সালমা সুলতানা’র কবিতা

সহসা পেলে সহসা হারায়

ভালোবাসি বলে বলিনি কখনো, ভালবাসি তারে কত,
পাছে হারাই তারে যদি সে বোঝে, দিয়েছি নিঃশেষে ছিল মোর যত!

সহসা হারায়ে সহসা পেলে
কে ছিল কার! ভুলে যায় নির্ভুলে!

যে নদী মিশেছে মোহনায়,বিলিয়েছে তার সকল শূন্য করে,
বয়ে যে বেড়ায় মহাসমুদ্র,ভয় কি তার বিজন রাত্রিরে!
চোখের কোণে জমে না জল, দেয়নি কেন সবটুকু উজাড় করে।

ঈশান আকাশে জমা মেঘ, না-ই যদি কভু দেখে,
কেড়ে যদি নেয় সবটুকু তার, দিয়েছিল যা ভুলে।
তবুও তারে বাসি ভালো, সমুখে চাই না আর,
যে থাকে মর্মে গভীর ধ্যানে,মিছে তারে খুঁজিনা আর!

প্রহসন

ফেরারি স্বপ্নের চোখে কালো কাপড় বাঁধা,
নকশী-বুননে থাকে মিথ্যে আশ্বাস।
বোধের ঘরে আগুন জ্বালিয়ে
মিথ্যে বাহবা পায় সভ্যতার বুলি।
খড়গ উঁচিয়ে মশার তরে হাতির সাথে সন্ধি,
ঠাকুরের ভোগে নিত্য নতুন অঞ্জলি!
প্রহসনের পরিধি মাপে ক্লান্ত পেশী!
জীবনের খেরো খাতায় হিসেব কষে
নিঃস্বতা আর শুন্যতা চলে পদব্রজে!
তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে স্বঘোষিত বুর্জোয়া
ঠুলি পরা বিবেকে, নিঃস্ব আদতে।

এমন করেই ভুলে যেও

এমন করেই ভুলে যেও সব —
মেঘ থমথমে দুটো চোখ,
শেষ বিকেলে চিবুক ছোঁয়া,
বাদল-সন্ধ্যায় কদম গুঁজে দেয়া,
অলস দুপুরে চিরকুট লেখা,
ভেজা চুলের টপটপে জল!
নিঃশ্বাসে নোলকের দোলা!

ভুলে যেও সব অখন্ড অবসরে —
চুড়ির রিনিঝিনি, শাড়ীর ভাঁজে
মুখ লুকানো, ছুঁয়ে দেয়া অজুহাতে!
ভুলে যেও অনুযোগ, ভুলে যেও গান,
ভুলে যেও পুরনো কবিতা, ব্যথার দান!
যদি আর না-ই পড়ে মনে—-
লেপটানো কাজলের জলাধার,
অপেক্ষার অভিমান, হাসি জলের আড়ে,
মুছে দিও সেটুকুও, যতটুকু রেখেছো তারে!

তোমার কাছে আমার অনেক ঋণ

তোমার কাছে অনেক দেনা,অনেক আমার ঋণ,
শূন্য খাতায় ব্যথার বোঝা, দিন বদলের দিন।

এক নিশীথে আমায় নিয়ে গল্প গুলো উড়িয়ে দিলে,
হাতের মুঠোয় হাত রাখা হাত ছাড়িয়ে নিলে একা ফেলে,
এক আকাশের পুরোটা নীল চোখের পাতায় এঁকে দিলে,
এক সমুদ্র-নোনা জলে সবটা কাজল মুছে নিলে!
যতন করে দুঃখ দিয়ে,জানতে চাইলে -“খুব বেশি কি কষ্ট পেলে!”

তোমার কাছে অনেক দেনা,অনেক আমার ঋণ,
শূন্য খাতায় ব্যথার বোঝা, দিন বদলের দিন।

বুকের মাঝে উথাল ঢেউয়ের একটি অথই নদী দিলে,
পাড় ভাঙা এক কূলের কাছে সমর্পণের ঘর বানালে,
কান্না-জলের ঢেউয়ের তোড়ে নদীর বুকে হারিয়ে গেলে,
হঠাৎ ঝড়ে ঘর খানা মোর বিলীন হলো গভীর জলে,
কেড়ে নিয়ে সবটা আমার,বললে ডেকে—‘খুব বেশি কি নিঃস্ব হলে!’

সারারাত এক নিমপেঁচার সাথে জেগে থাকি আমি

সারারাত এক নিমপ্যাঁচার সাথে জেগে থাকি আমি,
শিকার ধরবার আগে যেমন সুতীক্ষ্ন দৃষ্টি থাকে
শিকারের দিকে তেমনি তার ক্ষুধার্ত চোখে দেখি
সুতীব্র ঘৃণা, গাঢ় অন্ধকারের মত তাচ্ছিল্য।
শুনতে পাই প্রকৃতির সাথে ফিসফিসানি তার, খলখলিয়ে হাসি।
মানুষের টুটি চেপে ধরে প্রকৃতি বুঝিয়ে দিয়েছে সব হিসেব।
সমুদ্র করেছে বন্ধ বুকের কপাট, ওখানে যেতে মানা,
আকাশ সেজেছে সবটুকু নীলে, ও রূপ আমাদের জন্য নয়।
বাতাসের মৃদঙ্গ বাজে পাতার সুরে, সে সুর আমাদের জন্য নয়।
সুরঙ্গী চলনে জয়িতা প্রকৃতি, দু পায়ে তার ধিঙ্গি পায়েল।

মানুষের বুকে ভুলের গন্ধ, পুরনো মায়া, দিশেহারা দৃষ্টি তার।
মোহমায়ার সব হিস্যা ফেরত দিয়েছে ধোঁয়াটে আকাশ, সমুদ্রের ঘোল,পলাশ-অশোক, ভাঁটফুল,
দেবদারু, নিমপেঁচা, মাটির স্নেহের বেড়ে ওঠা ঘাসফুল।

আজ মানুষ পরাজিত মানুষের কাছে,
আজ মানুষ পরাজিত নিজের কাছে,
আজ মানুষ পরাজিত জীবনের কাছে।
আজ অভিযোগহীন সে,
চলেছে অনন্তে সাদা পিরাণে।

আমি কবিতার কাছে পৃথিবীর গল্প বলে যাব

আমি কবিতার কাছে আমার সর্বস্ব রেখে যাব,
আমি কবিতার কাছে এক পৃথিবীর গল্প বলে যাব।
নির্জলা প্রেমের কথা, লুকানো কান্নার কথা বলে যাব।

বলে যাব,কে ভেঙেছে পাখির ঘর, কে নিয়েছে ঘুম কেড়ে,
কবেকার বানে আঘাট হলো ঘাট, কে অর্বাচীন নিজ ঘরে।

বলে যাব, কার নদী হলো খরস্রোতা, কার নদী গেল মরে,
কার লেহনে কিশোরীর আঙ্গোট,কে অন্দর অধিগ্রহণ করে।

বলে যাব তাকে, কোন্ ফাগুনে লেগেছে ভীষণ আগুন,
কোন্ বর্ষায় ভেসে গেছে সব, কোন্ চৈত্রে পুড়েছে দারুণ।

বলে যাব, কেন পুঁজিবাদী-অন্তরে নির্ঘুম পুঁজিপতি,
কেন পৃথিবীর অসুখ, কেন নাখোশ বিশ্বপতি।

পুঁজিবাদী প্রেম, মূক ও মুখোশের কথা বলে যাব,
সব ভার দিয়ে কবিতার বুকে, আমি নির্ভার ঘুমাব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *