পেন্সিল ও রাবারের গল্প // হিমেল বরকত
২
এক দেশে ছিল এক পেন্সিল। দেখতে ছিল লম্বা, ছিপছিপে গড়নের। পড়ালেখা জানত
বলে তার ছিল ভীষণ অহংকার। গোল ফ্রেমের একটা চশমা পরে নাক উঁচু করে সে হেঁটে
বেড়াত। সবাই তাকে শ্রদ্ধা করত, মান্য করত।
কেবল একজন ছিল ব্যতিক্রম। তার নাম রাবার। দেখতে সে ছোটখাট, নাদুস-নুদুস।
দেখতে নরম হলে কী হবে, তার স্বভাব ছিল কঠিন। কোনো ভুলই সে সহ্য করতে পারত
না। ভুল পেলেই হাত দিয়ে, পিঠ দিয়ে ঘষে-ঘষে মুছে ফেলত।
পেন্সিলের অনেক ভুল লেখা সে এভাবে মুছে দিয়েছে। পেন্সিল হয়ত লিখেছে ‘সূর্য্য
উঠলেই কার্য্যে যাও’। রাবার য-ফলা দুটি মুছে শুদ্ধ করে দিল ‘সূর্য উঠলেই কার্যে যাও’।
আবার, পেন্সিল হয়ত লিখল ‘সকল প্রজারা শোনো’। রাবার ‘সকল’ শব্দটিই মুছে দিল।
‘প্রজারা’ লিখলে তো আর ‘সকল’ লেখা লাগে না।
৩
পেন্সিলের তাই মনে মনে খুব রাগ রাবারের প্রতি। সবার সামনে এভাবে ভুল ধরিয়ে দিলে,
হেনস্থা করলে কারো কি ভালো লাগে!
একবার সেই রাজ্যে ভীষণ দুর্যোগ দেখা দিল। প্রচন্ড খরা আর অনাবৃষ্টিতে ঠিকমত ফসল
ফলল না। ঘরে-ঘরে অভাব। যেটুকু ফসল ফলেছিল, কৃষকেরা ঘরে রেখে দিল। রাজার
সৈন্যরা এল ফসল নিতে। কৃষকেরা বলল, ‘এ ফসল দিয়ে দিলে আমরা খাব কী?
আমাদের ছেলেমেয়েরা খাবে কী?’
সৈন্যরা ফিরে এসে রাজাকে জানাল, ‘মহারাজ, কেউ তো ফসল দিতে চাইছে না।’ রাজা
গেলেন রেগে। এভাবে কি রাজ্য চলে! মন্ত্রীদের ডাকলেন, সভা করলেন। তারপর আদেশ
দিলেন ‘যার কাছে যত ফসল আছে তার ৩ ভাগের ২ ভাগ রাজভান্ডারে জমা দিতে
হবে।’
৪
রাজার নির্দেশমতো পেন্সিল তা লিখে দিল। সৈন্যরা সেই আদেশনামা নিয়ে আবার
কৃষকের ঘরে-ঘরে গেল। কৃষকেরা পড়ল মহাবিপদে। রাজার আদেশ! অমান্য করলেই যে
শাস্তি।
কৃষকেরা তখন রাবারের কাছে গেল। তাদের অবস্থা খুলে বলল। এই অভাবের দিনে
ফসলের ২ ভাগই রাজভান্ডারে জমা দিলে, তারা বাঁচবে কী করে!
রাবার ভেবে দেখল, আসলেই তো সংকট। কৃষকদের বাঁচানো দরকার। সে তখন রাতের
বেলা চুপিচুপি সেনাপতির ঘরে ঢুকল। তারপর সেই আদেশনামায় লেখা ২-এর লম্বা দাগটি
দিল মুছে। ২ হয়ে গেল ১।
৫
পরদিন সৈন্যরা ঐ কাগজ নিয়ে আবার কৃষকদের বাড়িতে গিয়ে শোনাল ‘যার কাছে যত
ফসল আছে তার ৩ ভাগের ১ ভাগ রাজভান্ডারে জমা দিতে হবে।’ কৃষকেরা এবার খুশি
হয়ে ১ ভাগ ফসল দিয়ে দিল।
পেন্সিল কিন্তু ঠিকই ধরে ফেলল। সে নিজেই তো লিখেছিল রাজার আদেশ। বুঝতে পারল,
এটা রাবারেরই কাজ। রাবারকে শায়েস্তা করার এমন সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? সে
তক্ষুনি লম্বা লম্বা পা ফেলে রাজপ্রাসাদে গেল। রাজাকে জানাল রাবারের কীর্তি। রাজা তো
ভীষণ রেগে গেলেন ‘এতো বড় স্পর্ধা! বন্দী করো ওকে।’
সৈন্যরা গিয়ে রাবারকে হাতকড়া পরিয়ে কারাগারে আটকে রাখল।
পেন্সিল তো মহাখুশি। তার একমাত্র শত্রুটি এখন কারাগারে। কে তার ভুল ধরবে? কে
তাকে বাধা দেবে? আনন্দে সে ধেই-ধেই করে নাচতে লাগল।
৬
সব রাজ্যেই তো সব কালে কিছু দুষ্ট লোক থাকে। ঐ অভাব-অনটনের দিনেও তেমনি
কিছু দুষ্ট ব্যবসায়ী একত্র হল। তারা গিয়ে পেন্সিলকে বলল, ‘আপনার এতো জ্ঞান, এতো
পাণ্ডিত্য! কিন্তু রাজা তো আপনাকে যথাযথ সম্মান দেয়নি। আমরা আপনাকে সেই সম্মান
দেব। আপনি আমাদের একটি কাজ করে দিন। আপনাকে দশ বস্তা চাল দেব।’
অন্যদের মতো পেন্সিলের বাড়িতেও তখন খাবার ফুরিয়ে এসেছে। এমন প্রস্তাব শুনে সে
খুশি হয়ে বলল, ‘বলুন, বলুন। কী চান আপনারা?’
ব্যবসায়ীরা বলল, “আপনি শুধু লিখে দিন ‘আমদানি কম থাকায় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি
করা হল।”
পেন্সিল তা-ই লিখে দিল। রাজ্যের সকলে ভাবল, এ বুঝি রাজারই আদেশ। ব্যবসায়ীরা
পেন্সিলকে দশ বস্তা চাল দিয়ে গেল। পেন্সিল তো ভীষণ খুশি। নিশ্চিন্তে খায়-দায় আর ঘুরে
বেড়ায় নাক উঁচিয়ে। ভরপেট খেয়ে-খেয়ে তার একটা ভূঁড়িও গজাল।
৭
এদিকে রাজ্যের অবস্থা খারাপ হতে লাগল। ঘরের ফসল ফুরিয়ে আসছে। বাজারে
জিনিসপত্রের দাম আকাশ-ছোঁয়া। চুরি-ডাকাতি গেল বেড়ে।
এ সময় একদল চোর এল পেন্সিলের কাছে। তারাও ব্যবসায়ীদের মতো পেন্সিলকে
অনুরোধ জানাল। বলল, “আমাদের খুব বিপদ। রাজার সৈন্যরা আমাদের লোকদের ধরেধরে
আটকে রাখছে। আপনি লিখে দেন ‘কারাগারে জায়গা নেই তাই, চুরি-ডাকাতির
অপরাধে কাউকে বন্দী করা যাবে না।” পেন্সিল পাঁচ বস্তা চালের লোভে এই মিথ্যা কথা
লিখে দিল।
রাজার সৈন্যরা লেখা দেখে ভাবল, এ বুঝি রাজারই আদেশ। সারা রাজ্য জুড়ে তখন শুরু
হলো ভয়ানক বিশৃঙ্খলা। যাদের বাড়িতে সামান্য ফসল ছিল, তাদের বাড়ি লুট হল।
দোকানে ডাকাতি হল। রাজার সৈন্যরা চুপচাপ সব দেখতে লাগল।
৮
এই ভয়াবহ অবস্থার কথা রাজার কানেও পৌঁছাল। রাজা দ্রুত সভা ডাকলেন, মন্ত্রীরা
এলেন। রাজা জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাজ্যের এ অবস্থা কেন?’
মন্ত্রীরা জানালেন, ‘আপনি যে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। চুরি-ডাকাতির শাস্তি
মাফ করে দিয়েছেন। তা-ই এই অবস্থা।’
রাজা তো অবাক! কখন আমি এ নির্দেশ দিলাম? সবার কাছে তখন স্পষ্ট হয়ে গেল, এসব
পেন্সিলেরই কাজ। রাজা ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে পেন্সিলকে বেঁধে আনার আদেশ দিলেন। আর
মন্ত্রীদের কাছে জানতে চাইলেন, ‘এখন উপায় কী?’
এক মন্ত্রী বললেন, ‘মহারাজ, ওসব আদেশ আগে মুছতে হবে। কিন্তু রাবার তো
কারাগারে। ওকে বের করা দরকার।’
রাজা বললেন, ‘ঠিক। বের করে আনো রাবারকে।’
৯
কিছুক্ষণের ভেতর পেন্সিল ও রাবার দুজনকেই আনা হলো রাজপ্রাসাদে। রাজা তো
পেন্সিলকে দেখে রেগেই আগুন। চেঁচিয়ে বললেন, ‘তুমি মহাপাপী জ্ঞানপাপী। তোমার
পড়ালেখাকে ব্যবহার করেছ অন্যায় কাজে। তোমার অপরাধ ভয়ংকর। তোমার শাস্তিও
হবে ভয়ংকর।’
রাজা একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘পেন্সিলের কথা শুনে রাবারকে আমি বন্দী
করেছিলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, ও রাজ্যের ভালোই চেয়েছিল। তাই, আজ থেকে
ওকে মুক্তি দিলাম। আর পেন্সিল চিরদিনের জন্য বন্দী থাকবে কারাগারে।’
পেন্সিল লজ্জায়, অপরাধবোধে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
রাবার তখন রাজাকে বলল, ‘মহারাজ, আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করি ভুলকে,
অন্যায়কে মুছে ফেলতে। আমি বন্দী থাকার কারণেই পেন্সিল এমন সব অন্যায় করতে
১০
পেরেছে। কিন্তু আমাদের সবারই তো ওকে প্রয়োজন। তাই অনুরোধ করছি, আমাকে
যেহেতু আপনি মুক্তি দিয়েছেন, তখন ওকে আর বন্দী না করলেও চলবে। আমিই ওকে
চোখে-চোখে রাখব।’
রাজা বললেন, ‘বেশ। তোমার উপর আস্থা রেখেই আমি পেন্সিলকে ছেড়ে দিলাম। এখন
তুমি যাও পেন্সিলের লেখা সব আদেশ মুছে ফেল।’
‘জি¦ মহারাজ, এক্ষুনি যাচ্ছি।’ এ কথা বলেই রাবার বেরিয়ে এল। তার পিছুপিছু পেন্সিলও
রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করল।
পথে নেমে পেন্সিল রাবারকে ডেকে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করো, রাবার। আমি সব সময়
তোমাকে ভুল বুঝে এসেছি। ভেবেছি তুমি আমার শত্রু। কিন্তু আজ সেই ভুল ভাঙল।
তুমিই আমার প্রকৃত বন্ধু।’
১১
রাবার হেসে বলল, ‘হ্যাঁ বন্ধু, আমি তোমার বন্ধুই। তুমি তো জ্ঞানী। জ্ঞানীরা যখন ভুল
করে, অন্যায় করে তখন তা ভয়ানক ক্ষতি নিয়ে আসে। তাই সব সময় চেয়েছি তোমাকে
শুদ্ধ রাখতে, তোমার ভুল মুছে দিতে।’
‘বাকি জীবনও তুমি তা-ই কোরো বন্ধু। আজ থেকে তোমাকে আমি মাথায় তুলে রাখব।’
পেন্সিল কৃতজ্ঞচিত্তে রাবারকে বলল।
সেই থেকে পেন্সিলের মাথায় শোভা পেতে লাগল রাবার। রাবারই হয়ে উঠল পেন্সিলের
বিবেক।
Excellent..
প্রাথমিক শ্রেণীতে টেক্সট বুকে অন্তর্ভুক্ত করার মত একটা গল্প।
অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন সব সময়।
কি দারুণ একটা গল্প! লেখককে অনন্ত শুভেচ্ছ।
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ। শুভকামনা রইল।
শ্রদ্ধেয় স্যার ও প্রিয় লেখক, আপনার “পেন্সিল ও রাবারের গল্প” ভীষণ ভালো লেগেছে। আমার ছেলেরা গল্পটি শুনে খুবই মুগ্ধ হয়েছে। আপনার জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো। অসংখ্য ধন্যবাদ, স্যার।
অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার ছেলেদের ভালো লেগেছে, এটা আমার জন্য বড় প্রাপ্তি। শিশুকিশোরদের জন্যই তো লেখা, ওদের ভালো লাগাটাই সবচে গুরুত্বপূর্ণ। ভালো থাকবেন নিরন্তর।
কি চমৎকার গল্পটা।
ঠিক সমোয়োপযোগী।
ধন্যবাদ লেখক হিমেল বরকত।।
অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ, আপা। আপনি পড়েছেন জেনে ভীষণ ভালো লাগলো। ভালো থাকবেন সব সময়।
chomotkar..osadharon..khub valo laglo..
অসাধারণ!
Thank you for your articles. They are very helpful to me. May I ask you a question?