শিশুতোষ গল্প

শিশুতোষগল্প।। হিজল ও কুমকুমি পরি।। জহির টিয়া

অনেক বছর আগে বাল্টিন নামের এক রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যে সাত বছরের হিজল নামের একটা এতিম মেয়ে বাস করত। দেখতে ছিল লাল টুকটুকে পরির মতো। যখন সে বছর তিনেকের, তখন তার মা একটা খালের পানিতে ডুবে মারা যায়। কিছুদিন পরেই তার বাবা কিটোন দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তার সৎমা ছিল খুব দজ্জাল। তার দিলে মোটেও দয়ামায়া বলে কিছুই ছিল না। হিজলের ওপর সবসময় নির্যাতন চালাত। সংসারের সকল কাজ কাজের মেয়ের মতো তাকে দিয়ে করিয়ে নিতো। তার বাবা কিটোন এসবের কিছুই জানতেন না। তিনি কাক ডাকা ভোরে কাজের সন্ধানে চলে যেতেন। তিনি রাত করে যখন ফিরতেন তখন হিজল ঘুমিয়ে যেত।
একদিন হিজলের সৎমা তার বাপের বাড়ি গেল কয়েকদিনের জন্য। প্রতিদিনের মতো তার বাবাও কাজের সন্ধানে চলে গিয়েছিলেন। বাড়িতে হিজল একা। ঘরে খাবার বলে তেমন কিছুই ছিল না। যৎসামান্য শুকনো খাবার ছিল। সে সে খাবারটুকু খেয়ে দুপুরের পর ঘুমিয়ে পড়ল। সূর্যটা যখন পশ্চিমে নেতিয়ে পড়েছে, এমন সময় একটা দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠলো হিজল। তাতেই তার মনটা মায়ের জন্য হু-হু করে কেঁদে ওঠলো। কিছুক্ষণ সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল। এদিকে ভীষণ খিদেও অনুভব করল। কিন্তু ঘরে তো কোনো খাবার নেই। তাই সে মন খারাপ করে বাড়ির পাশে খালপাড়ে গিয়ে বসল। ঠিক যেখানে তার মা ডুবে মারা গিয়েছিল সে জায়গাটায়। খালের ওপারে ছিল একটা ফুলের বাগান। সেখানে একটা বরইগাছও ছিল। তাই সে বরইগাছের কাছে যেতে মন স্থির করল। যদি কোনো বরই পাওয়া যায় গাছে তাহলে খেয়ে কিছুটা খিদে নিবারণ করা যাবে। খালে তেমন পানি ছিল না সে সময়। তাই তার যেতে সমস্যা হল না। হাঁটুজল ভেঙে পৌঁছে গেল বরইগাছের নিচে।
কাঁচাপাকা কিছু বরই ঝুলছিল গাছে। দেরি না করে হিজল কয়েকটা ঢিল কুড়িয়ে সজোরে ছুঁড়ে মারল বরই বরাবর। তাতেই কিছু বরই গাছের নিচে ঝরে পড়ল। বরইগুলো কুড়িয়ে খেতে যাবে এমন সময় একটা বুড়োপরি এসে হিজলের সম্মুখে দাঁড়ালো। তারপর ছল্লাছল্লা দুইখান দাঁত কিড়মিড় করে বলল- কে রে তুই? বিনা অনুমতিতে আমার বরইগাছের বরই পারিস? তোর সাহস তো কম নয় দেখছি! বুড়োপরিকে দেখে ভয়ে থতমত খেল হিজল। তার হাত থেকে বরইগুলোও মাটিতে পড়ে গেল। ভয়ের চোটে সে চোখ দুটো গোলগোল করে উত্তর দিলো- আমার পেটে প্রচণ্ড খিদে। সকাল হতে তেমন কিছু খাইনি। খিদের জ্বালা সহ্য করতে পারিনি। তাই খিদে নিবারণের জন্য বরইগুলো পেড়েছিলাম। ভুল হয়েছে, আমাকে ক্ষমা করো। আর আমি এতিম। আমার মা নেই। বুড়োপরি ছিল ভীষণ দুষ্টু! পরিদের বয়স হলে নাকি তারা একরোখা হয়ে যায়। কাউকে সহ্য করতে পারে না। বিশেষ করে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের দেখলে নাকি তাদের ঘাড় মটকিয়ে দেয়। এই বুড়োপরি কুমকুমির বয়স নাকি দুইশ সত্তর বছর। পরিরা তিনশ বছর পর্যন্ত বাঁচে। সেই হিসেবে এর বয়স শেষের দিকে। তাই তার মেজাজও বেশি খিটমিটে। যে পরিদের বয়স শেষদিকে, অর্থাৎ মরণের সময় ঘনিয়ে আসে তারা বরইগাছে এসে থাকে। এখানে বসেই নির্বিঘ্নে প্রার্থনা করতে পারে। তেমনি এই বুড়োপরি কুমকুমিও এসেছে পাঁচ বছর আগে এই বরইগাছে। পাঁচ বছরের ধ্যান ভেঙে যাওয়ায় বেশ রাগান্বিত হয়ে যায় বুড়োপরি। কিন্তু রাগকে সামলে হিজলের প্রতি মায়া জন্মে গেল তার। যেহেতু সে ক্ষুধার্ত- তার ওপর এতিম! সেজন্যে হিজলকে কাছে টেনে বুড়োপরি বলল- চল্ আমার সঙ্গে। তোকে অনেক খাবার দেবো। যত ইচ্ছে তত খাবি। এই বলেই হিজলকে উড়িয়ে পরিদের রাজ্যে নিয়ে গেল বুড়োপরি।

পরিদের রাজ্য দেখে হিজলের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বুড়োপরি অর্ডার করা মাত্রই ওর সামনে চলে এলো বিশাল একটা খাবারের টেবিল। তাতে বিভিন্ন রকমের ফলমূলে পরিপূর্ণ। আপেল,আঙ্গুর,আনারস, কমলালেবু, কিসমিস, বেদানা আরও কত রকমের ফলমূল। সে ইচ্ছেমতো সেগুলো খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষ করে ধন্যবাদ জানালো বুড়োপরিকে। বুড়োপরি কুমকুমি খানিকটা সময় হিজলকে তাদের রাজ্যটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালো। পরিরাজ্যের অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে হিজলের মন ভরে গেল। খুশিতে সে ছড়া কাটতে লাগল-

“পরির রাজ্য দেখে আমার
মন হল খুব ভালা,
ফলের স্বাদে মিটে গেছে
ক্ষুধার যত জ্বালা।”

বুড়োপরি কুমকুমি হিজলকে পিঠের ওপর বসিয়ে নিয়ে বরইগাছের নিচে ফিরে এলো। তারপর হিজলকে মাটিতে নামিয়ে বুড়ি গাছের ওপর বসে বলল- শোন্ হিজল, যখন তোর খিদে লাগবে, তখনই চলে আসিস আমার কাছে। তোর জন্য বেশি করে খাবার আনিয়ে রাখবো। হিজল উৎফুল্ল হয়ে মুচকি হেসে জবাব দিলো- আচ্ছা বুড়িমা।
এরপর যখনই হিজলের খিদে লাগে, তখনই বুড়োপরি কুমকুমির কাছে চলে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *