কবিতাবিশেষ সংখ্যা

কবিতা।। রেজাউদ্দিন স্টালিন।। ফেব্রুয়ারি কবিতা উৎসব সংখ্যা

আদমের দেহে বৃষ্টি

ছিলাম মরুভূর বালুতে বিস্তীর্ণ পথ
নিবৃক্ষ লু হাওয়ায় প্রান্তরের পোড়া কৃতদাস
শুনিনি পাখির কথা- মেঘের চুম্বন
কেবলই বিদ্যুতের হ্রেষাদগ্ধ মন
একবার পালিয়ে ঠাঁই নিই সমুদ্রের পায়ে
আর শিখে ফেলি দিগন্তের স্বাধীন স্বভাব
তারপর সম্রাটের রক্তনালী বেয়ে
ছুটে আসি উপত্যকার ঘন ঘাসে
মুখ থুবড়ে পড়ে থাকি ক্ষুৎ পিপাসায়

হঠাৎ নাকাড়া শব্দে নেমে এলো দীর্ঘ
দেবদূত
আকাশের নীল ছিঁড়ে তৃষ্ণা মেটালো
আর এক আদমের কণ্ঠ ভেঙে পড়লো বিশাল কান্নায়
আর ভূকম্পনের বেগে জগৎ কাঁপিয়ে
নামলো রক্তবৃষ্টি
আমার জিহ্বার আগুন গেলো নিভে
দাঁড়ালাম একা উর্বর অচেনা মাটিতে
সেই থেকে যতবার
তৃষ্ণায় ডুকরে কেঁদে উঠি
ততবার পৃথিবীতে আদমের দেহ ঘিরে
বৃষ্টি নেমে আসে

দুরবিন

স্মৃতির অশ্বারোহী ফিরে আসি কাতর শৈশবে
যখন সবকিছু মূল্যবান ছিলো
চিনেবাদাম চকোলেট আইসক্রিম
মেলায় কেনা সবুজ টিয়ে আজো
কাঁধে এসে বসে
ঠোঁটদুটো সেরকমই লাল
গরম জিলাপি জিভ টেনে
লম্বা করে রাখে

পাঁপড় হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ে
হাতের তালুতে
পয়সা জমিয়ে কেনা দুরবিন
তাকায় আত্মহারা দিগ্বিদিক
আর আরব্য জিনদের জাদুবলে কি
আশ্চর্য সবকিছু বড় হয়ে যায়
মানুষ- প্রকৃতি
স্মৃতির মহাদেশে সবই বর্তমান
এখনো চাঁদ ঘুমোতে যায়
আমার পকেটে
সূর্য দেরি করে পশ্চিমে ওঠে
আজো পত্রিকার শিরোনামে সাঁতার কাটে বঁড়শিতে গাঁথা সংবাদ
ছাপা হয় নতুন নক্ষত্রে জেসোলিনের
বেতার দুরবিন

কিন্তু আমি খুঁজছি কৈশোরে কেনা
সেই অমোঘ দুরবিন
আবার সবকিছু দেখবো বড় বড়
মানুষ ও প্রকৃতি

বিষন্ন গণ্ডোলা

নদীর হৃদয়ে ভাসালাম গণ্ডোলা,
স্রোতের সিঁড়িতে বেদনার তারা ফোটে।
মৃত্যুর কথা সহজে যাবে না ভোলা,
গলবে কি লাশ সুতীব্র সংকটে?

বেদনা এসেছে বসন্ত আসবে না?
এই শীতে পিঠে বরফের সাদা ঝোলা
বয়ে নিয়ে যাবো পথ তবু ফুরোবে না,
গণ্ডোলা ভাসে বিষন্ন গণ্ডোলা।

তুচ্ছকে যে ভালোবাসে

কোনো কিছু তুচ্ছ নয়
প্রতিটি বস্তু তার বৈশিষ্ট্যে হীরক
উইয়ের সামর্থ্য দেখি অসীম সঞ্চয়ে
ঘাসের ভ্রুর মধ্যে শিশিরের পাখি
ছাই সেও উজ্জ্বল চাঁদের বাসন
আমাদের সামর্থ্যের সীমা অব্যবহৃত
বুঝতে পারি না
দক্ষিণের মৃদু হাওয়া কিভাবে বদলে দেয়
লক্ষ লক্ষ ইলিশের গতি
ছেঁড়া পালে গান বাজে -গুণ টানো মাঝি
তুচ্ছ সব অপেক্ষার ধুলো সোনালি ধানের উৎসব
মায়ের ছোটো চুম্বনের বীজগুলো আজ মহীরুহ
কুনোব্যাঙ সাপ আর হিংস্রদের কথা আজ থাক
মাধ্যাকর্ষণ থেকে জগতের কোনো তুচ্ছ বিযুক্ত নয়
কত বিশাল সভ্যতা তুচ্ছ হয়ে পড়ে আছে
ইতিহাসে – ঘাসে
পাহাড় হঠাৎ কিভাবে পিঁপড়ে হয়ে যায়
মরুভূমি গলে যায় উটের গ্রীবায়
বুঝতে পারি না
শৈশবের অনুস্মৃতি কতটা মহান
তুচ্ছ ভুল বার বার করে তোলে তিক্ত ইউলিসিস
তুচ্ছকে যে ভালবাসে সেইতো সামাজিক

কতদূর ইথাকা

অনেকদূর হেঁটে এসে পেছনে তাকালে
আর বাড়ি দেখা যায় না
দৃষ্টির সূর্যপথ উঠে যায় মেঘবৃক্ষে
পেছনে কার বাড়ি
চণ্ডীদাসের নাকি কাহ্নপার
জ্ঞানদাস একবার বিদ্যাপতির নিমন্ত্রণে এসে
পথ হারিয়ে বহুদিন আলাওলের অতিথি ছিলেন
আর কালিদাসের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও
যেতে পারেননি মোহাম্মাদ সগীর

সবকিছু অচেনা অপরিচিত
গাছের দেহ সবুজ পাতারা কালো
নদীর পানি হলুদ
পাখির ডানা নীল
আর পথের ধূলো লাল

এভাবে কি চেনা যায়
যারা পেছনে সব দেখতে পারে
তাদের নাকের মধ্যে অদৃশ্য সুড়ঙ্গ
কাছাকাছি কপালে একটা সাঁকো
নিচে জলঘূর্ণি
আর গলায় সবুজ চাঁদ
পেছনে ফিরে বাড়ি দেখাটা কি খুব জরুরী
জন্মের পর থেকে হাঁটছি
আার মাঝে মধ্যে চেষ্টা করছি পেছন ফিরে দেখতে
আবছা দেখা যায় গোধূলির নাকে নক্ষত্র
এখন হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর
খুব ইচ্ছে পেছনে ফিরে দেখি
কতদূর ইথাকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *