উপন্যাস।। সুবর্ণ সর্বনাশ।। মনি হায়দার ।। পর্ব পাঁচ

আর? আমার সর্বনাশ।

হা হা হাসিতে ফেটে পড়ে হাবীব। মাতালের হাসি। সুখের হাসি। অসম্ভবকে হাতের মুঠোয় পাওয়া হাসি — যা কাল ছিল ভাবনারও অতীত সেই অবাস্তব স্বপ্নকুসুম, কতো সহজে তার বুকের উপর ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়লো আজ─ এই কয়েক মিনিট আগে? হাবীব সুখের বিপুল রোমাঞ্চে বাতাসে ভাসছে বেলুনের মতো। মালবিকা হকের লৌহ – কপাট গাম্ভীর্যের দেয়াল ভেঙে ঢুকে গেছে সে গভীর গোপন ঘরে। বুঝতে পেরেছে মালবিকা হকের সাধ্য নেই ওই ঘর থেকে হাবীবকে আর প্রস্থান বলতে পারে! কিংবা কপাট আটকে রেখে বলতে পারে─ প্রবেশ নিষেধ। দীর্ঘ আঠারো বছর ধরে বহু কষ্টে, তিল তিল করে গড়া তিলোত্তমা সুষমা, ধৈর্যের আভার , মাতৃত্বের সৌষ্ঠব সব এখন হাবীব নামক একটি সাধারণ ছেলের পায়ের কাছে দুলছে। মালবিকা এখন সামান্য নারী। খসে গেছে। তার অসামান্য হয়ে ওঠার যাবতীয় জৌলুস। এই জয়ের বিপুল গৌরবে হাবীব আকাশ পাতাল মথিত করে নাচতে চায়। দেখো, দেখো হে পৃথিবীর মানুষ, দেখো আমাকে। আমি নারীর ভেতরের কুসুমমাখা লৌহকপাট খুলতে পারি। আমি অজানাকে জানতে পারি। আমি মালবিকা হক নামের এক অসাধারণ সৌন্দর্যে বিভোর নারীর বুকে মুখ রেখে শিশির ধোয়া ভেজা বকুল কুড়ানোর গন্ধ কুড়াতে পারি। আমি আজ সব পারি — আমি হাসতে হাসতে মরতে পারি। আমি আমাকে আপন হাতে কাটতে পারি, ছিন্ন করতে পারি, আমি … হাবীবের ভেতর হাবীব ভাঙ্গতে থাকে।

হাবীব?

ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে — বলো।

তুমি কী কী খেতে পছন্দ করো?

যা খাওয়াবে তুমি, আমি তাই খাবো।

তবুও বলো কী কী পছন্দ তোমার?

 জটিল কোন খাবার একদম পছন্দ না আমার। পোলাউ বিরানী─ এই জাতীয় তৈলাক্ত খাবার খেতে পারি না।

মালবিকা হক অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন হাবীবের দিকে। চোখে তার পলক। পড়ে না।

অমন করে তাকিয়ে আছো কেন?

 তেলের খাবার কেন খাও না?

আমি গ্রামের মানুষ। মাছ, ভাত, তরকারি ছাড়া মাংস, পোলাও, কোর্মা জাতীয় খাবার আমার ভালো লাগে না। আর তেল দিয়ে রান্না কোনো কিছু খেতে পারি না ।

তাতে অবাক হবার কিছু নেই। অবাক হয়েছি আমি সত্যি; কিন্তু ভাত, মাছ, তরিতরকারি খাওয়ার কারণে নয়।

তাহলে?

পরে বলবো। তুমি বস আমি রান্না করি।

মালবিকা হক অনেক দিন পর অন্যরকম রান্না করেন। ডালের চর্চরি। চিংড়ি মাছ আর লাউ রান্না, তপসে মাছ ভাজি করেন। রান্নাঘরে সারাটা সময় ন্যাওটা বিড়ালের মতো পাশে পাশে থাকে হাবীব। মাঝে মাঝে হাবীব জড়িয়ে ধরে আদর করে মালবিকাকে। মালবিকা হক কপট রাগ দেখালেও মজা উপভোগ করেন আর মনে মনে হাসেন। রান্না শেষে টেবিলে খাবার দেন। তরিতরকারির সঙ্গে দু’টি কাঁচা মরিচ আর দু’টুকরো কাগজি লেবু। দীর্ঘ বছর পর আলো ঝলমল ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে আবার মমতার সঙ্গে কাউকে খাওয়ালেন মালবিকা হক। খেতে বসে হাবীব বলে, আমি তোমাকে ছাড়া খাবো না।

আজ তুমি খাও আমি দেখি, প্লিজ।

তুমি এমন করছো কেন?

কেমন করছি?

আমি আমার সঙ্গে খেতে বললে তুমি খেতে চাও না। বলো তুমি খাও— আমি দেখি।

আঁচলে মুখ মুছে তাকান মালবিকা হক — বলছি তার কারণ আছে।

সে কারণটা কী?

বলবো আর একদিন। আজ তুমি খাও। আমি দেখি।

হাবীব অবহেলা করতে পারে না মালবিকা হকের অনুরোধ। চুপচাপ খেতে বসে সে। হাবীব বেশ তৃপ্তির সঙ্গে খাবার খায়। মুখ মোছে। বুঝতে পারে, তাকে খাইয়ে মালবিকা হক অন্যরকম তৃপ্তি পেয়েছেন। কিন্তু সেটা কী বুঝতে পারে না হাবীব। জিজ্ঞেস করতেও সাহস পায় না। তারও এমন আন্তরিক স্বপ্নময় একটি পরিবেশ পেয়ে ভালো লাগছে। মানুষের জীবনে এমন নান্দনিক মুহূর্ত সব সময় আসে না। যখন আসে সে যেভাবেই আসুক তাকে গ্রহণ করতে হয়, উপভোগ করতে হয়। একটি জীবনে নানা প্রকার স্তর থাকে। সেই স্তরগুলোকে অতিক্রম করার সময় অর্জিত অভিজ্ঞতাকে অবজ্ঞা করার প্রয়োজন নেই। জীবনে কোনো কিছু ফেলনা নয়। হাবীব কোথাকার কোন অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে আহসানুল হাবীবের জীবনে এমন সুশোভিত লগ্ন আর কবে কখন আসবে কে জানে! সে সবটুকু উপভোগ করতে চায় চেটেপুটে। সে মালবিকা হককে ছোট করবে না। একটি জীবনের তারে আর একটি তার বাসা বেঁধেছে। সুর উঠেছে জীবন গাঙ্গে, হাবীব এই ঝড়কে ভয় পায় না। ঝড়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঝড়ের মোকাবিলা করতে চায়।

অনেক রাত হয়েছে হাবীব─ বারান্দায় দাঁড়ানো দু’জন পাশাপাশি। মালবিকা হকের মাথায় ওর মুখ। দু’জনকে জড়িয়ে রাখছে। তোমার চলে যাওয়ার সময় হয়েছে, বলেন মালবিকা হক।

আমি যেতে চাই না।

এক দিনে, এক বিকেলের সুযোগে অনেক বাড়াবাড়ি করেছি। আর নয়। এবার থামো হাবীব।

তুমি কী আমাকে ভয় দেখাচ্ছো ?

 চুপচাপ থাকেন মালবিকা হক।

আমার যে ভয় ছিল, সেটা ভেঙে গেছে। এখন এসব বলে আমাকে ফেরাতে পারবে না। আমি আগে দূর থেকে বিষের পাত্র দেখতাম, ভয়ে শরীর কাঁপতো। কিন্তু সেই বিষের পেয়ালায় ঠোট রেখে আকণ্ঠ বিষপান করে ফেলেছি।

 হ্যা বুঝেছি। এবার যাও।

যদি না যাই?

জোর করে পাঠাবো।

হাসে হাবীব। পারবে আমার সঙ্গে ? আমি তোমার এ বুকে মুখ লুকিয়ে এভাবে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে থাকবো। তারপরও কী পারবে আমাকে তাড়াতে?

হাবীব? মালবিকা হকের কণ্ঠ ভারী হয়ে আসছে।

কী হয়েছে তোমার? হাবীবের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।

আমার কিছু হয়নি। দয়া করে তুমি যাও। আমাকে একা থাকতে দাও।

আড়ষ্টবোধে আক্রান্ত হাবীব ঠিক আছে, যাচ্ছি। আবার কবে কখন আসবো।

চলে দরজায়, বলছি।

চলো। দু’জনে হেঁটে দরজায় আসে। মালবিকা হক দরজা খুলে দাঁড়ান। হাবীব হঠাৎ মুখটা তুলে ধরে মুখের সামনে — এই সুখ ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। আমার সব সুখ তোমার কাছে জমা রেখে যাচ্ছি।

মালবিকা হক গভীরভাবে তার দু’টি তৃষ্ণার্ত ঠোটে পরমস্পর্শ পান হাবীবের নরম ঠোঁটের। উপভোগ করেন তিনি চুপচাপ থেকে।

হয়েছে। অনেক হয়েছে। মালবিকা হক সামান্য জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেন হাবীবের দু’বাহুর বলিষ্ঠ বাঁধন থেকে─ যাও, আর সময় নেই। নিচে গেট বন্ধ করে দেবে দারোয়ান।

হাবীবকে ঠেলে দরজার ওপাশে পাঠান। হাবীব ঘুরে দাঁড়ায় — বললে না কবে আসবো আবার?

আর আসবে না। কখনও আসবে না। এলে অপমান করবো, অসভ্য কোথাকার! কার সঙ্গে কী ব্যবহার করতে হয় কিছু জানো না! হাবীবের মুখের উপর ঠাস শব্দে দরজাটা বন্ধ করে দেন মালবিকা হক।

মালবিকা হকের প্রতিটি শব্দ হাবীবের গালে ঠাস ঠাস থাপ্পড়ের মতো লাগে। হাবীব দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বানরের মতো। সে কী জীবিত আছে? নাকি মরে গেছে! মালবিকা হক কে? এতোক্ষণ — সেই বিকেল পাঁচটা থেকে এখন রাত এগারোটা পর্যন্ত কার সঙ্গে ছিল? কোনো ডাইনি নাকি কোনো নিপাট অভিনেত্রীর সঙ্গে সময় কাটিয়েছিল?

যা ঘটছে সবটুকু কি অলৌকিক? স্বপ্ন? জেগে জেগে বাস্তব স্বপ্নের চাষাবাদ করছে সে? হাবীব পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া থানার বোথলা গ্রামের কেরামত আলির ছেলে আহসানুল হাবীবের কী স্বর্গ থেকে পতন ঘটলো? এতোক্ষণ কী সে মালবিকা হকের স্বর্গের উদ্যানে ছিল? হাবীব কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল বা থাকতো বুঝতে পারছে না। কারণ চার তলায় কয়েকজন লোক সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল। ওকে দোতলায় সিঁড়ির ওপর মোহসীনদের দরজার সামনে স্তব্ধ পাথরের মূর্তির অবয়বে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, কে আপনি? কোথায় যাবেন?

স্বর্গে যাবো─ হাবীব আর দাঁড়ায় না। হন হন করে নিচে নামতে থাকে।

ওর কথায় লোকগুলো হেসে উঠে। একজন বলে, ব্যাটা আর স্বর্গ খোঁজার জায়গা পায়নি!

 অন্য আরেকজন বলে— পাগল। নতুন পাগল। পাগলীরে খোঁজে।

হাবীব খুব স্বাভাবিক মানুষ।

যে কোনো পরিস্থিতিকে সে সাহসের সাথে গ্রহণ করতে পারে। বন্ধু মহলে সে ধীর স্থির আর হিসেবি হিসেবে পরিচিত। সেই হাবীব কেমন করে একটু যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মালবিকা হকের কাছ থেকে এসে সরাসরি রুমে ফিরে আসেনি। সারাটা রাত উদভ্রান্ত পথিক হয়ে সারা ঢাকা শহর চষে বেড়িয়েছে। সে এক মুহূর্ত কোথাও থামেনি। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, বুড়িগঙ্গা ব্রীজ হয়ে আবার উল্টোপথে হেঁটে হেঁটে গুলিস্তানে এসেছে। গুলিস্তান থেকে মালিবাগ, মালিবাগ থেকে রামপুরা টেলিভিশন, টেলিভিশন থেকে মৌচাক, মৌচাক থেকে ফার্মগেট─ ইতোমধ্যে রাত শেষ। রাতের নিষিদ্ধ ঢাকা দেখছে। দিনে যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাতের অন্ধকারে সেই মানুষগুলো কোথায় যায়? সবাই কি বাসার বিছানায় পরম সুখে ঘুমুচ্ছে? পথে একবার একটি পুলিশের গাড়ি থামে ওকে দেখে। গাড়ি থেকে নেমে আসে এক পুলিশ সার্জেন্ট।

ভাইজান কি কপালকুণ্ডলার নাহান পথ আরাইছেন?

গভীর রাতে নীরব ঢাকা শহরের রাজপথে একজন পুলিশ সার্জেন্ট আঞ্চলিক ভাষায় বঙ্কিমের নায়িকার সংলাপ দিয়ে তাকে প্রশ্ন করছে। বেশ অবাক ব্যাপার ! আজকাল পুলিশেরা উপন্যাসও পড়ে তাহলে?

ভাইজানে আমার কথা হোনেন নাই?

কী কথা আপনার?

এতো রাইতে — সে ঘড়ির দিকে তাকায়, রাইত সাড়ে তিনটায় আপনে এইহানে। কি করতাছেন?

ঘুরে ঘুরে রাতের ঢাকা শহর দেখছি।

পুলিশ সার্জেন্ট একটা সিগারেট ধরায় মুখ ভরে ধোয়া ছাড়ে — ভাইজানের কি লেখা টেখ্যার অসুখ আছে ?

মানে?

মানে আমি যহন ইউনিভার্সিটিতে পরতাম তহন আমার একজন রুমমেট আছিল— নাম, খাড়ান , মনে কইরা লই— ঝিমমেরে একটু ভাবে পুলিশ সার্জেন্ট মনে পড়ছে ভাইজান। হ্যার নাম আছিল— কামরান খলিল। সেয় লেখালিখি করতো তো সেই লেখার লাইগা রাইতে শহর ঘুইরা বেড়াইতো। শুনছি— এখন দেশের বাইরে আছে। হের লাইগা জিগাইতেছি─ আপনে

না, আমি লেখক নই।

তাইলে?

 একটা কারণে আমার মন খুব খারাপ — তাই

ভাইজানে করেন কি?

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

পুলিশ সার্জেন্ট একটু ভাবে, তারপর আরও কাছে আসে — ঘটনাটা কি পেলেন জনিত?

হাসে হাবীব, কথা বলে না।

বুঝছি─ ভাইজান। ওইসব ন্যাকা ব্যাপারে বেশি সময় দিয়েন না। অল্প বয়স হলে চলে যান। নাকি গাড়িতে পৌছাইয়া দিমু?

না আমি যেতে পারবো।

আইচ্ছা — পুলিস সার্জেন্ট গাড়িতে ওঠে। হাবীব আবার রাতের নি : শব্দ ঢাকায় হাঁটতে থাকে।

সে বিধ্বস্ত উদ্ভট এক চেহারা নিয়ে সকালে রুমে ঢোকে।

বন্ধুরা দেখে হতবাক।

কী হয়েছে তোর?

কারও জিজ্ঞাসার কোনো জবাব না দিয়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার সেই ঘুম ভাঙে বিকেলে। রুমের বন্ধু মাসুদ কামাল একটু অবাক। হাবীব যা কিছু করে রুটিন অনুযায়ী করে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করা, বাথরুমে যাওয়া, গোসল করা, একটি সুনির্দিষ্ট সমতার তালে তালে করে। গোসল সেরে হাবীব সারাদিনের নজের তালিকা তৈরি করে। এই তালিকার মধ্যে ক্লাস, টিউশনি, কম্পিউটার শেখা, পত্রিকা পড়া, আড্ডা দেওয়া সব কিছুই থাকে। অনেকে ডাকে মানব রোবট বলে। নিয়মের বাইরে সে যেতে পারে না। নিয়মের বাইরে গেলে হাবীব খুবই অস্বস্তিবোধ করে। মনে হয় আকাশ থেকে হঠাৎ একটি প্রয়োজনীয় নক্ষত্রের পতন হয়েছে। দিনটাই খারাপ যায়। প্রমিলা বিষয়ক জটিলতার কারণে সে মেয়েদের সবসময় এড়িয়ে চলে। ধানমন্ডিতে গাজী মোবারকের মেয়ে খালেদা ইয়াসমিনকে পড়ায় হাবীব।

খালেদা পাবদা মাছ টাইপের মেয়ে। পড়ে ইন্টারমিডিয়েটে। ভাবখানা এমন করে যেন সে রোমের রূপসী। ঢলে ঢলে পড়ে। গায়ের মাংস হাড় থেকে বের করে দিতে চায় খাবারের থালায়।

Series Navigation<< উপন্যাস।। সুবর্ণ সর্বনাশ।। মনি হায়দার ।। চার

One thought on “উপন্যাস।। সুবর্ণ সর্বনাশ।। মনি হায়দার ।। পর্ব পাঁচ

  • সেপ্টেম্বর ৪, ২০২১ at ১০:১২ অপরাহ্ণ
    Permalink

    দারুণ একটা এপিসোড পড়লাম

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *