বই আলোচনা

মৌতাত সমাজ বাস্তবতা ও সময়ের মনস্তত্ত্বের এক অনবদ্য চিত্রকল্প।। লতিফ আদনান

বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় গল্পকার নুসরাত সুলতানার গল্পের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় আত্মিক ও অনবদ্য। তিনি পাঠকের হৃদয়কে শব্দের ভেতরে শব্দময় করে তোলেন, ছন্দের ঝংকারে করেন ছন্দময়। জীবনের নির্মাতা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা কিন্তু সেই জীবনকে লেখক যখন কালির আঁচড়ে চিত্রিত করেন তখন তা হয়ে ওঠে আরো বৈচিত্রময়। প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি নিয়েই
জীবন, সময়ের বাঁক বদলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে যায়। কিন্তু সমালোচকের চোখ চিরকালই তীর্যক। চোরা চাহনিতে তারা সমাজ সংসারকে অবলোকন করে। নুসরাত সুলতানা তার মেধা মনন মেধা পরিশ্রম ও চেতনার তন্ত্রীতে জেগে ওঠা বোধে নির্মাণ করেছেন সমাজের বাস্তব চিত্র। গল্পের পরতে পরতে রয়েছে সমাজের করুন চিত্র। ঘটনার নাটকীয়তা মনোবিশ্লেষণ প্রত্যাশিত বা অপ্রত্যাশিত বাঁক বদল।
‘মৌতাত’ নুসরাত সুলতানার গল্প গ্রন্থ। মোট নয়টি গল্প রয়েছে গ্রন্থটিতে। প্রতিটি গল্পের ঘটনা প্রবাহ বর্ণনা ভঙ্গি আঙ্গিক বিশ্লেষণ ভিন্নধর্মী। প্রতিটি গল্প যেন ভিন্ন গড়নের অনুপম রমনী যাদের সৌন্দর্য বোধ চিত্তাকর্ষণ ভিন্নতর। তবে কারো মৌলিক দাবীকে পাঠক উপেক্ষা করতে পারে না। মুগ্ধতার চোখে চেয়ে থাকে অপলক।
প্রথম গল্প অস্তিত্বের বৃষ্টি। কাহিনী প্রেম নির্ভর। শেষ পর্যন্ত প্রেম বিচ্ছেদের করুন পরিণতিতে অবগাহন করে। গল্পের ট্রাজেডি পাঠকের ভালো লাগবে। গল্পের বর্ণনা ভঙ্গি অসাধারণ। যেমন সন্ধ্যার চোখে আবারও শ্রাবণ ধারা। কাঁদো কাঁদো হয়ে সন্ধ্যা বলতে থাকে, এজন্যই তুমি আমাকে প্রথম থেকে কাছে ঘেষতে দাওনি। আবীরের সরল স্বীকারোক্তি হ্যাঁ কিন্তু তোমার সহজ সৌন্দর্য আমাকে ডুবিয়ে দিয়েছে।
গল্পের নায়িকা সাহসিকতার সঙ্গে প্রেমিকের সামনে দাঁড়িয়েছে তাদের সম্পর্কের ফসল নিয়ে। গ্রন্থের দ্বিতীয় গল্প তৃতীয় নয়ন। রোমান্টিক প্রেমের গল্প বর্ণনা ভঙ্গি
গল্পটিকে আরো প্রাণবন্ত করেছে। যেমন, পরিশেষে ন্যাচারাল পিস্ক লিপিস্টিক পরে যখন বড় একটা কালো টিপ কপালে পরেছে, মলির নিজেকেই নিজের বার বার দেখেতে ইচ্ছে করছে। মনে মনে বলছে- এই চোখের দিকে তাকালে তুমি ডুবে না গিয়ে থাকতে পারবে
না প্রফেসর। গল্পকার প্রেমিক হৃদয়কে উদ্বেলিত করে আন্দোলিত করে অনুভূতিতে সাড়া জাগায়।
গল্পের তৃতীয় গল্প ক্রুর হাসি, প্রেমের গল্প। গল্পের নায়িকা নিবেদিতা মূলত কবি। কলেজের ইতিহাসের প্রভাষক। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। চেহারায় রুচিতে অনন্য। নায়ক প্রাঞ্জল কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ব্যাংকের আইটি কর্মকর্তা। ফেসবুকের কল্যাণে তাদের মধ্যে
যোগাযোগ। প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হয়। কথা না বলে তারা থাকতে পারে না। নদীর স্রোতের মতই সম্পর্ক মোহনার দিকে এগিয়ে যায়। শেষে আসে সাক্ষাতের পালা। ধানমন্ডির লেকে দেখা করে দুইজন। নায়ক শারীরিকভাবে খর্বাকৃতি। নিবেদিতার সঙ্গে
তার শারীরিক অসঙ্গতি কেউ মেনে নিতে পারে না। কিন্তু নিবেদিতা মেনে নেয়। ঘটনা নানা বাঁক পেরিয়ে মোহনায় উপনীত হয়। একটি দূর্ঘটনা গল্পকে আরো বেশি নাটকীয় করে তোলে। গল্পটি সুখ পাঠ্য। পরবর্তী গল্প যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে। ঘটনার প্রেক্ষাপট মহান মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধ সময়ের মর্মান্তিক চিত্র লেখকের ভাষায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে যেন। পাক বাহিনীর হত্যা, খুন, ধর্ষনের চিত্র উঠে এসেছে গল্পে। অত্যাচারির নারী গর্ভে জন্ম নেয়া যুদ্ধ শিশুদের পরবর্তী পরিণতি সমাজ বাস্তবতা। যুদ্ধের পরে প্রকৃতির নিয়মেই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে থাকে। কিন্তু যারা দেশের জন্য সবকিছু বিলিয়ে দিলো তাদের পরিণতি হয় ভয়াবহ।
লেখক আমাদের সমাজের সচেতন মানুষ। তার নিজস্ব দৃষ্টি ভঙ্গিতে বিচার বিশ্লেষণ করেন ঘটনা। শব্দের নিপুন গাথুনীতে তা করেন ছন্দময়।

গ্রন্থের সর্বশেষ গল্প আশ্রিতা। আধুনিক জীবনের করুন চিত্র অত্যন্ত দক্ষতার সাথে চিত্রিত করেছেন লেখক। নারী ও পুরুষ চরিত্রের মনোবিশ্লেষণ তার ভাষার বুননে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আদ্রিতা নামের অসহায় কোন মেয়েকে আশ্রয় দেন একটি পরিবার কিন্তু গৃহকর্তী কখনো এটাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। কিন্তু ঘটনার পরিণতিতে একটি গৃহ কর্তীকে আশ্রিত মেয়ের আশ্রয়েই বেঁচে থাকতে হয়। অতি আধুনিক সময়ে সন্তানের কাছে বাবা মায়ের ঠাঁই হয় না। গল্পটি এমনি এক পটভূমিকায় রচিত। লেখকের অন্যান্য গল্পেও উঠে এসেছে প্রেম বিরহ সমাজ বাস্তবতা। কাহিনী বর্ণনায় অভিনবত্ব রয়েছে বলেই বইটি পাঠক প্রিয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *