ঈদসংখ্যার গল্প-।। যতিচিহ্নটা রয়ে গেলো।। ইসরাত জাহান
আফিম তো নেশা,
প্রেম তো আরো সর্বনাশা…
১.
বেলা তিনটা, লাঞ্চ শেষ করেছি বেশ কিছুক্ষন। কেন যেন রুমে ফিরতে ইচ্ছে করছে না। হোটেল লবির আরামদায়ক সোফায় চুপচাপ বসে থাকি। এই বিদেশ -বিভূঁইয়ে এসে মনটা হঠাৎ ঘরে ফেরার জন্য আনচান করে। এমনটা সাধারনত হয় না। চোখের দৃষ্টি অস্বচ্ছ হয়ে যাওয়ায় চশমার গ্লাসটা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে চশমাটা আবারও চোখে দিয়ে পেপারে চোখ বুলাই। মনের অস্থিরতা চোখে এসে ভর করায় পেপার পড়ায় মনোনিবেশ করতে পারি না, এরইমাঝে লিফটের দিকে চোখ দুটো চলে যায়, লিফটের দরজাটা উম্মুক্ত হতেই বেলাভুমিতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মতো আমার বুকের ভেতরে কয়েকটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে খড়খড়ে হৃদয়টাকে কাঁপিয়ে দেয়। আনন্দ ও কষ্ট বোধ কিছুক্ষনের জন্য হারিয়ে ফেলি, সদ্য কৈশোরে পা রাখা মেয়ের মতো বুকে কাপড় টেনে নেয়ার মতো নিজের মুখখানি আড়াল করার জন্য নিউজ পেপারটাকে মুখের সামনে মেলে ধরি। এভাবে পাঁচ মিনিট নিউজপেপারটা চোখের সামনে মেলে ধরে চুপচাপ বসে থাকি। পেপারটা সরাতে তার চোখে চোখ পড়ে যায়। সে যে ভ্রু-কুঁচকে এতোটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি। আমি তাকাতেই তার ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে, হাসি বিনিময় করে জিজ্ঞেস করে!
‘কেমন আছো জুঁই?’
আমি মাথা নাড়িয়ে মঙ্গলসূচক বার্তা দেয়ার চেষ্টা করি। তারপরে কিছু সময় দু’জনে নিরব হয়ে যাই, সংকোচ নামক আদতের কারনে ভেবে পাই না, কি বলবো? কি বলা উচিত? তার ভেতরেও হয়তো তাই!
পাঁচতারা হোটেলের দ্বিতীয়তলায় দীর্ঘ ও প্রশস্ত করিডোর, একপাশে সারিবাঁধা রুম, অন্যদিন কফি শপ। আমরা গিয়ে সেখানটায় বসি মুখোমুখি…
কতদিন পরে আমাদের দেখা হলো, বলতো? জিজ্ঞেস করে আমাকে।
আমি বলি, ‘প্রায় ২২ বছর’।
তোমার সাথে এখানে এইভাবে দেখা হয়ে যাবে, কখনো কল্পনা করি নাই।
(তুমি তো অনেককিছুই কল্পনা করতে পারবে না) মনে মনে কথাগুলো আওড়ে আমি বিনয়ী হাসি দেই।
দু’জনে আবারও নিরবে বসে থাকি, আমার মনে ভেতরে বয়ে যায় শীতল স্রোত। যা আমার বর্তমানকে হটিয়ে আমাকে নিয়ে যায় অতীতের বলয়ে, আমি স্থির হয়ে থাকি, স্মৃতিগুলো ঘুরে আমার বলয়ে, ওদের নিয়মে।
শুরুটা যেভাবে শুরু হয়…
গল্পটা একটু পুরনো। কিছু গল্প ও কথা থাকে যা বলতে গিয়েও বলা যায় না। এটাও সেরকম। আজ প্রবলভাবে তাড়া অনুভব করছি। এই তাড়া আসছে বুকের বাঁপাশে থেকে, ছলকে ছলকে। আমি শুনতে পাই সেই বানভাঙা স্রোতের ধ্বনি। সময়টা নব্বইয়ের দশক। পৃথিবীটা তখনও এখনকার মতো মাউসের গোল চাকতির নিচে বন্দি হয়নি।
সেই সময়টায় আমাদের নাখালপাড়ার সরু রাস্তায় রিকশার বাহুল্য ছিলো। প্রাইভেট গাড়ী, ল্যান্ড ফোন ছিলো আভিজাত্যের প্রতীক। ঢাকার রাস্তায় সোডিয়াম বাতির দাপুটেভাব, ট্র্যাফিক বাতির স্বল্পতা নিয়ে কারো কোন অভিযোগ ছিল না। সুউচ্চ অট্টালিকা দুই একটা মাথা উঁচু করে দাড়াতে শুরু করেছে মাত্র। প্রেমিক প্রমিকারা তখন প্রকাশ্যে রিকশায় ঘোরাঘুরি করার সাহস পেতো না। চুমুর স্বাদ শুধুমাত্র স্বপ্নে পাওয়া যেত। রাতে ঘুমের কোলে কাপড় নষ্টের লজ্জা শরীরে শিহরণ জাগাতো। সাদাকালো টিভির অধিপাত্য ছিলো, রঙীন টিভিটা কালভাদ্রে দেখা যেত। তাইতো ঘরের সাদাকালো টিভির মুখে ঝাঁটা দিয়ে আমি অভিদের বাসার রঙিন টিভি দেখতে যেতাম। আর মায়ের কান মলা খেতাম। তবে সেটা ছিলো গৌণকর্ম মূখ্য ছিলো তার দেখা পাওয়া।
২.
আমাদের সরু গলিটা কানা গলিতে এসে থেমে যায়, শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছটার কারনে, আর সেই গাছ নিয়েই যত বিবাদ ছিলো, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা দুই বাড়ির মাঝে , দূর থেকে বাড়ি দুটোকে দেখলে মনে হতো আলিঙ্গন করে আছে, যা দুই বাড়িতে বসবাসকারী মানুষগুলোর মাঝে প্রচন্ড অভাব ছিল। তবে নারকেল গাছের ছায়া ও ফল দুই বাড়ির লোকজন ভাগাভাগি করে নিতো। শুধু বছরের শেষ ও শুরুতে ভাগিদারদের নাম বদলাতো। আমাদের বাড়ির লোকজন বিশেষ করে আমার বড়চাচা ছিলেন এককাঠি সরস। সময় সুযোগ পেলেই ওই বাড়ির বদনাম শুরু করতেন। তিনি বেশী গর্বিত ছিলেন নিজেদের বাড়ির উচ্চতার কারনে। অভিদের বাড়িটি ছিলো দুইতলা আমাদের বাড়িটি তিনতলা, সাদৃশ্য ধরে রাখার জন্য অভির বাবা হুট করে ছাদের উপরে চিলেকোঠা বানিয়ে ফেলেন। ফলে আমাদের তিনতলা একটি জানালা ও অভিদের চিলেকোঠা জানালা মুখোমুখি এসে বসে গল্প করার জন্য। যা বড়চাচার একদম পছন্দ হয় না। সেকারনে বড় চাচা ভীষণ রেগে গিয়ে তিনতলা থেকে দোতালায় চলে আসেন আর আমরা দ্বিতীয়তলা থেকে তিনতলায় চলে যাই। অবশ্য সেজন্য আমি বেশী খুশী ছিলাম। কারন ওই চিলেকোঠায় থাকতো অভির ফুপাত ভাই তমাল, কোন এক অজানা কারনে তমাল ভাই ও ওনার মা অভিদের বাড়িতে থাকতো। আর ওখানেই জমা রয়ে গেলো কত অমীমাংসিত অধ্যায়।
৩.
আমার বাবা ও চাচা বিশ্বসংসারে একমাত্র শুয়ে বসে থাকাটাকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনে করার কারনে চাপা চালিয়ে কাটিয়ে দেন সারাটা জীবন, সাথে ছিলো দাদার অঘাত সম্পত্তি। তারপরও নিচতলায় ছিল চাচার হোমিওপ্যাথির চেম্বার, যা মাঝেমধ্যে পরিস্কার করার জন্য চাচী খুলতেন। আর আমার বাবার মুদি দোকান, যা ভাড়া দেয়া ছিলো ইদ্রিস চাচার কাছে। আমার চাচাতো বোন শ্রাবণী ও তমাল ছিলো সমবয়সী। তাই ছয় বছরের কনিষ্ঠ আমাকে ওরা দুজনে তেমন পাত্তা দিতো না, আমাকে সময় কাটাতে হতো আমার থেকে দুইবছরের ছোট অভির সাথে যাকে আমি একদম সহ্য করতে পারতাম না। আবার পরিবারের সবার ছোট হওয়ার কারনে তেমন পাত্তা পেতাম না কারো কাছে। তবে চৌদ্দতম জন্মদিনে আলাদা একটা ঘর পেয়েছিলাম হঠাৎ করে, আমার সেই ঘরটার জানালার সাথে তমালের চিলেকোঠার জানালাটার সদভাব তো সে কবে থেকে। মাঝেমাঝে পর্দাগুলো এই দর্শনের বিপত্তি ঘটাত। তবে বেশীরভাগ সময় ভাগ্যদেবীর কৃপায় পাশের বাড়ির সুদশর্ন যুবকের দেখা পেতাম। দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে তার কাপড় বদলানো, উদাস হয়ে সিগারেট খাওয়া, বই পড়া, সবকিছু দেখতাম, আমার ভালো লাগত। এই দেখাদেখি মাঝে কিভাবে যেন আমি তমালের প্রেমে পড়ে যাই। যেনতেন প্রেম না, গভীর প্রেম, একদিন না দেখলে কেমন যেন কষ্ট হতো, দমবন্ধ দমবন্ধ লাগত, দেখা পেলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। মাঝেমধ্যে তমাল কাছে যেতাম অংক করার বাহানায়। অবশ্য শ্রাবণী আপুর চোখ এড়িয়ে। কেন যেন সে আমাকে তমালের কাছ ঘেঁষতে দিতে চাইতো না।
৪.
‘জুঁই’ এই ডাকে আমার ঘোর কাটে, আমি তমালের দিকে মুখ তুলে তাকাই।
তুমিও কি এই হেলথ কনফারেন্স এসেছো? মুখের সামনে ঝুলে থাকা প্রশ্নটা ঝুলিয়ে তমাল এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়িয়ে আবারও মাথা নিচু করে বসে থাকি। বুঝতে পারি তমাল আমার নিরুৎসাহের কারনে কথা বলার উৎসাহ পায় না। তমালের মুখাবয়বে সংকোচরেখা ফুটে ওঠে। ব্যাপারটা আমাকে আনন্দ দেয়।
পাল্টা প্রশ্ন আমি ছুড়ে দেই তমালের দিকে,
তুমিও কি এই কনফারেন্সে এসেছো?
হুম, তবে অন্যদেশের প্রতিনিধি হয়ে, তোমরাই তো আমাকে দেশ ছাড়া করলে।
তমালের এই বাক্যটা আমার কানে গরম তেল ঢেলে দেয়ার মতো মনে হয়। আমি প্রতিবাদী হয়ে উত্তর দেই।
‘তোমাকে তো আমরা দেশ ছাড়তে বলি নাই তমাল,
তুমি নিজ ইচ্ছায় দেশ ছেড়েছ, কারন তুমি একজন একজন হিপোক্রেট।’
আমাকে তুমি কিভাবে এই কথাটা বললে জুঁই? আমার অন্যায়টা কি?
আজ এতো বছর পরে এসে ন্যায়-অন্যায়ের ধাঁপি খুলে বসো চাই না, প্লিজ মাফ কর তমাল। আমি উঠলাম।
কথাটা বলে আমি উঠে দাঁড়াই, নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হয় আমার, কেন লাঞ্চ শেষে রুমে ফিরলাম না! যদি লবিতে না বসতাম তাহলে তো আমার এই লোকটার সাথে এই বয়সে এসে আবারও দেখা হতো না। আমার চেয়ার ছাড়ার ওঠার সাথে সাথে তমালও উঠে দাঁড়ায়, আমার পিছু নেয় সেই কৈশোরের মতো৷ পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ধীর স্বরে আমাকে বলে।
‘জুঁই প্লিজ একটু বসো, কতদিন পরে তোমাকে দেখলাম, প্লিজ…
তমালের এই কথাটা আমাকে আবারও থামিয়ে দেয়, বুকের ভেতরে আটকে রাখা কৈশোরের সেই ছটফটে পাখিটা পাখা মেলে উড়তে চায়। সেই সুযোগে চোখভরে দেখে নেই আমার প্রথম ভালোবাসার মানুষটিকে।
৫.
আমি তখন দুই বেনী দোলানো অষ্টম শ্রেনী পড়ুয়া কিশোরী, যার সারাক্ষনই চোখ থাকতো চিলেকোঠার বসবাসকারী প্রিয় মানুষটির কর্মকান্ডের দিকে। স্কুল ছুটি হলে সোজা বাড়ি ফিরে দৌঁড়ে যেতাম নিজের ঘরের জানালাটার কাছে। এভাবে সবার চোখ এড়িয়ে আমি ডুবে যাই কর্দমাক্ত, ঘোলাটে প্রেমের পুকুরে। এই ডুবসাঁতারের লুকোচুরির মাঝে আমার দরজায় এসে কড়া নাড়ে অষ্টম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা। না চাইতে বৃষ্টির মতো অপূর্ব এক সুযোগ আসে আমার কাছে, অংক না বোঝার বাহানায় আমি ছুটে যাই তমালের কাছে প্রায় প্রতিদিন, তমাল তখন সদ্য কৈশোরের গন্ধ ঝেড়ে যুবকের বাউন্ডারিতে ঢুকে পরেছে। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বিভিন্ন জায়গায় ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বেড়াচ্ছে। ভালো ছাত্র, পাড়ায় বেশ সুনাম, যেখানে পরীক্ষা দেয় সেখানেই চান্স পায়।
একদিন সুযোগ বুঝে নিজের মনে কথাগুলো গোটা গোটা অক্ষরে লিখে বইয়ের ভেতরে লুকিয়ে নিয়ে তমালের কাছে যাই। সাহস করে হাত দিয়ে এক ছুটে চলে আসি সেই চিলেকোঠা থেকে। এরপরে নিরবতা নেমে আসে আমাদের দুপক্ষের মাঝে। চিলেকোঠার জানালায় ভারী পর্দাগুলো সারাক্ষন নামানো থাকে, আর তমাল চলে যায় চোখের আড়ালে। আমি তমালের আর কোন কর্মকান্ড দেখার সুযোগ পাই না। ওদিকে বিষন্নতা ঘিরে ফেলে আমাকে, নিজেকে নিজে বকাবকি করি নিজের বোকামির জন্য। একদিন শ্রাবণীর কাছে জানতে পারি তমাল মেডিকেল চান্স পেয়েছে তাই চলে যাবে আমাদের এলাকা ছেড়ে। আমি দূর থেকে ওর আসা দেখতাম শুধু। শুনি এতোদিন মামার বাড়িতে বড় হয়ে ওঠা তমাল ওর বাবার কাছে ফিরে যাবে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু আমার করার কিছুই থাকে না। আমাদের আর দেখা হয় না। আমি ধীরে ধীরে মন ও মেজাজ সবকিছু সামলে পড়াশোনার মাঝে আনন্দ খুঁজে পাই। অভির কাছে খবর পাই তমাল ওদের বাড়িতে আসে মাকে নিয়ে, আবার চলে যায়, এভাবে দিন গড়িয়ে ধীরে ধীরে বছরের কাছে নতজানু হয়। আমি মাধ্যমিক পরীক্ষায় অসাধারণ রেজাল্ট করে কলেজে ভর্তি হই। একদিন কলেজ থেকে ফিরে রুমের জানালার পর্দা সরাতেই দেখি চিলেকোঠার জানালার গ্রিল ধরে তমাল দাঁড়িয়ে আছে, চোখ আমার জানালার পানে। এতোদিন পরে তমালকে দেখে আমার ভেতরে সেই পোষ-মানানো পাখিটা ছটফট করে। প্রত্যাখ্যানের জবাব দেয়ার জন্য অথবা আত্মসন্মানবোধের কারনে আমি জানালার পর্দা টেনে রুম থেকে বের হয়ে আসি। তার কিছুসময় পরে অভি আসে আমার কাছে, হাতে ছোট একটা চিরকুট।
‘জুঁই, একবার আসবে, তোমার সাথে কথা ছিলো’
এতোদিনে কাঙ্ক্ষিত ডাক পেয়ে নিজেকে সামলে রাখতে পারি না, নির্লজ্জের মতো ছুটে যাই তমালের কাছে নিরব দুপুরে সবার চোখ এড়িয়ে।
দীর্ঘদিনে অদেখার কারণেই হউক বা অন্যকোন কারনেই হউক তমাল এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে, এতোটাই শক্ত করে জড়িয়ে রাখে যে আমার ভেতরের সব রাগ অভিমান নিমেষে হাওয়া হয়ে যায়,
তারপরে যা ঘটে তার জন্য আমরা দুজনের কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। দুজনেই নিজেদের ভেতরের সব নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলেছিলাম সেইক্ষনটিতে। যখন নিজেদের ভেতরের সকল রাগ ও না-বলা কথাগুলোর অবসান হয় তখন আবিষ্কার করি দুজনেই নিরাভরন, কান্ত, এলোমেলো, বিধ্বস্ত, কিন্তু মুগ্ধ ও পরিপূর্ণ। তমাল আমাকে জড়িয়ে রাখে নিজের মাঝে, ছাড়তে চায় না। দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই আমি এক ঝটকায় উঠে বসি ‘উঁহু ‘ শব্দ করে। মেঝেতে পা রেখে দাঁড়াতে পারি না তলপেটের তীব্র ব্যাথার জন্য। ব্যাথার সাথে সাথে অজানা ভয়, শংকা, ও লজ্জা আমায় ঘিরে ধরে। আমি ফিরে আসি আমার বলয়ে। তমালের কাছে নিজেস্ব কিছু অঙ্গীকার করে।
৬.
আমি বর্তমানে ফিরে আসি, হাত ঘড়িটায় তাকিয়ে দেখি বুঝতে পারি বিকেলের কনে দেখা আলোটা সন্ধ্যায় বিলীন হবে কিছুসময় পরে।
বলো কি জানতে চাও? আমি তমালকে জিজ্ঞেস করি।
তোমার কথা জানতে চাই, কেমন আছো? কি করছো?
এইতো রিসার্চ করছি, সেকারণেই এখানে আসা। আমার একটি পেপার এই কনফারেন্স সিলেক্ট হয়েছে। আগামীকাল প্রেজেন্টেশনের। তুমি কেন এখানে?
তোমার সেই পাঠ শুনতেই আমার মতো কয়জনের
এখানে আসা।
বাহ্ দুজনেই একই কনফারেন্স! বেশ কাকতালীয় ঘটনা কিন্তু।
তুমি এখানে বসেছিলে কেন?
যদি বলি তোমার অপেক্ষায়।
আমার জন্য তুমি কি আসলেই কখনো অপেক্ষা করেছিলে জুঁই? তমাল বেশ অভিমানী সুরে কথাগুলো বলে আমাকে। যদি করতে তাহলে হয়তো সবকিছু অন্যরকম হতো।
আমি তমালের অভিমানী সুরকে পাত্তা না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে কথা শুরু করি। তবে খুব জানতে ইচ্ছে করে বিয়ে করেছে কিনা, কয়টা বাচ্চা, ওর বউটা দেখতে কেমন? আমার থেকে কি বেশী সুন্দরী কিনা, তাকে নিয়ে কেমন সুখে আসে তমাল।
তুমি ইংল্যান্ডে কত বছর?
প্রায় আঠারো বছর, তুমি কি আমার পারিবারিক স্ট্যাটাস সম্পর্কে জানতে চাও?
জানতে তো চাই অনেককিছু সবকিছু কি বলবে তুমি?
সবই তো বলতে চাই…
আমি বিয়ে করি নাই, এক এয়ারহোস্টেজের সাথে লিভ টুগেদার করেছি কয়েক বছর, সে আমাকে রেখে চলে গেছে, এখন নিঃসঙ্গতাই ভালো লাগে। নিজের বিছানা ও বাথরুম কারো সাথে শেয়ার করতে পারবো না, মনে হয় কেউ এলে সে হয়তো আমার নির্জনতাটুকু খুন করবে।
মা মারা গেছেন, সেটা মনে হয় তুমি জানো। এই তো আমি, বেশ আছি, গবেষণা করছি আর পদচিহ্ন আঁকছি পৃথিবীর প্রতিটি কোনায়। তুমি কি বিয়ে করেছো?
হ্যাঁ, বিয়ে করেছি, স্বামী লোকটা বেশ ভালো, কিন্তু কেন যেন আমার সাথে বনিবনা হয়নি। দুজনে আলাদা আছি বেশ কয়েক বছর। ডিভোর্স হয়নি আমাদের।
তমাল কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে, যা আমার দৃষ্টি এড়ায় না, কিছুসময়ের নিরবতা ভেঙে তমাল বলে ওঠে, সবকিছু অন্যরকম হতে পারতো জুঁই, তোমার কারনে হলো না সেটা।
আমার কারনে মানে! তোমার কারনে সেটা হয়নি তমাল, তুমি একজন প্রতারক, তুমি আমার সাথে প্রতারনা করেছিলে, আমি দেখেছিলাম শ্রাবণীকে জড়িয়ে ধরে তুমি চুমু খাচ্ছো। তারপরও আমি কাউকে কিছু বলি নাই, সব অপবাদ নিজের ঘাড়ে নিয়ে তোমাকে পৃথিবীর শুদ্ধতম পুরুষ হবার সুযোগ দিয়েছিলাম।
তুমি আমার জন্য কিছুই করো নাই জুঁই, আমার সাথে রিলেশনে থাকা অবস্থায় তুমি অন্য একজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলে আমার অনুপস্থিতির কারনে। সেটা কি কম প্রতারনা।
সেটা তোমার ভালোর জন্য, তুমি তখন তৃতীয় বর্ষে, এতোটা চাপ ও দায়িত্ব পালন করতে পারতে না তখন, তাই।
আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে গিয়েছিলাম তমাল, তোমাকে সেটা আমি জানাইনি, জানাতে পারি নাই যোগাযোগের অপ্রতুলতার কারনে। এমনকি কাউকে কখনো বলতে পারি নাই তোমার নাম, তোমার সাথে সম্পর্কের কথা কাউকে বুঝতে দেইনি। আমার মা আমাকে সবার অগোচরে একদিন ক্লিনিকে নিয়ে যায়, আমাকে শুদ্ধ করার জন্য। তারপরে তুমি যখন ফিরে আসো তোমার মায়ের মৃত্যুর পরে মামা বাড়িতে সমবেদনার জন্য তখন আমি তোমার কাছে যেতে পারি নাই মায়ের চোখ রাঙানোর ভয়ে। মা কেমন করে যেন বুঝতে পেরেছিলেন বিষয়টা৷ তার কিছুদিন পরে দেখি শ্রাবণী সাথে তোমার লেপ্টালেপ্টি। তাই আমি নিরবে সররে যাই তোমার জীবন থেকে সবকিছুর ইতি টেনে। আর তুমি যাকে আমার নতুন রিলেশন বলেছো, সেছিল শ্রাবণীর বন্ধু। আমার কিছু না।
তমাল আমার কথাগুলো শুনে ওখান থেকে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায় , আমি ওকে আর ডাকি না, যে চলে যায় তাকে আবার নতুন করে ডেকে কি হবে। আমিও চলে আসি আমার রুমে। এতোদিনের গোপন অধ্যায় উন্মোচন করে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি, শরীরটাকে এলিয়ে দেই বিছানায়।
৭.
রাত তখন গভীর, ইন্টারকমের ফোনটা বেজে ওঠে। লাফিয়ে ওঠে ফোনটা রিসিভ করি, অপরপ্রান্ত তমাল, জেগে আছো এখনও?
না, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
আমি আসবো, তোমার রুমে, কিছু কথা ছিলো।
আসো।
কিছুক্ষনের ভেতরে কলিংবেলটা বেজে ওঠে। দরজা খুলতেই তমাল ঢুকে পড়ে রুমে। চোখ দুটো লাল, হয়তো চোখে কোন সমস্যা, আমি সেটাই ভাবতে চাই।
‘জুঁই আমার সাথে চলো, নতুন করে আবার সবকিছু শুরু করি। তোমাকে দেখে আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছি না, তোমাকে আমার দরকার।’
তমাল কথার ঝাঁপি খুলে বসে, ওর কষ্টের কথা, জীবনে সব প্রাপ্তি ও অর্জনের কথা বলে আর কাঁদে আমার হাত দুটো ধরে। আমিও আমার অসুখী দাম্পত্য-জীবন, কিশোরীকালে গর্ভপাতের কারনে সারাজীবন নিঃসন্তান রয়ে যাবার কথা, সেকারণে সবার নিগ্রহ সহ্য করে একটা জীবন কাটিয়ে দেয়ার গল্পগুলো বলি। আমরা আমাদের অদেখা সন্তানের কথা বলি, যদি পৃথিবীতে সে আসতো তাহলে কত বড় হতো! সেই অবান্তর কথাগুলো বলি আর কাঁদি দুজনে। এইমাঝে তমালের সাথে আমার শরীর আবারও মিশে যায়, অনুভব করি সেই প্রথম সঙ্গমের অনুভূতি। তমাল ওর নিবিড় আলিঙ্গনে মুছে দিতে চায় আমার এতোদিনকার জমানো সব কষ্ট ও দুঃখগুলো।
৮.
তমাল ঘুম থেকে ওঠার আগে আমি বেরিয়ে পড়ি এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। আজ আমার পেপার প্রেজেন্টেশনের কথা ছিলো, সবকিছু বাদ দিয়ে আমি পালিয়ে আসি তমালের কাছ থেকে, গতকাল রাতে তমাল সবকিছু শুধরে আবারও নতুন করে জীবন শুরু করার অঙ্গিকার করেছিলো, আমিও করেছিলাম, পরে মনে হলো নতুন করে সবকিছু শুরু করলেও আমাদের জীবনে নতুন কিছু ঘটবে না৷ দুজনে এখন মধ্যবয়সে এসে পৌঁছেছি। নতুন করে পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে আর কি হবে৷ একসাথে থাকলে দুজনার দোষ-ত্রুটিগুলো সামনে আসবে, সংসার করতে গেলে ঝগড়া হবে, নিজেদের নিকৃষ্টরূপগুলো দুজনার সামনে ধরা পড়বে। অশ্রদ্ধা, অসন্মান করবো হয়তো দুজন দুজনকে। মনে ভেতরে সব যতিচিহ্নগুলো আমাকে খোঁচাবে, আর আমাকে প্রশ্ন করবে, কেন ফিরে এসেছি? আমার হারিয়ে যাওয়া সন্তান হয়তো মন খারাপ করবে আমাদের সাথে না থাকতে পারার কারনে। তারচেয়ে এটাই ভালো তমালের সাথে মনে মনে সংসারযাপন করবো সারাজীবন আমার হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে সাথে নিয়ে।