ছোটগল্প

ছোটগল্প।। রাশি বদল।। রফিকুর রশীদ

মানুষের রাশি কখনো বদলে যেতে পারে?

            রাশি বদলের কথা শুনে দিয়া প্রথমে বিস্ময়ে দু’চোখ গোল গোল করে আমার মুখের দিকে তাকায়, আমার চোখমুখের মানচিত্র থেকে দুষ্পাঠ্য কী যেন পড়ে নেয় চট করে, তারপর আমার গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলে ওঠে,

             যাহ্! তাই কখনো হয়?

            রাশিফল-টাসিফলে সত্যিই আমার তেমন ভরসা নেই। সে কথা দিয়াকে আমি বহুবার বলেছি। নিরেট বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও মহাশূন্যে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান এবং মানবজীবনে তার অপ্রতিরোধ্য প্রভাবের ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকতেই চায় না।

            দিয়া আছে উল্টো মেরুতে। মহামতি কিরো সাহেবের উপরে তার অগাধ আস্থা। বাংলা ভাষায় লেখা ‘হাতের রেখা কথা বলে’ নামের বইটি নিয়ে বিস্তর ঘাটাঘাটি হয়েছে, তারপর চলছে ইংরেজিতে লেখা একাধিক অ্যাস্ট্রোলজি বইয়ের পাতায় পাতায় নিবিড় চাষ। তার ভ্যানিটিব্যাগে সব সময় গোলাকার অতশী কাচ থাকে। হাতের রেখায় প্রবল কৌতূহল। শিশু হোক, বৃদ্ধ হোক, সুযোগ পেলেই হাতের তালু মেলে ধরে, হাতের দুর্বোধ্য রেখার ফাঁকে ফাঁকে লাঙল চালায়; আবার আবোল-তাবোল হাজার কিসিমের প্রশ্ন করে বিব্রত করে। কে যে তার মাথায় এই নেশা ঢুকিয়েছিল সে কথা আর মনে করতে পারে না দিয়া, তবে স্বপ্নময় এই মজার জগতে বেশ ঘোরের মধ্যেই ডুবে থাকে সে। কেমন অনায়াসে আমাকে সে বলতে পারে,

            এ জগতের সন্ধান তুমি পাবে কী করে!

            কেন, তোমার ওই জগতের গেটে কি খুব শক্ত তালা-চাবি আঁটা আছে?

            এবার সে হাসিতে লুটিয়ে পড়ে। বাতাবি ফুলের মতো শুচিশুভ্র হাসি ছড়িয়ে বলে, এই জন্যেই তো বলি-পদার্থবিজ্ঞান পড়তে পড়তে তুমি নিরেট অপদার্থ হয়ে গেছ।

            অপমান গায়ে না মেখে আমি শুধাই,

            অপদার্থ মানে জানো?

            তোমাকে দেখলেই তো জানা হয়ে যায়। এর জন্যে অভিধান ঘাটতে হবে নাকি!

বেশি হয়ে যাচ্ছে না দিয়া?

            দিয়া এবার খপ করে আমার হাত চেপে ধরে,

            ও বাব্বা! বাবুর কি ঠোঁট ফোলানো হচ্ছে!

            না না, অপদার্থের আবার ঠোঁট ফোলানো!

            আমার ডান হাত ছিল দিয়ার হাতের মুঠোতেই। সেই হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে হঠাৎ সে বলে, এই দাঁড়াও দাঁড়াও, দেখি তোমার হাতের তালুটা দেখি!

            আমারই হাসি পায়। তবু কপট গাম্ভীর্যে বলি,

            তুমি বহুবার দেখেছ আমার হাতের রেখা…….

            তা দেখেছি। তবু মেজাজটা আজ কেমন খটমটে! হলোটা কী!

            অ। হাতের রেখা কি মেজাজের খবরও দেয়?

            দেয় দেয়। হাতের মুঠি খোলো তো দেখি!

            নতুন করে কী দেখবে! আমার হাতের সব রেখাই তো তোমার মুখস্থ!

            আহা বিরক্ত করো না তো! মুঠি খোলো।

            কী মুশকিল! আজ কি হঠাৎ পাল্টে গেল হাতের রেখা?

            না না, পাল্টায়নি হয়তো।তবু আমি বৃহস্পতির অবস্থানটা জানতে চাইছিলাম।

            দিয়ার কথায় আমি মোটেই গুরুত্ব দিই না, ফুৎকারে উড়িয়ে দিই,

            আরে ধ্যাৎ! রাখো তোমার বৃহস্পতি!

            তুমি এভাবে অবজ্ঞা করতে পার না তুহিন!

            এবার আমি হেসে উঠি। হো হো করে হাসতে হাসতে করুণ কথাটাই বলে ফেলি,

            আমার যে শনির দশাই শেষ হচ্ছে না দিয়া।

            দিয়া চমকে উঠে আমার চোখের দিকে তাকায়। সেখানে অশ্রু নাকি অগ্নিকণা ঝিকমিকিয়ে ওঠে আমি জানি না। চোখের পাতা নামিয়ে এনে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিই ঠান্ডা গলায়, নেপোলিয়ানের মতো করে আমিও চাকু দিয়ে চিরে ফাঁক করে নেব আমার ভাগ্য রেখা।

            আমার উচ্চারণের দৃঢ়তায় যেনবা বিমূঢ় হয়ে পড়ে দিয়া। বেশ কিছুক্ষণ নির্বাক স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। আমার চোখের দিকে চোখ মেলে তাকাতেও যেন তার ভয়। তখন অগত্যা আমাকেই বাঁধ ভেঙে এগিয়ে আসতে হয়। এবার আমিই দিয়ার হাত ধরে বলি,

            ও সব কথা থাক। তোমার সেই সপ্তর্ষিমন্ডলীর গল্প বলো শুনি।

            দিয়া ভীরু চোখে তাকায় আমার মুখের দিকে, কিন্তু নিজে মুখ খোলে না। কবে যেন একদিন পৌরাণিক কেচ্ছা শোনাতে শোনাতে সপ্তর্ষিমন্ডলীর মধ্যে আমাকে ঢুকিয়ে ফেলেছিল। সাত ঋষির আসন দিয়েছিল আমাকে। ঋষি বশিষ্ঠ! তার মুখে শোনার আগে কখনো এ নাম শুনিনি। অরুন্ধতীর কথা অনেক শুনেছি। তারই অন্যনাম শুনেছি স্বাতী তারা। আমার পছন্দ অরুন্ধতী, অরু। দিয়াকে আমি উসকে দেয়ার চেষ্টা করি,

            আহা, তোমার সেই অরুন্ধতীর গল্প বলো না শুনি।

            বলেছি তো সেই গল্প। তুমি কিছুতেই বশিষ্ঠ হতে চাওনি সেদিন।

            কী মুশকিল, আমার কি সেই যোগ্যতা আছে!

            তাহলে আমাকে অরু বলার মানেটা কী?

            ওই নামটা আমার খুব পছন্দ যে!

            না না, আমিও অরুন্ধতী হতে পারব না।

            বেশ তো তুমি দিয়াই থাকো। দিয়াকে দিয়েই চলবে আমার।

            দিয়া খুব খুশি হয়। খুশিতে ডগোমগো হয়ে জাপটে ধরে আমাকে। বলা নেই কওয়া নেই, দুম করে আমার গালে একটা চুম্বন এঁকে দিয়ে বলে,

            তাহলে চাকু দিয়ে হাতের রেখা কাটার কথা আর কখনো বলবে না বলো!

            দিয়ার ব্যাকুলতা দেখে আমার খুব হাসি পায়। হাসতে হাসতেই বলি,

            আচ্ছা, বলব না। তবে কাজটা করতে হবে।

            অমা, কী কাজ!

            কেটেকুটেই হোক আর যে-ভাবেই হোক-ভাগ্যরেখাটা বদলে ফেলতে হবে।

            তা কেটেকুটে কেন?

            বেশ, তাহলে খেটে খুটেই হবে। অপ্রসন্ন চাকরিভাগ্য যে বদলাতেই হবে!

            অ, তাই বলো। আমি দেখেছি-মেঘ সরে গেছে, বৃহস্পতি এগিয়ে আসছে, উজ্জ্বল আলোয় দিগন্ত উদ্ভাসিত হচ্ছে,তুমি হাত না দেখালেও আমি ঠিকই জানি।

            বাব্বা! তবে আর ভাবনা কী?

            না, ভাবনা নেই তো! প্রজাপতি উড়ছে উড়ছে……. কাঁধে এসে বসলেই হয়।

            প্রজাপতির কথায় আমার তো কাজী নজরুলকে মনে পড়ে যায়। সেই যে কোন ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি ‘প্রজাপতি প্রজাপতি, কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা’, শুনেই আসছি বটে, কিন্তু অসাধারণ ওই রঙিন পাখার রহস্যের কিছুই উদঘাটন করতে পারি নি। সত্যি বলতে কি, আমার এই দিয়াকেই কখনো কখনো নজরুলের প্রজাপতির মতো রঙিন আর ছেলেমানুষ মনে হয়। সে-কথা আমি দিয়াকেও বলেছি। বিশ্বাস করেনি দিয়া। হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। বরং নজরুলের কথা উঠে পড়ায় সে মজার এক গল্প শুনিয়েছে। কবি নজরুলেও নাকি ভয়ানক নেশা ছিল হস্তরেখা গণনার। পাত্র-অপাত্র নেই, তাঁর সামনে যে কেউ হাতের তালু মেলে ধরলেই হলো, শুধু ভাগ্যরেখা আর আয়ুরেখা নয়, গ্রহ নক্ষত্রের ফাঁকফোঁকর গলে আরো কত শত যে রেখা-উপরেখা আবিষ্কার করে তিনি বিমল আনন্দে হেসে উঠতেন, তার ইয়ত্তা নেই। সেই নজরুল নাকি একবার ঢাকায় এসে হাত দেখেছিলেন ফজিলাতুন্নেসার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা প্রথম বাঙালি মুসলিম নারী গ্র্যাজুয়েট। পরে গণিতে এমএ। এই ভদ্র মহিলার হাত দেখে কবি নজরুল এতটাই মুগ্ধ এবং আপ্লুত হন যে হৃদয়ের গভীরে প্রবল প্রণয় অনুভব করেন। সে অনুভূতি নিজের মধ্যে গোপন রাখতে পারেননি। প্রকাশ করে বসেছেন। সাড়া পাননি ফজিলাতুন্নেসার কাছ থেকে, যেমনটি তিনি চেয়েছেন। তবু তিনি পরবর্তীতে কবিতা ও গানে দৃশ্যাতীত স্পর্শ রেখে গেছেন তাঁরই জন্য। দিয়া খুব সুন্দর করে বলে- কবির শক্তি এমনই, উপেক্ষা দিয়েও অতিক্রম করা যায় না। শেষ পর্যন্ত জিতে যায় কবিতাই।

            বাপরে বাপ! দিয়ার কণ্ঠে এমন কাব্যানুরাগের কথা শুনে আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। পদার্থবিজ্ঞান পড়ে আমি অপদার্থ হয়ে গেছি, এমন অভিযোগ যতোই করুক, দিয়া বেশ ভালোই জানে- কবিতার প্রতি আমার একটুখানি গোপন পক্ষপাত আছে। আধুনিক কবিতার মানে-টানে বিশেষ কিছুই বুঝি না, তবু গলা কাঁপিয়ে প্রগাঢ় উচ্চারণে কবিতা আবৃত্তি করতে ভালো লাগে। এ নিয়ে দিয়া আমাকে কম কটাক্ষ করেনি। সে গরল আমি মুখ বুজে পান করেছি। সে বলেছে- কবিতা নয় নাটকেই তোমার গলা খুলত ভালো। তোমার উচ্চারণে নাটুকে নাটুকে ভাব আছে বেশ।

            কী মুশকিল, নাটকের কী দেখলে! আমি তাকে বুঝাতে চেষ্টা করি- আমি তো অভিনয়ই বুঝি না। ওটা আলাদা আর্ট।

            কোনো উত্তর না দিয়ে সে খিলখিলিয়ে হাসে।

            আমি অবাক হয়ে শুধাই,

            হাসির কী হলো?

            সে হাসতেই থাকে।

            আহা, হাসছ কেন?

            হাসিতে গড়িয়ে পড়ে দিয়া। উনুনের তপ্ত বালুতে খই ফোটার মতো সে হাসি। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনাধারার মতো উচ্ছল সে হাসি। উদ্দাম।

দুই.

            দিয়ার সে হাসি যে মোটেই অকৃত্রিম ছিল না, সেটা জানার সুযোগ হলো মাত্র কয়েকদিন পর। নাহ্, খই ফোটা কিংবা ঝরণাধারার মতো বলা তো চলে না। কাঁচের চুড়ির মতো ভঙ্গুর সে হাসি। দুই বছরেরও অধিক সময়ের চেনাজানা আমাদের, এর মধ্যে কত কথা হয়েছে, পরস্পরের কাছে আমরা কতভাবে মেলে ধরেছি, সবই মিথ্যে হয়ে গেল শওকত শাহিনের ফোন পাবার পর।

            কে এই শওকত শাহিন, আমি মোটেই চিনি না, জানি না, দিয়ার মুখে কখনো এই নামটি শুনেছে বলেও পড়ে না। অথচ কী যে ভৌতিক কান্ড দিয়ার ফোন থেকে বারবার এই পুরুষকণ্ঠটি ভেসে আসছে, নিজের পরিচয় দিচ্ছে শওকত শাহিন নামে, দিয়াকে যতোবার ফোন করি, ততোবার ওই কণ্ঠ জানায়- দিয়াকে যা বলার আমাকে বলতে পারেন।

            কেন, আপনাকে বলতে যাব কেন? কে আপনি?

            নিরুত্তপ্ত কণ্ঠে হে হে করে হেসে বলে,

            অসুবিধা নেই আমাকে বলতে পারেন, আমি জানিয়ে দেব দিয়াকে।

            আমি তো ফোন করেছি দিয়ার নম্বরে। আপনি ফোনটা দিয়াকে দিন!

            ভব্যতাহীনভাবে শওকত শাহিন বলে,

            আপনাদের প্রেম ভালোবাসাবাসির সব কথাই আমাকে জানিয়েছে দিয়া। লুকানোর কিছু নেই, আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। আপনাদের গভীর প্রণয়ের কথা জেনেও দিয়াকে আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি আমাদের পারিবারিক সিদ্ধান্তে। দিয়া নিশ্চয় ইনভাইট করবে আপনাকে।

            আমার দুই কানের মধ্যে তপ্ত সীসা গলে পড়ে। আমি বধির হয়ে যাই। আমি যেনবা উন্মাদ হয়ে যাই। নীলক্ষেত মোড়ে ভিড়ের মধ্যে আমার মোবাইল হারিয়ে যাবার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিজের নাম্বারের সিম তুলে সস্তায় কেনা চাইনিজ মোবাইল সেটে লাগিয়েছি। যেকোনো মুহূর্তে আমার এই নাম্বারে চাকরিপ্রাপ্তির শুভবার্তা আসতে পারে বলেই আমি ফোন কিনতে একটুও দেরি করিনি। পুরানো নাম্বারের সিম তুললেও হারিয়ে যাওয়া নাম্বারগুলোর জন্যে মন খারাপটা থেকেই যায়। দিয়ার নাম্বার স্মৃতি হাতড়ে ঠিকই বের করে আনি এবং নতুন ফোন থেকে প্রথমে যোগাযোগ করতে চাই দিয়ার সঙ্গেই। কিন্তু ফোন রিসিভ করে এই শওকত শাহিন। একবার দুবার তিনবার…. বারবার ওই একই ঘটনা। আমি দুই চোখ রগড়ে মোবাইলের মনিটরে তাকাই- কোনো ডিজিট টিপতে ভুল হলো নাকি! জিরো ওয়ান সেভেন ওয়ান ফাইভ… জিরো সিক্স… টু সেভেন.. নাহ্, সবই তো ঠিক আছে! তবু ওই উৎপাত- শওকত শাহিন।

            সে রাতে আমার আকাশ থেকে সব তারা টুপটাপ করে খসে পড়ে। আকাশ জোড়া সব কারুকাজ ঢেকে যায় যায় নিরেট অন্ধকারে। আমি তখন কী করি! এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আসে না। বিছানায় শয্যাকণ্টকি হয়, তখন শয্যা ত্যাগ করে সারা মেঝে পায়চারি করি। মাথার মধ্যে ঘূর্ণি ওঠে, ঘুরপাক খায় দিয়ার ভাবনা। হিসেব মেলাতেই পারি না- হঠাৎ কী হলো দিয়ার! শুনেছি ওদের পরিবারে সবাই আমার নাম জানে, আমাদের রিলেশনের ব্যাপারটাও অনেকটা ওপেন সিক্রেট, কেবলমাত্র দিয়ার বাবাই নাকি মেয়ের নিজস্ব পছন্দের ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেন না। আমার অযোগ্যতাই তাঁর অপছন্দের প্রধান কারণ কিনা সেটা স্পষ্ট বুঝার উপায় নেই। জীবনসঙ্গী তো দূরের কথা, দিয়া নিজে থেকে কোনো কিছু পছন্দ করতে পারে এটাই তাঁর বিশ্বাস হয় না। এ সব শুনে আমি অনেক সময় ঠাট্টা করেছি- হায়রে পিতৃহৃদয়! অপত্য স্নেহ  কি এমনই অন্ধ হয়! তোমাকে হয়তো কচি খুকিটিই ভাবছেন এখনো।

            দিয়া তার বাবার বিশালতার গল্প শুনিয়েছে। স্নেহকোমল মানুষটির অন্তরে যে কন্যার প্রতিই বিশেষ পক্ষপাত আাছে, সে গল্পও কয়েক দফা শুনিয়েছে। তারপর দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছে- আমার চাকরি-বাকরি হবার পরেই সে বাবার সামনে আমাকে উপস্থাপন করবে। চাকরি তো আমার হবেই, একটুখানি সময়ের ব্যাপারমাত্র, এ ব্যাপারে আমিও দৃঢ়প্রত্যয়, দিয়াও প্রবল আশাবাদী। কিন্তু, কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল- আকাশকালো মেঘ এসে সব আলো নিমেষেই মুছে দিল!

            সকালে ওঠে পুরানো কাগজপত্র ঘেঁটে শিপ্রার ফোন নম্বর খুঁজে পাবার পর স্বস্তি নেমে আসে বুকে, এবার হয়তো ভেতরের খবরটা ঠিকঠাক পাওয়া যাবে। দিয়ার মামাতো বোন শিপ্রা। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। ভারি ঠোঁটপাতলা স্বভাবের। মুখে যা আসে দুমদাম করে তাই বলে ফেলে। আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা খুব ভালোই জানে সে, তবু একদিন তামাশা করে বলে- দিয়া আপু, তোমার ওই গোবেচারা লাভারটাকে ছেড়ে দাও না! আমিও একটু প্রেম করে দেখি।

            কী আশ্চর্য, এ কি আচার না চাটনি যে মন চাইলেই চেখে দেখতে হবে। দিয়া কপট চোখরাঙানিতে শিপ্রাকে শাসন করে। এদিকে আমাকেও গোপনে শাসিয়ে দেয়া হয়- শ্যালিকা হইতে সাবধান। বলা যায় না, কী হইতে কী না হয়! রাক্ষুসীর কুদৃষ্টি পড়েছে তোমার ওপরে। বেশি ফোনাফোনি করো না।

            আমি ফোন না করলেও যদি শিপ্রা ফোন করে, আমি তখন কী করব! কত কথা যে খলবলিয়ে বলে মেয়েটি! দিয়া কষ্ট পাবে ভেবেই আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। নিজে থেকে ফোন করিনি বহুদিন। অথচ এই ঘোর দুঃসময়ে সেই শিপ্রাকেই আঁকড়ে ধরতে হয়। কাগজের পাতা থেকে নাম্বার দেখে দেখে ফোন করি, রিংটোন বাজে ‘আমারও পরাণও যাহা চায়…’ তিনবারেও সাড়া না পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে যায়, মনের ভেতরে খচখচ করে প্রশ্ন- কী সুখেই যে মানুষ এত বেলা অব্দি ঘুমোয়! ঘড়ির কাঁটা নটার ঘর পেরিয়া যাবার পর শিপ্রা নিজে থেকে কল ব্যাক করতেই আলো ফোটে মনের আকাশে, পাখি ডানা মেলে দেয় দূরের তৃষ্ণায়! কিন্তু কান খাড়া করতেই টের পাই- শিপ্রার কণ্ঠে বিষন্ন তার ঢেউ আছড়ে পড়ছে। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে গত শনিবারে সে ঢাকা থেকে নীলফামারী গেছে। গত রাতে ছিল দিনাজপুর মেডিকেলে মায়ের শয্যাপাশে। এমন বিপন্ন বেলায় আমার ফোন সে আশাই করেনি। একেবারে চমকে ওঠে প্রশ্ন করে, ‘তুহিন ভাই, আপনি!’

            ওদের এতসব বিপদ আপদের কথা শোনার পর দিয়াকে নিয়ে আমার উদ্বেগের কথা জানাতে খুব বিব্রত বোধ হয়। ফোন কেটে দেবার কথাও একবার ভাবি। কিন্তু সেটাও কি ভব্য আচরণ হবে! শেষে সব কথা গুছিয়ে খুব সংক্ষেপে বলতেই শিপ্রা টনটনে শক্ত হয়ে ওঠে, সোজাসুজি সে জানিয়ে দেয়,

            অসম্ভব! দিয়া আপু আপনাকে ছাড়া ভাবতেই পারে না।

            তাহলে আমার ফোন ধরছে না যে!

তাই তো আজ কদিন আমার যে ব্যস্ততায় গেল, কারো সঙ্গে আমি ফোনে কথাই বলতে পারিনি।

            না না, তোমার কথা হচ্ছে না। দিয়ারও কি কোনো বিপদ-আপদ হলো!

আপদ তো একটা আছেই কাঁধে চেপে। কী যেন নাম বললেন আপদটার!

            শওকত শাহিন। কে বলো তো লোকটা? তুমি কি চেনো?

            অ মা, আমি চিনব কী করে?

            তার দাবি অনুযায়ী অচিরেই সে তোমার মামাতো দুলাভাই হতে যাচ্ছে। তোমাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে এ নামে কেউ আছে নাকি?

            শিপ্রা টেনে টেনে উচ্চারণ করে নামটা… শওকত… শাহিন! নাহ্, মনে পড়ছে না তো! মামির দিকের কেউ আছে কি না তাও তো জানি না।

            তুমি একবার ফোন করেই দেখ না শিপ্রা।

            একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে শিপ্রার ফোনে। তারপর সে বলে,

            আপনি কি জানেন তুহিন ভাই- আপনার সঙ্গে ফাজলামো করেছিলাম বলে দিয়া আপু আমার সঙ্গে অনেকদিন কথাই বলে না ভালো করে!

            তাই নাকি!

            তবে আর বলছি কী! আপনার সঙ্গে প্রেম করতে চেয়েছি যে! সহ্য হয়!

            কিন্তু এখন সে কী করছে বলো!

            না না তুহিন ভাই, এভাবে বলবেন না। নিশ্চয় কোথাও একটা গিঁট বেঁধেছে।

            স্যরি। তাহলে এই শওকত শাহিন কে, সেটা বলবে তো?

            আমি কেমন করে বলব বলুন! খোঁজ নিয়ে দেখছি দাঁড়ান।

            কৃতজ্ঞতায় আমি গদগদ হয়ে বলি,

            প্লিজ শিপ্রা, প্লিজ।

            আমাকে হাসানোর জন্য শিপ্রা কৌতুক করে ওঠে,

            আপনাদের হাতের রেখায় কী বলে তুহিন ভাই- বিবাহবন্ধন নাই? হস্তরেখাবিদ বোন কি তবে নিজেদের হাত মিলিয়ে দেখেনি এতদিন?

            সে কথা তোমার বোনকেই শুধাও তাহলে!

তিন.

            অবশেষে আমার চাকরিভাগ্য প্রসন্ন হয়ে ওঠে। মোবাইল ফোনে বার্তা আসে, এমন কি কম্পিউটারে মুদ্রিত নিয়োগপত্রটিও হাতে এসে পৌঁছে। এই সুসংবাদ অতি দ্রুত দিয়াকে জানাবার জন্য আমার বুকের ভেতরে আকুলি-বিকুলি করে ওঠে। কিন্তু উপায়! দিয়ার নাম্বারে ফোন করলেই তো সেই গেরো- শওকত শাহিন।

            হ্যাঁ, এরই মাঝে শিপ্রা এই উৎকট উপদ্রব শওকত শাহিনের পরিচয় আষ্কিার করে জানিয়েছে আমাকে। দিয়ার বাবা কয়েকদিন আগে অসুস্থ বোনকে দেখতে গিয়েছিলেন নীলফামারীর জলঢাকায়। কথায় কথায় তখনই কেচ্ছা জানা গেছে। শওকত শাহিন হচ্ছে দিয়ার মায়ের খালাতো বোনের ছেলে। কানাডা প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার। দু’মাসের জন্য দেশে এসেছে। শওকত শাহিনের মা দিয়ার সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিতে চান। দিয়ার বাবা এমন সুপাত্র হাতছাড়া করবেন কিনা ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, অপেক্ষায় আছেন- মেয়ে যদি রাজি হয়।

            আমি ভাবতেই পারি না- দিয়া রাজি হবে এই প্রস্তাবে? কী করে জানাই তাকে- এখন আমি আর বেকার নই, পরশু সকালে খুলনা যাচ্ছি কাজে যোগ দিতে। না, কাল সকালে মতিঝিলে গিয়ে হেড অফিস থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিতে হবে, তারপর খুলনা। এ সবই শিপ্রাকে ফোনে জানিয়েছি। কিন্তু শওকত শাহিনকে জানাতে ইচ্ছে করেনি। এরই মধ্যে আমার সঙ্গে দু’এক দফা ভাব জমানোরও চেষ্টা করেছে লোকটা। ঘেন্নায় আমার গা রি রি করেছে। সে একটা দস্যু তস্কর, আমার আকাশ থেকে লুট করে নেয় একমাত্র চাঁদ, তার সঙ্গে কিসের ভাব!

            কী যে অবাক কান্ড- মতিঝিলে আমাদের হেড অফিসে ঢোকার মুখেই দেখি ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়িয়ে আছে দিয়া। মাত্র এই কয়দিনের অদর্শনে কী দশা হয়েছে চেহারার! তার চোখের দিকে তাকানো যায়না। কিন্তু দিয়ার পাশে দাঁড়ানো লোকটি কে? সুদর্শন, সপ্রতিভ চেহারা, ঠোঁটের ফাঁকে দুষ্টুমিভরা হাসির আভা।

            দিয়া আমার হাতে পুষ্পগুচ্ছ তুলে দিতেই লোকটি হাত বাড়িয়ে দেয় হ্যান্ড শেক করার জন্য, গালভরা হাসি ছড়িয়ে নিজের পরিচয় বলে- আমি শওকত শাহিন।

            শওকত শাহিন! মানে এই সেই দুর্বৃত্ত! একজন ভদ্রলোক এতটা নির্লজ্জ হয় কী করে- আমার দিয়াকে কেড়ে নিয়ে আবার আমরাই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আমাকে পরিহাস করার জন্য! ঘৃণায় ক্ষোভে আমি তার দিকে তাকাতে পারি না। কিন্তু দিয়াই বা এটা করল কীভাবে! দুজন মিলে হাত ধরাধরি করে ধেই ধেই নাচতে নাচতে চলে এসেছে আমার অফিসের ঠিকানায়। আমাকে অপমান করা ছাড়া এখানে কী কাজ তাদের?

            এক পা এগিয়ে এসে শওকত শাহিন সহাস্য বদনে আমার কাঁধে হাত রেখে কেমন অবলীলায় প্রশ্ন করে, কিছুতেই রাগ পড়ছে না, তাই তো?

            আমি মুখ ফিরিয়ে নিই। লোকটা উচ্চৈঃস্বরে হা হা করে হাসতে হাসতে বলে,

            চাকরি প্রাপ্তির এই সুসংবাদটি শোনার জন্য দিয়ার কী যে অধীর প্রতীক্ষা! অথচ সেই সংবাদটি তাকে পেতে হলো নীলফামারীর শিপ্রার কাছ থেকে। কেন, তাকে কি ফোন করা যেত না জনাব?

            উত্তেজনায় আমার কণ্ঠ কেঁপে ওঠে,

            আপনার জন্যই তো….

            কেন, কেন? আমি তো আগেই বলেছি- যে কোনো খবর আমাকে বললেই তা দিয়াকে পৌঁছে দেব। বলিনি?

            আমার কিছুই বলতে ইচ্ছে করে না। সামনে থেকে সরে যাবার পথ খুঁজি মনে মনে। শওকত শাহিন এক মুখে শত কথা বলে যায়- দিয়ার সে কি স্ট্রং কনফিডেন্স, চাকরি সে পাবেই। তুহিন চাকরি পেলেই বাবার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াবে দুজন। প্রয়োজনে তখন বিদ্রোহ করবে।

            দিয়ার মুখের দিকে আমি একবার তাকাই। কিন্তু শওকত শাহিন তখন দিয়াকে ধমকানো শুরু করেছে- কার জন্য বিদ্রোহ করবে তুমি, এই ভীরু নাবালকের জন্য?

            একে নিয়েই চলবে তো সারা জীবন! হাতের রেখা কী বলে, মিলিয়ে দেখেছ?

            আমার মাথা ঝিমঝিম করে। শওকত শাহিনের বকবকানি মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে দেয়। আমি তবু শিষ্টতা বজায় রেখে বলি,

            আমাকে অফিসে যেতে দিন প্লিজ।

            যাবে। নিশ্চয় যাবে। শওকত শাহিন এবার আমার দু’হাত জড়িয়ে ধরে বলে-

            তার আগে আমাকে ক্ষমা চাইবার সুযোগটুকু দাও। আজ ক’দিন তোমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছি, দিয়ার ফোন কেড়ে নিয়েছি, সবই করেছি তোমাদের সম্পর্কের গভীরতা বুঝবার জন্য। আমার যা বুঝার তা বুঝেছি। তুমি অফিস থেকে বেরুলে আমরা কোথাও বসতে চাই। কথাবার্তা সব গুছিয়ে ফেলতে চাই।

            আমার মাথার মধ্যে আবার সব তালগোল পাকিয়ে যায়। আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকাই দিয়ার মুখের দিকে। আমার চোখের ভাষা থেকে সে কী যে পাঠ করে নেয়, দ্রুত আমার কাছে এসে হাতে হাত রাখে, কী যেন বলতে চায়, কিন্তু বলা হয় না। চোখের পাপড়ি প্রতিরোধ ভেঙ্গে গড়িয়ে পড়েছে দু’ফোঁটা অশ্রুদানা।

            আমি আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। পা বাড়াই অফিসের দিকে। শওকত শাহিন আবারও মাথা পেঁচিয়ে আমার সামনে এসে বলে- শোনো হে ব্রাদার, তোমরা দুজনেই আমার বয়সে ছোট! রেস্তা বোঝো? রেস্তায়ও আমি বড়ো। কাজেই আমার কথা শুনতে হবে। আজ সন্ধ্যাতেই খালুজানের সামনে তোমাকে প্রেজেন্ট করতে চাই। যাও, তুমি অফিস থেকে এসো।

            এতক্ষণে আমি যেন গার্জেনগিরির কণ্ঠস্বর শুনতে পাই শওকত শাহিনের উচ্চারণে। দিয়ার খালাতো ভাই, রেস্তায় মুরুব্বি বটে; তাই বলে এসব কোথা থেকে কী যে হয়ে যাচ্ছে আমি যেন হিসেব মিলিয়ে উঠতে পারি না। লোকটির কণ্ঠ শুনে সারা দেহে মনে যে বিরক্তি ছলকে উঠেছিল, এখন আর সেই অনুভূতি যেন টের পাইনে। দিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বলি,

            তোমার কি মনে পড়ে দিয়া- মানুষের রাশিবদলের কথা শুনে তুমি খুব হেসেছিলে!

            দিয়া ঘাড় দুলিয়ে সম্মতি জানায়। তার মনে পড়ছে নিশ্চয় প্রেমে পড়লে মানুষের রাশি বদলে যাবার কথা আমি তাকে শুনিয়েছিলাম। আজ আবার তাকে আমি সগৌরবে জানাই- আমি নিশ্চিত দিয়া, আমার রাশি বদলে গেছে।

            দিয়া স্মরণ করিয়ে দেয়, তুমি তো তুলা রাশির জাতক।

            সে আমি ছিলাম বটে। গণনা করলে দেখবে সে রাশি এখন বদলে গেছে!

            এতক্ষণে শওকত শাহিনও যোগ দেয়,

            ভেরি ইন্ট্রাস্টিং! এখন কী রাশি হয়েছে?

            প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া রাশির তো একটাই নাম গাধা-রাশি।

            সকল ভব্যতা ভুলে শওকত শাহিন উচ্চৈঃস্বরে হা হা করে হেসে ওঠে।

আমিও হাসিমুখে বলে ফেলি,

            আমি আসছি ভাইজান।

            আচ্ছা এসো।

রফিকুর রশীদ গাংনী, মেহেরপুর।

২ thoughts on “ছোটগল্প।। রাশি বদল।। রফিকুর রশীদ

  • আনোয়ার রশীদ সাগর

    ধনযবাদ লেখককে।সুন্দর একটি গল্প উপহার দেওয়ার জন্য।সেই সাথে ধন্যবাদ কাব্যলোককে।

    Reply
  • আনোয়ার রশীদ সাগর

    ধন্যবাদ লেখককে।সুন্দর একটি গল্প উপহার দেওয়ার জন্য।সেই সাথে ধন্যবাদ কাব্য অনুশীলনকে।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *