প্রবন্ধ

৭ই মার্চের ভাষণের দূরদৃষ্টি, শিল্পমান ও প্রেরণা।। মীম মিজান

শেখ মুজিবুর রহমান। একটি নাম। একটি ইতিহাস। সেই ছোট্ট বেলা থেকে যিনি জড়িত ছিলেন নানামুখী কর্ম কান্ডের সাথে। ছাত্রাবস্থায় পাকিস্থান রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম। যুবক বয়সে ভাষা আন্দোলন। শিক্ষা আন্দোলন। গণ অভ্যুত্থান। ইত্যাদি সব আন্দোলনে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন তার দূরদৃষ্টিতা কতটুকু হবে সেটা নিশ্চয় অনুমেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে বিস্তর আলোচনা, পর্যালোচনা, গবেষণা হচ্ছে হবে। আমি আজকে সেই ভাষণের দূরদৃষ্টি, শিল্পমান ও প্রেরণা সম্পর্কে দু এক কলম লিখব।

নিরঙ্কুশভাবে ভোটে বিজয়ী হওয়ার পরও যখন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হচ্ছিলনা তখন এ দেশের স্বাধীকারকামী জনতার মধ্যে বিক্ষোভে দাবানল জ্বলছিল। পক্ষান্তরে ইয়াহিয়া খানেরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার পায়াতারায় যে কোনো উপায়ে বাঙালিদের উপরে দেশদ্রোহ অপরাধ চাপিয়ে ক্রাকডাউন দেয়ার পরিকল্পনায় ব্যস্ত। ঠিক এমন একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের দূরদৃষ্টি ছিল অনন্য সাধারণ। মাথার উপর বন্দী বা অপহরণের ভয়। পিছনে পাকিস্থানি বাহিনীর গুলি ভরা বন্দুক। সামনে লাঠি হাতে স্বাধীনতার উম্মাদেরা। কি এক বিভীষিকা! বন্দুকের বুলেটে কোল খালি হয়েছে অনেক মায়ের। কালো পীচ ঢালা রাস্তা হয়েছে লাল। তখনি একটি যুগান্তকারী ভাষণ দিচ্ছেন কত স্থির ও বুদ্ধিমত্তার সাথে। প্রথমে সকল দায়ভার চাপালেন পাকিস্থানি শাসক গোষ্টির উপর। নিজেকে করলেন দোষমুক্ত। কোনো হঠকারিতা খুঁজে পাওয়া যায়না তাঁর ভাষণে। সামনে যারা আছে। কত কষ্ট করে কত দূর দূরান্ত থেকে এসেছে। তাইতো তাদের সকল কষ্ট ও মর্মবেদনা গুলোকে মুছে দেবার জন্য দূরদৃষ্টির সঙ্গে তিনি তাঁর ভাষণে বাঙালিকে একান্ত আপন তুমি সন্মোধণ করে বললেন, ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’ তাঁর এ উচ্চারণে প্রতিটি বাঙালির শিরায় শিরায় আবেগ ও উত্তেজনার ঢেউ খেলে যায়। আর বক্তৃতা শেষ করলেন বাঙালির সংগ্রামের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত জানিয়ে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

নোবেল বিজয়ী শন ভ্যাকব্রাইড এর উক্তি আমরা এই ভাষণের দূরদৃষ্টি সম্পর্কে উদ্ধৃত করতে পারি, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ঠ নয়, প্রয়োজন মানুষের মুক্তি। বেঁচে থাকার স্বাধীনতা। সাম্য ও সম্পদের বৈষম্য দূর করাই স্বাধীনতার সমার্থ। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে ৭ মার্চের ভাষণে।’

উপমহাদেশের অর্থনীতির গুরু জীবন্ত কিংবদন্তি অমর্ত্য সেনের উক্তি থেকেও আমরা সেই ভাষণের দূরদৃষ্টি উপলব্ধি করি এভাবে, ‘তাঁর সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয় সমস্ত পৃথিবীও স্বীকার করবে।’ জ্যোতি বসু বলেছেন,‘৭ মার্চের ভাষণ একটি অনন্য দলিল। এতে একদিকে আছে মুক্তির প্রেরণা। অন্যদিকে আছে স্বাধীনতার পরবর্তী কর্ম পরিকল্পনা।’ প্রভাবশালী গণমাধ্যম এএফপি উল্লেখ করেছে, ‘ ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যদিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ঐ দিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।’ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের দ্যা ওয়াশিংটন পোস্টের এক ভাষ্যে বলা হয়,‘শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ঐ ভাষণেরই আলোকে।’ খুব কাছে থেকে সেই ভাষণ অনুধাবন করে ঢাকাস্থ মার্কিন কন্সাল বলেছিলেন, “রোববার ৭ মার্চ প্রদত্ত মুজিবের ভাষণে তিনি যা বলেছিলেন তার চেয়ে লক্ষণীয় হলো তিনি কি বলেন নি। কেউ কেউ আশঙ্কা করছিলেন, আবার কেউ কেউ আশা করেছিলেন যে, তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করবেন। এর বদলে বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান তিনি জানালেন।” অনেকেই মনে করেছিলেন যে আজকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিবেন। কিন্তু যার মননে প্রখর ও প্রচ্ছন্ন দূরদৃষ্টি তিনি কি পারেন নিরস্ত্র বাঙালিকে পাকিস্থানি বাহিনীর বন্দুকের মুখে ঠেলে দিতে। তিনি জানতেন কৌশলে পাকিস্থানিদের অন্য কোনো কিছু নিয়ে ব্যস্ত রেখে ভিতরে ভিতরে সসস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে হবে। তাই স্পশ্টভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,_এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

প্রত্যেক কর্মের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। এটিকে শিল্পমানও বলা হয়। শুধুকি চিত্রপটের শিল্পমান থাকে? বা কোনো সাহিত্যের? শিল্পমান শুধু চিত্রকল্প, সাহিত্য, চলচিত্রের গন্ডির ভিতরে আবদ্ধ নয়। কণ্ঠের ব্যবহারের মাধুর্য। কথার সাথে শারীরিক অঙ্গভঙ্গি। অঙ্গুলি পরিচালনা ইত্যাদি অনেক বড় একটি শিল্প কোনো বক্তৃতা মালায় বা ভাষণে। চলুন দেখি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে এই শিল্পমান গুলির কি কি আছে?

কথা বলতে পারলে কি সেটা ভাষণ হয়? না সেটা ভাষণ নয়। সংমিশ্রণ চাই অলংকার শাস্ত্রের। প্রান্জলতা। শব্দ চয়নে নিপুণতা।পরিবেশ বুঝে কণ্ঠের উঁচু নিচুতা। এসব গুলিই পরিলক্ষিত হয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণে। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, “৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার প্রকাশভঙ্গি ছিল অসাধারণ। এটা কোনো বাক্যবাগীশতা (demagogue) ধরনের ভাষণ ছিল না। ১৮ মিনিটের ভাষণটি ছিল বাহুল্যবর্জিত, শব্দ চয়নে ও বাক্যের বাঁধনে ছিল সহজবোধ্য, ঘরের আপন লোকের বাচনভঙ্গি দ্বারা ছিল অলংকৃত, প্রবাহমান ঝরণার মতো ছিল সাবলীল। কণ্ঠস্বর ছিল স্বতর্ঃস্ফূত। কণ্ঠের মডুলেশন ছিল মন্ত্রমুগ্ধকর—আগাগোড়াই বজ্র নিনাদের আওয়াজ ও প্রয়োজনমতো জ্বালাময়ী।”

কবি যেমন শব্দের খেলা করে সবাইকে মোহিত করেন, তেমনি তিনিও সকলকেই মোহিত করেছিলেন। ‘নিউজউইক’ সাময়িকীর বিখ্যাত রিপোর্ট, যেখানে বঙ্গবন্ধুকে উল্লেখ করা হয়েছিল ‘পোয়েট অব পলিটিকস্’ হিসেবে, সে-কথা আমরা জানি।

কবি নির্মলেন্দু গুণ তার কবিতায় বলেছেন,‘কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠবাণী? গণসূর্যে মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর- কবিতাখানী।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ প্রাজ্ঞ ও কৌশলী ভাষণ তাই পৃথিবীর অনেক রাষ্টবিজ্ঞানী আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গে প্রদত্ত ভাষণের চেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে তুলনা করে বলেছেন, আব্রাহাম লিংকনের প্রদত্ত ভাষণটি ছিল পূর্বপরিকল্পি ও লিখিত ভাষণ, প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণটি ছিল তাৎক্ষণিক এবং অলিখিত। সে হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণটি আব্রাহাম লিংকনের ভাষণটিকেও ছাপিয়ে গেছে। বর্ণচোরা সনেটার নামে একজন কবি বলেছেন, “তার কণ্ঠে হ্যামিলিওনের বাঁশি ওয়ালার মত সুর ছিল। কেননা রেসকোর্স ময়দানের সেই শ্রোতাগণ সাপ যেমন বীণ নাদে তাদের বিষের অনুরণনে থাকতে পারেনা বার বার ফোস ফোস করে উঠে ঠিক তেমনি তারাও বার বার মোহিত হয়ে ক্ষোভে নিনাদ করেছে।” তার এ ভাষণ শৈল্পিক মানে অনন্য।

তাঁর সেই কালজয়ী ভাষণটির প্রেরণা অফুরান। গ্রামের ক্ষেতের কৃষক, রান্না ঘরের রাধুনি, ক্লাশ ছেড়ে শিক্ষার্থীরা, আজানের মুয়াজ্জিন সবাই ছুটে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে যুদ্ধে। কোনো পিছুটান তাদেরকে আঁটকাতে পারেনি। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধে এই একটি মাত্র ভাষণ ছিল প্রেরণার উৎস। শুধু কি তাই? যুগে যুগে কালে কালে এ ভাষণের প্রেরণা অনির্বাণ।

যুগে যুগে এ ভাষণ নিপীড়ত, লাঞ্ছিত স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রেরণা ও উদ্দীপনা হিসাবে কাজ করবে। এই কারণেই বঙ্গবন্ধুর এ ঐতিহাসিক ভাষণটি সারা বিশ্বের সমসাময়িক রাজনৈতিক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব রাজনীতির ছাত্র ও রাজনৈতিক গবেষকদের দ্বারা প্রশংসিত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্বের ১২টিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন মহানায়ক আর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল অনুপ্রেরণার অফুরন্ত উৎস। তাই ৭ই মার্চের ভাষণ কেবল অবিস্মরণীয় নয়, বাঙালির জন্য অনিঃশেষ এর প্রেরণা। এটি রাজনীতির চিরায়ত এক ভাষ্য ও ধ্রুপদি সৃষ্টি।

এম. ফিল গবেষক
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *