ছন্দ-সচেতন আবেদীন জনী’র ‘মিঠেকড়া একশ ছড়া’ -আমীরুল ইসলাম
পত্রপত্রিকায় সবটা মিলিয়ে অনেক ছড়া ছাপা হয়। আমি পড়ার চেষ্টা করি নিয়মিত। ভালো লাগলে মনেও গেঁথে থাকে। এমনই একজন ছড়াকার আবেদীন জনী।
লিখছেন নব্বই দশক থেকে। পত্রপত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখে থাকেন। আমি তার অনুরাগী পাঠক। দুই দশকের অধিক কাল ধরে তিনি সক্রিয়।
হঠাৎ করেই হাতে এল ‘মিঠেকড়া একশ ছড়া’ নামের একটি ছড়ার বই। লেখক আবেদীন জনী। না, বইয়ের নামটি আকর্ষনীয় নয়। বহু ব্যবহৃত ও খুব সাধারণ নাম ‘মিঠেকড়া একশ ছড়া’। নামের মধ্যে কোনো ব্যঞ্জনা নেই। বইটি উল্টেপাল্টে ভালো লাগল। একশ ছড়ার সংকলন। বুক সাইজে ছাপা। প্রকাশক বাংলা প্রকাশ। বইটি কবিতার বইয়ের মতো। ভেতরে কোনো ইলাস্ট্রেশন নেই। পাতায় পাতায় অকারণে ছবি দিয়ে ছড়াগুলোর বিমূর্ত ভাবকে নষ্ট করা হয়নি। এক ঝলকে বইটা পড়ে শেষ করা হলো। নতুন যুগের ছড়া লেখকের নতুন চোখ দিয়ে দেখা নতুন ছড়া।
বইটা আকর্ষনীয়। ধ্রুব এষের সহজ প্রচ্ছদ। চোখ ও মন দুটোকেই আকর্ষণ করে।
আবেদীন জনী খুব সতর্ক ছড়াকার। তার বিষয়-ভাবনার মধ্যে সচেতনতা প্রকট হয়ে আছে।
খুব স্বচ্ছন্দে সে ছড়া লেখে। সরল ও খাঁটি ছড়া আছে। কবিতা ও পদ্য আকারে কিছু ছড়া আছে। লোকছড়ার ঢঙে কিছু ছড়া আছে। আর বিস্তারিত বিষয় তার ছড়াকে করেছে সমৃদ্ধ।
দেশপ্রেম, ইতিহাস-ঐতিহ্য, গ্রাম বাংলা, ঈদ, পহেলা বৈশাখ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, ভূত, ঘুড়ি, লাটাই, শিশুর পৃথিবী, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ঋতুবৈচিত্র, এসবই তার ছড়ার বৈশিষ্ট্য।
অসম্ভব ছন্দ-সচেতন এই ছড়াকার। মাত্রাবৃত্তে নানা বৈচিত্র ও স্বরবৃত্তে তার অনায়াস দক্ষতা চোখে পড়ে। ব্যাকরণিক দিক থেকে কোথাও ছন্দের গরমিল নেই। তিনি ছন্দ জেনে ছন্দের ব্যবহার করেন।
মাত্রাবৃত্তের দু-একটি উদাহরণ দেয়া যাক:
আমি তো / রোজ বিকেলে / খেলেছি খেলা
আমি তো / ঘুড়ির পিছে / ছুটেছি মেলা।
আমি তো / নৌকো-ভেলা / বেয়েছি কত
আমি তো / দিঘির জলে / নেয়েছি কত।
প্রথমে ৩ মাত্রার অতিপর্ব। পরে ৫ মাত্রার মাত্রাবৃত্তের চলন। পুরো লেখাটিতে (গাঁয়ের ছেলে) এই ধারাক্রম রক্ষিত হয়েছে।
কিংবা-
বিলেতে শাপলারা হাসিতে মাতোয়ারা
উড়িছে সাদা বক, ডানা কী ঝকমক!
(শরতের হাসি)
এই পুরো ছড়া-পদ্যটি ৩+৪ মাত্রাবৃত্তে রচিত। কোথাও মাত্রাপতন নেই। ছন্দে পটু না হলে এমন অনায়াসসিদ্ধ ছড়া লেখা কি সম্ভব?
আবেদীন জনী’র এই ছন্দ-সচেতনতা প্রমাণ করে, ছড়ার ব্যাপারে নবপ্রজন্মের ছড়াকাররা অনেক বেশি নিখুঁত ও নিটোল।
কিংবা, ৪ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত-
কুটকুট কামড়ায়
ছারপোকা চামড়ায়
তাই নাকি বাড়ি ছেড়ে
ভবঘুরে শাম রায়।
ছারপোকা সকলে
বাড়ি নিল দখলে।
(ছারপোকা বাড়ি ছাড়)
একটি নিটোল হাসির ছড়া। মাত্রাবৃত্ত ছন্দের সফল প্রয়োগ। অন্যন্য ছড়ায় প্রাধান্য পেয়েছে স্বরবৃত্ত। নানা রকম পর্ব বিন্যাসের মাধ্যমে স্বরবৃত্তের ভাঙচুর করেছেন তিনি।
ছড়া তো অনেকেই লিখে যাচ্ছেন। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের কেউ ছন্দে অতিমাত্রায় সচেতন-ব্যাপারটা ভালো লাগার মতো।
ছড়া মানেই হাস্যরস ও কৌতুকস্নিগ্ধতা। এই সনাতন ধারণা থেকেই জনী সরে এসেছেন। হাস্যরসের পাশাপাশি তিনি স্নিগ্ধ কবিতাময় ছড়াও লিখেছেন প্রচুর।
একশ ছড়ায় সবই যে খাঁটি তা দাবি করা যাবে না। হালকা চালের পদ্যও লিখেছেন। কিছু লেখায় খাঁটি কবিতার স্বাদ পাওয়া যায়। তবে আবেদীন জনী’র ‘মিঠেকড়া একশ ছড়া’ পড়তে পড়তে আবার অনুভব করলাম, ছড়া ব্যাপক অর্থে কবিতারই অংশ। ছড়ায় পদ্য থাকে। ছড়ায় কবিতা থাকে। কবিতার ভাব যদি না থাকে, তবে ছড়া প্রকৃত ছড়া হয়ে ওঠে না।
আবেদীন জনী প্রকৃত ছড়া লিখতে চান। তাকে সাধুবাদ। বাংলা ছড়ার উজ্জ্বল পৃথিবীতে আবেদীন জনীদের স্বাগতম।