস্তবজীবনের নিরেট অভিজ্ঞতালব্ধ ঘটনাগুলোকে লেখার উপাদান করে তুলতে সিদ্ধহস্ত। এমনটি আমরা আগেও দেখেছি। ফলে প্রতিটি মানব চরিত্রের ভেতর-বাহির এবং সমাজ-মনস্তত্বের সূত্র কীভাবে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে ঘিরে রয়েছে কিংবা নষ্ট রাজনীতি সময়-সমাজ-মানুষকে কীভাবে গ্রাস করছে, স্বপ্নার জীবনের অনিবার্য পরিণতিকে তুলে আনতে গিয়ে নিষিদ্ধশয্যার অন্যান্য খল চরিত্রের মাধ্যমে তারও একটা সুচারু বর্ণনা এখানে সাবলীলভাবে তুলে এনেছেন লেখক। সমাজ, বাস্তবতা, রাজনীতি, হানাহানির মাঝেও প্রেমের প্রসঙ্গ ভুলে যাননি লেখক। বরং দুই মেরুতে অবস্থান ও বয়সের একটি বড় পার্থক্য থাকলেও নারী-পুরুষের চিরন্তন ভালোবাসার প্রস্ফুটন দেখিয়েছেন নিষিদ্ধশয্যায়। যদিও প্রেমের পরিণতি পুরোপুরি খোলাসা করেন নি। এ প্রেম স্বপ্নার সাথে পুষ্পশয্যা প্রপার্টিজ এর এজেন্ট আজিজের। যে প্রেমের শুরু কিংবা পরিণতিটা অন্য আট-দশটা প্রেমের মতো নয়। যেখানে স্বপ্নার অপূর্ব রূপের চাইতেও ব্যক্তিত্বই আজিজকে আকর্ষিত করে। অর্থাৎ একজন যৌনকর্মীর প্রেম আঁকতে গিয়ে লেখক কোথাও ভোগের সামগ্রী হিসেবে তাকে উপস্থাপন করেন নি। একদম নিরেট মানবীয় প্রেমকেই তুলে ধরেছেন। যেখানে একসময় স্বপ্নাও ধীরে ধীরে নির্ভরতা বাড়াতে থাকে আজিজের প্রতি। অর্থাৎ দুই মানব-মানবীর ভেতরে চিরন্তন প্রেমকে ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে সমকালের বেশিরভাগ লেখক যে পথে হাঁটেন জব্বার সে পথে হেঁটে কেবল রূপজ মোহকেই বড় করে দেখান নি। ব্যক্তিত্বকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে মানসিক দ্বন্দের বিচিত্র বহিঃপ্রকাশ তাদের ভালোবাসাকে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলতে না পারলেও একেবারে শেষে স্বপ্নার ক্ষোভ মিশ্রিত অভিব্যক্তিতে আজিজের প্রতি তার ভালোবাসাকে পুরোপুরি স্পষ্ট করে দেয় পাঠকের সামনে।

বাংলাদেশে সরকার যৌনকর্মীদের জন্য পতিতাপল্লী অনুমোদন করলেও মৃত্যুর পর একজন পতিতার দেহকে কি করা হবে তা নিয়ে কোনো লিখিত বা অলিখিত সনদ প্রদান করেনি। ফলে কিছু ব্যতিক্রম ক্ষেত্র বাদে এখনও কোনো পতিতার মৃত্যুর পর তাকে কাফনের কাপড় পরানো কিংবা জানাযা দেওয়া হয়না। এমনকি কোনো শ্মশানেও দাহ করা হয়না। নির্জনতায় মাটি চাপা দিয়ে পুঁতে ফেলা কিংবা বস্তাবন্দী করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়াই যেন নিয়তি। অর্থাৎ বেঁচে থাকতে তারা যেই লাঞ্ছনা সহ্য করে, তারচেয়ে আরো বেশি সহ্য করে মৃত্যুর পরে। গল্পের শুরুতেই আমাদের এমন একটি প্রেক্ষাপটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন লেখক। শুরুতেই দুই ভুবনের দুইজন মানুষের কথোপকথন। একজন স্বপ্না অন্যজন তার মা। যেখান থেকে আমরা জানতে পারি, মাকে কবর দিতে না পারার আফসোস মেয়ে স্বপ্নাকে কুড়ে কুড়ে খায়।

অর্থাৎ শুরুতেই উপন্যাসের গতিপ্রবাহের একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বোঝা যায়, নিষিদ্ধশয্যা মূলত একজন নারীর জীবন সংগ্রাম আর আক্ষেপের গল্প। পড়তে পড়তে বারবার ঘোর লেগে যায়। না পাওয়ার বেদনা যেমন প্রতীয়মান হয়ে বারবার এসেছে, তেমনিভাবে অজস্রবার প্রতারিত হওয়ার আখ্যানও উপস্থাপিত হয়েছে। উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র স্বপ্না তার মায়ের সাথে একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান সেলিম ঠাকুরের অবৈধ সম্পর্কের ফসল।

৩.

পতিতাই হোক আর মহীয়সীই হোক মেয়েরা মায়ের জাত। কোনো মেয়েই চায় না দেহ বিক্রি করতে। পুরুষের ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায় তারা এ পথ বেছে নেয়।

স্বপ্নার ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা ঘটেছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে জন্মদাতা সেলিম ঠাকুরের শয্যাসঙ্গীও হতে বাধ্য হয় সে। যদিও লেখক ব্যাপারটিকে এখানে অস্পষ্ট রেখেছেন। তবে বুঝে নিতে সমস্যা হয় না। এখানেই শেষ নয়, সেলিম ঠাকুর তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ করতে এমপি আলাউদ্দিন মিজিসহ আরও অনেক রাজনৈতিক নেতাদের শয্যাসঙ্গী হতেও বাধ্য করে স্বপ্নাকে। একসময় সে গর্ভবতীও হয়। গর্ভের সন্তানকে বাঁচাতে পারে না সে। অ্যাবরশনের টেবিলে এই নিয়ে আক্ষেপ ঝড়তে শোনা যায় তার কণ্ঠে- ‘ওহে নবজাতক, আমি এখানে কেউ না। তোমার লাইসেন্স ওই আলাউদ্দিন মিজির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। ঠাকুরের মতো জন্তুর ওপর নির্ভর করছে। তাদের অবৈধ বীর্যের বাহক ছাড়া কিছুই না আমি।’ তবে একটা সময়ে এসে পতিতাবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে সমাজের বিভিন্ন অপকর্ম নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ভাইকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে চায় কৌশলে। এর পাশাপাশি জন্মদাত্রী মায়ের করুণ পরিণতির কথা ভেবে নিজের সহায় সম্বল বিক্রি করে ‘পুষ্পশয্যা প্রপার্টিজ’ নামে একটি অভিজাত কবরস্থানে নিজের শেষ আশ্রয়টা নিশ্চিত করতে চায়। কিন্তু কিছু অসৎ সমাজপিতা যারা তাদের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে তাকে শয্যাসঙ্গী করেছে, বছরের পর বছর যাদের সাথে একই ছাদের নিচে থেকেছে, সেই তাদের আপত্তি ও

প্রতিবন্ধকতায় ‘পুষ্পশয্যা প্রপার্টিজ’ এর পাশাপাশি কবরে নিজের অন্তিম শয্যা সাজাতে পারে না স্বপ্না। সেটিই হয়ে ওঠে তার জন্য নিষিদ্ধশয্যা। স্বপ্নার পাশাপাশি এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র সেলিম ঠাকুর। আগাগোড়াই রহস্যঘেরা একজন। সে হিন্দু কি মুসলমান এ নিয়ে একটা ধন্ধ স্পষ্ট। ঔরসজাত হলেও স্বপ্না এবং ইকবালকে সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায় না সে। এমনকি সম্পদের দাবিদার হয়ে ওঠা ইকবালকে খুন করতেও দু’বার ভাবে নি। স্থানীয়রা তাকে ভয় পায়। নামে মিল থাকায়, উপন্যাসটি পড়তে পড়তে কখনও কখনও খন্দকার মোশতাকের অন্যতম ঘনিষ্টজন এবং ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের অন্যতম কুশীলব তাহের ঠাকুরের সাথে তাকে মিলিয়ে ফেলছিলাম। তাহের ঠাকুরের মতো সেলিম ঠাকুরকেও আমার কাছে একইরকম রাজনৈতিক কুচক্রী বলে মনে হয়েছে।

নিষিদ্ধশয্যায় লেখক একটি গল্প বলতে যেয়ে সে গল্পের ডালপালাকে বহুদিকে বিস্তৃত করেছেন। স্বপ্নার জীবনের চরম ট্রাজেডি কিংবা নিপীড়িত নারী সমাজের প্রতি আবহমান অবিচারের ভেতরেই বইটির বিষয়বস্তুকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি তিনি, আমাদের ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থার নিন্দনীয় রূপকেও চোখে আঙুল দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। টুকরো টুকরো দৃশ্যপটকে এখানে কাহিনীর মতো করে অনর্গল বর্ণনা করে গিয়েছেন। ফলে নিষিদ্ধশয্যা উপন্যাসটি পড়তে শুরু করলে থামা যায় না। এখানে ঘটনার উপস্থাপন ও বয়নকৌশল যেমন মুগ্ধকর তেমনই ভিন্নতর।

অন্যদিকে, পুরো উপন্যাস জুড়ে লেখক বেশকিছু নীতিবাক্যের যথার্থ ব্যবহার করেছেন। এগুলোকে আমার কাছে সমাজ-রাজনীতি ও জীবন সম্পর্কে জব্বার আল নাঈম এর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফসল বলেই মনে হয়েছে। যা উপন্যাসটিকে ভিন্ন একটি আঙ্গিক বা মাত্রায় নিয়ে গেছে। ভাগ্যহত নারীদের জীবন সংগ্রাম এবং বঞ্চনা অনুভব করতে হলে এ উপন্যাসটির পাঠ জরুরি। কারণ, উপন্যাস ‘নিষিদ্ধশয্যা’ সুবিধাবাদী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিরাট চপেটাঘাত।

Love

Active

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *