বিশেষ সংখ্যা

কবিতার বরপুত্র রেজাউদ্দিন স্টালিন

রেজাউদ্দিন স্টালিন। জন্ম- ১৮-০১১৯৬১। সার্টিফিকেট নাম- শেখ রেজাউদ্দিন আহমেদ। পিতা- শেখ বোরহানউদ্দিন আহমেদ। মাতা- রেবেকা সুলতানা।জন্মস্থান- বৃহত্তর যশোর। গ্রাম- নলভাঙা। অর্থনীতিতে স্নাতক সম্মান। রাষ্টবিজ্ঞানে এম এ। নজরুল ইন্সটিটিউটের সাবেক উপ পরিচালক। কৈশরেই লেখালেখি শুরু। ১৯৭০সালে যশোর থেকে প্রকাশিত শতদল পত্রিকায় প্রথম ‘শপথ’ নামে কবিতা প্রকাশ।

মোট গ্রন্থ ১০১ কাব্যগ্রন্থ ৬৫

উল্লেখ্যোগ্য-
ফিরিনি অবাধ্য আমি
ভেঙে আনো ভেতরে অন্তরে
সেইসব ছদ্মবেশ
আঙুলের জন দ্বৈরথ
হিংস্র নৈশভোজ
ভাঙা দালানের স্বরলিপি
সবজন্মে শত্রু ছিলো যে
জ্যামিতি বাক্সের গল্প
তদন্তরিপোর্ট
অবুঝ যাদুঘর
প্রতিবিদ্যা
অস্ত্র ভাঙার মুহূর্ত

ছড়াগ্রন্থ-
হাঁটতে থাকো
শৈশব
চিরশিশু

প্রবন্ধ-নজরুলের আত্ম নৈরাত্ম
গদ্য বই- রবীন্দ্রনাথ আরোগ্য
নির্বাসিত তারুণ্য
কাঠ কয়লায় লেখা

কবিতা অনূদিত হয়েছে-

ইংরেজি, উর্দু, হিন্দী, উড়িয়া, স্প্যানিশ, গ্রিক, রোমানিয়ান, ফরাসী, জাপানি, নাইজেরিয়ান, নেপালি, সুইডিশ, জার্মান, চিনা, আজারবাইজানী, ভিয়েতনামী, পর্তুগিজ, সার্বিয়ান, রুশ, কাজাক, কোরিয়ান, তাইওয়ানীয়, ইন্দোনেশিয়ান, আলবেনীয়, বুলগেরিয়ান, পোল, ইতালীয়, আরবি, আফ্রিকান, তার্কিশ, ফার্সি, সহ ৪১টি ভাষায়।

ভিডিও সিডি১০টা। আবৃত্তি এ্যালবাম- ৬টা। প্রদীপ ঘোষের কন্ঠে আবৃত্তি এ্যালবাম-আবার একদিন বৃষ্টি হবে।

পুরস্কার-

বাংলাএকাডেমি
মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার
দার্জিলিং নাট্যচক্র পুরস্কার
ভারতের সব্যসাচী পুরস্কার
পশ্চিমবঙ্গের সেন্টার ফর স্টেজ সম্মাননা
সিটি আনন্দ আলো পুরস্কার
খুলনা রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার
ধারা সাহিত্য আসর পুরস্কার
তরঙ্গ অফ ক্যালিফোর্নিয়া সম্মাননা
লস এঞ্জেলস বাদাম সম্মাননা।
লস এঞ্জেলস রাইটার্স ক্লাব সম্মাননা
ইংল্যান্ড জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন সম্মাননা
গান্ধী শান্তি পুরস্কার, ভারত
নিকোলাই গোগোল ট্রায়াম্ফ আন্তরিক পুরস্কার সহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা।

সম্পাদিত পত্রিকা- রৌদ্রদিনখ।পদাবলি।
মঞ্চ ও টিভি উপস্থাপক।
ভ্রমণ -ভারত, নেপাল, দুবাই, আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও চীন।

মোট কাব্যগ্রন্থ -৬০ টি

ক)ফিরিনি অবাধ্য আমি- ১৯৮৬
খ) ভেঙে আনো ভেতরে অন্তরে- ১৯৮৭
গ) সেইসব ছদ্মবেশ- ১৯৮৮
ঘ) আশ্চর্য আয়নাগুলো- ১৯৮৯
ঙ) আঙুলের জন্য দ্বৈরথ- ১৯৯০
চ) ওরা আমাকে খুঁজছিলো সম্ভাবনার নিচে- ১৯৯১
ছ) পৃথিবীতে ভোর হতে দেখিনি কখনো- ১৯৯৭
জ) পদশব্দ শোনো আমার কণ্ঠস্বর- ২০০৩
ঝ) পুনরুত্থান পর্ব- ২০০৪
ঞ) অভিশ্রুত বর্তমান- ২০০৫
ট) ভাঙা দালানের স্বরলিপি- ২০০৬
ঠ) চেয়েছি আলাদা হতে- ২০১০
ড) সব জন্মে শত্রু ছিলো যে- ২০১১
ঢ) স্তব্ধতার শোকবহি- ২০১৩
ঢ়) বায়োডাটা- ২০১৪
ণ) ও প্রভু ওঁম শান্তি নেই- ২০১৫
ত) জ্যামিতি বাক্সের গল্প- ২০১৬
থ) তদন্ত রিপোর্ট- ২০১৭
দ)অবুঝ জদুঘর- ২০১৮
ধ) সরলার সংক্ষিপ্ত জীবনী- ২০১৯
ন) প্রতিবিদ্যা- ২০২০
প) অস্ত্র ভাঙার মুহূর্ত- ২০২১
ফ) ডায়োজিনিসের লণ্ঠন- ২০২২

হাঁটতে থাকো (ছড়াগ্রন্থ) -২০০৮
ক) শৈশব (ছড়াগ্রন্থ) -২০১৪
খ) জলচাষী (ছড়াগ্রন্থ) -২০১৭
গ) রবীন্দ্রনাথ আরোগ্য(প্রবন্ধ) -২০১২
ঘ) নজরুলের আত্ম-নৈরাত্ম- ২০০৯
ঙ) নির্বাসিত তারুণ্য -১৯৯৬
চ)কাঠকয়লায় লেখা -২০১৭
ছ)দিব্যচোখে দেখছি -২০১৭
জ) একুশ প্রশ্ন এক উত্তর (সাক্ষাৎকার) -২০১৩
ঝ) প্রশ্নের পুরাণ(সাক্ষাৎকার) -২০১৪
ঞ) দু:সময়ের ইউলিসিস -২০১৭
রৌদ্রদিন, স্বরবর্ণ, পদাবলী।
নৈঃশব্দের গান

গুন গুনিয়ে ওঠে হেমন্তের নৈঃশব্দ্যে
তন্ত্রীর ভেতর দিয়ে সেই স্বর কুঁকড়ে যায়
শীতের শস্যদানায়
আর গ্রীষ্মের গাণ্ডীবে ছলকে ওঠে-
অসীম গান্ধার
বর্ষার কান্নায় নিভে যায়
-কোমল ঋষভ
শরতের শাদা মেঘের তৃষ্ণায়
হয়তো ছিলো-তুমুল ধৈবত
বসন্ত এলে মনে হয়
সেই গান শুনবো
কিন্তু ক্ষুধার্ত শুকনো পাতা
উড়িয়ে নেয় মৌতাত
কে শুনবে এই গান নিজে
না অন্য কেউ
সে যদি না আসে
আর যদি সে আসে
তাতে পার্থক্য নেই কিছু
সেই গান লেখা হয়নি কোনোদিন
সুর হয়নি তার

সেই অভিশপ্ত শহর
রেজাউদ্দিন স্টালিন

সেই অভিশপ্ত শহর
মানুষ পাথর হয়ে বসে থাকে
যেখান থেকে এসেছিলো
ভুলে যায় তার নাম
যেতে পারে না গন্তব্যে
বদলে যায় তার সবকিছু অবয়ব
আর আত্মা
হাতের পাত্র থেকে পানি বিড়াল হয়ে লাফ দেয়
নিঃশ্বাস নিলে নাকের ভেতর মর্মরের কাঁটা
অস্ত্র থেকে কার্তুজ বেরিয়ে ঢুকে যায় হৃৎপিণ্ডে
একে অন্যের বিপদে হাসে আর
ছবি আঁকে
সেই অভিশপ্ত শহর কেউ কারো
ভাষা বোঝে না
অসহ্য ইশারা আর সংকেত
নারী সম্ভোগের সুরা পাত্র
শিশু বাড়তি বোঝা
মুদ্রায় দেখা দেন মহাপ্রভু
সব স্তোত্র ব্যক্তির বন্দনা
সব পথ মিনতরের গোলকধাঁধা
সব বাহনই শবাধার
পতঙ্গের চেয়ে মানুষ আগুনে ঝাঁপ দেয় বেশি
সঙ্গীতের সুরে নাগিনীর নিঃশ্বাস
রোম পুড়লেও নিরো
বাঁশি বাজায় না

পারদের পৃথিবী
রেজাউদ্দিন স্টালিন

বাজপাখির ডিমে পারদ ভরে
মুখে রাখলে মানুষ উড়তে পারে
মানুষ পাখির প্রতিদ্বন্দ্বী
তার চোখের মধ্যে দুটো বিমান
কানের ভেতর ক্ষেপণাস্ত্র
মুখের গর্ভে বারুদের বস্তা
মানুষের পছন্দ মাছের কঙ্কাল
নীলকন্ঠ পাখির পালক
মৃত বাঘের চোখ
আর অনাথ ক্ষুদিরামের ফাঁসি
ধনীদের যুদ্ধ খুব অপছন্দ
ভোগের মাত্রা কমে যায়
গরীব যুদ্ধ ভালোবাসে
যুদ্ধ ভুলিয়ে দেয় ক্ষুধা
ভবিষ্যতে বারগুলোতে মদের সাথে
পানি বিক্রি হবে পেগে
পাহাড় গলিয়ে ডিমের মামলেট হবে
গাছের রোস্ট হবে উপাদেয়
মাটির নিচের পৃথিবীতে যারা বাস করে
তাদের প্রিয় খাবার মানুষের মাংস
মানুষ পছন্দ করে পুরাতন
অপেক্ষা করে নতুনের
সুন্দরীরা বসে আছে যিশু পুনরুত্থিত
হলে তাকে বিয়ে করবে
পৃথিবীর সেটাই সবচে সুন্দর শহর
যে শহর কেউ কখনো যায়নি
সবচে সুন্দর নারীকে কেউ কখনো দেখেনি
সবচে সুন্দর কবিতা যা পড়া হয়নি
মানুষ উড়তে শিখলে আর পৃথিবীতে ফিরবে না

সমীকরণ
রেজাউদ্দিন স্টালিন

দৌঁড়ায় সে
এগোয় না একচুলও
পৌঁছায় না
লাগে না পায়ে ধুলো
পদচিহ্ন থাকে না তার পথে
জিহ্বা বুলায় শূন্যের উপর ক্ষতে
দেখা যায় না পদক্ষেপ
দাগ থাকে না- করে না ভ্রুক্ষেপ
তার আত্মবিসর্জন
রক্তনিমজ্জন
বেগের সূত্রতো স্থাণু
জড়িয়ে ধরে জানু
গোলক ধাঁধাঁর সংখ্যাটা কি আছে
তাকে খুঁজতে সে দৌড়ায়
তাকে ডাকতে সে দৌড়ায়
কিন্তু এগোয় না এক পা ও
সে পৌঁছে না কোত্থাও
তাকে শুষে নিচ্ছে ঘর
সে অন্যতে নির্ভর
সে এগোয় না এক চুলও
আংরাখা সব তুলো
সে হাঁটতে থাকে হাঁটে
ভাবে দৌড়াবে তল্লাটে
সে ছুটতে থাকে ছোটে
চোখে বিশ্বভূবন ফোটে
তার আটকে থাকে পা
সে কোত্থাও যায় না

রাতের কালো কোকিল
রেজাউদ্দিন স্টালিন

রাতের কালো কোকিল
মুখর করে তোলে বসন্তের গান
মাতাল সব মানুষের ঘুম
লরিতে চড়ে নির্বাসনে যায় ভোর
চেকপোস্ট খতিয়ে দেখে শ্বাস প্রশ্বাস
দেয়াল আর তার সাঙ্গপাঙ্গ পাথর
আরো উঁচু হয়ে ওঠে-
সূর্যের মাথা ছাড়িয়ে
রাষ্ট্র বাড়িয়ে দেয় ট্যাক্স
বিদ্যুতের বাহাদুরি
গ্যাসের গর্জন
অকটেনের খিঁচুনি
ক্ষিপ্রতা আর ঋষভ স্বর
রাতের কালো কোকিল
কাঁধে তার গিটারের মহীসোপান
যুবক যুবতী মেতে ওঠে অচেনা দীর্ঘ চুম্বনে
ঢেউ তোলে অজানা আতঙ্ক
মেঘেরা নেমে আসে মুখের কাছে
কানফাটা বজ্রের করতালি
সংবাদে সবকিছু স্বাভাবিক
সংকীর্তণ আর মহিমাকীর্তন
মৃত্যু ক্ষুধা যন্ত্রণা অনিবার্য নিয়তি
সব গ্রন্থাগারের চোখ বাঁধা
সব কারাগারের কণ্ঠ স্তব্ধ
রাতের কালো কোকিল গান গায়
পৃথিবীর সব আইল্যান্ডে
মস্কো থেকে তেহরান
চিন থেকে ভারতবর্ষ
আমেরিকা থেকে ইউক্রেন
জুরিখ থেকে জেরুজালেম
ঠোঁটে তুলে নেয় বাঁশি
নদী এসে মেশে তার সাথে
বৃক্ষ মাথা দুলিয়ে সমর্থন দেয়
আগুন নাচে শিখা ছড়িয়ে
খুলে যায় সব দেয়াল
গলে যায় পাথরঘন্টা
বাতাস অপেক্ষা করে বসন্তের
রাতের কালো কোকিল
কপালে তার নক্ষত্র
কণ্ঠে আদিম আকাশ
দিগ দিগন্ত ঝলকায় তার গানে
রাতের কালো কোকিল

জনক
রেজাউদ্দিন স্টালিন

প্রাতঃস্নান সারলো সূর্য
এরপর কর্মব্যস্ত অনেকেই
একজন নদীকে প্রণাম করে জলে নামলো
একজন স্রষ্টাকে স্মরণ করে পানিতে
মুণ্ডিত মস্তক নিমীলিত চোখ আরেকজন
একটু দূরে এলোমেলো নির্ঘুম চুল
থেঁতলে যাওয়া বিষণ্ন সিঁদুর
ঝাঁপ দিলো সূর্যের বুক চিরে জলে
রক্তাভায় ভরে উঠলো বুদ্বুদ
বিরতি চিহ্ন হাত উঁচু করে বোঝালো-
কেউ হারিয়ে যাচ্ছে মৎস্যকণ্যা
তাকে অসহ্য অঙ্গার থেকে টেনে তুলতে হবে
স্রষ্টা সহায় ভেবে যুবক ডুব দিলো হেডিসের পাতালরাজ্যে
যমুনার স্রোত অগ্রাহ্য করে ফিরিয়ে আনতে চায় তাকে
প্রতিরোধ ভেদ করে
তুলে আনলো হোরাসের নৈঃশব্দ্য
মেয়েটির ঠোঁটের দরজা দিয়ে
ছু্ঁড়ে দিলো অম্লজান
যতক্ষণ না ফিরে আসে বায়ু দেব
ততক্ষণে শোরগোলের শিখা উঠলো আকাশে
যুবককে অভিযুক্ত করলো
জনতা ধর্ষনের দায়ে
গণরোষে ছিন্নভিন্ন সকাল
তাকে বাঁচাতে এলো মুন্ডিত মস্তক বৌদ্ধভিক্ষু
এলো প্রজাপতি ব্রহ্মার সাধক
ততক্ষণে আক্রোশের কহরদরিয়া
সহস্র ফণায় গর্জে উঠেছে
যুবকের নাক থেকে বুক থেকে
পাঁজরের প্রতিটি গ্রন্থি থেকে
বেরুতে থাকলো কুরুক্ষেত্র
মৃত্যুর আগে গর্ভনাড়ির প্রতিরক্ষা ভেঙে
এফোঁড় ওফোঁড় হওয়া যুবকের আর্তস্বর-
ও আমার জননীর মতো
আমি ঠিক তার জনকের মতো

এই কবি ও তার কবিতার সঙ্গে আমার একই সঙ্গে পরিচয় ঘটে, এবং সেটা তার আত্মপ্রকাশের কালেই। সেই সময়ে আমি ‘সাহিত্যপত্র’ নামে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করি। সম্পাদনার কাজটি ছিল আনন্দদায়ক। নতুন ও পুরাতন লেখকের সঙ্গে পরিচয় ও যোগাযোগ ঘটত; সেটা ছিল এক ধরনের সামাজিকতা। ভেতরে একটা আমলাতান্ত্রিকতা যে সচল ছিল না তাই-বা কী করে বলি। লেখা আসে, বিবেচনার জন্য, অনেকটা দরখাস্তের মতো। বাতিলের, গ্রহণের, পরিমার্জনার ক্ষমতা রাখি, সেটা কম কীসে! আমলাতান্ত্রিকতা আমার পরিবেশের ভেতর ছিল, খানিকটা হয়ত আমার পিতার কাছ থেকেই পাওয়া। যিনি সরকারি কর্মচারী ছিলেন। রেজাউদ্দিন স্টালিন এসেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কামরায়, কবিতা নিয়ে। সেই সাক্ষাৎকারে আমলাতান্ত্রিকতা হয়তো নাড়াচাড়া দিয়ে উঠেছিল, যে জন্য তার নামের বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে কৌতূহল প্রকাশ করেছিলাম। স্টালিন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সপ্রতিভভাবে বলেছিল নামটি তার মায়ের দেওয়া। বুঝলাম পারিবারিক পটভূমিতে রাজনীতি-সচেতনতা রয়েছে। এরপর আমলাতন্ত্রের চৌকাঠটি পার হয়ে তার লেখায় চোখ বুলিয়েই টের পেয়েছি আমার সামনে নতুন এক কবি উপস্থিত, যে লিখবে, এবং লিখবে নিজের মতন করে। ওর কবিতা পত্রিকার পরের সংখ্যাতেই ছাপা হয়েছিল। তারপর ওই পত্রিকাতে তো বটেই, আমার সম্পাদিত অন্য পত্রিকাতেও ওর লেখা প্রকাশ করতে পেরে খুশি হয়েছি। খুশি হয়েছেন পাঠকও। সেটা আমি জানি।

ওই বয়সে অনেকেই কবিতা লিখে, কাব্যযশোপ্রার্থী হয়, কিন্তু টিকে থাকে না। রেজাউদ্দিন স্টালিন লেগে থেকেছে, এবং তার কবিতা অচিরেই পাঠকগ্রাহ্য হয়েছে। স্টালিনের কবিতার প্রথম পাঠে যে মৌলিকত্বের দেখা পেয়েছিলাম, তা আরও বিকশিত হয়েছে। আত্মপ্রকাশের কালে যে নিজস্বতা ছিল তা কখনোই মলিন হয়নি, বরং আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতায় অনুভূতি আছে। সেটা তো থাকতেই হবে, অনুভূতি ছাড়া কে কবে কবিতা লিখেছেন। কিন্তু দেখতে পাই যে ওর অনুভূতি বক্তব্য হয়ে ওঠে। বলার প্রয়োজন পড়ে না, তবু স্মরণে রাখার জন্য বলতে হয় যে বক্তব্য আর কবিতা এক নয়। বক্তব্য কবিতার রূপ নেয় যদি তাতে নান্দনিকতা থাকে তবেই। শব্দ, শব্দের অর্থ, তার ধ্বনি, অনুষঙ্গ, উৎপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপকল্প সব কিছুই জরুরি। তবে সবকিছুই আসে বক্তব্যের প্রয়োজনেই। বক্তব্যই আঙ্গিক তৈরি করে নেয়, উল্টোটা ঘটে না; তাই বলে আঙ্গিক ও বক্তব্য যে পরস্পর বিচ্ছিন্ন থাকে এমনটা মোটেই নয়, তারা অভিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য বটে, ব্যবচ্ছেদ ঘটাতে গেলে কবিতার মৃত্যু ঘটে। রেজাউদ্দিন স্টালিনের জগৎটা আমাদের পরিচিত তার সীমানাটা আমরা জানি। কিন্তু ওই সীমানাটা এই কবি মানে না। নিজের শক্তিতে তাকে সে প্রসারিত করে নেয়। এবং একই সঙ্গে গভীরতাও সৃষ্টি করে। দেখার দৃষ্টি, অনুভবের শক্তি, কল্পনার ক্ষমতা, ভাবনার বৈশিষ্ট্য এবং উপস্থাপনার অনুশীলিত দক্ষতায় পরিচিত বিষয়গুলো নতুন হয়ে ওঠে। ওর কবিতায় স্থান আছে, রয়েছে বৃষ্টিভরা আকাশ, আছে আকাশ ও পৃথিবীর জানাজানি, রয়েছে আন্তর্জাতিক বিশ্ব। সব মিলিযে একটা নিজস্ব ও ভিন্ন রকমের জগৎ। স্টালিনের কবিতা এই সঙ্গে আত্মজৈবনিক ও সর্বজনীন।

ভালো কবিতায় দু’টি উপাদান বেশ ভালোভাবে থাকে। একটি গদ্য, অপরটি নাটকীয়তা। রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতায় গদ্য আছে। তার কবিতায় শৃঙ্খলা কেবল ছন্দ ও ছন্দস্পন্দের নয়, সেই সঙ্গে যুক্তিরও। আছে নাটকীয়তাও। সকল সফল শিল্পকর্মে ওই নাটকীয়তাটা থাকে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্পষ্টভাবে। নাটকীয়তা তৈরি হয় দ্বন্দ্ব থেকে। দ্বন্দ্ব বিষয়ের সঙ্গে আঙ্গিকের, বক্তব্যের এপক্ষের সঙ্গে ওপক্ষের। স্টালিনের কবিতার প্রাণবন্ততা ও প্রবহমানতা ওই দ্বান্দ্বিক নাটকীয়তার ফলে খুব স্বাভাবিকভাবে তৈরি হয়ে যায়। আমরা আকৃষ্ট হই। অনেক সময়েই মনে হয় সে একটি গল্প বলছে, আমরা কৌতূহলী হয়ে উঠি পরিণতিটা জানার জন্য। গন্তব্যে পৌঁছে দেখি সেখানে অভিনবত্ব আছে, যেমন রয়েছে স্বাভাবিকতা। বাংলা ভাষায় ক্রিয়াপদ নিয়ে সমস্যা আছে। স্টালিনের কবিতায় ক্রিয়ার ব্যবহার স্বচ্ছ ও স্বাভাবিক। কবিতা পঙক্তিতে সবল ক্রিয়ার উপস্থিতি বক্তব্যকে সজীব করে তোলে। উপস্থাপনায় পৌরুষের পরিচয় দেখি, কোথাও কোথাও পুরুষতান্ত্রিকতার প্রকাশও অনিবার্যভাবেই ঘটেছে। বিশেষণের সতর্ক অথচ মৌলিক প্রয়োগে বিশেষ্যগুলো আকর্ষক হয়ে ওঠে। কবিতায় রূপক থাকে, থাকতেই হয়; স্টালিনের কবিতাতেও আছে। তার ব্যবহৃত রূপকগুলো আমাদেরকে ভাবিত ও উদ্বেলিত করে। দেশি-বিদেশি বহু মিথ সে ব্যবহার করেছে; সেগুলোও নতুন হয়ে উঠেছে। স্টালিন কোথাও আড়ষ্ট নয়। কিন্তু সর্বদাই অনুভব করি যে তার স্বতঃস্ফূর্ততা ও সাবলীলতার ভেতরে সংযমের অদৃশ্য বিধান কাজ করছে। তার সব কবিতাই সুখপাঠ্য, এবং একটি অপরটির মতো নয়। আবার সফল রচনাই নির্ভুলরূপে নিজস্ব। স্টালিনের আছে দেখবার ও গ্রহণ করবার ক্ষমতা। তার ঘরের দরজা জানালা খোলা, সামনে আছে উন্মুক্ত প্রান্তর, রয়েছে দেশের ও বিশ্বের ইতিহাস। তবে পথচলাটা তার নিজস্ব। একটি কবিতায়, নাম যার ‘পথের নির্বাচন’ স্টালিন নিজের পথচলার কথাটা বলেছে। তিনটি পথ ছিল সামনে, একটি স্বর্গের, অপরটি নরকের। এ দুটির কোনোটিই তার কাছে গ্রাহ্য হয়নি। উভয়কে প্রত্যাখ্যান করে তৃতীয় পথটি সে বেছে নিয়েছে। পথ তাকে বলছে :

এ পথে আপনি স্বাধীন;
আপনার সবকিছু আপনি স্বেচ্ছায় নির্বাচন করুন।
কোনো পথপ্রদর্শক নেই। আপনিই আপনার নিয়ন্তা;
এগুবার কিংবা ফেরার দায়িত্ব আপনার নিজের।

এই কবি স্বাধীন, এবং স্বনিয়ন্ত্রিত। নিয়ন্ত্রণটা শিল্পের। সে এগোয়, পথ ভোলে না, এবং অন্যদেরকে ডাকে নিজ নিজ পথ খুঁজে নেবার জন্য। গন্তব্যটা হচ্ছে সমৃদ্ধ ও সুন্দর জীবন; এই যাত্রা অভিযাত্রিক কিন্তু তাই বলে যে অনিকেত তা নয়, এবং গন্তব্যে পৌঁছার চেয়েও মূল্যবান হচ্ছে পথচলা ও পথচাওয়া, স্থির গন্তব্য যে রয়েছে এমন নিশ্চয়তাই বা কে দেবে।
রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতার অনেক কিছুই আমার ভালো লাগে, বিশেষভাবে ভালো লাগে পরাভূত হতে অসম্মতির প্রকাশ। তার এ জিনিসটা মোটেই আরোপিত নয়, এটা এসেছে একেবারে ভেতর থেকেই। সে শ্রমশীল ও আশাবাদী, সে দুঃখকে স্বীকার করে, কিন্তু হতাশ হয় না। এই দৃঢ়তা নান্দনিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তার রচনাকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে।

তার পথচলা অব্যাহত থাকুক, এটা বিশেষভাবে কামনা করি।

জন্ম মানেই সৃষ্টির অপার সম্ভাবনা। প্রত্যেক মানুষের একটি স্বপ্ন থাকে। আর জন্ম থেকেই সে স্বপ্নের শুরু। কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন মনে করেন মানুষ তাঁর স্বপ্নের চেয়ে বড়।আর সেজন্য সে বাঁচতে পারে। পৌরাণিক ফিনিক্স পাখির মতো তিনি বারবার নতুন করে তার শব্দগুলো জাদুবাস্তবতায় জীবিত করেন আবার মৃত্যুর মুখে দাঁড় করিয়ে দেন। অমানবিকতার মধ্যেই মানবিকতার গল্প তৈরি হয়। তাই বাংলাদেশের ক্যানভাসকে তিনি দীর্ঘ -আলোকিত করতে চান। ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যাহা তাহা সব সত্য নহে।’ রবীন্দ্রনাথের কবিতার এই চরণ অন্তস্থ করেন তিনি। তার কাছে ভালোবাসার, বেদনার , একাকিত্বের আলাদা রং নেই। সেজন্য সমান গুরুত্বের সঙ্গে এ বিষয়গুলো তাঁর কবিতায় স্থান পায়। ইংল্যান্ডের এক দার্শনিকের কবরে লেখা ছিল ‘আমার হৃদয় কিছু দিতে চায় কারণ আমি সমাজ থেকে অনেক পেয়েছি।’ কবি স্টালিনও সমাজকে দিতে চান।

একজন সমৃদ্ধ মানুষ শুধু তাঁর পেশার মধ্যে হারিয়ে যান না। তিনি শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, সংগীত, চিত্রকলাসহ বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন এবং সংশ্লিষ্ট থাকেন সমকালীন শিল্পচিন্তার সঙ্গে। রেজাউদ্দিন স্টালিনও কবিতার সঙ্গে প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, ছড়া সাক্ষাৎকারসহ সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় বিচরণ করেছেন। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি সাহিত্য চর্চা করছেন। মাত্র আট বছর বয়সে পত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হয়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরিনি অবাধ্য আমি’। এ পর্যন্ত কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের ৬০ টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থের নাম – “একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে”। তিনি দেশের অন্যতম জনপ্রিয় কবি। পৃথিবীর নানা ভাষায় তাঁর কবিতা অনুবাদ হয়। এভাবে বাংলা কবিতাকে তিনি বিশ্বের পাঠকের কাছে উপস্থাপনে ভূমিকা রাখছেন।

কবিতার স্বাধীনতা চিরন্তন।কবি ও কবিতার কোনো সীমানা নেই। রেজাউদ্দিন স্টালিন ও সীমানা মানেন না। নোঙরবিহীন তাঁর যাত্রা। সব ছেড়ে তিনি অসীমের পানে ছুটতে থাকেন । তাঁর অনুভব, কল্পনা ও বিষয়ের বৈচিত্র্য আছে। তাঁর কবিতায় যেমন বাংলার আকাশ, রোদ, বৃষ্টি, জোছনা আছে তেমনি বৈশ্বিক মানবতার উত্থান-পতন, ভাঙা-গড়া, আনন্দ-বেদনার গল্পও আছে। তাঁর এক একটি কবিতা যেন জীবনের এক একটি গল্প। সাধারণ বিষয়গুলো কবিতায় হয়ে ওঠে অসাধারণ। রাষ্ট্র ব্যবস্থার নানা বৈষম্য, অনাচার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা সোচ্চার। আবার সেই একই কবিতায় পরম মমতায় ধারণ করেন প্রেম, বিরহ, দুঃখ-বেদনা এবং দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা।

সাহিত্যে বিলাসিতার জায়গা নেই। এক অকল্পনীয় প্রতিভার অধিকারী হয়েও বরীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এর সাধনা করেছেন। কবি স্টালিনও নিরন্তর ভাবনা, লেখালেখি ও চর্চার মধ্যে থাকেন। অক্ষর ও শব্দের মধ্য দিয়ে জীবনকে দেখেন। যে লেখে সে সময়কে লেখে, জীবনকে লেখে, মহাকালকে লেখে এবং দিন শেষে নিজেকেই লেখে। যার শব্দ ছাপা হয় তাঁর জীবন সৃষ্টি হয়। এসবই কবি স্টালিনের অন্তরের অনুসঙ্গ কবিতায় চিত্রিত। বড় মানুষেরা সাধারণত বিনয়ী, নিরহংকার ও নির্বিবাদী হয়ে থাকেন। কবি স্টালিনের মধ্যেও এটা দেখা যায়। দেশ প্রেমের ক্ষেত্রে তিনি অনন্য। তাঁর ভাবনা দেশপ্রেম কাউকে দেখানোর বিষয় না। এটা বুকের গভীরে লালন করতে হয়। এ দেশের মানুষ চিরকাল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। এসব মানুষের কথাই তাঁর কবিতার কথা।

কেউ যদি কোনো কিছু গভীরভাবে বিশ্বাস করে তাহলে সে তা অর্জন করে।তিনি যখন বলেন-

“শুধু আমি সবকিছু ঠিক করে উঠতে অপারগ,
ঘড়িকে ঠিকমতো নাস্তা দিতে পারি না।
জুতোর দাঁত মাজতে ব্রাশ কেনা হয় না এবং
চশমার জন্য একটা ফ্লাট।
অপেক্ষা করছি
ভাবছি হয়তো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।”

তাঁর আধুনিক কাব্যচিন্তা নিরাশার মধ্যে আশাবাদের জায়গা করে দেয়। যেখানে চশমার একটা ফ্লাট দরকার।প্রতীকের এমন আশ্চর্য আয়োজন আমাদের কৌতূহল বাড়িয়ে দেয়। রেজাউদ্দিন স্টালিন সেই অনন্য কবিদের একজন যার প্রত্যেকটি কবিতা বিষয় ও প্রকরণে আলাদা।
প্রতিনিয়ত মানুষকে এই আশা হতাশার, অর্জন-বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। লালনের গানে আছে এমন মানব জীবন আর হবে না। কবি স্টালিনও মনে করেন যা করতে হবে তা এই এক জীবনেই। নিরবধি সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করেন।

তাঁর কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আছে। তিনি এমন দেশ চান না যেখানে একদল লুটেরা নদী, খালবিল, পাহাড় দখল করবে। রাজার কোষাগারে নাগরিকের জমা টাকা নিয়ে যাবে বাজিকর। টলস্টয়ের আন্না কারেনিনা উপন্যাসে আছে, ‘সব সুখী মানুষ একই রকম। কিন্তু অসুখী মানুষগুলো যার যার মতো করে আলাদা।’ তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় এই অসুখী মানুষের বেদনার ন্যারেটিভ।

রাষ্ট্র বেশির ভাগ সময় ভুলে যায় ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য’, ভুলে যায় যে একজন মানুষকে ও দুঃখ দিয়ে অপমান করা উচিত না। কবি স্টালিনও মনে করেন একজন মানুষ রাষ্ট্রনায়ক, কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক যা-ই হতে চান না কেন প্রথমেই তাঁকে ভালো মানুষ হতে হবে। এই মানুষই তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়। তিনি জানেন মানুষের শক্তিই বড় শক্তি। সব জায়গায় ভালো মানুষ আছে। অধিকাংশ মানুষই শুভত্ববাদের পক্ষে। তাদের চেষ্টায় একদিন সুন্দর বাংলাদেশ নির্মিত হবে।
এক সাধক তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন, ‘নিজের প্রদীপ নিজে হও।’ কবি স্টালিন সব সময় নিজেকেই সমৃদ্ধ করে চলেছেন। তাই নিরন্তর নিজের সঙ্গে তাঁর নিজেরেই লড়াই। প্রতিনিয়ত নিজেক ভাঙেন, গড়েন, নতুন করে নির্মাণ করেন। তিনি মনে করেন জীবনে হারানোর কিছু নেই। যেকোনো জায়গা থেকে জীবন শুরু করা যায়। বরীন্দ্রনাথের বিসর্জন কাব্যনাটকে আছে, ‘মেঘ ক্ষণিকের। এ মেঘ কাটিয়া যাইবে…, চিরদিবসের সূর্য উঠিবে আবার…।’ তিনি জানেন ভালো সময় আসবেই। তাই দুঃসময়ে পথ হারান না।

নিজেকে বিকশিত করার ভালো দিক বই পড়া ও ভ্রমণ। তিনি গ্রিক পুরাণ থেকে সাহিত্যের প্রায় সব বিষয় জানার চেষ্টা করেন। ভারত, নেপাল, চীন আমেরিকাসহ নানা দেশ ভ্রমণ করেন। তাঁর কবিতায় দেখা যায় স্বাধীন মত প্রকাশের আকাঙ্খা।
বিপন্ন মানুষের মুখ। মানবিক দর্শনের জিজ্ঞাসা।
তিনি রকৃতপক্ষে জীবনবাদী কবি। তাঁর কবিতায় রয়েছে মানব মুক্তির কথা এবং গভীরতর সমাজ বিপ্লবের সংকেত।
একজন সৃষ্টিশীল মানুষ তাঁর অপার সৃজনশীলতা শুধু একটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ করেন না। তাই কবিতা ছাড়াও কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন সাহিত্যের আরও বিষয়ে নিজেকে যুক্ত করেছেন।
এর মধ্যে রয়েছে “রবীন্দ্রনাথের আরোগ্য” নামে একটি প্রবন্ধের বই।‘ হাঁটতে থাকো’ প্রথম ছড়ার বই। আছে উপন্যাস “সম্পর্কেরা ভাঙে” । এ ছাড়াও সিলেক্টটেড পয়েমস শিরোনামে তাঁর কবিতার একটি ইংরেজি অনুবাদের বই রয়েছে। হিন্দি, উর্দু, চীনা, জাপানী, ফরাসী, রুশ ও জার্মানসহ নান ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে। আছে তিনটি সাক্ষাৎকারের বই।
২০০৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান। এ ছাড়াও তিনি মাইকেল মধুসূদন পুরস্কারসহ বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছেন। বরেণ্য এই কবি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬২ সালের ২২ নভেম্বর। রেজাউদ্দিন স্টালিন তার সময় থেকে বেরিয়ে
নতুন সময়কে আলিঙ্গন করতে উদগ্রীব।পুরাতনকে, প্রচল সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে নতুন দিন আবাহনের অগ্রদূত হতে চান।দরোজা কবিতায় স্পষ্ট করে বলেন-“আমাদের এখন বাইরে যেতে হবে,দরোজাটা ভেঙে হোক কিংবা ঘরটা।”
আমাদের এখন বাইরে যেতে হবে, অবশ্যই যেতে হবে।কবির প্রতি অভিনন্দন ও ভালোবাসা। ভালো থাকুন তিনি জীবনের প্রতিটি দিন।

আশফাকুজ্জামান
লেখক, সংগঠক ও সাংবাদিক

রেজাউদ্দিন স্টালিন এই সময়ের একজন  ব্যতিক্রমী ধারার কবি। প্রচলিত বিষয় ও আঙ্গিকের বাইরে প্রথাবিরোধী চিন্তার অনন্য সমীকরণ  তাঁর কবিতা। ভাষা ভিন্ন, চিত্রকল্প আর বাকপ্রতিমার আশ্চর্য প্রকৌশল রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে।  প্রথাবিরোধী এই পথে প্রাতিষ্ঠানিক প্রণামী কম, কিন্তু সাহিত্যের  শক্তিশালী ও সংযমী ধারা এটি। তাঁর কবিতায় আছে পুরাণের প্রাচুর্য, দার্শনিক সত্য,অসম্ভব বাস্তবতা  এবং সম্প্রসারিত বাস্তবতা। জাদুবাদের জগতে তিনি প্রবেশ করেন বাঙালির ঐতিহ্য ভাবনা নিয়ে।প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্য বিশ্বস্ত যোগাযোগ, একই সাথে তাঁর কবিতায় আছে প্রেম, বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক বোধ। তার কবিতা দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে তার যুদ্ধবিরোধী শান্তিমগ্ন উচ্চারণের জন্য। আন্তর্জাতিক পাঠকরা  অনুবাদের মাধ্যমে তার কবিতা এবং বাংলা কবিতা চেনার সুযোগ লাভ করছে। এটি সত্যিই আনন্দের। আমরা আমাদের ভাষা নিয়ে গর্বিত কিন্তু আমরা আমাদের কবিতা আন্তর্জাতিক মঞ্চে আজো সেভাবে নিতে পারি নি। রেজাউদ্দিন স্টালিন  সেই প্রয়োজনীয় কাজটি করতে চেষ্টা করছেন এবং অনেকাংশে সার্থকতা অর্জন করেছেন।

এই বিশেষ দিনে, আমরা কেবল কবি’র জন্মই উদযাপন করছি না, সেই সাথে অনেকের হৃদয় স্পর্শ করেছে এমন শব্দ এবং পংক্তিমালা গুলো উদযাপন করছি। তিনি কবিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সৌন্দর্যকে আলোকিত করেছেন। স্টিভেনসন বলেছিলেন  একজন লেখকের মোহিত করার ক্ষমতা ছাড়া বাকি সবই নিরর্থক। 
স্টালিনের কবিতার পংক্তি পাঠকদের মোহিত করে, ভাবায়,নতুন চিন্তার জন্য প্রস্তুত করেও অনুপ্রেরণা জোগায়। সান্ত্বনা এবং আনন্দের উৎস যদি কবিতা,বিরহ ও প্রেমের সারাৎসার যদি কবিতা, প্রতিবাদ ও প্রশ্নের প্রতিপাদ্য যদি কবিতা তবে আমাদের শরণ নিতে হবে রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতার এই অনিবার্য হয়ে ওঠার অপরিমেয় শক্তির নাম রেজাউদ্দিন স্টালিন। আমি বহু কবিতার আসরে যাই,দেশে বিদেশে।প্রকৃত কবিদের তালিকা প্রস্তুত হলে রেজাউদ্দিন স্টালিনের নাম থাকে সর্বাগ্রে। 

ভাবতে ভালো লাগছে কেকের মোমবাতি  প্রজ্বলনের সাথে সাথে সৃজনশীলতা এবং অনুপ্রেরণার শিখা কবির আত্মায় উজ্জ্বলভাবে জ্বলতে থাকবে। আমরা আরও অনেক সুন্দর কবিতার জন্য অপেক্ষা করছি যা কবি বিশ্বের সাথে ভাগ করবেন।কবির দুটি অমর চরণ এখানে উদ্ধৃত করি:

‘কেউ যদি দেয় বিশ্বজোড়া বাড়ি
আমিতো দেবো মাত্র দশহাত লজ্জা ঢাকা শাড়ি।'(অভয়)
কবিতাটির দায়বোধ আমাকে প্রাণিত করে।

২০২৩ সালের এই জন্মদিনটি কবির জন্য নতুন স্বপ্নের, প্রত্যয়ের প্রতিফলন হোক।এবং নতুন বছর শুরুর  মুহূর্ত হোক কবির অনন্য কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি। প্রজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টি  দিয়ে  জগতকে  ও জীবনকে দেখার প্রখরতা বাড়ুক এবং তিনি সাহিত্য জগতকে সমৃদ্ধ করতে থাকুন এবং সীমাহীন সৃজনশীলতায় ভরে উঠুক কবিডার খাতা।
কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন আপনাকে বিশ্বসাহিত্যের পীঠস্থান আমেরিকার নিউইয়র্ক থেকে অভিবাদন। দুর্দান্ত জন্মদিন এবং আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের শুভেচ্ছা জানাই!

আবদুল্লাহ জাহিদ
কবি ও প্রাবন্ধিক

কবির দেখা আর সাধারণ মানুষের দেখা কখনোই এক হয় না। সেজন্য সাধারণ মানুষের দেখায় যে উপলব্ধির জন্ম হয়, কবির দেখায় সে উপলব্ধি ভিন্নতর হয়। এভাবে যে কোনো কবির সঙ্গে অন্য যে কোনো সাধারণ মানুষের পার্থক্য রচিত হয়ে যায়। কবিতে কবিতে দেখার পার্থক্যেও বিস্তর ফারাক। কারও কারও দেখাটা নিছকই দেখাতেই সীমাবদ্ধ। কারও কারও দেখাটা পর্যবেক্ষণে পর্যবসিত, কারও কারও দেখা হৃদয়ের প্রতিফলনে বিদ্ধ, কারও কারও দেখা মস্তিষ্কের হিসাব-নিকাশে সীমাবদ্ধ।

কবি থেকে কবিতে দেখার এ পার্থক্য তাদের রচিত কবিতার মধ্যে বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়। এ দেখা বা পর্যবেক্ষণ যার যত ভিন্নতর হয়, যার যত হৃদয়গ্রাহী হয়, মনোগ্রাহী হয়, তিনি তত স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন।

রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা এ দেখা ও পর্যবেক্ষণের পার্থক্যে চিহ্নিত। কীভাবে? তা আলোচনা করার আগে তার বাল্মিকী নামক কবিতার কিছু অংশ পাঠ করা যেতে পারে-সবাই যা চেয়েছিলো/তা হইনি আমি/হয়েছি রত্নাকর বাল্মিকী/ব্যাংক ভোল্টের টাকা/ধনীদের সম্পদ/এসব আমার করতলগত/ভয়ে ভূস্বামী দিয়েছে শস্য/মজুদতার মুদ্রা/কিন্তু আমি অরণ্যের বৃক্ষে চালাইনি কুঠার/কারো হৃদয়ের হাসিতে বাধ সাধিনি/বরং পাখির চোখের পানি মুছে দিয়েছি/চিতা থেকে তুলে এনেছি কান্না/… লিখেছি শ্লোক আর লক্ষ্যভেদী অভিসম্পাত/দেবতা ও মানুষের পার্থক্য/সবাই যা চেয়েছিলো তা হইনি আমি’

বাল্মিকীর ছদ্মাবরণে তিনি আসলে নিজের কথা বলে যান। যেখানে দেখা যায় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ। দৃষ্টি আলাদা বলেই দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা পাই আমরা। সবাই যা হতে চায় তিনি তা হতে চান না। তিনি বৈষয়িকতার বিপরীতে প্রাকৃতিকতার পক্ষে কখনো কুঠার হাতে অরণ্যে বৃক্ষের বুকে আঘাত করেননি। এমনকি পাখির চোখের কান্নাও তিনি মুছে দেন।

সত্যি সবাই যা চেয়েছিল তা হননি তিনি। বাল্মিকীর সঙ্গে আত্মপ্রক্ষেপণের মাধ্যমে তিনি মূলত করে ফেলেন নিজেরই আত্মসংশ্লেষণ। যা নির্মম ও শৈল্পিক স্বীকারোক্তিও।

কবিতায় কবির আত্মসংশ্লেষণ থাকবে। সাধারণের কবিতায় তা যেরূপে শিল্পীত তা অনন্য। তা অন্য কারও কাবিতায় একইভাবে পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের কবিতায় এ উপাদান উপস্থিত থাকে অজান্তেই, আড়ালে, কখনো নিষ্ক্রিয়রূপে আবার কখনো সহজাতভাবে। কিন্তু স্টালিন এখানে তা প্রয়োগ করেছেন বা তুলে এনেছেন সচেতন শিল্পীতভাষ্যে। সুনির্দিষ্টতার মধ্য থেকে তিনি ইঙ্গিত করেছেন অনির্দিষ্টতার। দুয়ে মিলে হয়ে উঠেছে বহুল আরাধ্য কবিতার অপেন এন্ডিং এবং প্যারাডক্স। ফলে তার আপাত সুনির্দিষ্টতা যা আধুনিক কবিতায় সবচেয়ে দুর্বল উপাদান হিসাবে মনে করা হয় তার উপস্থিতি আর থাকে না। কবিতা হয়ে ওঠে বিশেষ দ্যোতনাময়, ভিন্নাথির্ক গতিসিদ্ধ এবং বারবার পাঠ্য-আকর্ষণীয়।

প্রতিগল্প নামের কবিতা নিয়ে কথা না বললে স্টালিন কবি হিসাবে কতটা শক্তিমান তা অজানাই থেকে যাবে। স্বরবৃত্তের লেখা কবিতাটি যেন বিশ-একুশ শতকের আয়না। আমরা তো গল্প নিয়ে ব্যস্ত, আপাত সরলপ্রাপ্তির আশায় উদ্বেল। কিন্তু ভেতরের গল্প সম্বন্ধে উদাসীন। এখানেই আমরা ব্যর্থ। কবি চোখে আঙুল দিয়ে প্রতিগল্পের মাধ্যমে শোনাচ্ছেন আসল গল্প। দৃশ্যমান গল্প কখনোই প্রকৃত গল্প নয়। আড়ালে থাকে আসল গল্প

ঘরের আছে একটা দেওয়াল থাক সে/জন্ম আমার বিশ শতকের বাক্সে।/…পা বাড়ালাম বাইরে যাওয়ার জন্য/ একুশ শতক বলল জীবন ধন্য।/কিন্তু আমি পিছলে পড়া বিশ্ব/ উপনিবেশ-ফন্দিতে সব নিঃস্ব/ঋণের স্রোত ভাসছে বোকার ফূর্তি/ দাদাগণ তো যিশুর প্রতিমূর্তি/দিচ্ছে সবই খাদ্য এবং বস্ত্র/শর্ত কেবল কিনতে হবে অস্ত্র।/যাক ভেসে সব দুর্যোধনের চুক্তি/কি প্রয়োজন হত্যার এ প্রযুক্তি

জন্ম বিশ শতকে হলেও একুশ শতকের একটা অংশে তার সৃষ্টিশীল জীবন চলমান। বদ্ধ জীবন পেরিয়ে এসে একুশ শতক জীবনকে ধন্য করার উপাদান নিয়ে হাজির। কী এসব? চোখ ধাঁধানো অস্ত্র, ড্রোন, মুঠোফোন ইত্যাদি। কিন্তু আড়ালে আমরা যারা তিৃতীয় বিশ্বের বাসিন্দা তারা তো সভ্যতার আভিজাত্যতা থেকে পিছলে পড়ে নিঃস্বাতিরিক্ত নিঃস্ব কেন? তার কারণ উপনিবেশিকতা। এ ঔপনিবেশিকতা এখন দৃশ্যমান না হলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে বিরাজমান। এ যে অস্ত্রের ঝনঝনানি এর মাধ্যমে একদিকে বিশ্বকে অস্থিতিশীল করা হচ্ছে অন্যদিকে খাদ্য বস্ত্র বিতরণের আড়ালে অস্ত্র বাণিজ্য চলমান। একুশ শতকের এ নির্লজ্জপনা থেকে বলা গল্পই ‘প্রতিগল্প’ কবিতাটি।

‘আমরা তো চাই শুনতে বাঁচার গল্প/চোখ ধাঁধানো লোভের যা বিকল্প’

চোখ ধাঁধানো রূপ ত্যাগ করার কথা তো তিনিই বলতে পারেন যিনি ভিন্নতর চোখ দিয়ে দেখেছেন আলো ঝলমলে পৃথিবীর ভেতরের ভয়াল অন্ধকার, ভিন্ন দৃষ্টির পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা না থাকলে কী সেটা কখনো হয়? হয় না। আমাদের সরল চোখে যা ধরা পড়ে না-তাইই তার চোখে ধরা পড়ে এজন্য। আর কবিতায় তা তুলে আনেন তিনি শিল্পীতরূপে।

রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতার স্বাতন্ত্র্য এখানেই।

এমরান কবির
কবি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *