ছোটগল্প

ঈদসংখ্যার গল্প।। দ্য আটিস্ট নমিনেশন।। শাহমুব জুয়েল

ছায়াতরু কী ঝকঝকে কিন্তু বৈশাখের নির্মম রোদে তুলোধুনো হচ্ছে মাঠ। হাপড়াচ্ছে শরীর; কৃষক দাঁড়াতে পারছে না। উরু নুয়ে পড়ছে তপ্ত মাঠে। ধাঁধাচোখে ফসলিজমির কিনারে বসে উসখুস করছে আতেক আলি। এই দৃশ্য, এই চিত্রপট -কার সৃষ্টি- তিনি কী ঈশ্বর? তিনি কী ঘুমান না? নির্ঘুম রাতে ছাউনির নিচে থাকা মানুষের নিয়ত কেবল ডাকই শোনেন- না কি শোনেনই না। বুঝ হয়ে ওঠার আগ থেকেই এই অন্তিম বিশ্বাসের দ্বিধাদ্বন্দ্ব আতেক আলির। কেউ যখন কয়, ইয়া আল্লাহ! হে ঈশ্বর! ওহ খোদা,ওহ গড! তখন আরশ থরথর করে ওঠে, মনে আগুনের ফুলকি লাগে এবং মস্তিষ্কের গলিগুলো দমাদম জ্বলে ওঠে। মায়াদূত এসে মানুষের জমাকষ্টে জল ঢালে এবং উপভোগ করে মানুষের মন ও দেহ। স্বস্তি -নিঃশ্বাস ছেড়ে পৃথিবীর দিকে পা বাড়ায় মানুষ। সৃষ্টির সেলিব্রিটি মানুষ। পথে পথে হরেক রকম মানুষের ভিড়। দিনের ছুটি শেষে গহীন অন্ধকার নামতে থাকে। আতেক আলি মনে মনে টের পায় চিরচেনা একজন আটির্স্টের। কেবলই দ্য আর্টিস্ট! তার চোখে শ্রষ্টার রূপ নানান কায়দায় ধরা দেয়। পথ- প্রান্তরের হাজার হাজার বৃক্ষপাতার নতবুক দেখে একদিন টনক নড়ে আতেক আলির, আদ্দিকালের চাপড়া ঘরের সম্মুখে হাতলওয়ালা চেয়ার পোঁতে এবং গাঁড় ঝুলিয়ে মেঘের রংমাখা ও নীলছোঁয়া আকাশের দিকে ঘনঘন চোখ ঠাপালে তার মগজের শেকড়গুলো শিরশির করে ওঠে। গাছ -গাছড়া ও আগান বাগানের দিকে তাকালে বুকটা দুরু দুরু করে। কয়েকমাস আগে খলিতাঝাড়া মেয়েটাও বাড়ি ছেড়ে গগন গগন মাইল চলে গেল। কলুর বলদের মতো সংসার টানতে টানতে এখন সে ক্লান্ত। শরীরের গোপন জায়গাগুলোতে হাত বুলাচ্ছে। পাহাড়ে জেগে ওঠা পুরোনো গাছেরগুড়ির মতো মেছতাগুলো কেমন বেশ কালছে রঙের। চোখ বন্ধ করে আদ্দিপুরুষের চাষবাসের অভাব ও স্বভাবের কথা ভাবছিল। বাড়ির বাঁদিকে হঠাৎ কান্নার শব্দ শুনে উঠে দাঁড়ায় এবং ধীরে ধীরে পথের পাশে বাড়িটির দিকে এক পা দু পা করে এগুতে থাকে।

ভরমানুষের ঘর। বাহিরে থেকে বোঝার উপায় নেই, কী হচ্ছে ঘরের ভেতর। লাল শাড়ির আঁচলে নতমুখে থাকা পুরুষের পাঞ্জাবি গিঁটানো। দীর্ঘডাক শুনলেন – মেয়ে খরিদের ব্যবস্থা চলছে। মোটা অঙ্কের হিসেব। মেয়ের বাবার প্লাট কিংবা প্লটের দিকে পুত্রশকুনের দৃষ্টি, চিলের মতো চোঁ-চোঁ করছে। ছেলেপক্ষ গত কদিনে মেয়ে দেখতে দেখতে কানাশকুনও বনে গেছে। গেরামে আর তেমন ঘরটর বাকি নেই। মেয়ে নয় মেয়ের পুরত্ব, ঘাঢ়ত্ব, শ্রীময়ী দৃষ্টি, শিক্ষা, চাকুরি, পাকাঘরের খাঁচা ও আসবাব, মাথায় এসবের দিব্বি চিন্তা,বাড়ির আরদালিতে ছেলেটার দস্তখত সাঁটানো থাকবে। কেউ ওঠার আগে তাকেও তোয়াজ করতে হবে- এসবের চাহিদা দেখাতে দেখাতে আতেক আলি দিকশুন্য হয়ে গেল – ওরে বাপরে! এসব দেখছি ভারিক্কী ব্যাপার।

কী দায়রে বাপ! কার! কার আবার কনেপক্ষের। রবীন্দ্রনাথও এই জাতীয় ঘুম ভাঙাতে পারলেন না; ব্রক্ষ্মাঠাকুরের ইসৎচেষ্টাও ভেস্তে গেল। ঘটকপাখি ভাইয়ের চাপায় বিষম জোর হিসেবটা এখন আরও চওড়া। চিন্তা নেই, চোখ উঠিয়ে আতেক আলি বললেন -ঈশ্বরের দৃষ্টি এড়ানো যায় না।

ভিড়ের মধ্যে সবায় ব্যস্ত- ছাতিফাটা কান্নায় বার বার ভেঙে পড়ছে কেবল মেয়ের মা, মায়ের মনে মায়ারোগ। মেয়েকে তুলে নেবে যে ছেলেটি, তার স্বভাব নিয়েও মনে মনে ঢর আছে। যদি ছেলেটি গাউরা টাইপের পড়ে ঠিক তাঁর স্বামীর মতো। আজীবন তাহলে পাটাপুতার ঘসায় ঘসায় মরিচের মতো তার দফাও রফা হয়ে উঠবে। চিরকার গোঙরিয়ে মরতে হবে মেয়েটিকে; মা হিসেবে দায় এড়াতে পারবে না কোনোদিন- বেতাল চিন্তা।

ঘরভর্তি মানুষের ভিড়ে বারবার মহড়া দেয় আতেক আলি – এলাহী কাণ্ড! অচেনা পুরুষের সঙ্গে মেয়েটি পা বাড়াচ্ছে- স্রেফ অচেনা। পেছন পেছন সবায় কানফোঁড়ন দিচ্ছে- ভালো হয়ে চলিও মা, কানকথা ও কানফোঁড়নে এসবে একদম কান দিবি না। হিশমার হাত টেনে ছেলেটার হাতের মুঠোয় পেরেকের মতো ঠাঁসা দেয় হিশমার বড়ো ফুফু। তারে সবায় মানে, চিকন স্বরের মানুষ, বুদ্ধি- সুদ্ধিতে পাকা এবং ঘরামি। হিশমা তার কথায় মন দিয়ে মাথা নাড়ার ফাঁকে ফাঁকে বিলাপও করছে অনেক। কান্নার ধকলে শাড়ির ভাঁজগুলো ঝড়মুখো পাড়ের মতো বারবার থুবড়ে যাচ্ছে। ছেলের সঙ্গে আসা উঠতি ছেলেগুলো এসব দেখে হাসাহাসি করছিল। আশপাশে কেউ নেই কিন্তু একটা কথা আতেক আলির কানে এলো ঈশ্বর কী তাহলে পুরুষ? চিন্তা, বড়ো চিন্তা! কি তিনি। চিন্তায় চিন্তায় গভীর রাত নেমে এল।

শেষরাতে বিছানায় গেল সে। চোখে গভীর ঘুম চোখ বন্ধ না হতেই ঘুম ভেঙে গেল- ভাঙতি ঘুম। চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানা ছেড়ে দাঁড়াল আতেক আলি। হাই তুলে বলল, রহম করো, হে প্রভু। কদিন আগেই তিলপুরে ভাড়া বাসায় ওঠে আতেক আলি। তিলপুরের নাম শুনলেই মানুষ হেসে ওঠে। তিলপুর মানে তিলনাইয়রের কথা, বৃটিশ আমলে পাড়ার এক মেয়ের গালে তিল দেখে রবার্ট হ্যারিস তিলনাইয়রের প্রেমে মজে, দুজনের বিয়েও হয়। বুড়ো হ্যারিসের ক্যান্সার ছিল, হাঁসের মাংস খেয়েছিল সে। হাঁসের মালিক শুধু বলছিল, হে আরশের মালিক!
কী দুর্ভাগা হ্যারিস! তার বডিগার্ড ছিল চীনা, লোকটি খুব কৌশলী, ঝোঁপ বুঝে কোপ মারে। বুনো হাঁসের মাংস স্বাদে ভরপুর গল্পটা তার মুখেই শোনা রবার্ট হ্যারিসের। বেদেখালে হাঁস দেখে লোভ তাড়া করে তাকে। মাংসও হজম করছিল একদিন। ওই সময়েই হ্যারিসের কণ্ঠ খ্যাসখ্যাসে হয়ে গেল। হ্যারিস বুঝতে পারল কাজটি মোটেও ঠিক হয়নি। রবার্ট হ্যারিসের মনে অনুশোচনা হচ্ছে- স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে উপাসনার খোঁজে গেল।

বাড়ি থেকে পা বাড়াতেই সম্মুখে জোর গলায় জনতার জিকিরের শব্দ শোনে। তিলনাইয়রের গোমটা টেনে বলল, হ্যারিস এটা পিরের খানকা। আসো দেখি কী চলছে। পির সাহেব রবার্ট হ্যারিসকে দেখে আওয়াজ ছোটো করে এবং বললো, কী চাস ব্যাটা! কোরআন দাও, আমাকে একখণ্ড কোরআন দেও! উপস্থিত সকলে মিলে খুব আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলো। মুখে মুখে চাউর হচ্ছে। রবার্ট হ্যারিস তাহলে মুসলিম হয়ে গেল!
রবার্ট হ্যারিস স্ত্রীকে নিয়ে সম্মুখে ছোটে, দেখতে পায় কিছু লোক হাতে গোজা জবা ফুল নিয়ে ছুটতে দেখে বললেন- আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? মন্দিরে। তাদের পিছু পিছু রওনা করলেন হ্যারিস। মন্দিরের ঘন্টা বেজে উঠছে। রবার্ট হ্যারিস ঠাকুরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললেন -গুরুজি আমাকে একখণ্ড গীতা দেও। সবিনয়ে গীতা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতেই উৎসুক জনতা তাকিয়ে কানাঘুঁষা করছে, তাহলে সে ধর্ম গ্রহণ করেছে? তিলনাইয়র হাঁটতে পারছিল না; রবার্ট হ্যারিস বললেন – সম্মুখে বটবৃক্ষ। আরেকটু পরেই দুজনে জিরিয়ে নেবো। এখন হাঁটতে থাকো। বটবৃক্ষের পাশেই বুদ্ধের আরাধনার শব্দ কানে এলো। সৃষ্টির সাধনা করছে। বুদ্ধের পাশে ভক্তের ভিড় দেখে দুজনে হাঁটু গেড়ে বসে। ভিক্ষু মাথায় হাত বাড়িয়ে বললেন-বেঁচে থাকো এবং শুদ্ধ হও।
রবার্ট হ্যারিস বললেন, গুরুজি আমাকে একখন্ড ত্রিপিটক দিন। ভিক্ষু এগিয়ে দিয়ে বলল, মেনে চলবে। রবার্ট হ্যারিস ত্রিপিটক চুমাতে চুমাতে বেরিয়ে গেল। কয়েক কদম এগিয়ে এসে নিজের কাছে থাকা বাইবেল বের করে কোমরপাশা বাজারে বাঁধাই দোকানে গেল এবং বললেন, হে দোকানি গ্রন্থগুলো একসঙ্গে বেঁধে দাও। নেড়ে দেখে দোকানি একটু বিব্রত হয়ে বলল, বাঁধাই করবো? কেন নয়। বাঁধাই হলে পুনরায় বাড়ির দিকে রওয়ানা করে দুজন। প্রতিমধ্যে রাস্তার পাশে দেখা পায় পুরোনো চীনা বন্ধুর। যার হাতে ঝকমক করছে একটি গ্লোব। সুক্ষ্ম চোখে নেড়ে নেড়ে দেখছে ভূ-খন্ডকে। তিলনাইয়রকে পাওয়ার পর চীনাবন্ধু তাকে ছেড়ে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন দেখা হয়নি দুজনের। বিশ্বব্যাপী চীনাদের রাজত্ব, তারা ব্যবসা বুৃঝে, অন্য কিছু না। ভালো করে দেখে এবং হ্যারিসকে চেনে জড়িয়ে ধরে। গ্লোব হাতে দেখেই দাবী করে রবার্ট হ্যারিস। গ্লোবটি চাই! চীনাবন্ধু হাসতে হাসতে গ্লোবটি ধরিয়ে বললেন, পয়সা দাও কয়টা চাও দিতে আমার কোনো অসুবিধে নেই।

দীর্ঘ পথ হেঁটে হেঁটে তিলনাইয়রের শরীর ভার হয়ে গেল। কিন্তু স্থিরচিন্তা হ্যারিসের। সে ভিন দেশের মানুষ, এদেশের মানুষ ও প্রকৃতিতে তার খুব কৌতুহল, সাড়ে পাঁচ কি. মি পথ হেঁটে মলাটগ্রন্থ ও গ্লোব নিয়ে বাড়িতে পা রাখলো । রবার্ট হ্যারিস বাসায় উঠতেই স্ত্রীর হাতে গ্লোবটি দিয়ে বললেন, খোয়াবে না। কথা শেষ হয়নি। রবার্ট হ্যারিস উরু গেড়ে নুয়ে পড়লেন, বুক চেপে বসলেন- প্রচন্ড ব্যথা। তাঁর দুচোখের পাতা নেমে গেল স্ত্রী চিৎকার দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন হ্যারিসকে। তার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

ক মাস ধরে তিলনাইয়র হ্যারিসের বাড়িটি দেখাশোনা করছে। একদিন চীনাবন্ধু খবর নিয়ে এলো। হাতে মোটা ফাইলপত্র, তিলনাইয়রের হাত দিয়ে বললেন-হ্যারিসের মৃত্যুর পূর্বে একখান উইল রেখে গেছে সে। হাঁসের মালিক খুঁজে পেলে হ্যারিসের অর্ধেক সম্পত্তি পাবে হাঁসমালিক। বাকি অর্ধেক থাকবে গবেষণার খাতে। তত্ত্বাবধানে থাকবে তিলনাইয়র। এহেন খবরে পরদিন থেকেই বহু তরুণ ভিড়তে থাকে। তরুণদের উৎসাহ দেখে আনন্দ পায় সে। গবেষণাগার গড়ে ওঠে হ্যারিসের বাড়ি। হ্যারিসের অপূর্ণতা ঘুছিয়ে তিলনাইয়রের নামও ক্রমে ক্রমে চারদিকে ছড়াতে লাগালো।

তিলপুরের নামডাক এখন মানুষের মুখে মুখে। আদ্দিপাড়া, দালানগুলো জরাজীর্ণ। তবে নতুন দালানের চেয়ে ধাপগুলো খুব শক্ত। আতেক আলির এপাড়াই বাস। ঘরের সম্মুখে খেলতে গিয়ে হোঁচট খায় পাশের ঘরের তানিশা। তিরতিরিয়ে চলে এলো অনন্ত। মায়াবী ছেলে সে। পরের দুঃখ দেখলে মনে আগুন ধরে ছেলেটার। সেই আগুনে পোড়ে অপরের দুঃখ এবং খাঁটি সোনা হয়ে ওঠে। তানিশার পাঁয়ের পাতাগুলো টেনে টেনে দিচ্ছিল। ঈশ্বরের কৃপায় সে সুস্থ, মুহুর্তের মধ্যে দৌড়াতেও লাগলো। অলৌকিক দৌড়!

মনে গোপন আশার ঢেউ- চেপ্টা চেপ্টা সিঁড়ি অতিক্রম করছে আতেক আলি। আবছা শব্দ পেয়েই তানিশার ঘর থেকে দৌড়ে বাবার সম্মুখে দাঁড়ায় হিশমা। বৃক্ষ ও চারাগাছের মতো দুজনের স্থিরদৃষ্টি! হিশমা বাবার গলা জড়িয়ে বলল,বাবা চাঁদের পাশে শুয়ে থাকা আমাদের ভাইটি কবে ফিরবে… আতেক আলি সিঁড়ির খোলা জানালা দিয়ে আকাশের ভরা মেঘ দেখে নেয়। কোথাও রোদের দেখা নেই, মেঘে ঢাকা আকাশ। মাঝে মাঝে নীলের খেলা, আকাশে সাদা কালো ও নীলরঙের খেলা। নীলচাষীদের দুঃখগাঁথা দিনলিপির কথা মনে পড়ে আতেক আলির। হিশমা এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। সন্তানের গন্ধ, নাকের ডগায় করতালি দিতে থাকে, পাশফিরে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে এবং মাঝকপালে চুমু খেতে খেতে বলল, মামনি নীল জামায় তোমাকে খুব মানাচ্ছে। সব বাবা মায়েরাই সন্তানের আটিস্ট, জন্ম আর্টিস্ট, বেড়ে তোলার আটিস্ট, মেনার্স আর্টিস্ট, মেয়েকে কোন পোশাক দারুণ লাগবে সব বাবা মার একান্ত জানা কথা। আতেক আলিও বিপরীত নয়। হিশমাকে জড়ানো মূহুর্তে আতেক আলির চোখে এক ফোটা জল দেখে হিশমা বাবাকে ছেড়ে দেয়। একসমুদ্র স্নেহ মুহূর্তেই কষ্টভরা সমুদ্রের টেউয়ের মিইয়ে গেল। বাবাকে ছেড়ে ঘরের দিকে ফিরে গেল হিশমা। মেয়ের মন ভীষণ খারাপ! বাবার দুঃখ বেড়ে গেল।

বিয়ের পূর্বাভাস পেয়ে গত দুদিন শোপিসের দিকে ফিরেও তাকায়নি হিশমা। শিক্ষাজীবনে যত শোপিস ক্রয় করেছে সবগুলো ধূলোময়লা জমে জমে আদ্দিভূমি তৈরি হয়েছে। আরবভূমির মতো বালির আস্তরভূমি। আরব্যভূমির কথা মনে পড়লে আঁতকে ওঠে সে। একাধিক বিয়েকামী শহর। পাড়াতে অনেকেই আরব দেশে গল্প করে এবং একাধিক বিয়ে কতটা শান্তি দেয় সেই গল্পগুলো ঠোঁটের আগায় নাড়াতে থাকে। বালি দেখলেই বুকের ভেতরটা তেঁতে ওঠে তার। মনে পড়ে আরব্যকাহিনি। ভয়ে বালির দিকে ফিরেও দেখেনি সে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বাবা বলছিল মা তোকে এবার ছাড়তে হবে। ছাড়ার কথা কদিন আগেও শুনেছিল কিন্তু এবার বাবার বলার মধ্যে দায়মুক্তি ভাব দেখে হিশমার নিজেকেই নিঃস্ব মনে হতে লাগলো। ছেড়ে যাওয়ার মধ্যেই কী আর্ট!

বালিও একধরণের আর্ট, আরব্য আর্ট। সোপিচে বালিমাখা আর্টের নমুনা। মনে হচ্ছে শতবছর ধরেও কারো হাত পড়েনি। কোনে ছিল আগ্রার তাজমহল। মমতাজের কথা মনে পড়ে হিশমার। মমতাজের ভালোবাসার অভাব পুরণ করেছে কী এই তাজমহল? এসব প্রশ্ন মনে বারবার ভর দিতে থাকে। মাকড়শার জাল তাজমহলের ওপর, পেটুক মাকড়শা একা একা নৃত্য করছে। ভালোবাসা না থাকলে তাজমহলও ঢেকে যায়- আধোঢাকা তাজমহল। শুকনো কাপড় দিয়ে মুছতে মুছতে মনে করতে চেষ্টা করছিলো। কে- কবে দিয়েছিল এই শোপিচ। মনে পড়ছে -ওই ছেলেটি। সে কী তাঁর মনের অসুখ দূর করতে পারবে? বছরখানেক আগে পরিচয় ঘটে দুজনের। বাসার সামনের রাস্তায় পার হয়ে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করেছিল- নিজেদের বাড়ি? পরদিন থেকে পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করতে থাকে। শ্রাবণদিনে প্রাইভেট থেকে ফেরার পথে যাত্রীছাউনিতে দেখা হয়েছে দ্বিতীয়বার এবং দীর্ঘ আলাপও জমে উঠেছিল। সেদিন রাস্তাঘাট ফাঁকা ছিল, বাদলা হলেই মফস্বল শহরের রাস্তাগুলো জনশূন্য হয়ে ওঠে। শহরতলি থেকে তিন কি.মি পার হলেই তাদের বাড়ি। রাস্তা ঘাট পাকা হওয়ায় সবই এখন শহরতলি মনে হচ্ছে। শ্রাবণবৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে একটু চোখ তুলে তাকিয়েছিল হিশমা। বিন্দু বিন্দু মায়ায় আটকে গেল সে। ছেলেটাকে আর আড়াল করতে পারেনি। ছেলেটার নাম অয়ন্ত, দিনে দিনে মনের দুয়ার মুক্ত হতে লাগলো। মনের বালুচরে উর্বরমেঘ এবং ভারি বৃষ্টিতে মনের সবকটা জানালা উন্মুক্ত হয়ে গেলে, দুজন দুজনকে আলাদা করে দেখতে পায়নি। আতেক আলির চোখ ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ না; টের পেয়ে ওৎঁ পেতে ছিল। ধরা পড়ে গেল হিশমা। জোর জবরদস্তি করে। হিশমা ফটাফট দীর্ঘদিনের গোপন কথাগুলো বলতে লাগলো। আতেক আলি আর চুপ থাকলো না। মেয়ের বিয়ে দেওয়াই উচিত- সমাজে খাটো হওয়া থেকে বাঁচার এটাই নিশ্ছিদ্র উপায়! কেবলই মেয়ের বিয়ে। দেরি করা পাপ।

বিয়ের পিঁড়িতে বসতেই টপাটপ জল গড়াচ্ছে হিশমার, চোখের কোঠায় জলের ঢেউ। মনে ঢর – উনিশ-বিষ হলে ঘোরতর বিপদ। তার ইচ্ছেমতো সব হচ্ছে- মেয়ের মনের ইচ্ছার বাহিরে কোনো কাজ করবে না আতেক আলি। কিন্তু মেয়ের চোখে জলখেলা দেখে বলতে লাগলেন- হে দয়াল। বিরক্তমুখে তাকালেন বরপক্ষের বশির আলি। আজকাল মেয়েদের কান্না চোখে পড়ে না; মেয়ের কান্নায় প্রতিবেশিদের অনেকেও কানাঘুঁসা করতে লাগলো। কিন্তু মেয়ের বাবা আতেক আলি নিচক তাকিয়ে রইলো। রক্তটান কতটা দৃঢ় আতেক আলির দিকে তাকালেই হিসেবটা একশোভাগ ধরা পড়ে গেল। মেয়ের মাথায় হাত রাখতেই হিশমা জড়িয়ে ধরে বাবাকে। জলে ডুবে থাকা পদ্মের মতো জলেমাখা পদ্মসুখই। স্নেহমাখা দৃশ্য দেখে উপস্থিত বাবামহলের হৃদয়ে ঘনঘন টান লাগতে থাকে। পাশ থেকে দূরসম্পর্কের কারো ভারিকণ্ঠ শোনা গেল -কে যেনো কয়ে ওঠে৷ ধুত্তুরি মেয়ে মাইনসের যত ঢং। পিরিতের বিয়া আবার কান্দে রান্দে কতো কী- তাজ্জিপ ব্যাপার; রাইখেন তো। কথাটা আঁচড়ে পড়তে না পড়তেই টান দেয় বাড়ির দখিন ইশার মেররাব আলি। আপনি তো বেজাইল্লা মানুষ। আসল কতা কন! আতেক আলি পুত পাইছে একখান। পুতের অভাব আর রইব না। ঠিক কইছি না বলেই ঘর ছাড়ে মেহরাব আলি।

বাবার কলজের টুকরা মেয়ে হিশমা। এত্ত আদর তাকে কেউ করেনি। ঘরের ছোট্ট মেয়ে সে। ভয়ঙ্কর সুন্দরী না হলেও শ্যামলরঙা চেহারায় লাজুকলতার মতো মায়া নুয়ে নুয়ে পড়ছে, মন ভোলানো দৃষ্টি মাখামাখি করছে মুখের ওপর। ঘরের বাহিরে বরযাত্রী তাড়হুড়ো করছে। মেয়ের হাত ঠেসে ধরে বললেন, উঠ মা! আর দেরি করিস না। মাথা উঁছিয়ে হিশমা লিকলিকে দুহাত বাবার কাঁধে রেখে বলল, বাবা- বাহিরে ঘন কুয়াশা, রাত করে বাড়ি ফিরবে না; ঠোঁটে কামড় দিয়ে চোখের জল সামলাতে চেষ্টা করলেন আতেক আলি।

তার শ্বাস রোগ, পৈতৃক রোগ। মুক্তিযুদ্ধের সময় কচুরিপানার ভেতরে লুকিয়ে লুকিয়ে পাকবাহিনির নৌকা ডুবিয়ে দিতো তার বাবা, দীর্ঘদিন বর্ষাজলে ডুবাতে ডুবাতে সর্দি ও বুকে কফ জড়িয়েছিল। আতেক আলি জন্মকাল থেকে বহন করছে এই পৈত্রিকরোগ। বহু ঔষধপত্র খাইয়েছিল কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বাবারকালের রোগ ইহ জীবনে সেরে ওঠেনি।

বাড়ির আশপাশে তিনবিঘা খেত। মৌসুমী ফসলের লাভে চারা গাছ বসায়। চারাগাছগুলো হনহন করে বেড়ে উঠছে। আজগুবি ভাগ্য তার। মাটিতে হাত লাগলেই বীজ গজায়। ঈশ্বরের হাত আছে৷ তার হাতের ওপর নচেৎ টানামার্কা হাত এতো গুণ পাকার কথা না। ধানী ফসলের মাঠে কাস্তে দিয়ে আল পরিষ্কার করছিল আতেক আলি। হঠাৎ ভিরমি খায়। আলের ওপর মাথা সবুজ ধানের ওপর পা মুড়িয়ে পড়ে আছে। সোনাফলানো এক কিংবদন্তির নিথর শরীরটা দিনদুপুরে পড়ে থাকা ভাগ্য বিড়ম্বনা ছাড়া আর কি! তাজ্জিপ ব্যাপার! পাশের খেতে কাজ করছে কাঁকন চোকদার, সঙ্গে আছে ছোটো ছেলে কৃষাণ। মাটির দিকে নুয়ে দুজনে ধানের গোছাগুলো আগাছামুক্ত করতে করতে কানে আসে বকের শব্দ, মাঠের শোভা বক। ফসলের মাঠে পোকামাকড়ের বসতি বেড়ে গেলে বকগুলো নুয়ে নুয়ে জড়ো হচ্ছে- পোকামুক্ত করে ধানের শীষ। কৃষাণ ডাক শুনে মাথা উছায়। ধানের ওপর পোকামাকড়ের নড়াচড়া শুরু হয়েছে কদিন। বকের দেখা পেয়ে কৃষাণ মনে সুখ পায়। মাথার ওপর দিয়ে বকগুলো উড়ে গেল-শান্তিদূত!

আতেক আলির খেতের ওপর বকগুলো ডেকে ডেকে উড়ছে। কৃষাণের দৃষ্টি গেল আতেক আলির ওপর। বাপ- ব্যাটা দুজনে দৌড়ে গেল। শব্দহীন আতেক আলির ধড় নড়ছে। বেঁচে আছে কিন্তু আয়ু অস্তপ্রায়। দুজনে পাঁজকোলা করে বসায় তাঁকে; নিশ্বাস ঘন হতে হতে চোখ খোলে আতেক আলি। কৃষাণের দিকে ঘন ঘন তাকায় এবং ভারি নিশ্বাস নেয়। দাঁড় করিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। মাথার ওপরে ঘুর্ণি খেতে লাগলো ছোটো প্লেন, কাঁকন চোকদার ভয়ে কাঁপছিল। কৃষাণ বলল, বাজান ভয় পাইছো? এটা হইলো ড্রোন। কাঁকন চোকদার কেঁপে কেঁপে বলল, বাজানরে ড্রোন! উঠ! উঠ! সে কদিন আগে টিবিতে রুশ সেনাদের ড্রোন হামলা দেখেছিল। ইউক্রেনে কৃষকের ওপর হরদম হামলা হয়েছে। মাঠের পর মাঠ বিরান হয়ে গেছে তাদের। রুটির জুড়ি ইউক্রেন কৃষকশূন্য। দেশে দেশে আমদানি বন্ধ। ওরে বাপরে ড্রোন কয়ে এক লাফে আলের ওপর পা তোলে কাঁকন চোকদার। আরে বাজান- ভয় পাইয়ো না; এটা সেরকম ড্রোন না; ড্রোন ক্যামেরা। ফটো উঠায় ভিডিয়ো করে। আমাগো জলির চাচার ছেলে বানাইছে। কদিন ধইরাই ওয় উড়াইতেছে।

আতেক আলি আঁতকে ওঠে। জলিলের ছেলে ড্রোন বানাইছে। কি কও; হু চাচা ঠিকই কইছি। কোনগা,
অয়ন্ত। কী কও! সে খুব দুষ্ট ছেলে। আমাগো হিশমা কইছিল। বাজান আমাগো গাঁয়ে একটা রত্ন আছে।
অনেক জিগাইলাম কে সে। হিশমা কইলো টের পাইবেন। হিশমার বিয়ের পরপরই স্বামীসহ রাশিয়া চলে গেল মেয়েটা। সহজে কথা কওয়া যায় না; কামকাজে ব্যস্ত… মেলা ব্যস্ত।
আতেক আলি কল দিতে চায় কিন্তু বেলা দেখে বলল,
তারে এখন পাওয়া যাইতো না; কামের সময় তারা কল ধরে না; কাজে তাগো খুব খেয়াল। আমাগো মতো যখন তখন ফোনেটোনে ঘুর্নি দেয় না। আতেক আলির কোমড়ে বড়ো হেন্ড সেট। বের করেই মেয়েকে কল দিয়ে রাখে। কাঁকন চোকদার তার সেটের দিকে তাকিয়ে বলল, কী আতেক আলি? এইখান বুঝি মাইয়্যায় দিছে। মিষ্টি হাসি দেয় সে। আতেক আলি কিছু বলার আগেই কাঁকন চোকদার তাকে থামিয়ে বলল, থাক বুঝছি। কৃষাণ তার বাবার অপুর্ণতা টের পায়। কী বাজান? তুমি ভাবছো তোমারও যদি একটা মাইয়্যা থাকতো। ঠিক কইছস! আহারে বাজান। একটু আগে আতেক আল চিতায়া রইলো নিজ চোখ ঠাহর করেও এডা কইলারে বাজান। তোমরা এ অঞ্চলের বাপগো এইডাই সমস্যা। তোমাগো মনে টান, দেহে টান, টান… আর টান।

আতেক আলির ঘরে লেঙলি মা। মায়ের বয়স শতকের কৌটায় হলেও ছেলের কণ্ঠ শুনতেই আঁতকে ওঠে। বাড়ির পাতা নড়লেও বুড়ির কানে মঠের ঘন্টাধ্বনির মতো বেজে ওঠে। একেই বলে মা পুতের টান। পৃথিবীর স্বর্গরাজ্যের অধিকারিণী মা। আতেক আলির চিৎকার শুনে খুড়িয়ে খুড়িয়ে আসে বুড়ো মা। জোয়ান কালে ঘাটকুলে চিতিয়ে পড়ে ডান পা ভাঙছে। সেই বছরই পেটে ধরেছে পোলা আতেক আলিরে। সেই থেকেই দুজনের মন একই টঙে বাঁধা, একজনের শরীরে টান পড়লে দুজনেই টের পায়, যারে কয় ঘুড়িসুঁতার টান। বুড়ির শরীরে খিঁচুনি হলেও মনে টান লাগতে থাকে। দূর থেকেই ডাকতে লাগলো -ওই বাজান আতেক, কী হইছে তোর। কইছি না; শেষ কালে হইলেও একটা বাইচ্চা কাইচ্ছা লও। হুনলি না, পোলা নাই জীবনের কি দাম। বুড়ো হইলে দেখবো কে? ম্ইনষে সব লইয্যা যাইবো কথা হুনলি না; এই পেটে না ধরলে আরেকটা জোয়ান মাইয়্যা লও। জোয়ান বেটি হইলে পোলা না হইয়্যা যাইবো কই। আঁর কথায় কান দিলি না; বয়সকালে কাম না করলে বুড়াকালে কী দশা এবার বুঝ। ঘর থেকে বেরিয়ে বুড়ো মা আতেক আলির চুলের ওপর হাত রাখে এবং কাঁপুনি ধরা হাতে নেড়ে দেখে। মনে হচ্ছে হেয়ার মেসেজ হিটার। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো আতেক আলি। দুজনের দেখাদেখিতে মনে হচ্ছে- মমতাঝরা স্বর্গসুখের অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন হয়ে গেল।

কৃষাণের খুব অভিমানী মুখ। মন চায় এহনই গাঁয়ের ইউনিফর্ম ছেড়ে শহুরের শৌখিন পথ ধরতে থাকে। জন্মভিটে ত্যাগ করা যায় না; মায়াচিহ্ন তাড়া করছে। শৈশবগাঁথা স্মৃতি মনের গহীনে আঁচড় দেয়। মনভোলানো হাসি ও রঙিন স্বপ্নের পথরেখা চিমটি কাটে পিগম্যান্টে। আধেক গাঁয়ে ও শহুরে জীবনপাতা মানুষের মন গাঁয়ের মানুষের জন্য পাথুরে রোগই বটে।

বহুলোকের সঙ্গে কথা হয়েছে কৃষাণের। যারা গেরামের দিকে পা দিয়েছে। যারা ছিলেন- খেতখামারে কাজের ফাঁকে পড়াশোনায় ডাঁটওঠানো মানুষ। তারা এখন সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে ছুটছে। সরকারের দপ্তরে দপ্তরে হুকুম হাঁকায়। গেরামে তরুণ বয়সের ছেলে -মেয়ে কমে গেছে। জীবন গড়ার আশায় ছোটাছুটি করছে। আতেক আলিকে রেখে ফিরতেই কৃষাণকে ডাক দেয় সাইমুন। গতকালই দুজনের কথা হয়েছিল। সাইমুন কৃষি ডিপ্লোমা শেষ করছে। মাঝে মধ্যে গাঁয়ে আসে। ফলন ও উৎপাদন সম্পর্কে কৃষকদের পরিস্কার ধারণা দেয়। কৃষকের বাম্পার ফলন হওয়ায় সাইমুনের প্রতি বিশ্বাস বেড়ে যায় কৃষকদের। আগামীকাল সভা বসবে- কৃষকসভার। বাড়ি বাড়ি যেতে হবে তাদের। কৃষাণই সাইমুনের ভরসা, তাকে নিয়েই পাড়ার লোকদের সভা বসায়। কৃষাণকে খুঁজতেই বেরিয়েছে সাইমুন। সাইমুনকে পেয়ে বলল, কিরে কৃষাণ? এত্তো মনভোলা ক্যান কালকে সভার কথা মনে নেই। মনে আছে ভাই, আতেক আলিকে তুলতে গিয়ে বেজায় দেরি হয়ে গেল। তার আবার কি হইছে? তার তো চাঁদকপাল। এক মেয়ে হিশমাই বদলে দিয়েছে অভাবী সংসার। সব শখই পুরণ হইলো। শখপুরণ মানুষ। হিশমার বিয়েতেই সুখ ফিরছিল ব্যাটার। আমরা এখনো কোনো পথই খুঁজে পাইনা। তবে আপসোস করি না, পথে যখন আছি। আরে ভাই পথে থাকলে পথের দেখা পাইতে আর কতক্ষণ! তা অবশ্য ঠিকই কইছস।

পথই পথের দেখা দেয়। গাঁয়ে কোনো ছিন্নপুত্র নেই। গত কবছরে বহু ছেলেপুলে মানুষ হয়েছে। একটা ধাক্কা খেল গত কয়েকবছর। বাপদাদার ঘটিবাটি সংস্থান না থাকলেও নিজেকে বদলে দিয়ে সংসারও বদলে দিয়েছে গাঁয়ের পোলাপান৷ ঘরে ঘরে স্বনির্ভর ছেলে-মেয়ে। যে যার মতো ঘাম জরায়৷ শিক্ষার হার বাড়ছে, কর্মক্ষমের হার বাড়ছে দিনদিন। কৃষকসভার নামে আমূল পরিবর্তন দেখা দেয় গাঁও মানুষের। রক্ত ও হাঁটুক্ষয় এবং ঘামঝরা মানুষের ভাতের অভাব হয় না; ঘরে ঘরে স্বচ্ছল পুরুষের ভিড়। মেয়েরাও পিছিয়ে নেই; বেশি সক্ষম হয়েছে মেয়েগুলো। পাশের গাঁয়ের মানুষের কথার শরম গায়ে না মেখে পড়াশোনার পাশাপাশি সংস্কৃতিও চর্চায় মনযোগ তাদের। কৃষাণের কৃষকসভা সঙ্ঘের নামে বদলের হাওয়া দেখে পরের গাঁয়েও গড়ে উঠছে ভিন্ন ভিন্ন সঙ্ঘ। ভাও মতো হাওয়া ছুটছে।

এগিয়ে যাচ্ছে তিলপুর৷ আতেক আলির নেতৃত্বে
কৃষকের কাজে যেতো ভিন পাড়ায়। আতেক আলির বয়স ভাটির দিকে; তার সঙ্গীদের বয়সও তাই। তাদের ছেলে পুলে কৃষি কাজ করে না; হাতেখড়ি নিয়ে দপ্তরে দপ্তরে চেয়ারগুলো দখলে নিয়েছে। হ্যারিসের ফ্রি গবেষণা সার্ভিসে গাঁয়ে নতুন হাওয়া বইছে। সাইমুন গবেষণা কেন্দ্রের নিয়মিত সঙ্গী। পড়াশোনার পাশাপাশি কৃষি গবেষণায় তার বিস্তর জানাশোনা আছে। কদিন হলো সে উপজেলার কৃষি দপ্তরের চাকুরিটা পেয়েছে কদিন আগে। সোনায় সোহাগা ছেলে সে। এখানকার কৃষি কর্মকর্তা সাইমুনকে দেখেই মনে জোর পায় আতেক আলি।

সাইমুন গাড় ফিরে দেখে আতেক আলিকে। ভয় পায় কৃষাণ, আতেক আলি রোগাটে মানুষ, আবার তিরিক্ষি মেজাজেরও বটে। মিনিটকতেক আগেই দেড় কি.মি বিল দৌড়ে তাকে বাড়ির দেরাজে পৌছালো।
চিৎকার দিয়ে ডাকে ওই সাইমুন ওই সাইমুন। মনে হচ্ছে, নাভী থেকে টান ধরেছে সে, দম পুরাবার আগে গাঁয়ের মিচির আলি এমন চিৎকার দিয়েছিল। দ্বিতীয় চিৎকারের দাবী ওঠার আগেই উপস্থিত সবার চোখে জল চলে এসেছিল। মানুষ ধরে নেয় দুনিয়ার দরজা বন্ধ হয়ে গেল মিচির আলির। মনে বড্ড ভয় পায় কৃষাণ। সাইমুনের হাত ধরে আতেক আলির পায়ের কাছে ঘেঁসে। আতেক আলি সাইমুনের মাথার তালুঅংশ দিয়ে আঙুলের লাঙল চালায়। গাঁয়ের কৃষক পিতা আতেক আলি। আঙুলে উর্বরা গেরস্থলি দেখে বাবার লাঙলের কথা মনে পড়ে সাইমুনের। সারের জন্য পিতার শর্ষেবোনা জীবনটা পুলিশের বুলেটের খাবলায় উড়ে গিয়েছিল।

আতেক আলির চোখে রক্তজল। কী চাচা কাঁন্না করছেন ক্যান? -আগিলা কথা। তোমরা সেদিন সারের জন্য উপজেলা গেইটে দাঁড়িয়েছিল। অফিসার ও আড়ৎদার হাঁকিয়ে বলল, বাগেন বাগেন সার- শেষ শেষ। বস্তাটা তখন হাতের মুঠোয় ছিল মতিউলের। চিৎকার দিয়ে ওঠে, বড়ো চিৎকার, স্লোগান দিতে থাকে, উফ কী স্লোগান? স্বাধীনতার পর এমন স্লোগান দিতে আর কাউকে দেহিনাই৷ লোক জড়ো হতে থাকে। কার অজানা, হাড্ডি-গুড্ডিওয়ালা গামছাবাঁধা চাষা- দিনমজুর যারা মানুষের মুখের দানাপানি চাষ করে, মুখভর্তি ভাত হান্ডায়। সেদিন আন্দোলন গরম হতে থাকে কেবল মতিউরের কথায় -কৃষি অফিসার ভয়ে পেছনের গেইট ছাইড়া ডাকাতিয়ার ওইপারে গেল। আড়ৎদারগো ক্ষমতার দৌড়, বাপরে তারা পুলিশগো খবর দেয়, পুলিশ বেদড়ক ঠেঙানি দেয়, গুলিও ছোঁড়ে কিন্তু মতিউরের দীর্ঘ হাত ও বকের লাহান গলাটা উচাটন করে স্লাোগান হাঁকাতে থাকে, পেট ও পিঠ এক করও, দুনিয়ার চাষা -মুজুর এক হও লড়াই করো, লড়াই করো… কাম ওইলো না। কৃষিখেত উর্বা যায়, আড়ৎদার ফায়দা লুটতে থাকে।

বেসামাল কৃষক ধুত্তরি শালা, পুলিশের গুষ্টি কিলাই গুলি… গুলি… গুলি ছোঁড়ে পুলিশ। মতিউরের বুক ভেদ করে আমার ডান হাতের কব্জি চিইলা য়ায়,আমি তার পাশে, মতিউর লুটিয়ে পড়ে। শক্তমাটির ওপর কৃষকজনতার পিতার দেহ কাতরাতে থাকে। গরম ভাত খেয়ে নেমেছিল মতিউর। নিশ্বাস শেষ হওয়ার পূর্বে ডেউক দিলে তরতাজা একটা ভাত বেরিয়ে এল। আমার চটের বস্তাটা ডান হাত থাইক্কা খসে যায় এবং রক্তঝরে, ঘামমাখা রক্ত। রক্তের গন্ধ নেই; ভাতের গন্ধ। বুকের ওপর হাত রেখে বসলাম তার মাথার কিনারে। বস্তাটা আমার হাতে দিয়ে মৃদু হেসে ঘুমিয়ে গেল। কালঘুম। কৃষকের কালঘুম। সেদিন থেকে কৃষকেরা গাঁয়ে শপথ নেয়। আমাদের গাঁয়ের ছেলে মেয়েরা দখলে নিবে এসব দপ্তরের বড়ো বড়ো সিট।

সাইমুনের চোখে জল খেলা করছে। রক্তজল। বাবার কথা রাখতে গিয়ে আতেক আলি কৃষি ডিপ্লোমা পড়তে বলছিলেন। সাইমুন কান্নাভেজা মুখে বলল, কাকা- এজন্যই আমাকে কৃষি নিয়ে পড়তে বলছিলা। হয় বাজান, তুমি উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা। শুইনে আজ মনটা বিষম খুশি খুশি লাগে। বাজান, খেয়াল রাইখো আর যেনো কারো প্রাণ না যায়। চাচা, বাবার কসম, আমি আমার সাধ্যমতো কৃষকের জন্য কাজ করবো।
এ গাঁয়ের কৃষক সন্তানরা হবে দপ্তরের হুকুমদাতা। ঠিক কইছো, আমাগো কিশোর সভার কারণে গাঁয়ে হাওয়া লাগছে। সেই হাওয়া তিলপুর থেকে দূরের গাঁয়েও উড়ছে।

হ্যারিসের গবেষণা কেন্দ্র থেকে বের হচ্ছে শত শত ছেলে -মেয়ে। গবেষণাই ধর্ম। ক্যাপ মাথায়, হাতে হাতে কালো ব্যাগ, ব্যাগের ওপরে ল্যাপটপ, জড়ো লোক দেখে তারা থেমে গেল। রাস্তার পাশে আতেক আলি। তার পায়ের কিনারে এসে বসে ছেলে মেয়েরা এবং বলল, চাচা আপনি কাঁদছেন কেন? তোমরা বড়ো হও,কর্মের দীর্ঘ পথে পা বাড়াও! কথাগুলো বলতে বলতে আতেক আলি মাথা ওঠায় এবং নাভীমূল থেকে জোরে জোরে টান দিতে দিতে বললেন, আমাকে একজন আর্টিস্ট ডাকছেন…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *