ছোটগল্প।। কাঠফুলের গহনা ।। জাহীদ ইকবাল
আঠারো বছরের সংসার জীবনে এতোদিনে একদম হাঁফিয়ে ওঠার কথা; নানান খুনসুটি আর টানাপোড়েনে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে যাবার কথা অথচ মনে হচ্ছে এইমাত্র বিবাহ করে নতুন সংসারে পদার্পণ করছি। ভিতরে ভিতরে দারুণ এক উত্তেজনা। সুখ সুখ অনুরণন। যেন মনের গহীনে অন্যরকম এক উৎসবের হাটবাজার বসেছে। দু’জন টোনাটুনির মতো ঘুরেফিরে এটা কিনছি ওটা কিনছি, একের পর এক কিনে যাচ্ছি। কেনাকাটা যেন ফুরোচ্ছেই না। আমাদের পকেটভর্তি এক হাজার, পাঁচশো টাকার চকচকে বান্ডিল। কোনো দরকষাকষি নেই। সবকিছুই একদাম। আমাদের মুখে বাঁধভাঙা হাসি। ভিতরে উপচেপড়া খুশি। এতো উৎসব! এতো আনন্দ কেন! আজ কি বিশেষ কোনো আনন্দদিন? ঠিক ধরেছেন, আজ আমাদের আঠারোতম বিবাহ বার্ষিকী। অথচ মনে হচ্ছে আজ আমাদের বিয়ে। আমরা বাসর ঘরে বসে আছি। বিশ্ব-ভ্রম্মাণ্ডের সব সুন্দর যেন আমাদের পালঙ্কে সাজুগুজু করে বসে আছে। মুমুকে পরীর মতো লাগছে। ইচ্ছে করছে ওর খোঁপায় একটি কাঠগোলাপ গুঁজে দিয়ে বলি___ এই নাও মুমু, পৃথিবীর সব সুন্দর তোমার খোঁপায় গুঁজে দিলাম। বছরের এই একটা দিন ওকে আমি অন্যরকম ভাবে নেড়েচেড়ে উল্টেপাল্টে দেখি। যতোই দেখি কিছুতেই যেন মুগ্ধতা কাটে না। আবেগের পুকুরে সাঁতার কাটতে কাটতে আমি পাহাড়-নদী-সমুদ্র ছুঁয়ে যাই।
‘তোমার গায়ের গন্ধ এতো মিষ্টি! তুমি এতো সুন্দর মুমু!’
‘মিথ্যে বলছো!’
‘মোটেও না। তোমাকে খুব চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।’
‘মিথ্যে কথা।’
‘একটু জড়িয়ে ধরি!’
‘যত্তোসব ঢং। কোথায় শিখেছ এসব! বয়স কত হয়েছে একবারও হিসেব করেছো? এসবে এখন কি আর তোমার তৃপ্তি হবে! তোমার চাই সবুজ সবুজ উঁচু পাহাড়। শান্তস্নিগ্ধ কুলকুল নদী। আমার তো ভাই মরা নদী। শরীর শুকিয়ে কড়াইয়ের কাঠ হয়ে গেছে। যা-ও একটু মাংস আছে__ওটাও শুকিয়ে চুপসে যাবার জোগাড়। এখন আর তোমার জন্য এক চিলতে সুখ নেই। স্বস্তি নেই।’
‘বাহ মুমু! তুমি তো দারুণ সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলা শিখে গেছ! তোমার কথা শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি ! প্লিজ আমাকে বুকে তুলে নাও।’
‘চাপাবাজ! কোথায় শিখেছো এসব মেয়ে পটানো চাপাবাজী গল্প! তোমার মুখে আগে তো কখনো এমন করে শুনিনি! তুমি তো কলেজেও এতোটা রোমান্টিক ছিলে না! কোনো সুন্দরী যুবতীর প্রেমেটেমে পড়েছ নাকি?’
‘আরে না! এই বুড়োহাবড়ার প্রেমে কোন মেয়ে পড়বে! তুমি কি পাগল হয়ে গেলে মুমু!’
‘হুঁ, আমি তোমার প্রেমে পাগল হয়ে গেছি।’
‘তাহলে কাছে আসছো না কেন?’
‘কাছেই তো আছি। আর কতো কাছে আসবো?’
‘এসো একদম বুকের ভিতরেই চলে এসো। আজ আমার খুব মরে যেতে ইচ্ছে করছে…।’
‘মরবে তবে আজ নয়, অন্য কোনোদিন। অন্য কোনোখানে। খুব নির্জনে, ছায়াবীথি তলে। এখানে কোথাও গোরস্তান নেই। তুমি মরে গেলে তোমাকে দাফন করবো কোথায়?’
‘কেন তোমার বুকের ওই গোরস্তানে! মুমু ওখানেই আমাকে দাফন কোরো।’
‘করবো তবে আজ নয়।’
‘আজ নয় কেন! আজ এবং এই মুহূর্তে…।’
‘তুমি বললেই কি সব হবে! নদীটা আমার। সাঁতার কাটবে তুমি অথচ অনুমতি নেবে না; কোনো বাঁধা-নিষেধ মানবে না__তা কী করে হয়!’
‘নদী কারো নয়। এই নদী শুধুই আমার।’
‘দেখো যুবক, এতো উতলা হয়েও না। নদী এখন অসুস্থ। তাজা রক্তে ভরা। এই নদীতে সাঁতার কাটতে মানা আছে।’
‘তবুও।’
‘না, একদম কোনো দস্যুগিরি চলবে না।’
‘তুমি কার নীলাঞ্জনা?’
‘শুধুই তোমার!’
‘তাহলে চলে এসো বুকের সমুদ্রে__দু’জন লোনাজলে সাঁতার কাটি।’
‘এতো দিন কোথায় ছিলে! কেন আমাকে ছোঁয়নি?’
‘ইচ্ছে করেই ছুঁইনি। তুমিও আমাকে চাওনি বলে!’
‘খুব চেয়েছি।’
‘চেয়েছো তবে তোমার সেই চাওয়া আমার মতো এতোটা তীব্র ছিলো না!’
‘আমি তোমার ওপর অভিমান করেছিলাম।’
‘জানি আর জানি বলেই চুপকথার মতো চুপ ছিলাম। দেখি তুমি কতো দিন না এসে থাকতে পারো।’
‘আমিও ঠিক তোমার মতো এমনটাই ভেবেছিলাম।’
‘পারলে না তো! অবশেষে আমার কাছেই হেরে গেলে?’
‘হ্যাঁ, একদম।’
‘তাহলে ঝড়-তুফানের মতো চলে আসো!’
‘তুমি না বললে…।’
মুমু ভীষণ রকম হেসে ওঠে, ‘মিথ্যে বলেছি। ঠাট্টাও বোঝ না! আমার জন্য কতোটা পাগল হয়েছ___ এটা বোঝার জন্য।’
‘এটাও আমি জানতাম।’
‘তুমি এতো দুষ্টু!’
মুমু বালিকার মতো বুকে আসে। আমি চুপ হয়ে যাই। শান্ত নদীর মতো ওর বুকে মুখগুঁজে ঘুমিয়ে পড়ি। মুমু আমাকে ভীষণ রকম জড়িয়ে ধরে।
একটা সময় আমাদের সংসার ছেঁড়া স্যান্ডেলের মতো জোড়াতালি দিয়ে চলে গেছে। আমরা একটু ভালোভাবে বাঁচার জন্য, ভালোভাবে থাকার জন্য অনেক ছোটাছুটি করেছি। দু’জন ঝগড়াঝাটি, তর্কাতর্কিও কম করিনি। কারো বিরুদ্ধে কারো অভিযোগ-অনুযোগও নেহায়েৎ কম ছিলো না। তবুও এক সাথে একই ছাদের নিচে দীর্ঘ আঠারোটি বছর কেটে গেছে। পুরো মাসের বাজার কোনো মাসেই করা হয়নি। মাসের মধ্যখানে, বিশ একুশ তারিখের ভিতরে প্রায়শই বাজার ফুরিয়েছে। ডিম, আলুভাজি, আলুবত্তা দিয়ে চলেছে মাসের বাকি কটা দিন। তবুও হতাশায় মুষড়ে পড়িনি। ছেলেমেয়েরাও আমাকে বুঝেছে। আমার সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েছে। বড় মেয়েটা এবার জিএসসি দিয়েছে। ছোটো মেয়েটা চতুর্থ শ্রেণীতে। সংসারে খরচ তো কম না। যা বেতন পেয়েছি তা দিয়ে কোনোভাবে টেনেটুনে চলে গেছে।
চাকরিটা হুটহাট করে যায়নি। অফিস বন্ধ হবার দু’মাস আগেই অফিস কতৃপক্ষ নোটিশ দিয়ে জানিয়ে ছিলো। চাকরি চলে যাবার পর একদম থালা নিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছিলো। তবুও মুমুর সঙ্গে প্রমিজ করেছি__ আমাদের দিন যতই খারাপ যাক, অভাবে দুর্দিনে কাটুক, আমরা ঝগড়া করবো না। কখনো কেউ কাউকে ছেড়ে যাবো না। আমরা একে ওপরকে বুঝবো। বোঝার চেষ্টা করবো। প্রায় দেড় বছর আমার কোনো চাকরি ছিলো না। চাকরি হবে হবে করেও হয়নি। মেয়ে দুটো ওদের মামা বাড়িতে ছিলো। মাসের পর মাস মেয়ে দুটোর সঙ্গে কোনো দেখাসাক্ষাৎও হয়নি। মুমুর গহনা বলতে হাতের একজোড়া বালা, দুটো কানের দুল। ওগুলো বারবার সে আমার হাতে তুলে দিয়েছে। আমি নেয়নি। অবশেষে না নিয়েও পারিনি। সবকিছু বিক্রি করেও কোন কূল কিনারা হয়নি। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় থেকেছি। কখনো এক গ্লাস পানি, কখনো একটা বিস্কিট খেয়ে কতো দুপুর যে রাস্তায় রাস্তায় ক্ষয় হয়েছে__ তার কোনো ইয়াত্তা নেই। পাঁচ টাকার বাসভাড়া দিতে পারিনি বলে সমস্তপথ হেঁটে গেছি হেঁটে এসেছি। তবুও এই শহরে কোথাও একটা কাজ জোটেনি। নিয়ম করে অনেক রাত করে বাসায় ফিরতাম। রাতভর বই পড়তাম। গল্প লিখতাম। মুমু থাকতো চুপচাপ। শামুকের মতো নিজেকে লুকিয়ে রাখতো নিজের খোলসের ভিতরে। ওর কথা একটাই ___ ‘সব ঠিক হয়ে যাবে।’
একদিন সকালে বাসা থেকে বেরুবার পথে অফিসের বস নাজমুল সাহেবের ফোন আসে।
‘সাদাত সাহেব?’
‘জ্বি, স্যার।’
‘কেমন আছেন?’
‘কোনো রকম বেঁচে আছি স্যার।’
‘আপনি জব করছেন কোথাও?’
‘জ্বি না, স্যার।’
‘কী বলেন! এই দেড় বছর ধরে আপনি কোনো জব খোঁজেননি?’
‘খুঁজেছি স্যার। চাকরি হয়নি।’
‘কীভাবে চলেছেন এতোদিন?’
‘একভাবে চলে গেছে স্যার। কিছু ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে নুনেভাতে চলে গেছে দিন।’
‘আপনি তাহলে আগামীকাল থেকে আমাদের অফিসে জয়েন্ট করুন। আমরা আবারও প্রজেক্টটা চালু করতে চাচ্ছি___ অলরেডি চালু হয়েও গেছে। আপনি দক্ষ এবং বিশ্বস্ত। আপনাকেই আমাদের অফিসে খুব প্রয়োজন।’
কথাটা শুনে আমি খুশিতে লাফিয়ে উঠি। আনন্দে আত্নহারা হয়ে যাই। খুশিতে চোখ ফেটে অশ্রু গড়ায়। মুমুর কথাই ঠিক হয়েছে___’সব ঠিক হয়ে যাবে।’ অলরেডি ঠিক হয়েও গেছে। বস লাখ খানেক টাকা আমাকে এডভান্স করেছেন। টাকাটা একদম নিতে চাইনি। তিনি এক প্রকার জোর করেই দিলেন। অভাবের বাজারে এই টাকার মূল্য আমাদের কাছে কোটি টাকার সমান।
০২.
সাদাত পারে। কীভাবে পারে! এটা আমার বোধগম্য নয়। ও খুব সহিষ্ণু। মাঝেমধ্যে ভাবি___ হয়তো আমার শরীর ওকে টানে না; আমাকে দিয়ে ওর তৃপ্তি হয়না। না কোনোটাই না; ও শরীর নিয়ে ভালোই খেলতে জানে। মজা কীভাবে দিতে হয় তা-ও জানে। ওর কথা বলার ভিতরে এক ধরনের ম্যাজিক কাজ করে। মুগ্ধতায় বুঁদ হয়ে শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে;
হাঁসফাঁস করে; কাছে না এসে আর পারে না; ও ঠিক তখনই কাছে আসে। এ ছাড়া সে একচুল পাশেও ঘেঁষে না। এভাবে দীর্ঘদিন চলে যায়। ওর কোনো অস্তিত্ব টের পাই না। আমিও ওকে জাগাতে যাই না। ও যেন কিছুটা শিশুর মতো সরল। ওকে আমার দু’সন্তানের জনক বলে মনে হয়না। মনে হয় সাদাত সেই পঁচিশের তাগড়া যুবক। তবে কোথাও একটা গন্ডগোল সাদাত পাকিয়েছে। নীলাঞ্জনা সেই গন্ডগোলের নাম। ঘুমের ভিতরে মাঝেমধ্যে এই নামটা সে উচ্চারণ করে।
ভাবতে অবাক লাগে, সাদাত এই মধ্যবয়সে এসেও প্রেম করছে! এতো টানাপোড়েনের ভিতরেও প্রেমের স্বাদ জাগে! মানুষ কখন প্রেম করে! প্রেমে পড়ে! আমার কোন জিনিসটা ওর অপছন্দ। কী অভাব ওর! এসব আমি বুঝতে পারি না। আমার মাথায় ঢোকে না। সারাদিন অফিস করে আবার টিউশনি করার এতো এনার্জি আসে কোত্থেকে! এটা আমি বুঝতে পারি না। সে বেতন আগের চেয়ে বেশি পাচ্ছে। টুকটাক কিছু ঋণ ছিলো, সেগুলোও শোধ হয়েছে। মেয়ে দুটো ভালো একটি ইশকুলে পড়ছে। ওদের প্রায় সব চাহিদাই কমবেশি পূরণ করছে। আমাকেও সমানে এটা-ওটা কিনে দিচ্ছে। নিজেও কমবেশি কিনছে। গত মাসে লেখালেখি করার জন্য একটা ল্যাবটপ কিনেছে। ক্রমশই বই দিয়ে সমস্ত ঘর ভরে ফেলছে। রাতভর কি সব ছাইপাঁশ লেখে। ওসব লিখে আজকাল আর কিছু হয়না। এখন প্রত্যেক ঘরে ঘরে লেখক। লিখতে গেলেও কাড়ি কাড়ি টাকাপয়সার প্রয়োজন হয়। প্রচুর স্টাডি করতে হয়। এতো সময় কি ওর আছে?
সাদাত অফিস করে যে সময়টুকু পায়___ তার সবটুকুই চলে যায় টিউশনির পেছনে। আমাকে যে আলাদা করে একটু সময় দেবে, সেই সময়টুকু ওর নেই। বাসায় আসবে, খাবে, তারপর ল্যাবটপ নিয়ে বসে যাবে। রাতভর লিখবে। ও যে কখন ঘুমায় একদম টের পাই না। বরাবরই আমার ঘুম একটু বেশি। কোনো কিছু পারি আর না পারি, আমি ঘুমাতে পারি বেশ। বালিশে মাথা রাখামাত্র ঘুম আমাকে জড়িয়ে ধরে। ঘুম থেকে উঠেই দেখবো__ হয়ত পড়ছে নয় তো লিখছে। বিরক্তিকর। এতো সব লিখে কী হবে? সাংসারিক কাজকর্ম করে যে সময়টুকু পাই, তা দুটো ছেলেমেয়ের পেছনে চলে যায়। তবু্ও যেন সময় কাটতে চায় না। ভিতরটা খালি খালি লাগে। ভীষণ কান্না পায়। মাঝেমধ্যে নিজেকে খুব ঘেন্না হয়। সাদাতের যখন চাকরি ছিলো না, তখনও আমার জন্য ওর কোনো সময় বরাদ্দ ছিলো না। ও ভাবে, আমি খুব হ্যাপি। নো নেভার। পুরাটাই ভুল। আমি হ্যাপি নই। ওর ভালোবাসার ধরন আমি বুঝতে পারি না। এক সময় ওকে আমি প্রচণ্ড রকম মিস করতাম। ওর আদর না পেলে পাগলের মতো হয়ে যেতাম। প্রতিরাতে নাভিতে ওর চুম্বন না পেলে খুব মরে যেতে ইচ্ছে করতো।
ও যেন কেমন! মুখে হাসি থাকতে হবে, ঝগড়া করা যাবে না, আবার পৃথক পালঙ্কে শোয়াও যাবে না। ছায়ার মতো তার কাছে থাকতে হবে। অল টাইম কম্পোমাইজ করে চলতে হবে। অদ্ভুত ধরনের একটা মানুষ। এতো কাছে থেকেও সে যেন অনেকটা দূরের মানুষ। কখনো সখোনো ওকে আমার একজন দক্ষ অভিনেতা ঠাহর হয়। একবার শাদাত আমাকে একজোড়া কাঠফুলের গহনা কিনে দিয়ে বললো___
‘এটা তোমাকে দিলাম। যত্নে রেখো। পারলে সিন্দুকে তুলে রাখো।’
‘কেন?’
‘একদিন দেখবে ওগুলো সব মুক্তার গহনা হয়ে গেছে!’
‘তুমি এসব কি বলছো?’
‘ঠিকই বলছি।’
‘কাঠফুলের গহনা কেউ সিন্দুকে তুলে রাখে?’
‘কেউ রাখে না তুমি রাখবে!’
‘তুমি একটা পাগল।’
‘মুমু, পৃথিবীতে কিছু কিছু ভালোবাসা আছে__ যা সিন্দুকে তুলে রাখতে হয়। যত্ন নিতে হয়, তা না হলে মরে যায়…।’
‘তাই বলে একজোড়া কাঠফুলের গহনা?’
‘হ্যাঁ, এই কাঠফুলের গহনাই আমার ভালোবাসা।’
সাদাত ভালোই পাগলামো আর অভিনয় করতে জানে। আমি মুগ্ধ না হয়ে পারি না। প্রেমিকার মতো দীর্ঘতর চুম্বনে ভিজিয়ে রাখে কখনো বা মাছের মতো ডুব দিয়ে কোথায় যেন তলিয়ে যায়__ মাথা জাগায় না। আমিও ওকে কোথাও খুঁজেই পাই না।
অভাব অনটন, পরিবেশ পরিস্থিতি মানুষকে বদলে ফেলে। কাউকে হিংস্র পশুও বানিয়ে দেয়। সাদাত এমন ছিলো না। চাকরিটা চলে যাবার পর ও কেমন যেন বদলে গেছে। আমিও কম বদলাইনি। সারাদিন সাদাত বাসায় থাকতো না; অনেক রাত করে বাসায় ফিরতো। মেয়ে দুটো ছিলো বাবার বাড়ি। একা একা একটা ঘরের ভিতরে কতোক্ষণ থাকা যায়! একদম হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। পাশের ঘরের হামিদ সাহেব এবং তার স্ত্রী আমাকে হেল্প করেছেন। পাশে থেকে ভালোই সাপোর্ট দিয়েছেন। লোকটা হয়তো সাদাতের সমবয়সী হবে। তার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। দারুণ মিশুক। সাদাতের মতোই একটা অফিসে জব করে। বেতন বাড়লে সাবলেট বাসাটা তারা ছেড়ে দেবেন। সাদাতও এই একই কথা বলেছে। দেড়খানা রুমে চার চারটা মানুষ নিয়ে এতো ঠাসাঠাসি করে থাকা যায় না।
আমিও দ্রুত বাসাটা ছাড়তে চাই। হামিদ সাহেব লোকটাকে আগে আমার স্যালুট করতে ইচ্ছে করতো। বৈয়ামের সুস্বাদু চাটনি মনে হতো। সারাক্ষণ তার সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করতো। এখন জুতাপেটা করতে ইচ্ছে করে। লোকটা আস্তা একটা খবিশ। মানুষটাকে অনেক বেশি বিশ্বাস করে চরম ভুল হয়েছে। যে বিশ্বাস আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিন তার স্ত্রী বাসায় ছিলো না….। এ সময়ে লোকটা যৌন তাড়নায় হিংস্র হয়ে ওঠে। সাদাতকে বিষয়টি জানাইনি। তার স্ত্রী বাসায় থাকে না। পরে উল্টো আমাকেই সন্দেহ করে বসবে। যতোটা সম্ভব প্রবলেমটা নিজেই সলব করার চেষ্টা করলাম। মানুষ যে বেড়াল-কুকুরের মতো এতো নির্লজ্জ আর বেহায়া হতে পারে, এটা আমি ভাবতে পারি না। হাতেমুখে বঁটি দিয়ে কুপিয়েছি, কামড়ে-খামচে সারা শরীর রক্তাক্ত করেছি__তাতেও লোকটার একবিন্দু লজ্জা হয়নি। সে বলে___
‘আমাকে তুমি মেরে ফেলো মুমু। তবু্ও…।’
‘অসম্ভব!’
‘তুমি ইচ্ছে করলে সব সম্ভব।’
‘প্লিজ,পা ছাড়ুন! আপনাকে কিন্তু আমি একদম জানে মেরে ফেলবো!’
‘সেইটাই কর__এই নাও মাথা পেতে দিলাম…।’
লোকটা দু’চোখের অশ্রু ছেড়ে দিয়ে ন্যাকা কান্না জুড়ে দিলো। কুকুরের মতো পা ধরে পায়ের কাছে বসে থাকলো। হায়রে নরপিচাশ! নিজের ঘরে সুন্দরী স্ত্রী থাকার পরও পরস্ত্রীর প্রতি কী জঘন্য লোলুপদৃষ্টি! ধিক এইসব নরপশুকে, যারা নারীর সরলতার সুযোগ নিয়ে দেহভোগ করে।
‘আমি সুইসাইড করবো’ বলে লোকটাকে খুব ভয় দেখালাম___তারপর সে রক্তাক্ত শরীর নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে ঢুকলো। প্রায় ছয় সাত দিন তার সব ধরনের তাঙফাঙ, ন্যাকা কান্নাকাটি অফ থাকে। একদমই ঘর থেকে বেরুতো না। অফিসেও যেতো না। তার কোনো সাড়া শব্দও নেই। আমি ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড রকম ভয় পেয়ে গেলাম। লোকটা সুইসাইড করলো না তো! এতো গরমের ভিতরে সারাদিন দরজা জানালা না খুলে থাকা সম্ভব! আমি দরজার কাছে গিয়ে কয়েকবার ফিরে এসেছি। জানালায় উঁকি দিয়েছি। না তার কোনো সাড়াশব্দ নেই। ঘরের ফ্যান টিভিও অফ। ভয় ক্রমশই বাড়তে থাকে। কোথায় যেন ইঁদুর মরেছে। বিশ্রী গন্ধ এসে নাকে লাগছে। কিন্তু মরা ইঁদুরটাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। ইঁদুরটা বোধহয় আমার মগজের কোথাও মরে পড়ে আছে!
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর তার দরজায় গিয়ে হাত রাখলাম। দরজাটা যেন একা একাই খুলে গেলো। পুরো ঘর অন্ধকার। দরোজাটা খোলা মাত্র টের পেলাম ইঁদুরটা এই ঘরের ভিতরেই কোথাও মরেছে। মুখে ওড়না চেপে মোবাইলের আলো ছুড়তেই আঁতকে উঠলাম। হামিদ সাহেব বেহুঁশ হয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে। ঘরের লাইট অন করে তার কপালে, গায়ে হাত রাখলাম। সমস্ত শরীরে প্রচন্ড জ্বর। ভেবেছিলাম বদমাশটা বোধহয় মরে গেছে। কিন্তু না; জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করে পানি! পানি! করছে।
‘হামিদ সাহেব! হামিদ সাহেব!’ বলে দু’বার তার কাঁধে ঝাঁকুনি দিলাম। সে সাড়া দিলো না। এই অবস্থায় লোকটা মরে গেলেও আরেক বিপদ। গলায়, হাতে, মুখে কাটা ঘা এখনো ভালো করে শুকায়নি। হঠাৎ নরপশুটার ওপর আমার একটু মায়া জন্মালো। তার মাথায় পানি দিয়ে জ্বরের ওষুধ খাইয়ে দিলাম। একবার তার চোখ দেখলাম, টকটকে লাল। হাত-পা,মুখ, গা-গতর ফুলে বিশ্রী একটা অবস্থা। তার স্ত্রীকে ফোন দিলাম। তিনি আগামীকাল আসবেন। এই লোকের যে অবস্থা, সকাল পর্যন্ত টিকবে বলে মনে হয় না। রাতভর এই চিন্তা আমাকে ঘুমাতে দেয়নি। দ্বিতীয়বার তার ঘরে যেতেও সাহস পাইনি। সাদাত এই বিষয়ে কিছুই জানে না। ওকে ইচ্ছে করেই কিছু জানাইনি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম লোকটা নেই। মরে বরফ হয়ে পড়ে আছে।
ভয়ে আমার কলিজা শুকিয়ে যাবার যোগাড়।
সাদাত বললো,
‘হামিদ সাহেব মরলো কীভাবে?’
‘ক’দিন আগে কারা যেন তাকে খুব মেরেছে।’
‘কেন?’
‘জানি না। মার খাওয়ার পর থেকে সে আর ঘরের বাইরে বের হয়নি।’
‘তার স্ত্রী কোথায়?’
‘গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছে। যেদিন গেছে তার পরের দিনই এই ঘটনাটা ঘটেছে।’
‘এতো বড় একটা ঘটনা আমার পাশের ঘরে ঘটে গেলো অথচ তুমি আমাকে তার কিছুই জানালে না!’
‘কীভাবে জানাবো? তুমি রাতে বাসায় ফেরো কখন?’
‘তবুও ইচ্ছে করলে জানাতে পারতে!’
‘আমার মনে ছিলো না।’
‘আমরা তো এখন অনেক বড় একটা ঝামেলার ভিতরে পড়ে গেলাম ! এখন বাড়িওয়ালা এবং পুলিশকে কী বলবো?’
‘যেটা সত্য সেইটাই বলবো!’
‘তার স্ত্রীর নাম্বারে একটা ফোন দাও…। না। এসবের কিছুই সাদাত আমাকে জিজ্ঞেস করলো না। বরং সে নিজে থেকেই তার স্ত্রীকে ফোন দিলো। দুপুরে কুমিল্লা থেকে তার স্ত্রী, তার বড় দুই ভাই এলো। তার স্ত্রী আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রচুর কান্নাকাটি করলো। কোনো পুলিশ কেস হয়নি, বাড়িওয়ালাও কোনো ঝামেলা করেনি। কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই লাশ চারতলা থেকে এম্বুলেন্সে উঠলো।
পরের মাসে আমরা সেই বাসাটা ছেড়ে রায়ের বাজারে বাসা নিই। এই ঘটনার অনেক আগে থেকেই সাদাত আমাকে কেমন যেন এভয়েট করে চলতো। তখন আমি হামিদ সাহেবে ডুবে ছিলাম। প্রায়ই তাদের বাসায় খেতাম। তাদের ঘরে টিভি দেখতাম। তার স্ত্রী টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়তো। আমি আর হামিদ সাহেব চুটিয়ে টিভি দেখতাম আর তার মুখে দেশবিদেশের দারুণ সব গল্প শুনতাম।
বাংলাদেশের একটি প্রথম সারির নাম করা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে সাদাতের প্রথম উপন্যাস __’নীলাঞ্জনা’ বেরুলো। সব ধরনের খরচখরচা দিলো অফিসের বস নাজমুল হুদা সাহেব। নীলাঞ্জনার কোনো আখ্যান আমি জানি না। বইয়ের প্রচ্ছদটা অসাধারণ হয়েছে। বইটা উৎসর্গ করেছে দুই মেয়েকে। নীলাঞ্জনা একটা প্যাকেটে মোড়ানো ছিলো। রাতে বাসায় এনেছে। অফিসে যাবার পথে সাদাত আমার হাতে নীলাঞ্জনা ধরিয়ে দিলো। আমি বইটা হাতে পেয়ে খুশিতে আটখানা হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম, এবার জানা যাবে___ কে এই নীলাঞ্জনা! যাকে নিয়ে সাদাত সম্পূর্ণ একটি নভেল লিখে ফেললো! সময় নষ্ট না করে দ্রুত উপন্যাসের পৃষ্ঠা উল্টাই। বইটা উত্তম পুরুষে লেখা।
…মুমুর ভালো নাম নীলাঞ্জনা। এই নামে তাকে কেউ ডাকে না। আমি ডাকি; যখন আমার মুড ভালো থাকে। মুমু মাঝেমধ্যে চমকে ওঠে। কেন চমকে ওঠে? কারণ এটা তার নিজের বানানো নাম। শখের বসে কলেজ লাইফে রেখেছিলো। এখন সেই নামটা নিজেই বেমালুম ভুলে বসে আছে। ভাবছে নীলাঞ্জনা নামের কোনো এক মেয়ের সঙ্গে আমি চুটিয়ে প্রেম করছি। ভেরি ইন্টারেস্টিং না! হ্যাঁ আরও ইন্টারেস্টিং কিছু আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে, একটু নিচের প্যারায় নেমে আসুন।
মুমু আমার স্ত্রীর নাম। বেশ সুন্দরী আর নাদুসনুদুস। ফর্সা, লম্বা, গোলগাল মুখ। প্রথম দর্শনে যে কারোরই ভালো লাগবে। আমিতো প্রথম দেখেই ফিদা হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর কতো রকম পাগলামো___ অবশেষে বউ। যাইহোক মুমু এখন দুই বাচ্চার জননী। সে হামিদুল ইসলাম নামের এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছে। ভদ্রলোক আমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন। তিনি নিঃসন্তান। আমাদের সঙ্গে সাবলেট থাকেন…বেশ মোটাসোটা। শ্যামলা ফর্সা…।
নীলাঞ্জনা আর পড়া হয়ে ওঠে না। চোখের পানিতে লেখাগুলো ঝাপসা হয়ে ওঠে। সাদাত সবকিছু জানতো অথচ সে আমাকে কিছুই বুঝতে দেয়নি। লজ্জায় অপমানে মনে হচ্ছে আমি বিল্ডিংসহ তিন হাত মাটির নিচে তলিয়ে যাচ্ছি…।
খুব সুন্দর একটি গল্প, পাঠে মুগ্ধ হলাম জাহিদ ভাই, লিখতে থাকুন সাফল্য ইনশাল্লাহ আসবে।