তিন রঙের তিনটি পাথর- পর্ব ৩ নীল পাথরের নীলঘুড়ি।।মালেক মাহমুদ
নীল পাথর হাতে নিয়ে হাসি দেয় কাশেম। পাথরের ভেতর দেখতে পায় একটি মাছের ছবি। মাছ ঘুড়ি হয়ে উড়ছে। মিশে যেতে লাগলো আকাশে। ছবির মতো ঘটে যেতে লাগল। নীল পাথর রেখে দিল পাথরের জায়গায়। তারপর ভাবতে লাগল–
গগনের রূপ নীল হয় দিনের বেলা। সাদাও হয়। কালোও হয়। গোধুলি রঙেও রাঙায় আকাশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি একাকার হয়ে মিশে যায়। প্রকৃতির কারণে ধরণীর বুকে ঘটে যায় নানা ঘটনা। রাতে কিম্বা দিনে। পাহাড় কিম্বা জমিনে। নবধারা সৃষ্টির উল্লাসে মাতয়ারা প্রকৃতি। নানা রকম পরিবর্তনের বৈচিত্র্যময় রেখা ফুটে ওঠে। কিশোরের মন পাখি হতে চায়। পর্বতের চূড়ায় উঠতে চায় মন। জানা ও বোঝার ভেতরে দেখা মেলে স্বপ্ন। নদীর ঢেউয়ের মত উতালপাতাল করে কিশোরের মন। চেনা জগতেই হয়ে যায় অচেনা। অচেনা জগতে চেনার স্বাদ গ্রহণ করার মজাই আলাদা। যেমন, একা আকাশ দেখা। আকাশের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নেওয়া। ভাবনার জগতে নিজে মিলিয়ে নেয়া বেশ আনন্দের মনে হয় কিশোর কাশেমের কাছে। বাংলাদেশে প্রকৃতির খেলার ভেতরে দেখা মেলে ছয়টি ঋতু। ঋতুগত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তীত হয় পরিবেশ। আমরা ছয় ঋতুর বাংলাদেশে ঋতু বৈচিত্র্যের আনন্দ উপভোগ করি। কিশোরমন আরও বাড়তি আনন্দ নেয়ার চেষ্টা করে যায়। সেই রকম আনন্দ উপভোগ করতে চায় কাশেম। পাখি হতে চায়। উড়ে দেখতে ধরণীর বুক। ইচ্ছে করলেই তো হয় না। স্বপ্ন পূরণে চেষ্টা থাকতে হয়। মনে জোর থাকতে হয়। মনের শক্তিই বড় শক্তি।
ভাবতে ভাবতে, পাহাড়ের পাদুদেশে দাঁড়িয়ে আছে কাশেম। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে একটি ঘুড়ি উড়ছে। কে উড়াচ্ছে এই ঘুড়ি? নীল আকাশের দিকে উড়ে যেতে চায় ঘুড়ি। কাশেমের হঠাৎ নীল পাথরের কথা মনে পড়ে যায়। নীল রঙের সঙ্গে সাদা মেঘের ভেলা উড়ে বেড়ায়।
ঘুড়ি আকাশে উড়ে। ঘুড়ির বুকে বেঁধে দিয়েছে সুঁতো। লাটাই ধরে আছে কিশোর। কে সেই কিশোর। কাশেমের মনে ঘুড়ি দেখার বাসনা জেগে ওঠে। যে চিন্তা সেই কাজ। বাতাসের গতি বেড়ে যায়। ছিঁড়ে যায় সুঁতো। ঘুড়ি উড়ে আসে কাশেমের কাছে। কাশেম নিতে চায় ঘুড়ি। আবার ভাবে, না, ঘুড়ি নেব না। এই ঘুড়ি তো আমার না। পরের ঘুড়ি কেন আমি নেব। আমি যেদিন নিজে ঘুড়ি বানাতে পারবো সেইদিন আমি ঘুড়ি উড়াব। আর সেই ঘুড়ি হবে সকল ঘুড়ির থেকে আলাদা। এই ভাবনা ভাবতে ভাবতেই জাবির এসে সামনে দাঁড়ালো।
দেখে কাশেমের হাতে ঘুড়ি। কাশেম হাসিমুখে ঘুড়িটি জাবেরের হাতে তুলে দিল।
কুশল বিনিময় শেষে কাশেম বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। কিছুদূর যাবার পরে চোখে পড়ে অল্প জলে মাছের খলবলানি। কাশেম দাঁড়ায়, এগিয়ে যায় জলের কাছাকাছি। দেখে নীল রঙের মাছ। এরকম মাছ সে এর আগে কখনো দেখেনি। মাছগুলো ধরার চেষ্টা করে। ধরবেতো রাখবে কোথায়?
জল থেকে উপরের দিকে উঠে। একটু হেঁটে ঘুরে তাকেতেই দেখতে পায় একটি নীল রঙের মাটির পাতিল। এত সহজেই পেয়ে যাবে পাতিল তা ভাবেনি কাশেম। কি যে সুন্দর সেই নীল রঙের পাতিল। নীল মাছ ধরে রাখে নীল পাতিলে।
বাড়িতে নিয়ে আসে। মায়ের কাছে নামিয়ে দেয় মাছের পাতিল। মাছগুলো দেখে হাসি দেয় মা। বাড়ির পুকুরে ছেড়ে দেয় নীলমাছ। একটি মাছ কিছুতেই পাতিল থেকে বের হচ্ছিল না। পুকুর জলে সেই নীলমাছটি আর ছাড়া হলো না। তাই, মা চিন্তা করেন এই মাছটি রান্না করবেন। রান্না করা হলো। নতুন এই মাছটি খাবার জন্য বাড়ির তিনজন একসঙ্গে জড়ো হলো। তিন টুকরো করা হয়েছে। বাবার পাতে মাথা। কাশেমের পাতে পেটি আর মায়ের পাতে লেজা। খাবার শেষে কাশেমের বাবা বলে এতো সুস্বাদের মাছ আর কখনো খায়নি। কাশেম এর মায়েরও এই মত। যে মাছগুলো পুকুর জলে ছেড়ে দেয়া হয়ে ছিল সেই নীলমাছগুলোর যত্ন বাড়িয়ে দিল। কাশেম ঘরে গিয়ে দেখে তার নীল পাথরটি নেই। কাশেম ভাবে লাল পাথর হারিয়ে পেলাম লাল হাঁস। নীল পাথর হারিয়ে নীলমাছ।
এক মাসে পুকুরে মাছে মাছে একাকার হয়ে গেল। প্রতিবেশীদের ডেকে নীলমাছ ভোজনের আয়োজন করে কাশেমের বাবা। সবাই এই মাছ খেয়ে বেশ খুশি হলেন। অল্প দিনের ভেতরে নীলমাছের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। নীলমাছের চাষ বেড়ে যেতে লাগলো গ্রামের পর গ্রাম। কাশেমের মনে আনন্দ দোলা দিয়ে যায়।
ঘুড়ির মত উড়তে থাকে মন। মনের আনন্দে নীলমাছের আদলে একটি নীলঘুড়ি বানাতে চিন্তা করে কাশেম। নীল পাথরকে স্বরণে রাখতে তার এই চেষ্টা। এই ঘুড়ি বানাতে কাশেমের সময় লেগেছে সাতদিন । নীল রঙের মাছ আকৃতির এই নীলঘুড়ি। নীলমাছের আনন্দে আনন্দিত হতে থাকে মন। সাতদিন পরে ঘুড়ি উড়িয়ে দিল আকাশে।