আলমগীর রেজা চৌধুরীর সুষম পঙ্কুক্তির সাধুময় বিন্যাস : শ্রেষ্ঠ কবিতা ।। জোবায়ের মিলন ।।

শ্রেষ্ঠ কবিতা! আসলে শ্রেষ্ঠ বলে কি কিছু আছে? একজন কবির জীবদ্বশায় শ্রেষ্ঠ কবিতা কী করে হয়? যদি হয় তবে কি কবির মানসে সেই নীল-রমণী এসে ধরা দিলো, যে বলে গেলো- কবি তুমি ফুরিয়েছো! নাকি কবি নিজে নিজেই তৃপ্তির চকলেট চুষে বুঝে নিলেন যে, তার দ্বারা আর উত্তম কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব নয়? নাকি এ কেবল সরল পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চোখ ভুলানোরই কোনো প্রকারন্ত? জীবিত কবির ক্ষেত্রে নাম যদি শ্রেষ্ঠই রাখতে হয় তবে কেন ‘এ যাবৎ শ্রেষ্ঠ কবিতা’ নয়?

এপ্রিল ২০২১, জয়তী প্রকাশনি থেকে প্রকাশিত সত্তর দশকের চৈতন্য-চমন কবি আলমগীর রেজা চৌধুরীর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’বইটি পড়ে বইটির নামকরন নিয়ে উপর্যুক্ত প্রশ্নগুলো মনে আসলো প্রথমে। প্রশ্নের বিপরীতে যুক্তি, তর্ক, প্রতিতর্ক থাকতে পারে, থাকুক।

এবার আসা যাক কবিতায়: আলমগীর রেজা চৌধুরী কবিতায় সিদ্ধহস্ত কবি। প্রাজ্ঞ। তার কবিতার ভাষাই বলে দেয় তার নির্মাতার নাম। কবিতার দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে এসে এখন তিনি নিজ নামে প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুলসম, যেখানে পাঠ নিলে উন্মুক্ত আকাশ এসে বুকের বোতাম খুলে দরজায় দাঁড়ায় কাব্যপ্রতীমার আশীর্বাদ নিয়ে নানান স্বরে, সুরে, বিচিত্র আলপনা কল্পনার তুলিতে তুলে। এই সংকলিত কাব্যগ্রন্থটিতেও তার ব্যতিক্রম নয়। সত্তুর দশক থেকে শুরু করে আশি, নব্বুই এবং একবিংশ শতকের শূন্য, প্রথম ও দ্বিতীয় দশকের নানান সময়ে লেখা নির্বাচিত একশো ছাপ্পান্নটি কবিতা ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’নামের মলাটে কবি সন্ন্যিবেশিত করেছেন নিজের নির্বাচনী মানদন্ডে; যা পাঠে বহুগ্রন্থের ভিজ্ঞ এক কবিকে স্পষ্ট দেখা যায় এখানে সরু সিনা উঁচিয়ে উজিয়ে থাকতে। এই গ্রন্থটি আলমগীর রেজা চৌধুরীকে একমুঠোয় বুঝতে যেমন সাহায্য করবে তেমনি বিভিন্ন গ্রন্থে ছড়িয়ে থাকা মনোলোভা কিছু কবিতা এখানে গ্রন্থিত এক-ভাঁজ-ভেতরে। কবি আলমগীর রেজা চৌধুরীকে জানার জন্য বা একবসায় পাঠ করার জন্য তার পাঠকের জন্যগ্রন্থটি জরুরী। কবিতার পাঠকের জন্যও। সেই দৃষ্টিতে এটি একটি ভালো কাজ। এই গ্রন্থটির অধিকাংশ কবিতাই কাব্যপাঠের মতিচূড়ে ভরা; যেন কবি তার দীর্ঘজীবনের নদীকে দশদিক থেকে অবলোকন করে উপস্থাপন করেছেন আপন শৈলীর শব্দাংশে। কবিতাগুলোসত্যি অভিভূত করে, ঋব্ধ করে যখন পাঠ করা হয়-

‘বিরান শস্যক্ষেত, খরায় পোড়ে মাটির শরীর
গোয়ালে বলদ বাঁধা, কাতরায় কৃষকের চোখ;
এখনি বৃষ্টি নামুক, আলপথে জলের নহর
বৃষ্টি চাই, কাঁদে মানুষ, বিদীর্ণ ফসলের বুক।
আবার কখনো সখনো ভেসে যায় জলের ভেলা
একাকার গ্রাম, গঞ্জ, লোকালয়, নিকানো উঠোন;
বানভাসি মানুষ জানে প্রকৃতির দারুণ খেলা
জীবন মৃত্যুরে নিয়ে প্রতিদিন কৃষক সন্তান।
আমি তো নিজেকে চিনি
কতটা কোমল পেলবতা মিশে আছে মৃত্তিকায়, জীবন-জগৎ সংসারে,
নতুন প্রজন্ম জানে আমার স্বপ্নের বৃক্ষলতা-
প্রিয়াংকা জল দাও, জীবনের গহন শেকড়ে।
কুটিল সময়ের ফাঁদে নবীন অনার্য সন্তান,’

যুদ্ধ নয়, আরাধ্য সুন্দর চাই সমগ্র জীবন’ ( প্রিয়াংকার জন্য হৃদয়নাথ-৫)। কবিতাগুলো একে একে পড়তে থাকলে দেখা যায় নিংড়ানো বেদনা, দেখা যায় যাতনার কড়ি-কমল, দেখা যায় বিষন্ন বিকালের হাহাকার, ক্রন্দন, চিৎকার, যাপন। দেখা যায় প্রতিবাদ, ক্রোধ, ধিক্কার। দেখা যায় একটি দেশ, তার ভেতরের দশ। আলমগীর রেজা চৌধুরীরর কবিতায় পাওয়া যায় সমাজ, সংসার, জীবন, উৎযাপন; প্রচল দিনাঙ্কেও প্রচলিত অঙ্কন, ব্যতিক্রমি ভাব আর ভঙ্গি; ভাষার এক নিষ্ঠ নিয়ন; কথা আর কথালাপের বাস্তব দর্শণ।

কবি সমাজ-দর্শক। স্বচ্ছ আয়না। বিদগ্ধ বয়সের স্রোত পেরিয়ে আসা এই কবির কবিতায় তাই তো আমরা দেখতে পাই সীমাহীন এক পৃথিবীর নি:সীম মুখ। পাই কাঁটাতারহীন পাখির বসবাস। সেই বসবাসে পাই রক্ত, নদী, ঝর্ণা আর সমুদ্রের উত্তুঙ্গ নিশ্বন। তার কবিতাগুলো আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় প্রেম, বিষ, বিষাক্ত তক্ত। আমরা সে সুধা পান করে কবিকে নয়, জানতে পারি জন্মজগত ভাবের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। আর কবি যদি হয়ে ওঠে কাঞ্চনঝঙ্ঘা তবে কি আর কথা থাকে; তার কবিতা ছবি হয়ে ভাসতে থাকে সম্মুখ পর্দায়, যেন আমরাই কবি, আমরাই আঁকছি আত্মপোলব্ধির দিগন্তঅব্দি-

‘যতটুকু মনস্তাপ বুকেতে রেখেছি জলভরানত চোখে
তুমি তার সবটুকু শুষে নিও,
এই গ্রিনস্ট্রিটে আমি বড় বেশি একা
চোখে যার স্বপ্নিল জলছবি
প্রতিদিন মৌসুমি বাতাসে খুলে দেই ঘরের সমস্ত দরজা,
এই বুকের জ্বলন্ত কপাট
শঙ্কিত হয়ে শাণিত করি হৃদয় আমার।
তুমি যদি কোনোদিন ফিরে যাও
জলভরানত চোখে
তুমি তো দেখবে না
মনস্তাপে গড়েছি ভালোবাসার এপিটাফ।’(এপিটাফ)।

কবি আলমগীর রেজা চৌধুরীর এই গ্রন্থটি আমাদেরকে স্বস্তি দিয়েছে। যারা তাকে পড়তে করতে চাই, বুঝতে চাই তাদের জন্য এ গ্রন্থটি উপকারী, তাকে একসাথে পাওয়ার জন্য। পাঠে আমরা তাকে এভাবে দেখতে পাই-

‘তোমাকে দেখেই পাল্টে গেছে জীবনের জটিল নিয়ম
বুনেছি গোলাপ ঝাড়,
গোছাচ্ছি ভঙ্গুর বাসন-কোসন
বাতাসে তুড়ি মেড়ে হাঁটছি যত্রতত্র,
বাসন্তী বিকেল চোখের কোরকে গড়ে স্বপ্নের সোপান,
আহ! এইতো মধুরিমা সাতাশের উন্মুল হওয়ায়।
তুমিও কি বৈশাখী হওয়ার মতো বদলে নিলে বুকের বিষন্ন দুয়ার?’
(রূপান্তর)।

এখানেই আমরা তাকে আরও দেখতে পাই প্রেমিকের রাজবংশীর মতো আকুতি ভরা মিনতিতে, পাই প্রেমো আহব্বানের বাক্যবয়ানের আপত দৃশ্যের আড়ালে জীবন ও যাপনের কুটিল সূত্রগুলোর সহজ বর্ণনায়। অনেক ক্ষেত্রে তাকে পাই শব্দের চোরাগুপ্তার মধ্যে বিপুল বিচ্যুতির বিপরীতে প্রবল প্রতিবাদের স্বরে। সরল দেখায় যা মনে হতে পারে প্রেমের কবিতা, দেহ-মনের ভালোবাসায় বিগলিত উচ্চার কিন্তু চিন্তার কোদালে কোপ দিলে দেখা যায়, কী নিদারুণ সময়-কথা বলছেন তিনি গাম্ভির্যের বিনম্র আবরণে, যা জলের মতো টলটলে। স্বচ্ছ ও পরিস্কার।

‘এই শীতে আমাদের শেষ কথা বলবো বলে তোমাকে বিষাদের সিম্ফনিতে ডেকেছি এতদিন।
দেখো, কাঙাল ছেলেবেলায় আমাদের কোনো বসন্ত-টসন্ত ছিল না,
ব্যাকুল বন্যার মতো উথলিয়া উঠতো সময়ের বৈতরণী
সেই বুঝি সুখ ছিল, অল্পতেই ভালোবেসে ঘর বেঁধে ফেলা যেত।
এই শীতে আমাদের শেষ কথা অনন্ত
বিচ্ছেদ।’
(শীতে বিরহ কথা)।

অস্বীকার করার জো নেই যে, বুকের কাছে ধুপ ধুপ করা কবিতা, পড়তে পড়তে দাঁড়িয়ে যাওয়া কবিতা কিংবা একটি কবিতা পড়ে ভাবনায় পড়ে যাওয়া কবিতাএই সময়ে অতটা সহজ না।বলছি না, আলমগীর রেজা চৌধুরীর সব কবিতা থমকে দেওয়ার মতো বা এই গ্রন্থে গাঁথা সবগুলো কবিতা চমকে যাওয়ার মতো; তবে অনেকগুলো কবিতা গভীরতা দেখায়। বোধের বিন্যাসে চমৎকার পাড় এঁকে এঁকে এঁকেবেকে নিয়ে যায় গৌতম গাঙ্গে, যেখানে একটা ধাক্কা অনুভূত হয়। কবিতা তো এমনই, তাই না? ধার যায় না, ছোঁয়া যায় না, অনেক সময় বলা বা ব্যাখ্যাও করা যায় না কিন্তু কী যেন কি একটা ঘুরে ঘুরে অনুরণিত হয় শিরায়-উপশিরায়, ভাবনায়। ভাবায়। এই যেমন:

‘ঝুলে আছে উর্ণনাভ, পীতবর্ণ বিকেলে ছাইরঙ ফসিল।
বিবর্ণ দিগন্তরেখায় হলুদ আভা।
এখানে আকাশ নেই, বাতাসের পাখিরা ভ্রমর গুঞ্জন শেষে ঘুগিয়ে গেছে।
মধ্যদুপুরের সুনসান নীরবতা।
শুধু তুমি ঝুলে আছ
উল্টোভাবে চামচিকে সদৃশ।
আহারে মাতৃকূল, মমতাহীন পৃথিবী জুড়ে শুধু যন্ত্রণার
এপিটাফ।’ (ঝুলে আছে উর্ণনাভ)।

আমি বোদ্ধা নই, বিশ্লেষক নই, কেবল মাত্র পাঠক হিসেবে মনে করি, পাঠোপর মগজে টন করে উঠাটা বা টন করিয়ে উঠাতে পারাটা লেখকের জন্য অতিব বড় একটি বিষয়। কবি আলমগীর রেজা চৌধূরী সেটা পারেন, পেরেছেন তার কবিতার দ্বারা, কবিতার অন্তর্দর্শের ইঙ্গিত দ্বারা, কবিতার অলংকার বজিয়ে রেখে কাব্যশৈলীর সৌন্দর্য দ্বারা। যারা দীর্ঘসময় আলমগীর রেজার কবিতাকে পড়ি তাদের কাছে খুব করে বলার অবশ্য কিছু নেই। যারা এই গ্রন্থটি প্রথম পড়ব তাদের কাছে বলা, কবিতা কখনো রিংটোন না, কবিতা হলো বোধে বাইব্রেশন। আলমগীর রেজার কবিতা এই বাইব্রেশনটি অত্যন্ত সুদক্ষভাবে তুলতে পারেন বলে তার কবিতা পাঠে যেমন তৃপ্তি পাওয়া যায়, তেমনি দেখা যায় প্রবাহিত কালে জীবন ও যাপনের এক বিচিত্র ও বৈচিত্র্যময়সুষম পঙ্কুক্তির সাধুময় বিন্যাস; যা যে-কোনো পাঠককে পরিপক্ক করে; এই গ্রন্থটিওতা’ই করবে।

উত্তরাধুনিক এই সময়ে প্রকাশনাও যেহেতু শিল্প সেহেতু বলা যে, মলাট-বাইন্ডিং কিছুটা অযন্ত চোখে পড়েছে, তুলনামূলকভাবে ৩৪৫টাকা-দামটাও চড়া, দু-এক জায়গায় বানান বিভ্রাট দেখা আছে। এছাড়া গ্রন্থটি কাব্যকুলের আবশ্য পাঠযোগ্য মনে হয়েছে। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ শিল্পী শতাব্দী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *