ঈদ সংখ্যা ২০২১- এর ছোটগল্প।। সন্দেহ।। জয়শ্রী দাস
গত বছর মিনহাজ সাহেব সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। তিনি একজন আবেগপ্রবন মানুষ। মেধাবী মিনহাজ সাহেব অবসর গ্রহণের পরপরই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে যান।
দুই সন্তান তাদের। দুজনই পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরি করছেন।
মিনহাজ সাহেব গল্প, উপন্যাস পড়তে পছন্দ করেন। আবেগ অনুভব করেন যখন কোন কষ্টের বা সুখের বই পড়েন। তিনি বই পড়তে পড়তে কখনো কাঁদেন, কখনো হাসেন। মিনহাজ সাহেবের স্ত্রী খুবই সন্দেহপ্রবণ। তার নাম দিলারা বেগম। বয়স পঞ্চাশ বছর।
এক বিছানায় শুয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে যখন মিনহাজ সাহেব বই পড়েন, তখন দিলারা বেগম মনে মনে রাগে চিৎকার করে উঠেন। যদিও মুখ থেকে কোন শব্দ বের হয় না। দিলারা বেগমের সন্দেহ তার স্বামীর হয়তো নতুন সম্পর্ক হয়েছে এই কারণে এমন করে কাঁদে আর হাসে।
তিরিশ বছরের সংসারে এযাবৎকাল তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। কারণ মিনহাজ সাহেব সকাল সাতটায় অফিসের উদ্দেশে বের হয়ে যেতেন, ফিরতে ফিরতে বেজে যেত সন্ধ্যা সাতটা। এরপর খাওয়া, টিভি দেখা
অতঃপর ঘুম। ছুটির দিনে তিনি সন্তানদের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু এখন জীবনের রুটিন অন্যরকম। চাকরির ক্ষেত্রে মাত্র দুই ঘণ্টা অফিস করতে হয়। আছে অখন্ড অবসর। মিনহাজ সাহেবের অজান্তে দিলারা বেগমের মনে সন্দেহের মাত্রা বাড়তে থাকে। এর মাঝে মিনহাজ সাহেবের স্ত্রী শারীরিকভাবে অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে নিয়ে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আনা হয়। কিন্তু দিলারা বেগমের শরীরের হাড় মাংসের চিকিৎসা করলেও মনের ভেতরে যে সন্দেহ নামক ভাইরাস বসে আছে তার চিকিৎসা করা হলো না। দেশে ফিরে মিনহাজ ভাবলেন তিনি মনোযোগ সহকারে তার অর্ধাঙ্গিনীর সেবা করবেন। এ কারণে তিনি চাকরি ছেড়ে দিলেন। এবার দিলারা বেগমের স্বরূপ প্রকাশ পেল।
-তুমি চাকরি ছাড়লে কেন?
-তোমার সেবা করব বলে।
-তুমি সারারাত বই পড়ছ কেন? কার সাথে ফোনে এত কথা বলো?
তার কথা বলার ধরণ দেখে মিনহাজ সাহেব হতভম্ব।
-তুমি এমন করে কথা বলছ কেন? কি হয়েছে লক্ষ্মী।
-এইসব ন্যাকামি বন্ধ করো। সারারাত তুমি বই পড় অন্যদিকে ফিরে। তুিম ভাবো আমি কিছু বুঝি না?
মিনহাজ সাহেবের স্ত্রীর মনে সন্দেহ আর যায় না। তিনি বাসার সব কাজের মানুষকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করলেন। তার সারাক্ষণ মনে হতে লাগল মিনহাজ সাহেব অন্য কোন খারাপ উদ্দেশ্যে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। তার স্ত্রী চাকরি ছাড়ার পর থেকে মিনহাজ সাহেবের বাইরে যাওয়া মোটামুটি বন্ধ করে দিলেন। তার মনে হতে থাকে তার স্বামী এখনো সুস্থ আছে। সে অসুস্থ। স্বামী হয়তো অন্য কারো সাথে প্রেম করে সেই মহিলাকে বিয়ে করতে পারে। স্বামী গোসল করতে গেলে তার মোবাইল নিয়ে বসে তার ফেসবুক, মেসেঞ্জার সবার আগে চেক করেন। কিন্তু কোথাও কিছু তিনি খুঁজে পান না। তখন সে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এবার মিনহাজ বুঝতে পারলো তার স্ত্রী দিলারা মানসিক রোগী, রোগের নাম সন্দেহ।
দিনে দিনে সম্পর্কের অবনতি হতে লাগে। ছেলে-মেয়েরা মাকে বুঝায়।
কিন্তু মা অবুঝ। মিনহাজ সাহেব মনোযোগ সহকারে উপন্যাস ও গল্পের বই পড়তে লাগল। স্ত্রীকে তিনি ভীষণ ভালোবাসেন। স্ত্রী বাইরে যেতে মানা করেছেন তিনি বাইরে যাচ্ছেন না। মোবাইল ধরা অপছন্দ করে তিনি মোবাইল ধরছেন না। কিন্তু এর পরও তার সন্দেহবাতিক যাচ্ছে না। যদি তিনি বারান্দার গ্রিল ধরে একটু বাইরে দেখেন তখন স্ত্রী এসে বলে ঘরে এসে বসো, আগে দেখে আসি রাস্তায় কোন মহিলা আছে কিনা? দুর্বিষহ সময়ের একটা বছর শেষ হলো।
মিনহাজ সাহেব ছেলেমেয়েদের ডাকলেন, তাদেরকে বিষয়টি খুলে বললেন। দিলারাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। এতে হিতে বিপরীত হলো, মানসিক রোগের ডাক্তার দেখে দিলারা হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে খুব চিৎকার চেঁচামেচি করে বলতে লাগল, ‘আমি কি পাগল…’।
ডাক্তার না দেখিয়ে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। মিনহাজ সাহেব কিছু কিছু লেখকদেও বই খুব পছন্দ করেন। মনোযোগ সহকারে তাদের বই পড়েন। তার মধ্যে একজন লেখক ছিল মেয়ে তার নাম আয়েশা সিদ্দিকা। তার লেখার একটা চরিত্রের সাথে দিলারা বেগমের চরিত্র সম্পূর্ণ মিলে যাচ্ছে। মিনহাজ সাহেব এক বন্ধুর মাধ্যমে আয়েশা সিদ্দিকার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
-আপা, আমার স্ত্রীর আপনার গল্পের চরিত্রের মতো অবস্থা কি করি বলেন তো?
আয়েশা সিদ্দিকা হেসে বলেন, স্ত্রীর কাছ থেকে কিছুটা দূরে থাকেন, কয়েক দিন পর দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।
এভাবে দুই এক দিন তাদের ফোনালাপ চলে। আলাপ ছিল খুবই নিষ্পাপ। কিন্তু এটাও একদিন ধরা পড়ে স্ত্রীর চোখে। মোবাইল নম্বর চেক করে তিনি বের করে ফেলেন আয়েশা সিদ্দিকার অবস্থান। তিনি তার স্বামীকে বলেন, চলো আজকে বেড়াতে যাই।
স্বামী মিনহাজ স্ত্রীর সঙ্গে গেলেন, গিয়ে দেখলেন একজন ভদ্র মহিলার অফিস। তার রুমে গিয়ে দিলারা বেগম তাকে নিয়ে বসলেন।
-আপনি আমার স্বামীর সঙ্গে কথা বলেন কেন?
-আপনি কে?
-আপনি যে মিনহাজ সাহেবের সঙ্গে কথা বলেন আমি তার স্ত্রী।
বইয়ের পেছনে পাসপোর্ট সাইজের একটি ছবি ছাড়া আয়েশা সিদ্দিকার কোন কিছুই মিনহাজ সাহেব আজ পর্যন্ত দেখেননি। হঠাৎ করে মিনহাজ সাহেবের হুঁশ ফিরে এলো।
- আপা, আপনি কি আয়েশা সিদ্দিকা?
-হ্যাঁ, কেন বলুন তো! আপনারা কারা।
-আপনি আমাকে চিনবেন না। আপনার একটা বই পড়ে আমি আপনাকে দুইদিন ফোন দিয়েছিলাম আমার স্ত্রীর বিষয়ে কথা বলেছিলাম।
-ও হ্যাঁ হ্যাঁ। তা আপনার সমস্যার সমাধান হয়েছে? - না। আমার সেই ফোনালাপ অনুসরন করে আমার স্ত্রী দেখেন এখানেই চলে এসেছে। আমি জানতামই না তিনি আমাকে এখানে নিয়ে আসবেন।
এবার মিনহাজ সাহেবের স্ত্রী চিৎকার-চেঁচামেচি আরও বেড়ে গেল ‘আচ্ছা, আমাকে নিয়ে আলাপ হয়েছিল। চলো বাড়ি যাই। এবার তোমাকে দেখাবো মজা।’
বাইরে সূর্যটা ঠিক মাথার উপরে। ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ। আর এখানে অতীষ্ঠ হয়ে আছে সংসার জীবনের দুই নরনারী।
প্রিয় লেখিকার সামনে অপমানিত হয়ে মিনহাজ সাহেবের মনে হলো আর বাঁচার প্রয়োজন নেই। তিনি বাড়ি ফিরে চুপ হয়ে বিছানায় পড়ে রইল। তিনি একবার ভাবলেন স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যাবেন, একবার ভাবলেন আত্মহত্যার পথ বেছে নেবেন। কিন্তু তিনি তার স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসেন। কল্পনাও করতে পারেন না তাকে ছেড়ে চলে যাওয়া বা আত্মহত্যা করার। তিনি জীবনের সব সময় ভেবেছেন মরণই তাদের বিচ্ছিন্নতা হবে। কিন্তু এখন আর তিনি পারছেন না। মিনহাজ সাহেব দুইদিন বসে সব বিষয়ে চিন্তা করলেন। তার স্ত্রীকে শহরের বাড়ি লিখে দিলেন। একদিন খুব ভোরে যখন ঘরের কেউ জেগে উঠেনি। তখন তিনি একটা ব্যাগগুছিয়ে অজানার উদ্দেশে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
সেদিন মিনহাজ সাহেব সংসারের অশান্তি থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে একটি বাস ধরলেন। ছয় মাস ধরে তিনি গ্রামের বাড়িতে আছেন। তার স্ত্রী কল্পনাও করতে পারেননি যে মিনহাজ সাহেব গ্রামে চলে যাবেন। কারণ বহুদিন ধরে তার কারণেই তার স্বামীর গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছিল। মিনহাজ সাহেব এখন ভালো আছেন। এখানে কিছু দিন আনে দিন খায় লোকের সঙ্গে তার বসবাস।
ছোট একটি জমিতে আলু, টমেটো, পটল এগুলোর চাষ করছেন। কিন্তু এখানে কেউ তাকে সন্দেহ করে না। শান্তি দেয়। সবুজে চোখ জুড়িয়ে যায়। তিনি খুব ধীরে ধীরে তার স্ত্রী এবং সন্তান সবার কথা ভুলে যান।
লোকলজ্জার ভয়ে দিলারা বেগম প্রথম কিছুদিন চুপ করে থাকলেন ।
এরপর বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করতে লাগলেন। কেউ তার স্বামীর সন্ধান দিতে পারলো না। কিন্তু মিনহাজ সাহেবের সন্তানেরা তার বাবাকে খুঁজে
বের করলেন। তারা দুজন বাবাকে শহরে ফিরে যাবার জন্য অনুরোধ করতে লাগল। মিনহাজ সাহেব স্থির ভাবে বললেন, ‘এখানে আমি মোবাইল ফোন ব্যবহার করি না। মাঠে কাজ করি, বই পড়ি । সবচেয়ে বড় কথা এখানে আমাকে কেউ সন্দেহ করে না। আমি আর শহরে ফিরে
যাবো না। তোমার মায়ের যতœ করো।’
দিলারা বেগম ভালো নেই। তার মত সন্দেহপ্রবণ মানুষগুলো ভালো থাকতে পারে না।
জয়শ্রী দাস : কথাসাহিত্যিক ও গবেষক