মস্তিষ্কের তৃতীয় মুদ্রণ: একটি প্রয়োজনে পরিবর্তনের ডাক।। শব্দনীল

সকালের চা হাতে নিয়ে কবি ও উপন্যাসিক রনি রেজার মস্তিষ্কের তৃতীয় মুদ্রণ’ গল্পগ্রন্থটি হাতে নিলাম। হালকা শুকিয়ে যাওয়া লাল খয়েরি রক্তের ছাপে ছয় সেলাইয়ের কাঁটাছেড়া বন্ধন আমাকে কৌতূহলী করে তুললো বইটি পড়ার। একই সঙ্গে গ্রন্থটির ভেতরে প্রবেশ না করলে কিছুটা অন্যায় হবে, তাও বুঝিয়ে দিলেন চিত্রকর্মের মাধ্যমে প্রচ্ছদ শিল্প মিজান স্বপন। ভিন্নধারার আটটি গল্পনিয়ে ব্যর্থ প্রেমিকের মতো সেজে উঠেছে গল্পগ্রন্থটি। এক বসায় কোনও বই পড়ার অভ্যাস না থাকায় ধীরে ধীরে বইটি পড়ে শেষ করলাম।
পড়া শেষে মনে হলো কিছু একটা লেখি তবে পর্যালোচনা নয়। কোনও গ্রন্থই আতসি কাঁচের নিচে ফেলে খুটিয়ে দেখার রোগ আমার নেই। যদিও সয়াবিন তেলে ডোবা বেগুন ভাজার মতো আমাদের দেশের বেশির ভাগ গ্রন্থ পর্যালোচনা হয় অথবা বিজ্ঞ হওয়ার ভাবে ঠাসা। আকাশ ছোঁয়া দামের কারণে তেলের কথা ভাবাই যায় না, অন্য দিকে খুব একটা না জানা মানুষ আমি। ডোবা-ঠাসার মধ্যে না গিয়ে নিজের অভিমত প্রকাশ করাই বুদ্ধিমানের কাজ ভাবলাম। জীবনের কোনও এক মুহূর্ত থেকে ছোটগল্পের পথ চলা শুরু হয় অর্থাৎ সাহিত্যিকদের মত অনুযায়ী চকিত চমকে ছোটগল্পের যাত্রা। তারই উদাহরণ, মস্তিষ্কের তৃতীয় মুদ্রণ। সাধারণ ভাবে আমি গল্পের ভেতর জীবন বোধের দর্শন, সামাজিকতা এবং প্রেম খুঁজি । কবি ও কথাসাহিত্যিক রনি রেজার পর্যবেক্ষণ, উপস্থাপনের ভিন্নতা এবং উপমার অলঙ্করণ আমাকে দারুণ ভাবে টেনেছে। তার উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করাবো আমিনুদ্দিনের ঈদ, একটি সম্মানজনক খুন এবং মরিসের গবেষণাগার থেকে। অন্যান্য গল্পগুলোও দারুণ কিন্তু আমার ভালোলাগা আগে প্রাধান্য দিবো এইটাই স্বাভাবিক। আমিউদ্দিনের ঈদ চলুন আমিনুদ্দির কাছে যাই। অজপাড়া গায়ের এক অবহেলিত দূরান্ত শৈশব। যার গাছে চড়ার গল্প সকলে জানে এবং সে বিনাস্বার্থে বড়বড় আম-জাম-কাঁঠাল-নারকেল গাছ চোখের পলকে উঠতে পারে। তার ভেতরে ভয় বলতে কোনও শব্দ নেই, কারণ তাকে বেঁধে রাখার মতো কেউ নাই। তবে তাকে নিয়ে স্বপ্ন বাঁধার মানুষ আছে। বাবা নিজের সন্তানকে ফেলে রাখলেও মিলন মিস্ত্রী রাখেনি। ধরণীতে মা ছাড়া সকলের যত্ন-আত্তিতে স্বার্থ থাকে। আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি সত্য সৎমা যে ঘরে থাকে, সে ঘরে বাবা তার নিজের সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়। কিন্তু বিনাস্বার্থের ভয়-ভীতিহীন আমিনুদ্দিকে দেখে নিজের বুদবুদ স্বপ্নের বীজ বুনতে একমিনিটও দেরি করেননি মিলন মিস্ত্রী। একটি সময় নিজের বড় মেয়েকেও আমিনুদ্দিনের হাতে তুলেদেন মিলন মিস্ত্রী। খুব সাদামাটা সামাজিক গল্প। আমরাও সামাজিক জীব। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা নিয়ে একে-অন্যের সহযোগিতা নিয়েই জীবনযাপন করি। যাপিত জীবনের এই যাত্রাটি গল্পকে আরও অলংকরণ করেছে। তার ফলে সাধারণ গল্প একটি মোড় ঘুরিয়ে ভিন্ন স্থানে চলে এসেছে। এই ভিন্ন স্থানে চলে আসার কাজটি করেন একজন শিল্পী। কবি ও কথাসাহিত্যিক রনি রেজা সেটি করেছেনও। এই গল্পের শুরুতেই কড়কড়ে নতুন টাকার মতো দর্শন এসে আমার সামনে হাজি- ‘ইট্টু জিরাইয়া নিই। মরার আগে জানডারে সাজা দিয়ার কোনো কাম নাই’।
মৃত্যুর যে আয়োজন আছে এইখানে আমি পেয়েছি। এবং যে জানে মৃত্যু সুন্দর, সে গ্রহণ করতেও প্রস্তুত থাকে। তবে এই আয়োজনের প্রস্তুতি একদিনে বা একটু সময়ের ভেতর হয় না। একে লালন করতে হয় দীর্ঘদিন ধরে। উত্থান-পতনের একটি খেলা নিয়ে আমিনুদ্দিনের জীবন চলে। যেখানে ছোট-বড়- মাঝারি ঢেউয়ের সঙ্গে পাশা উল্টে যাওয়ার ঝটকাও আছে। একজন মানুষের মৃত্যু আয়োজন কিসের জন্য হতে পারে তার চিত্রকল্পও আঁকা আছে এই গল্পে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, মৃত্যুর সময়ও বেঁচে থাকার ইচ্ছা মানুষের ভেতর জন্ম নেয়। দীর্ঘদিনের সামাজিকতার চর্চা ও পারিপার্শ্বিক ঘটনা প্রবাহের মধ্যে দিয়ে। পেয়েছি আমিনুদ্দিনের শেষ ভাবনায়- ‘তাহলে তার জানাজার নামাজ হবে কয়টায়? ঈদের নামাজের আগে, না পরে’।
এইখানে স্রষ্টাকে নির্দয় বলার যায়গা আছে। যা আমাদের জীবনের একটি অংশ। এই অংশটি রনি রেজা চাইলে এড়িয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু জীবনমুখী গল্পে এই এড়িয়ে যাওয়াটাই কাল। কারণ, কোনও রাখঢাক না রেখে শিল্পীর কাজ সত্যকে শৈল্পিক ভাবে উপস্থাপন করা। অন্যদিকে সন্তানের মধ্যে কন্যা জন্ম হওয়া একটি পাপ এবং সেই পাপের জন্য তাকে দায়ী করা হয়। এটুকুই নয়, সে যে কন্যা বা নারী তাই তাকে পুরুষ শাসিত সমাজের ইচ্ছাকেই নিজের মনে করতে হবে এবং তা বারবার বোঝানো হয় পালন করার। যদি তানা করে নিজের অভিমতকে পায়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে কেউ, তখন সে বেঁচে অধিকার হারায় সমাজ থেকে। আর এই কাজটি ঘটে প্রথমেই ঘর থেকে এবং ঘর সমাজের বাহিরে নয়। যার জন্য নিজের আপন বোনকে খুন করতে ভাইদের হাত কাঁপে না। কাঁপেনা দশমাস দশদিন পেটে লালন করা মারও। যদিও আমাদের বিবেগবোধ-মানুষিকতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে কিন্তু তা খুবই সামান্য। শহরে যারা বসবাস করছেন, তাদের ভেতর কিছুটা পরিবর্ত দেখা গেলেও জুজু হয়ে এখনও বসে আছে অন্ধকার। লোকালয়ের সন্ধ্যায়।
‘একটি সম্মানজনক খুন’ আমার কাছে মনে হয়েছে, পুরুষ শাসিত সমাজের একটি কালো অধ্যায়। যেখানে আলোর প্রবেশ করা দরকার। শুধু দরকার নয় খুবই দরকার। গল্পটি পড়ার সময় বারবার এই কথাটি মনে হচ্ছিলো। এই যে একটি চিন্তাকে নিজের ভেতর থেকে বেরকরে আনার প্রয়াস, তা কিন্তু আমার না। লেখকের। তিনি পরিবর্তন চান, তার আর একটি উদাহরণ দি, আমরা দেখি দশ-পনেরজন বা বিশজন ছাত্র নিয়ে একটি মাদ্রাসা গড়ে উঠছে এবং মানুষ তাদের যাকাত ফিতরা দিয়ে সাহায্য করছে। এইটা কিন্তু একদম নিজের ইচ্ছায় দিচ্ছে কিন্তু তা নয়, অনেক সময় বাধ্য হচ্ছে। এতে কি হচ্ছে, যে সঠিক সাহায্য পাওয়ার দাবিদার তাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এই বঞ্চিত হওয়ার খেলা কিন্তু সব খানেই আছে। ‘মস্তিস্কের তৃতীয় মুদ্রণ’ গল্পগ্রন্থের প্রতিটি কণায় প্রয়োজনে পরিবর্তনের ডাক আছে। যা আমি পেয়েছি। গন্থটির আটটি গল্প ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচের ভালোলাগা নিয়ে আমার সামনে এসেছে। ঝামেলা হচ্ছে, অল্পতে নিজের ভালোলাগাকে গুছিয়ে সকলের সামনে আনা অনুচিত মনে করি। কারণটি সাধারণ, আমি যদি সকল গোপন সূত্র সামনে আনি তাহলে অন্যান্য পাঠকরা কি করবে। এইটা একটু ভাবার বিষয়। সেই ভাবনা থেকে রনি রেজার চমক ‘মরিসের গবেষণাগার থেকে’ গল্পটির একটু কথা বলে নিজের তালগল পাকানো ভালোলাগার প্রকাশ বন্ধ করতে চাই। বর্তমান সময়ে সাইন্স ফিকশনের জনপ্রিতা হুরহুর করে বাড়ছে। একজন কথাসাহিত্যিকের বড়গুণ, নতুনকে গ্রহণ করে নিজের সৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করা। রনি রেজার এই চেষ্টাটি আমাকে ভালো ভাবে আকর্ষণ করেছে। মানব জাতির একটি রূঢ় সত্য, ‘একটি জাতি অন্য জাতিকে ধ্বংস করতে তৈরি করে যত সব মরণাস্ত্র’। অন্যদিকে আধিপত্যের জন্য গবেষণাগারে তৈরি হয় মরণ ভাইরাস। ২০১৯ থেকে ২০২১-এর সময়ে বৈশ্বিক মহামারী করোনার তাণ্ডবলীলার চিহ্ন বিশ্বের প্রতিটি পরিবারেই আছে। নিজেদের ধ্বংস করে আনন্দ উল্লাসে মাততে পারে শুধু মাত্র মানুষই। এই আনন্দ উল্লাস গেঁথে আছে ইতিহাসের পাতায়। বলা যায় রক্তে অলংকৃত হয়ে আছে। এক্ষেত্রে ‘মরিসের গবেষণাগার থেকে’ গল্পটি রূপক উদাহরণ বলা যায়। তবে আমাকে টেনেছে ভিন্নমাত্রার প্রেমের গল্প হওয়ায়।
‘নারী হৃদয় কি যত্ন ছাড়া বাঁচে?’ এই প্রশ্নটি দিয়ে বোঝা যায়, রনি রেজা সামগ্রিক অর্থে প্রশ্নটি ছুড়েছেন। তার কথা ধরে বলতে চাই, না যত্ন ছাড়া কোনও কিছুই বাঁচে না। দেখুন একটি বুনো ফুলের গাছকে প্রকৃতি কতটা মায়া দিয়ে লালন করে। আমাদের বেঁচে থাকতে হলে আমাদেরকেই যত্নবান হতে হবে।
অন্যদিকে, গল্পগ্রন্থটি সম্পর্কে যদি কেউ প্রশ্ন করে বসেন আবোলতাবোল বাদ দিয়ে এককথায় প্রকাশ করেন। তখন বলবো, ‘মস্তিস্কের তৃতীয় মুদ্রণ’ একটি প্রয়োজনে পরিবর্তনের ডাক। তবে কবি ও কথা সাহিত্যিক রনি রেজার সামর্থ অনুসারে গল্প অলংকরণে রয়েছে কিছু কিছু ফাঁক। যা পূরণ করতে তিনি বাঁধবেন আরও ভালো কিছু বাঁধ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *